বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অলৌকিক

জীবনে বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে যাকে অনায়াসে ভুতুড়ে বা অলৌকিক বলা যায়, আজ তার মধ্যে থেকে দুটি ঘটনা আপনাদের বলবো|প্রথম ঘটনাটি ঘটে আমার কৈশোরে|

 

সময় টা সত্তরের দশকের শেষের দিকে, তখন আমার পরিবার থাকতো কল্যাণীতে|আমার তখন অষ্টম শ্রেণী |আজকের কল্যাণী হাইওয়ে যারা দেখছে তারা সেকালের কল্যাণী হাইওয়ে সংলগ্ন এলাকার কথা ঠিক করে কল্পনা করতে পারবেনা|তখন ওই অঞ্চলের পরিবেশ ছিল একেবারেই অন্য রকম|মেঠো পথ, কাচা বাড়ির সারি, অরন্য সংকুল পরিবেশ, কম জনবসতি|সব মিলিয়ে চার পাশে এক আদিম বন্যতা|গ্রাম্য জীবন ও ছিলো অন্যরকম|পড়াশোনার বাইরে মাঠে মাঠে খেলে বেড়ানো,গাছ থেকে ফল পেরে ভাগ করে খাওয়ার|সন্ধ্যে বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে ভাই বোন মিলে পড়তে বসা|তারপর শেয়াল আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া|সব মিলিয়ে সে এক অন্যরকম দিন ছিলো|যেন এক রূপকথার স্বপ্ন রাজ্য|যে সময়ের কথা বলছি তখন ওই অঞ্চলে সব জায়গায় বিদ্যুৎ এসে পৌছায়নি|যেখানে এসেছে সেখানেও প্রায়ই লোডশেডিং|সন্ধ্যের পর চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করতো|সূর্যাস্তের পর ঘরের বাইরের জগৎ টা যেন এক রহস্যময় নিষিদ্ধ অন্ধকার জগতে পরিনত হতো|

 

কল্যাণী হাইওয়ে সংলগ্ন এক পাড়ায় তখন আমরা থাকি স্বপরিবারে|পরিবার বলতে আমি, মা বাবা, ভাই ও দিদি|সেই সময়ে তাকে গ্রামই বলাযায় 

যদিও এখন চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে|গ্রামের কিছু দুর দিয়ে বয়ে গেছে এক প্রায় মজে যাওয়া ক্ষীণ জল রাশি যার কোনো একটি শাখা নাকি মিশেছে গঙ্গার সাথে|এর থেকে কিছু দূরেই গাছ পালার ছায়া ঘেরা এক ফালি ডাঙ্গা জমি যা স্থানীয় শ্মশান হিসেবে ব্যবহিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে|সন্ধ্যের পর ওদিক টা কেউ যায়না বড়ো একটা|এমনিতেই বিশেষ অনুষ্ঠান বা নিত্য প্রয়োজন ছাড়া বেশ কিছুদিন যাবৎ বাইরে কেউ যাচ্ছিলো না বড়ো একটা|সময় মাঘ  মাস, শীত  কাল|গ্রাম গঞ্জর দিকে এমনিতেই শীতের রাত একটু তাড়াতাড়ি নামে|মোটামুটি সন্ধ্যার পরই এলাকা সুনসান ও নিস্তব্ধ হয়ে যায়|আর সে বছর শীত ও পড়েছিলো ভয়ঙ্কর রকমের, যাকে বলে হার  কাঁপানো শীত|

 

কদিন ধরেই কিছু একটা কানা ঘুঁষো শুনছিলাম যে এলাকায় নাকি কিছু একটা অশুভ ঘটছে|বিশেষত রাত টা নাকি আর বিশেষ নিরাপদ নয়|সন্ধ্যের পর বাইরে না যাওয়ার কড়া আদেশ জারি হয়েছিলো|ব্যাপার টা যে কি তার মর্মার্থ তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি|যদিও সেই সময়ে মফস্সলের দিকে এ যাবতীয় ভয় ও নানা রকম অলৌকিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা|আমরা ছিলাম আমাদের মতো|বেশ কাটছিলো দিন গুলো|তবে সন্ধের পর একা থাকতে যে একটু গা ছম ছম করতোনা তা বলবো না|

 

সেদিন ছিলো অমাবস্যা|বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ঠান্ডা টা আরো জাঁকিয়ে পড়েছে|কারেন্ট ছিলোনা|একটা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছিলাম ভাই বোনেরা মিলে|কিছুক্ষন পর দিদি চলে গেলো রান্না ঘরে মা কে সাহায্য করতে|ভাইও কিছুক্ষন পড়ার পর ঢুলে পড়লো বইয়ের পাশে|আমি একা|পড়ছিলাম বেশ|আগামী কাল স্কুলে পড়া ধরবে জানতাম|কিছুক্ষন পর দরজায় মৃদু টোকা শুনে সোজা হয়ে বসলাম তার পর আমার বন্ধু, পাশের পাড়ার পল্টুর আওয়াজ ভেসে এলো বাইরে থেকে|হয়তো কোনো দরকারে এসেছে|কিছুক্ষন অপেক্ষা করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম|কেউ নেই বাইরে অন্ধকার|তবে দূরে যেন অস্পষ্ট কাকে দেখা যাচ্ছে|একটা ছায়া মূর্তি|এগিয়ে গেলাম|মূর্তি টা ঘুরে  সামনে চলতে লাগলো|পল্টু বলে দুবার ডেকে সারা পেলাম না|পিছু নিলাম|চলতে থাকলাম|কোনো এক দুর্নিবার আকর্ষণ যেন আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানা গন্তব্যর উদ্দেশ্যে|থামতে পারলাম না|কে যেন আমায় ডেকে নিয়ে যাচ্ছে|চলতেই হবে|ক্রমে বড়ো রাস্তায় উঠলাম, এগোতে লাগলাম|কোথায় যাচ্ছি, কেনো যাচ্ছি জানিনা, তবে যাচ্ছি, যেতে হচ্ছে|কেউ কথাও নেই|ছায়া মূর্তিটাও আর দেখা যাচ্ছেনা|তবে ভয় লাগছে না|কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি|

 

কতক্ষন এভাবে কেটেছে জানিনা|সম্বিৎ ফিরে পেলাম পেছনে একটা ধাক্কা অনুভব করে|ঘোর কাটলো আর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বাবা ও দিদি দাঁড়িয়ে|বাবার হাতের লণ্ঠনের আলোয় বুঝলাম একটা খাল পারে দাঁড়িয়ে|দূরে একটা শিমুল গাছ|অর্থাৎ শ্মশানের কাছেই আছি|কোনো রকমে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলাম|পথে যত প্রশ্ন করা হলো তার কোনো উপযুক্ত উত্তর দিতে পারিনি|

 

তারপর বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগেছিলাম|পল্টু এসেছিলো দেখতে ও জানিয়ে যায় সে ওদিন এখানে ছিলই না, মামার বাড়ি গেছিলো কলকাতায়|বড়ো হয়ে বুঝে ছিলাম ও বড়ো দের কাছে শুনেছিলাম একেই বলে নিশির ডাক যা তখন ওই অঞ্চলে প্রায়ই হতো|যদিও সে রাতে ঠিক সময়ে দিদি আর বাবা না এসে পড়তো কে জানে কি ছিলো কপালে|

 

দ্বিতীয় ঘটনাটি বছর খানেক আগের কথা, কলকাতা থেকে বোলপুরে যাচ্ছিলাম গাড়িতে, আমি আর সঙ্গে আমার ড্রাইভার|বোলপুরে আমার একটা ছোট্ট বাংলো আছে তাই মাঝে মাঝেই যেতে হয় নানা দরকারে বা কখনো নিছক দেখাশোনা করতে বা কর্মচারী দের মাইনে দিতে|সাধারণত আমি সকাল সকালই বেড়িয়ে পড়ি আর বিকেলের আগেই পৌঁছে যাই, আর বেশি ভাগ সময়ই কাজ সেরে রাতে বোলপুর থেকে বেড়িয়ে পড়ি কলকাতায় ফিরে আসি রাত দশ টা এগারোটার মধ্যে,কখনো কখনো রাতের খাওয়া সেরে একটু বেশি রাত করেও ফিরেছি|বাংলোয় রাত কাটানো বড়ো একটা হয়না পেশা গত ব্যস্ততার জন্য |এবারও তেমনি প্ল্যান ছিলো|একাই যাচ্ছিলাম কারন ছেলের পরীক্ষা চলছে ওর মা ওকে নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে|

 

বৈশাখ মাসের শেষের দিক ছিলো,সকাল থেকে কেমন একটা গুমোট আবহাওয়া|সকালে বেরোবার ইচ্ছে থাকলেও কোনো কারণে বেরোতে বেশ দেরী হয়ে গেলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছিলো|দক্ষিণ কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম কাটিয়ে জাতীয় সড়কে উঠতে উঠতে সূর্য প্রায় ডুবে গেলো আর কিচ্ছুক্ষণ পর থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলো তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া|গাড়ি যখন শক্তি গড়ের কাছে তখন শুরু হলো তুমুল ঝড় সাথে শীলা বৃষ্টি|গাড়ির চলে টুং টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম |রাস্তা ঘাট দেখতে দেখতে শুন শান হয়ে গেলো|কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার জানিয়ে দিলো সামনের রাস্তা আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা আর চালানো সম্ভব না, থামাতে হবে গাড়ি |কি আর করা যায় দাঁড়িয়ে পড়তে হলো |সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমে এলো ওদিকে ঝড় বৃষ্টি থামার নাম নেই |বসে থাকতে অসহ্য লাগছিলো মনে হচ্ছিলো একটু চা পেলে দারুন হয় কিন্তু সব দোকানের ঝাঁপ ফেলা কোথাও কেউ নেই |ফ্লাস্ক টাও তাড়াহুড়ো তে বাড়িতেই ফেলে এসেছি |সকালের খবরের কাগজ টায় চোখ বোলাতে লাগলাম গাড়ির ক্ষীণ আলোতে |কিছুক্ষন পর বৃষ্টির দাপট একটু কমলো তবে ঝড় এখনো চলছে|

 

সামনের দিকে চোখ গেলো কিছুক্ষন পর, দেখলাম একটা বন্ধ দোকানের সামনে হাটু গেড়ে কেউ একটা বসে আসছে পাসে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা পথে ঘাটে যারা চা বিক্রী করে তাদের হাতে থাকে, মনে আশা জাগলো, ড্রাইভার কে বলে গাড়িটা ধীরে ধীরে সেই দোকান এর সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করলাম|ছাতা হাতে নেমে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ঠিক ই ধরেছি, চা বিক্রেতা |চা আছে কি জানতে চাইলে লোক টা এক কাপ চা ঢেলে এগিয়ে এলো, গরম চা ধোয়া উড়ছে |স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম |চুমুক দিয়ে দাম মেটাতে গিয়ে দেখলাম এক টাকাও খুচরো নেয়, আর লোকটা পাঁচশো টাকা খুচরো দিতে পারলো না |শেষে লোকটা বললো অসুবিধা নেয় বাবু ফেরার পথে দিয়ে দেবেন, সে নাকি রোজ সন্ধ্যে থেকে রাত এই দোকানের সামনেই চা বেচে |দোকানের নাম আর তার নাম জিগেস করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম |তার নাম অনিল |

 

রাত এগারোটায় বোলপুর পৌঁছে ছিলাম, সেদিন আর ফেরার উপায় ছিলোনা, পর দিন কাজ সেরে সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম আগের দিনের চা খাবার কথা প্রায় ভুলে যেতেই বসে ছিলাম কিন্তু সেই জায়গা টা তে আসতেই সব মনে পরে গেলো, খুঁজে খুঁজে সেই মুদির দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করলাম |আজ রাস্তা ঘাট একদম অন্য রকম, পরিস্কার আবহাওয়া, লোক জন আর গাড়ির ভিড়|গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসে সেই লোকটিকে কোথাও দেখতে পেলাম না |দোকানের মালিক কে অনিল নামে চা ওয়ালার খোঁজ করতেই সে হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বললো অনিল চা ওয়ালা  তো আর নেয় সেতো একদিন এখানেই রাস্তা পার করার সময় লরি চাপা পরে মারা যায় |সে প্রায় এক বছর আগের কথা|তারপর থেকে আর তো কেউ এখানে রাস্তায় চা বেচে না|শুনে চমকে গেলাম |

 

বাকি রাস্তা চুপ চাপ গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম আর মনে একটাই প্রশ্ন ঝড় তুলতে থাকলো, কি দেখলাম সেই ঝড়ের রাতে, এর উত্তর আজও পাইনি, তবে খুঁজছি|

 

 

 

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু