বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মুক্তি

আমার আর শুভর প্রেম টা বেশ জমে উঠেছিল তবে মনের চেয়ে বেশি শরীরে| আমি পুরুলিয়ার মেয়ে , বাবা মা আর বোন এই নিয়ে আমার পরিবার | সরকারী চাকরির পোস্টিং পেয়ে এসেছি কলকাতায় | সপ্তাহান্তে  শনি রবিবার বাড়িতে কাটিয়ে আবারো সোমবার ফিরে আসি  নিজের কর্মস্থলে | এখানে একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি, মাইনে বেশ ভালোই পাই তাই লেডিস মেসে থেকে আর সবার সাথে রুম শেয়ার করার কষ্ট টুকু করতে হয় না | সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে একাকিত্ব কাটাতে ফেসবুকে সময় কাটাই কিন্তু যা হয় আর কি, ফেসবুকের নিত্যনতুন ছেলে গুলো এমন পাগলামি করতে থাকে, প্রায় দিনই দেখা করার কথা বলে অনেকেই, তাই আমিও ওদের কারো কারো সঙ্গে ইচ্ছে hlebtime pass করতে করতাম, কখনো একটু বেশি কিছু ... শরীরের দাবিকে অস্বীকার করতে পারিনা মাঝে মধ্যেই | এভাবেই শুভর সঙ্গে আলাপ, সুদর্শন, সুপুরুষ, এম. বি.এ করে একটি নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত| ওর কথায়, ব্যবহারে আন্তরিকতা আমাকে আকর্ষণ করতো আর তাই ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই দেখা করতে ভালোই লাগে, সম্পর্ক টা বিছানা অব্দি গড়াতে দেরি করেনি | শুভর মতো করে আনন্দ আজ অব্দি কেউ আমাকে দিতে পারেনি |

শুভর সঙ্গে রাত কাটানো মানেই মদের আসর, মদ খেতে খেতে আমাকে ওর কোলের মধ্যে টেনে নেয় আর খুব সুন্দর করে নানারকম গল্প বলতে থাকে | ওর জীবনের কথা, বেড়াতে গিয়ে ভালো লাগার কথা , এমনকি ঠাকুরের গল্প বা কখনো কখনো ভূতের গল্পও করে |

এই সব গল্পের মধ্যেই টেনে নি ওকে নিজের ঠোঁটের মধ্যে, তারপরের কাজ ওর, একটা মেয়েকে কিভাবে শারীরিক ভাবে  খুশি করতে হয় সেটা ওর থেকে বাকি ছেলেদের শেখা উচিৎ |

নেশা টা সেদিন খুব বেশি চড়ে গেছিলো ওর.... ঘরের হালকা নীল আলোয় পরিবেশ টা এতো মায়াবী লাগছিলো, ওকে কাছে টানতেই আমাকে বলে ওঠে " এই তুমি টিউব লাইট টা জ্বেলে এসো তো ... তোমার মুখটা আমার অন্য রকম লাগছে, ভীষণ চেনা একজনের মতো ",  ওর কথায় হেসে উঠে ওকে আবার জড়াতে যেতেই ছিটকে সরে যায় ও | চিৎকার করে ফেলে" যা  বলছি তাই করো, ওই নীল আলো টা তোমার মুখে যেন না পড়ে |" অবাক হলেও ওর কথা মতোই  টিউব লাইট টা জ্বেলে দিতেই শুভ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায় |

টানা পনেরো মিনিটের চরম মিলনের পর শ্রান্ত ক্লান্ত শুভ আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে " যেদিন আমাকে আর পাবে না, আমার গলার স্বর আর শুনতে  পাবে না, কি করবে সেদিন তুমি? "

জানিনা কথাটায় কি ছিলো কেঁদে ফেলি ওর কথাটা শুনে | শুভ আমাকে বুকে চেপে বলে " ও আমাকে নিতে আসে, আমি বেঁচে যাই প্রতিবারই... কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

ওর কথায় আশ্চর্য হয়ে যাই আমি..... কে আসে, কার কথা বলছে জানতে চাইলে বলে "চুপ, চুপ.. শুনে ফেলবে ও, কাছে কাছে থাকো আমার  ".. ছেলেটার ওপর অহেতুক মায়ার সৃষ্টি হয় কেনো জানিনা, চুপ করে যাই |ও যে আমায় ভালোবাসে সেটাও বেশ অনুভব করছিলাম কিছুদিন ধরেই, কিন্তু কেনো কিছু বলিনি, সরিয়ে দিইনি ওকে তা জানিনা, তবে কি আমিও ওর প্রেমে পড়েছি?.......


          ******************************


দিন পনেরো কেটে গেছে কিন্তু শুভ র সেই রাতের কথাগুলো ভুলতে পারিনা, মনে হয় জানতেই হবে আমাকে এর পেছনের রহস্য | শুভ কে ডাকি এক রাতে,মদের নেশাটা একটু চড়তেই  কথায় কথায় জানতে চাই ওর জীবনের সব চেয়ে ভয়ানক ঘটনা কোনটা? শুভ বলতে শুরু করে..... "তুমি কোনোদিন ভূত দেখেছো?  ভুতের ভয় পেয়েছো?  আমি না দেখলেও তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়েছি বহুবার | বহুবার ওরা আমায় নিতে এসেছে, কিন্তু পারেনি, সেটাই আমার সৌভাগ্য |"

আমি হতবাক হয়ে যাই ওর কথাগুলো শুনে |সদ্য যুবক শিক্ষিত আজকালকার  একটি ছেলের মুখে  এসব কথা মানায় না |কিন্তু ওকে না থামিয়ে জানতে চাই পুরো কথাটা |

শুভকেও যেন কথার নেশায় পেয়েছে, আমাকে ছোঁয়ার থেকে বেশি আগ্রহী ওর অভিজ্ঞতার কথা আমাকে শোনানোর জন্য, আমিও নির্বাক শ্রোতা হয়ে শুনে যাই ওর কথা |

শুভ বলে যায় "আমার পিসি থাকে দিল্লী তে, কলকাতার নিউটাউন অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে বেশ কয়েক বছর হলো | পিসিরা যখন কলকাতা আসে,  তখন ওই ফ্ল্যাটে থাকেন, আমরাও যাই দেখা করতে | কয়েকমাস আগে মা বাবা আর আমি পিসির ফ্ল্যাটে গেছিলাম দেখা করতে, কিন্তু সন্ধেবেলা পিসি কিছুতেই আমাদের ছাড়লে না, বললো রাত টা ওদের বাড়িতে থেকে পরদিন ফিরতে | আমার মাও গল্পে এমন মত্ত ছিলো যে রাজি হয়ে গেলো |

মাঝরাতে হঠাৎ জানলার কাঁচ ভাঙার প্রচন্ড শব্দে চমকে উঠে বসি, মনে হলো রান্নাঘর থেকে এলো আওয়াজ টা, বেশ অবাক হলাম এই দেখে যে, আমি ছাড়া আর কারো ঘুম ভাঙলো না এতো আওয়াজেও | যাই হোক সাহস করে রান্না ঘরের দিকে এগোতেই দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে, ফ্রক পরা, এতো রাতে বাচ্চা মেয়ে কোথা থেকে আসবে, কে এই বাচ্চাটা ভেবে না পেয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোতেই বাচ্চা মেয়েটা আমার দিকে একবার ঘুরে তাকালো, অসম্ভব মিষ্টি একটা মুখ কিন্তু চোখ গুলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, ঠিক যেন নীল আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটা রান্না ঘরের জানলা দিয়ে ঝাঁপ মারলো, পুরো ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে আমি ভয়ে বিকট একটা চিৎকার করে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই | বাড়ির সবাই এসে আমার জ্ঞান ফেরায়, কেউ বিশ্বাস করতেই চায় না কিছু, কিন্তু বিশ্বাস করো ওই নীল চোখ আমি যখন তখন দেখতে পাই,  যদিও ওই রাতের পর আমি আর কখনো পিসির বাড়ি যাইনি তবু ওই চোখ দুটো যেন আমাকে ডাকে |পিসির ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছেই থাকে, তবু আমি যাইনা কখনো ওখানে |

কিন্তু ওই মেয়েটা, ও আমাকে নিয়ে যাবে মৌ, ঠিক নিয়ে যাবে "| বলতে বলতে শুভর মুখটা যেন হঠাৎ সাদা হয়ে গেলো ভয়ে |

ওকে বুকে জড়িয়ে বলে ফেলি তোমাকে আমার থেকে কেউ কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না, যতদিন আমি আছি তুমিও আছো |আচমকা কথাটা বলে ফেলে অবাক হয়ে যাই নিজেই, তবে কি আমি শুভ কে ভালোবেসে ফেলেছি?

ওই রাতেই আমি ঠিক করি শুভ র এই ভয় আমাকে কাটাতেই হবে, ওর পিসির বাড়ি একটা রাত আমায় থাকতেই হবে |


           ************************************


একমাস কেটে গেছে, নানারকম ব্যস্ততায় শুভর সঙ্গে দেখা হয়নি আর | যদিও ফোনে কথা হয় প্রায়ই, আমরা ঠিক করেছি সামনের দোলের ছুটিতে বেড়াতে যাবো পুরুলিয়ার বড়ন্তি তে, রাঙা পলাশের আবির রং মেখে রাঙা হবো দুজন |

নির্দিষ্ট দিনে সকাল আটটা নাগাদ শুভর নিজের গাড়ি তে রওনা দিলাম বড়ন্তির উদ্দেশ্যে | যাত্রার শুরুতেই কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে পথ কাটলো, আমি কুসংস্কার মনে করলেও শুভ এসব বেশ মানে | ও বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো গাড়িটা রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে, যতক্ষণ না অন্য কোনো গাড়ি আমাদের গাড়ির পাশ কাটিয়ে যায় |

কিছুটা চলার পরেই অদ্ভুত ভাবে গাড়ির পেছনের চাকা পাংচার হয়ে গেলো, শুভ নিজেই টায়ার বদল করে আবার  গাড়ি স্টার্ট দিলো |

এরপর ঘটলো আরো ভয়ানক দুর্ঘটনা, কোথা থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে পড়লো শুভর গাড়ির সামনে, আচমকা ব্রেক কষতে গিয়ে গাড়ি এমন ঝাকুনি খেলো যে আমার নাকে মুখে লেগে রক্ত পড়তে লাগলো | ততক্ষনে পুলিশ এবং বেশ কিছু লোকজন জমা হয়ে গাড়ির পাশে, ওই অবস্থাতেই গাড়ি থেকে কোনোমতে  নেমে গাড়ির সামনে যেখানে বাচ্ছা মেয়েটার পড়ে গেছিলো সে দিকে দৌড়ে যেতেই হতবাক, কোথায় কি?  কেউ পড়ে নেই গাড়ির সামনে, কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি কিন্তু আমি আর শুভ স্পষ্ট দেখেছি একটা বাচ্ছা মেয়ের সঙ্গে আমাদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হোলো |

পুলিশকে সব কথা জানাতেই তিনি বললেন " দিন দুপুরে নেশা করেছেন নাকি মশাই?  যান বাড়ি ফিরে যান, ম্যাডামকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন "| ততক্ষনে আমাদের দুজনের যেন হুঁশ ফিরেছে, খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো শুভ এরপর |" আমরা আর এগোবো না, হয়তো আরো বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে |এবার সত্যি বাড়ি ফিরবো, চলো তোমাকে আমার বাড়ির সবার সাথে,  পরিচয় করিয়ে দি, এই কদিন তুমি আমাদের বাড়িতেই সবার সঙ্গে  থেকো | "

ফেরার পথ টুকু সারাক্ষন আমি ওই বাচ্ছা মেয়েটার গাড়ির সামনে দৌড়ে আসা, এক্সিডেন্ট হওয়া সব কিছুর  কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শুভর পিসির বাড়ির ঘটনা টা মনে পড়ে গেলো |

হঠাৎই শুভ  একটা ডাক্তারখানার সামনে গাড়ি টা থামাতে আমার যেন হুঁশ ফিরলো | " আঘাত তেমন কিছু নয়, একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবেন " ডাক্তার বাবুর কথা শুনে শান্তি পেলাম দুজনে...কিন্তু সেই সময়ই দুস্টু বুদ্ধি টা মাথায় খেলে গেলো আমার | শুভ কে যে করেই হোক রাজি করাতে হবে ওর পিসির বাড়ি যাওয়ার জন্যে... আমাকে জানতেই হবে কিসের এতো ভয় ওর?


আদুরী গলায় বললাম শুভকে " ভীষণ খিদে পেয়েছে শুভ, চলোনা কোথাও বসে খাই "...... "হুম খিদে পেয়েছে আমারও  " বলতে বলতেই রাস্তার পাশের ছোট্ট ছিমছাম একটি রেস্তোরা দেখে সেখানেই গাড়িটা পার্ক করলো শুভ |

দুপুরবেলা বলেই হয়তো রেস্তোরা টা একদম ফাঁকা, দু জন লোক শুধু বসে ড্রিংক করছে, আমরা একটা কোণের দিকের টেবিলে বসে খাবার অর্ডার দিলাম, আর তার পরেই আমার প্ল্যানমতো ঘন হয়ে বসলাম শুভর পাশে, আদরে আদরে ব্যস্ত করে তুললাম ওকে... শুরুতে বাধা দিলেও একটু পরেই  শুভ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো... ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম " আর পারছিনা শুভ, চলোনা কদিন শুধু তুমি আর আমি একলা হয়ে থাকি তোমার পিসির বাড়িতে, তোমার বাড়িতে এতো লোকের মধ্যে তোমাকে নিজের করে পাবোনা গো ", একটু চমকে উঠলেও হয়তো উত্তেজনার বশেই রাজি হয়ে গেলো শুভ |

                 *************************


শুভ র পিসির ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বোটকা একটা গন্ধ পেলাম, কিন্তু কিসের গন্ধ সেটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না, তার আগেই শুভ আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে ফেললো বিছানায় |

প্রায় আধ ঘন্টা রতি ক্রীড়ার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম দুজনেই |

তখন কতো রাত জানিনা....  হঠাৎ যেন ভীষণ শীত করে উঠতে ঘুম টা ভেঙে গেলো আমার | ঘরময় যেন নীল একটা আলোর আভা....... তাকিয়ে দেখি  আমার ঠিক পাশে অবাক দৃষ্টিতে একটি বাচ্ছা মেয়ে দাঁড়িয়ে | তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই বাচ্ছাটি খিল খিল করে হেসে ঘর থেকে ছুটে চলে গেলো, ওকে ধরব বলে আমিও দরজার দিকে এগোতেই মনে হলো কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে | তখনই মনে হলো শুভ কে ডাকা দরকার, কিন্তু গলা দিয়ে যেন কিছুতেই স্বর বেরোচ্ছে না, পেছন ফিরে খাটের দিকে তাকাতেই দেখি বিছানায় শুভ শুয়ে নেই,এলো চুলে মাথা নিচু করে  বসে আছে একজন মহিলা... প্রচন্ড ভয়ে এবার চিৎকার করে উঠে পালানোর চেষ্টা করতেই  আমার চুলের মুঠিটা টেনে ধরে এই মহিলা অদ্ভুত ভয়ংকর রকম গলার আওয়াজে বলতে লাগলো " কে তুই?  কেন এসেছিস এখানে?  ওরা তোকেও মেরে ফেলবে..... পালা পালা "বলেই আমার  চুল টা ছেড়ে দিয়ে ভয়ংকর ভাবে হাসতে লাগলো | "শুভ কে আমি মেরে ফেলবোই, ওকে ছাড়বোনা, রাজা পালিয়েছে কিন্তু শুভ কে ছাড়বোনা " আবারও হিসহিসিয়ে বলে উঠলো ঐ মহিলা....

"কে তুমি?  কেনো মারবে আমার শুভ কে?  রাজাই বা কে? কি করেছে ওরা?  প্লিজ ছেড়ে দাও তুমি শুভকে, ওর বদলে আমাকে মেরে ফেলো " শরীরের  সমস্ত শক্তি একত্র করে বললাম ঐ  অশরীরী মহিলাকে উদেশ্য করে | " আমি নন্দিনী..... প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো " বলেই যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ঐ অশরীরী... "বলো বলে যাও আমাকে, যেও না, কে তুমি " বলতে বলতে হঠাৎই কোথায় যেন  প্রচন্ড একটা ধাক্কা খাই, অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে বুঝতে পারি নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে ভেসে যাচ্ছে আমার শরীর |


জ্ঞান ফিরতে দেখি শুয়ে আছি বিছানায়,  শুভর চোখের তলায় কালি.... সারারাত ওর ওপর দিয়ে যে বেশ ঝড় গেছে ওর মুখটাই বলে দিচ্ছে | আমাকে তাকাতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে কোনো ডাক্তারবাবুকে ফোন করে সেটা জানালো  | উঠে বসে কাল রাতের ঘটনাটা মনে করতেই মাথা টা বেশ যন্ত্রনা করে উঠলো , আমাকে বসতে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো শুভ |

"প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমাকে, তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে তোমাকে না ডেকেই আমি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে গেছিলাম সোনা, এমনকি ঘরের লাইট টাও জ্বালিনি তোমার ঘুমের অসুবিধে হবে বলে, খুব ভুল করেছি  | এই কান ধরছি, আর করবো না ;কিন্তু তুমি কেন আলো জ্বালাওনি?  তোমাকে এরকম বিবস্ত্র অবস্থায় তোমাকে আমি পাশের ঘরে  খুঁজে পাই.... পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা খুব উপকার করেছেন কাল | আচ্ছা কি হয়েছিল বলোতো? "

এতক্ষন একটাও কথা বলিনি আমি |

এবার আস্তে আস্তে শুভ কে জিজ্ঞেস করি "রাজা আর নন্দিনী কে?"

এই দিনের আলোতেও দেখলাম শুভর মুখটা ভয়ে কেমন সাদা হয়ে গেলো |

"তুমি বিশ্রাম করো, আমি খাবার কিনে আনি " বলেই শুভ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই  | 

আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে আমি পুরো ফ্ল্যাট টা ভালো করে দেখলাম | ঘরে জিনিস বা আসবাব তেমন নেই, যদিও পুরো ফ্ল্যাট টা বেশ বড়ো | আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম পাশের ঘরের দেওয়ালে একটা দরজা, বড়ো একটা তালা ঝোলানো,মনে হলো এটা হয়তো store রুম | তখনো দরজার গায়ে বেশ খানিকটা রক্ত লেগে আছে, বুঝলাম এই দরজা তেই কাল ধাক্কাটা খেয়েছিলাম |

কিন্তু কাল যা যা দেখেছি, এতো টাই স্পষ্ট যে কিছুতেই ভুলতে পারছিনা |

শুভ ফিরে এলেও আর যেন স্বাভাবিক হতে পারলো না,অফিসের কাজ আছে বলে ল্যাপটপ খুলে বসে রইলো,  আমিও আর বেশি বিরক্ত করলাম না |

সারাদিনটা কিভাবে যেন কেটে গেলো | সন্ধের পর মুড হালকা করতেই  ড্রিঙ্কস নিয়ে বসলাম আমি আর শুভ |

টুকটাক গল্প গুজবে মনটা একটু ভালো লাগছিলো, হঠাৎই লোডশেডিং হয়ে গেলো, শুভ তাড়াতাড়ি উঠে রান্না ঘরে গেলো মোমবাতি খুঁজতে আর তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো | " মৌ মৌ, আবার আবার ওরা এসেছে, বাঁচাও আমাকে, ঘরের মধ্যে তখন যেন বরফের শীতলতা নেমে এসেছে....... সেই অসম্ভব ঠান্ডার মধ্যে শুনতে পেলাম ভয়ঙ্কর একটা মহিলা কণ্ঠস্বর, " শুভ নন্দিনীকে ভুলে গেলি? " হাতের মোবাইলটার টর্চ টা জ্বালাতেই আর কেউ কোত্থাও নেই | কারেন্টটাও চলে এলো সঙ্গে সঙ্গেই |

শুভ তখনো থরথর করে কাঁপছিলো, ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম

" শুভ আমাকে খুলে বলো সব... নইলে তুমি আমি দুজনই শেষ হয়ে যাবো, সকালে আমাকে এড়িয়ে গেলে... সারাদিন কথা বললেনা ভালো করে,কেন?  রাজা আর নন্দিনী কে?  কি সম্পর্ক ওদের? "

" রাজা আমার পিসতুতো দাদা আর  আর নন্দিনী...... নন্দিনী ওর প্রেমিকা ছিলো মৌ "....হঠাৎ কোথাও থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো |

" মৌ চলো আমরা পালাই এখান থেকে... মেরে ফেলবে ও আমাদের... চলো এক্ষুনি ".....বলেই আমার হাত ধরে টানলো শুভ... কিন্তু আমার যেন ওজন বেড়ে গেছে, পা টাও যেন জমে গেছে, এক চুলও নড়তে পারছিনা তখন....কেঁদে ফেললাম আমি ... " শুভ ও আমাদের ছাড়বে না, আজ রাত হয়তো আমাদের জীবনের শেষ রাত, তুমি বলো ওদের কথা.... মৃত্যুর এতো কাছে এসে আর ভয় কি... "

               ****************************

শুভ বলতে শুরু করলো..... "সালটা 2014,কলকাতায় চাকরির সুবাদে  রাজা, মানে আমার পিসতুতো দাদা কলকাতায় থাকার কারণে এই ফ্ল্যাট কেনা হয় আর তখনই ওর  পরিচয় হয়  নন্দিনীর সঙ্গে |    দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে, কিছুদিন বাদেই ওদের মধ্যে নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কও হতে থাকে এই ফ্ল্যাটেই |  আর এতেই নন্দিনী প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে, আর রাজাকে বলে ওকে বিয়ে করতে | কিন্তু রাজা কখনোই রাজি ছিলোনা ওকে বিয়ে করতে | নন্দিনীর প্রেগন্যান্সির খবরে ওর সমস্ত ভালোবাসা যেন উবে যায় |

নন্দিনীর ছিলো খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে...ওর প্রেগন্যান্সির খবর শুনে ওর বাড়ির লোক এসে খুব ঝামেলা করে আর সেই রাতেই শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে বাড়িতেই  বিয়ে হয়ে যায় রাজা আর নন্দিনীর | এরপরেই রাজা কেমন পাল্টে যায়... কিছুতেই নন্দিনী আর তার গর্ভের সন্তানকে মেনে নিতে পারেনা | শুধু রাজাই নয়, আমার পিসি পিসেমশাইও এই বিয়েটা মেনে নিতে পারেনা | নন্দিনীর সঙ্গে আমারও ভালোই আলাপ ছিলো, ওর কথামতো অনেক বার রাজাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু কাজ হয়নি | এরপর চাকরি সূত্রে আমি চলে যাই ব্যাঙ্গালোর আর ওখানে থাকার সময়ই নন্দিনীর ফোনে জানতে পারতাম রাজা ওকে মারধর অব্দি শুরু করেছে, এই নিয়ে রাজাকে ফোন করলে তারপর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় |

আমিও কিছুটা অপমানিত হয়ে আর বিশেষ যোগাযোগ করতাম না | পরে শুনেছিলাম ওদের একটা মেয়ে হয়েছে কিন্তু তাকে আমি কোনোদিন দেখিনি | নন্দিনীও আর ফোন করতো না আমাকে |

এর দু বছর পর আমি তখন কিছুদিন ছুটি নিয়ে  কলকাতা এসেছি, হঠাৎ এক রাতে নন্দিনীর ফোন... আমি হ্যালো বলতেই অসম্ভব আর্তনাদ করে বলতে থাকে " রাজা আমার মেয়ে টাকে মেরে ফেলেছে শুভ, পুলিশে খবর দাও.... " বলার সাথে সাথেই শুনি রাজার  প্রচন্ড  চিৎকার, ফোন টাও কেটে যায় | আমি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি এই ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে, কি কুক্ষণে যে এসেছিলাম, কেন যে নন্দিনীর কথামতো  পুলিশ নিয়ে আসিনি সেদিন...... "

শুভ একটু থামলো, ততক্ষনে সেই চাপা কান্নার আওয়াজ ভয়ংকর এক গর্জনে পরিণত হয়েছে  আর পাশের ঘরের দরজায় কারা যেনো তুমুল শব্দ করছে, যেনো বলছে খুলে দিতে... শুভ কে বললাম " তুমি থেমোনা, বলো কি হলো " শুভ বলে " ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দেখি গোটা ফ্ল্যাট রক্তে ভেসে যাচ্ছে, আমাকে দেখে রাজা বলে, ও দায়মুক্ত হলো, আবার ওর স্বাধীন জীবন কাটাবে, আমাকে হতভম্ব দেখে বলে নন্দিনী আর ওর মেয়ে, দুজনকেই মেরে ফেলেছে ও ,নন্দিনীকে মারধর করার সময় ওদের বাচ্ছা মেয়েটা ভয় পেয়ে রান্না ঘরে ঢুকে লুকোতে যায় আর তখনই ধাক্কা লাগে  রাজার সঙ্গে, তখন ও রাগের মাথায় জ্ঞানশুন্য হয়ে বাচ্ছাটাকে রান্না ঘরের জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়,আর তারপর  নন্দিনীর আমাকে ফোন করা দেখে নন্দিনীর গলা টিপে ধরে | মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় নন্দিনী | ফ্ল্যাটের গার্ড কে প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে মেয়ের বডি তুলে আনার ব্যবস্থা করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই...তারপর নন্দিনী আর ওদের মেয়ের লাশ ঢুকিয়ে দেয় ঐ store রুমে |  তারপর আমাকে বলে এই ব্যাপারে আমি যদি কাউকে কিছু বলি তাহলে ও আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আমার মা বাবাকে মেরে ফেলতে দু বার ভাববে না | আমি সেই আতঙ্কে এতদিন পুলিশ কে কিছু জানাই নি মৌ.....  পিসি, পিসেমশাই বাকি আত্মীয়রা সবাই জানে নন্দিনী মেয়েকে নিয়ে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, আমি সব জেনেও কাউকে কিছু বলতে পারিনি, গত দেড় বছর ধরে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি পুরো ব্যাপার টা  " বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শুভ |

" এক্ষুনি পুলিশে ফোন করো শুভ, আর দেরি নয়.... সত্যিটা জেনে লুকিয়ে রাখার জন্যে হয়তো তোমার কিছু  শাস্তি হবে, কিন্তু আজ যদি না জানাও নন্দিনীর হাতে আজ আমাদের দুজনের মৃত্যু অবধারিত " বলতে বলতে আমার ফোন টা এগিয়ে দিলাম ওকে |

আশ্চর্য ব্যাপার হঠাৎ সব কিছু যেন শান্ত হয়ে গেলো...আর কোনো কান্নার শব্দ পেলাম না,  ঘরের ঠান্ডা ভাব টাও চলে গেল, ঐ store রুমের দরজা পেটানো টাও বন্ধ হয়ে গেলো আচমকাই |

পুলিশ এসে  দুটো দুটো কঙ্কাল উদ্ধার করলো ঐ store রুমের তালা ভেঙে, ওখান থেকেই পাওয়া গেলো নন্দিনীর একটি ডায়েরি .... শুভ কেও ওরা নিয়ে গেলো ওর জবানবন্দি নেওয়ার জন্যে |

আমি রইলাম একা ঐ ফ্ল্যাটেই... হঠাৎ যেন সমস্ত ভয় কেটে গিয়ে ভীষণ এক আনন্দ হতে লাগলো....

নন্দিনী আর ওর মেয়ে হত্যাকারী এবার উপযুক্ত শাস্তি পাবে ভেবে |

তখন রাত শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই.... ভোরের নরম আলোয় ভরে গেছে ঘর, জানলায় এসে দাঁড়ালাম সূর্যোদয় দেখবো বলে...হঠাৎ যেন মনে হলো ছোট্ট একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে একজন সুশ্রী মহিলা হাসিমুখে  আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে , আমিও হাত নাড়তেই মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ওরা | কোথাও যেন পড়েছিলাম সূর্যোদয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ প্রার্থনার জন্য শুভ সময় |

দু হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম ওদের আত্মার শান্তির জন্যে |




পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু