দেওয়াল দেবতার কাছে
হাঁটতে হাঁটতে গোলাবাড়ির মোড়ের অন্ধকার গলির সাত নম্বর বাড়ির কাছে আসতেই ফণীবাবুর ডান পায়ের জুতোটা ছিঁড়ে গেল। সবে মাত্র ঘড়িতে সাড়ে সাতটা অথচ রাস্তাটা কেমন নিঝুম। কোনও রিক্সা, অটো নেই। তার বাড়ি থেকে এইটুকু পথে গোনা-গোনা মাত্র চারটে লাইটপোস্ট আছে, সেগুলোর মধ্যে দুটো গত বছরের ভোটের পর থেকেই খারাপ। আর যে দুটো লাইট জ্বলে সেগুলোর একটিতে আলো আছে, আরেকটিতে প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। সেই প্রাণ যায়-যায় আলোর লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে এক বাড়ির প্রাচীরের গায়ে একজন বয়স্ক লোক প্রস্রাব করছে, আর হালকা স্বরে গান গাইছে – ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’।
ফণীবাবুর বাড়ি থেকে এইটুকু দু-মিনিটের হাঁটা পথ। জুতো জোড়া হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে যাবে যেই তখনই সেই লোকটির কর্মটি তার চোখে পড়ল। এইসব একদমই তার সহ্য হয় না। মুখ ফসকে বলেই দিলেন – “ও মশাই, আর কি কি মনের খাতায় লিখে রাখার বাকি আছে!”। সেই লোক আপন কাজে ব্যস্ত। দেড় মিনিটের কাজ সম্পন্ন করে তার দিকে এগিয়ে আসতেই বলে ফেললেন – “মশাই, আপনার কি কমন সেন্সের অভাব? যেখানে সেখানে প্রস্রাব করেন কেন? দেখতে পান না দেওয়ালের গায়ে কি সাঁটানো আছে?”।
- বেশ করেছি। আপনার বাড়ির দেওয়াল? আপনি বলার কে, মশাই?
- আমি যেই হই না কেন, আপনি ওখানে প্রস্রাব করলেন কেন? দেওয়ালে ঠাকুর দেবতার টাইলস বসানো আছে সেটা কি দেখতে পাননি? অন্ধ নাকি?
- দেখুন, আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। আমি যে জায়গায় পেচ্ছাব করেছি সেই জায়গায় কিন্তু ঠাকুরের কোনও টাইলস লাগানো ছিল না, কিছুটা দূরে লাগানো আছে। এখনও আমার পেচ্ছাবের দাগ দেওয়ালে লেগে আছে। আপনি দূরত্ব মেপে দেখতে পারেন।
- ছিঃ। আপনিতো ভীষণ নোংরা এবং অভদ্র লোক! দোষ করবেন আবার উল্টে গলা উঁচিয়ে কথা বলবেন? কিসের সাথে কিসের কথা তুলছেন?
- বড্ড বেশি কথা বলছেন। আরও বেশি বেশি করে ওখানে পেচ্ছাব করব, পারলে হেগে দেবো। মটকা গরম করবেন না। যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানে যান। আর যদি বেশি বাড়াবাড়ি করেন তাহলে এইবার আপনার গায়ে মুতে দেব। চুপ থাক, শালা।
এই বলে লোকটি হাঁটতে লাগল।
- ধুর শালা, নেশাটাই নষ্ট হয়ে গেল। আবার এখন মদ আনতে যেতে হবে।
ফণীবাবু চুপ করে চেয়ে রইল অভদ্র লোকটির চলে যাবার দিকে। এত কিছু হয়ে গেল একটা লোকও বাড়ি থেকে বেরোল না। বেশি রেগে গেলে তার আর মাথা ঠিক থাকে না। হাই-প্রেসারের রোগী। দীর্ঘ জীবন ধরে স্কুলে শিক্ষকতার পরে চার বছর হয়েছে রিটায়ার্ড এখন। বাড়িতেই বেশির ভাগ সময় কাটে, সন্ধ্যেবেলায় চা পানের পর বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে যায় প্রতিদিন। রাতে শহরের আলো দেখতে দেখতে ফুটপাতে কিছুক্ষণ হাঁটাটা তার এই চার বছরের নতুন অভ্যাস।
বাড়িতে তিনজন মানুষ থাকে, ফণীবাবু, তার স্ত্রী এবং মেয়ে। তিনজনের সীমাবদ্ধতা তিনটে চ্যানেলে - এবিপি আনন্দ, স্টার জলসা আর সংগীত বাংলা। প্রত্যেকজনের আলাদা আলাদা সময় বাঁধা আছে। সন্ধ্যের হাঁটা শেষ করে এসে রাত সাড়ে আটটার খবরটা তিনি দেখবেনই। প্রতিদিন সাড়ে আটটার আগেই বাড়ি ফিরে আসেন। আজ আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল তিনি এখনও বাড়ি ফিরেননি।
- ও মিনি, এত সময় হয়ে গেল তোর বাবা আসছে না কেন? মোবাইল আর চশমা নিয়ে গেছে? একটা ফোন করে দ্যাখ না, মা।
- মোবাইলতো নিয়ে যায়নি! চার্জে বসানো। চশমা নিয়ে গিয়েছে।
- একটু বাইরে গিয়ে দ্যাখ না। এক্ষুনিতো বৃষ্টি আসবে। ছাতা নিয়ে গিয়েছে?
- না।
মিনি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে রাস্তা শুনশান পড়ে রয়েছে। কোথাও কোনও মানুষজন নেই। বাড়ির সামনে একটা বড় খাদ। খাদের পরে পাহাড় আর পাহাড়, আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে। সূর্যাস্তের প্রথম আলোতে সোনালী হয়ে উঠছে পাহাড়গুলোর চূড়া। সে আনমনে সূর্যাস্ত দেখছে।
- ও মিনি, মিনি-রে। কোথায় গেলি?
মিনির কোনও হুঁশ নেই। কিছুই সে শুনতে পাচ্ছে না। সে এখন অন্য জগতে। হেঁটে যাচ্ছে খাদের পাশের রাস্তা দিয়ে। কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর হোঁচট খেয়ে তার এই হেলুসিনেশন ভেঙ্গে যায়। ফিরে আসে নিজের বাস্তবে। সে দেখে আকাশ অন্ধকার, দু’টো লাইটপোস্টের আলো জ্বলে রয়েছে, আর তার পায়ের সামনে তার বাবা নিথর অবস্থায় মরে পড়ে রয়েছে।
- বাবা। বাবা, ওঠো। কি হয়েছে তোমার? কেউ আছেন? দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করুন।
সে তার বাবার মাথাটাকে তার কোলে নিয়ে বসল। ‘বাবা-বাবা’ বলে অনেকবার ডাকার পরেও তার বাবা সাড়া দিল না। এমনকি কোনও মানুষজনেরও সাড়া পাওয়া গেল না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।
কাঁদতে কাঁদতে আস্তে আস্তে তার চোখের দৃষ্টি অস্পস্ট হয়ে উঠছে। আশেপাশের সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে হারিয়ে ফেলছে তার বাস্তব সময়, অনুভূতি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনের সমস্ত দৃশ্যগুলো যেন পালটে গেল। সে এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সব কিছু। আগের কথা কিচ্ছু মনে নেই। তার হাতের নখ বড়বড় হয়ে আছে। পরনে অপরিষ্কার ছেঁড়া জামা। তার কোলের উপরে পড়ে আছে সাদা রঙের একটা ধুতি। সে এখন পাহাড়ের অনেক উপরে। তার পাশে একটা গুহা। গুহাটার গায়ের কিছু কিছু অংশে লাল রঙের সিঁদুরের ছাপ, দেবতার ছবি এবং সস্তিক চিহ্ন রয়েছে। সামনে খাদ পেরিয়ে অনেক দূরে দূরে কিছু বসতি রয়েছে অথচ কোনও মানুষজনই চোখে পড়ছে না।
গুহার দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে সে। এক মাঝ-বয়সী মাতাল গুহার দেওয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে গান করতে করতে আসছে। ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলই ফুরায়ে যায়, মা’। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেখানে প্রণাম সেরে গুহার দেওয়ালের গায়ে মদের খালি বোতলটা ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলল সে। বোতল ভাঙ্গার শব্দে মিনি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে। মাতালটি তার কাছে এসে দাঁড়াল।
- বুঝলি! সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলই ফুরায়ে যায়। তুই কি পারবি আমার সাধ মেটাতে, আশা পুরাতে? হা হা হা [উচ্চস্বরে হাসতে লাগল]।
- মিনি, চুপ করে থাকল। ভয়-ভয় চোখে সেই মাতালের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাতালটি এইবার আরও কাছে এসে মিনির কোলের ধুতি ধরে টান দিল। মিনি শক্ত করে ধরে থাকল সেই ধুতি।
- গুহাতে কেউ নেই। চল্, একদান হয়ে যাক খেলা।
- না, আমি যাব না।
মাতালটি এইবার তার জামার ছেঁড়া জায়গায় হাত দিয়ে বলল – ‘ইঁদুর ছিঁড়েছে?’। মিনি লোকটির হাতে নখ দিয়ে আঁচড় দিয়ে দিল। লোকটি এইবার তার গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার গায়ের ছেঁড়া জামাটাকে আরও বেশি করে ছিঁড়ে দিল।
- গুহাতে যাবি না তো কি হয়েছে? এখানে দান চালব।
সে চিৎকার করতে লাগল। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে লোকটির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর লোকটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল – “চল্, খাদে যাবি?”। এই বলে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে খাদে ফেলে দিল।
মাতালটির চিৎকারে মিনির হেলুসিনেশন কেটে গেল। সে কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু দেখল একজন মাতাল ড্রেনের ভিতর পড়ে গেছে এবং সে অকথ্য ভাষায় তাকে এবং তার বাবাকে গালাগাল দিচ্ছে। মিনি ছুটে গিয়ে তার বাবার মৃতদেহের কাছে বসল।
মিনির ফোনটা বেজে উঠল। অপর প্রান্তে তার বাবার কণ্ঠ। 'মিনি, কোথায় তুই?'