বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

লাঠি

আমি একজন পেশাদার জ্যোতিষী, জ্যোতিষ সংক্রান্ত কাজে,অংশীদার দের দাবী রাখতে ও কিছুটা পেশা গত তাগিদ থেকে প্রায় সারা বছরই আমাকে দৌড়ে বেড়াতে হয় রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কখনো বা নিজের রাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে পাড়ি দিতে হয় অন্য রাজ্যে |কতো রাত কেটেছে যাত্রা পথে,  রাস্তায়, গাড়ির মধ্যে|কতো ঝড় ঝঞ্ঝার সাক্ষী হয়েছি, অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছে একাধিক বার তার কোনো লেখাজোকা নেই|তবে আজ যে অভিজ্ঞতার কথা বলবো বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা অসম্ভব |এক কথায় বলতে গেলে সে ছিলো এক অতিমানবীক বা ভৌতিক অভিজ্ঞতা|আজ কিছুটা গল্পের ছলে সেই হারহিম করা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবো আপনাদের সাথে|

 

শ্রাবন মাস ভরা বর্ষা, সন্ধ্যের দিকে মাঝে মাঝেই ঝড় আর তার সাথে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো কদিন ধরে কিন্তু এতো প্রকৃতির নিয়ম তা বলে তো ঘরে বসে থাকা চলে না,হাতে অনেক গুলো কাজ যেতে হবে উত্তর বঙ্গের কোচ বিহার|যেদিন কলকাতা ছাড়ি সেদিন আকাশ বেশ পরিষ্কার, মনে আশা জাগলো এবার কিছুদিন ঝড় বৃষ্টি হবে না আর সেই ফাঁকে কাজটাও সেরে আসতে পারবো|সক্কাল সক্কাল একদিন বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে সঙ্গে ড্রাইভার রাজেন  ও আমার এক সহকারী নিখিল| প্রতিবারই তাই করি|মালদা হয়ে ডাল খোলা ডাল খোলা পৌঁছাতে সময় লাগলো বারো ঘন্টা মতো কিছুক্ষনের বিশ্রাম ও চা পানের পর আবার যাত্রা শুরু, দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম শিলিগুড়ি তারপর রাজেন একটা চেনা কিন্ত কম ব্যবহিত রাস্তা ধরলো কোচ বিহার যাওয়ার জন্য, একটা জন মানব শূন্য বাইপাস চার পাশে গভীর অন্ধকার ও নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে কিছু ভারী ট্রাক দৈত্যের  মতো ছুটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে |

 

আকাশ বেশ পরিস্কার, মন টাও ফুরফুরে, একটা প্ৰিয় রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে বেশ শুনতে শুনতে চলেছি হটাৎ একটা বিচ্ছিরি শব্দে ব্রেক কষে গাড়িটা রাস্তার এক পাসে গিয়ে দাঁড়ালো|রাজেন নেমে গিয়ে দেখে এসে হতাশ হয়ে বললো গিয়ার বক্সে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে তার দ্বারা সম্ভব না একটা মিস্ত্রি লাগবে|কাছেই একটা গ্যারেজ আছে হয়তো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে |নিখিল এর সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম আমি আর নিখিল গাড়িতেই থাকবো রাজেন এগিয়ে গিয়ে মিস্ত্রি খোঁজার চেষ্টা করবে |কথা মতো রাজেন টর্চ জেলে বেড়িয়ে পড়লো|

 

আধ ঘন্টা খানেক গাড়িতে বসে থাকার পর কেমন একটা অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো|ওদিকে নিখিল দেখলাম সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে|গাড়ি থেকে নেমে এসে একটু পায়চারি করা শুরু করলাম|সুন্দর মেঘ মুক্ত আকাশ, ক্ষীণ জ্যোৎস্নার আলো, ঝিঁঝি পোকার ডাক আর মৃদু মন্দ বাতাস,সব মিলিয়ে বেশ লাগছিলো|শহরের বদ্ধ জীবরা এই গ্রাম্য পরিবেশ, এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কে কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ পায়না খুব একটা|কিছুক্ষন পর বুঝে গেলাম আজ রাতে আর কোচবিহার যাওয়ার হচ্ছেনা ওদিকে রাজেন কেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা|এবার একটা খিদে ও তেষ্টা অনুভব করতে শুরু করলাম, কাছে খাবার তেমন নেই জল একেবারেই শেষ কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো রাস্তাও নেই |এই সব ভাবছি এমন সময় দূরে একটা ক্ষীণ আলো চোখে পড়লো, হয়তো জনবসতি বা কোনো হোটেল বা ধাবা জাতীয় কিছু থাকলেও থাকতে পারে| কিছুক্ষন এর মধ্যে নিখিল কে ডেকে তুলে গাড়ি ও জিনিসপত্রর দায়িত্বে তাকে রেখে সেই আলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম| সঙ্গে নিলাম একটি টর্চ ও চায়ের ফ্লাস্ক|

 

আলো খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোটো বহু পুরোনো  দোতালা বাড়ির সামনে এসে পৌছালাম বেশ বুঝতে পারলাম নিচ টা খাওয়ার হোটেল ও উপরে অতিথিশালা|ডাকা ডাকির পর এক বৃদ্ধ লণ্ঠন হাতে সামনে এসে দাঁড়ালো|কথা বলে জানা গেলো কিছুক্ষন অপেক্ষা করলে খাবার ও  চা দুটোই পাওয়া যাবে এমনকি চাইলে রাত টাও তাদের উপরের একটি ঘরে কাটানো যাবে অতি স্বল্প মূল্যে|কিছুক্ষন কাঠের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করার পর গরম রুটি তরকারি এসে পড়লো,  খেতে খেতে ঠিক করলাম রাতটা এদের অতিথি শালা তেই কাটাবো কারন ইতিমধ্যে টিপ টিপ করে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে|

 

খাওয়ার পর বৃদ্ধ কে সব জানাতে তিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন এবং ইশারায় তার পেছনে আসতে বললেন |কথা বিশেষ বললেন না|কেমন যেনো একটু অদ্ভুত প্রকৃতির|যাই হোক ঘরটি ছোটো হলেও বেশ পরিস্কার পরিছন্ন, বিদ্যুৎ নেই তাই টেবিলে লণ্ঠন রেখে বৃদ্ধ ঘর থেকে অন্ধকারেই বেড়িয়ে গেলেন|ঘুম আসছিলো না তাই সামনের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর লক্ষ্য করলাম আকাশ আবার পরিস্কার হয়ে গেছে এবং সামনের সব কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এমনকি আমার গাড়িটা দূরে রাস্তার উপর আবছা ছায়া মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে|জানলার বাইরের জগৎটা এক মায়াবী স্বপ্ন রাজ্যের মতো মনে হচ্ছে, যতদূর চোখ যায়, এক আদিম শূন্যতা|হটাৎ একটা পেঁচা ডেকে উঠলো কাছেই কোথাও|গাটা কেমন জানি ছম ছম করে উঠলো|আর দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম|

 

কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা, হটাৎ কি একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো, রেডিয়াম দেয়া ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা বাজে,কিছুক্ষন চেষ্টা করে আর ঘুম হবেনা বুঝতে পেরে কিছুক্ষন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিলাম তারপর আবার জানলার পাসে গিয়ে দাঁড়ালাম|এবার দেখলাম গাড়ির কাছে টর্চ জ্বলছে,একটি ছায়া মূর্তিও চোখে পড়লো,বুঝলাম রাজেন ফিরে এসেছে|কিছুক্ষন পর ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো, জ্বলে উঠলো হেড লাইট|বুঝলাম সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে আবার বেড়িয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত এখন বেড়িয়ে পড়লে হয়তো ভোরের আগেই পৌঁছে যাবো গন্তব্যে|কিছু খাবার ও চায়ের অর্ডার আগেই দিয়েছিলাম সেগুলো সঙ্গে নিয়ে বিল মিটিয়ে হোটেল ছাড়ার আগে বৃদ্ধ এগিয়ে এলো একটি লাঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা রাখুন পথে সাপের উপদ্রব আছে|মন্ত্র মুগ্ধের মতো লাঠিটা হাত থেকে নিয়ে নিলাম|হাতটা তার হাতে স্পর্শ হতে মনে হলো একটুকরো বরফ যেনো ছুঁয়ে গেলো শরীর|আর কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম|কিছুক্ষন এর মধ্যে আবার তিন জন গাড়ি নিয়ে কোচ বিহারের পথে|দিনের আলো ফুটতে দেখলাম লাঠিটা অপূর্ব সুন্দর রুপো বাঁধানো ও কারুকার্য করা|

 

সেবার যাত্রা পেশা গত ভাবে  বেশ সফল হয়েছিল, কাজের চাপে ভুলেই গেছিলাম সে রাতের অভিজ্ঞতা|ফেরার পথে আবার একি পথ ধরে ছিলো রাজেন তাই ভেবে ছিলাম লাঠিটা ফেরত দিয়ে যাবো কিন্তু সেই স্থানে আসতেই চমকে উঠলাম|কোনো হোটেল নেই,তবে একটি ধ্বংস স্তুপ আছে যা বহু পুরোনো বলে মনে হলো আর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা সাইনবোর্ড  "পথিক নিবাস - এখানে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে "এটা সে রাতেও দেখেছিলাম|কি দেখছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না হটাৎ পাস দিয়ে যাওয়া এক সাইকেল আরোহী কে থামিয়ে গোটা ঘটনা টা জানাতে সে বললো অনেক বছর আগে এখানে নির্মল রায় নামে এক ব্যক্তি প্রায় একাই এই হোটেল চালাতো, সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয় ও তার কিছুদিন পর ঝড়ে হোটেল টা পড়ে যায় |সেই থেকে এই অবস্থায় পড়ে আছে এটা| কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম|সেই সাইকেল আরোহী ভদ্রলোক আমার হাতের লাঠিটার দিকে তাকিয়ে  থেকে বললেন ঠিক এইরকম একটা লাঠি থাকতো ওই নির্মল বাবুর হাতে তিনি নাকি বহুবার তা দেখেছেন|সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেছিলো আমার সারা শরীর দিয়ে|লাঠিটা যেনো একটা সাপের আকার নিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে শুরু করেছে আমার হাত|

 

এরপর ফেরার পথে শুধু একবার গাড়ি থামিয়ে একটু জলাশয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছিলাম সেই লাঠিটা|আর খুব একটা কথা বলতে পারিনি বাড়ি অবধি |আজও ভুলিনি সে রাতের স্মৃতি, সেই ভৌতিক অভিজ্ঞতা আজও আমায় ভাবায়|আজও চমকে উঠি নিজের অজান্তে|

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু