বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

নাম বিভ্রাট

 

কৌতুক বা হাস্যরস জীবনের একটি বিশেষ অঙ্গ। কৌতুকের বোধ মানুষ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। কারোর কাছে যা কৌতুক তা অন্যের কাছে নিতান্তই বোকামি বা কপটতা বা অশ্লীলতা হতে পারে । সব কৌতুকের রসাস্বাদন সবাই করতে পারেনা । আবার বয়স এবং সম্পর্ক ভেদে কৌতুক ভিন্ন হয় এবং তার গ্রহণযোগ্যতাও ভিন্ন । কিন্তু কিছু ঘটনা বা মুহুর্ত থাকে যা পরিবেশ এবং সময়ের সাপেক্ষে চূড়ান্ত কৌতুকময় হয়ে উঠতে পারে । আমার ছাত্রজীবন  এবং কর্মজীবনে বেশ কিছু ঘটনা আছে যা মনে পড়লে একলা বসে বসেই অট্টহাসি হাসতে থাকি । সেরকম কিছু ঘটনা আজ আবার মনে পড়ছে । আজ এই সুযোগে একা না হেসে আপনাদের সাথে হাসার ইচ্ছা হল । মধ্য হাওড়ার এক সুপ্রাচীন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বেশ কিছু ঘটনা, স্মৃতির প্রাঙ্গণে আজও খেলা করে এবং আজীবন খেলা করবে বলেই মনে হয় ।

 

তখন সম্ভবত ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি । আমাদের শ্রেণীতে এক নিতান্তই সাদামাটা সরল হৃদয় বালক পড়ত । তার নাম ছিল শুভঙ্কর ভট্টাচার্য । পৃথিবীতে এই নাম এবং পদবী যুক্ত বহু মানুষ থাকতে পারে, কিন্তু এই মহামানবের নাম এবং পদবী নিয়ে যা ঘটেছিল বা সংঘটিত করা হয়েছিল তা সম্ভবত এই বিশ্বে আর দ্বিতীয়বার ঘটবে কিনা তা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে । বাবা মা যে নাম প্রদান করেই থাকুক না কেন সহপাঠীরা যে একটি ভিন্নতর নামে সম্বোধন করবে, তা চিরাচরিত নিয়ম এই বিশ্বের । শুভঙ্কর তার ব্যতিক্রম হয় কি করে ? তবে নামের থেকেও তার পদবী ছিল বিশেষ আলোচ্য বিষয় সহপাঠী মহলে । শুরু হয়েছিল শুভঙ্কর নামে সম্বোধন দিয়েই, তবে শেষ  হয়েছিল এক অদ্ভুত নাম " ভুটি " দিয়ে । ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকাকালীন এই বিরল নামটি উপাধি দেওয়া হয়েছিল সহপাঠীদের তরফ থেকে এবং এখনো পর্যন্ত আমাদের সব সহপাঠীরা এই নাম ছাড়া ওর আসল নামে ডাকার কথা চিন্তাও করতে পারেনা । আসলে গোপন কথাটি হল ওর শুভঙ্কর নামটি আমরা সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছি । একটি অকপট স্বীকারোক্তি এই উপলক্ষ্যে করে রাখি যে - এই আমি যে এখন শুভঙ্কর নামটি আপনাদের জানাতে পারলাম তার জন্য সেই বিরল বন্ধুটির কাছে কৃতজ্ঞ ; যে এতদিন পরও শুভঙ্কর নামটি স্মৃতির মণিকোঠায় সে সযত্নে রেখে দিয়েছিল এবং অন্তত আটটি দুরভাষ মাধ্যমে যোগাযোগের পর নামটি আমি পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছি ।

 

যাই হোক, এই নাম বা বলতে গেলে পদবী বিবর্তনের ইতিহাস একটু সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি ; শুভঙ্কর ভট্টাচার্য নামটি নিম্ন লিখিত ক্রমানুসারে যেভাবে বিবর্তিত হয়েছে :-

প্রথম শ্রেণী - শুভঙ্কর

দ্বিতীয় শ্রেণী - ভট্টাচারিয়া

তৃতীয় শ্রেণী - ভুট্টাচরিয়া

চতুর্থ ও পঞ্চম - ভুট্টা

ষষ্ঠ শ্রেণী - ভুটি

 

শুভঙ্করের পরিবার বিশেষ করে তার পরবর্তী প্রজন্ম আশা করি আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে যে এরপর আর কোনো বিবর্তন ঘটেনি তার নামের ।

 

খুব বিরল প্রজাতির কিছু সহপাঠী ছাড়া প্রায় সবার নামই বিবর্তিত হয়েছে এবং তা সহপাঠী মহলে উজ্বল রূপে বর্তমান । কিন্তু শুভঙ্করের পরিবার একবার অত্যন্ত বিড়ম্বনায়  পড়েছিল এই সম্বোধন বিভ্রাটের কারণে । আমাদের অষ্টম শ্রেণীর দুটি বিভাগ ছিল একটি 'ক' বিভাগ ও আর একটি 'খ' বিভাগ । ভুটি সহ আমরা ছিলাম 'ক' বিভাগে । ফুটবল ম্যাচ উপলক্ষ্যে বেশ রোমাঞ্চ ছিল সবার মধ্যে । 'খ' বিভাগের বিরুদ্ধে জয়ের খতিয়ান জারি রাখতেই হবে । ভুট ট ট , মুখে বারবার সেই চলে আসে , মানে শুভঙ্কর ছিল মধ্যমণি অর্থাৎ মিডফিল্ডার ।সুতরাং তার খোঁজ পরে গেল । পরের দিন ম্যাচ , আজ সে অনুপস্থিত । এক সহপাঠী , " মামা " ( আরো এক সহপাঠীর সম্পর্কে মামা তাই সার্বজনীন মামা ) কে দায়িত্ব দেওয়া হল শুভঙ্করের বাড়িতে গিয়ে তাকে আগামীকালের ম্যাচের কথা জানানোর । মামা প্রস্তুত । খোঁজ খবর নিয়ে তার বাড়ির গলিতে হাজির মামা এবং জুতো ওরফে জ্যোতি ( জ্যোতিপ্রকাশ থেকে যার নাম বর্তমানে বন্ধু মহলে " জুতো " ) । গলির মুখে যাবার পর দুই মহামানবের খেয়াল পড়েছে যে, নির্দিষ্ট ভাবে তার ( ভুটির) বাড়িটি কোথায় তা তাদের জানা নেই । তাই প্রতিবেশীদের বাড়িতে খোঁজ পড়ল । কিন্তু ভুটি  নামের কাউকে তারা চিনতে পারলনা । হঠাৎ মামার খেয়াল হল যে এই বিবর্তিত নামে কেউ তাকে এই পাড়ায় চিনবে না । তাই এবার স্মৃতির খননকার্য শুরু হল তার আসল নামটি উদ্ধারের  জন্য । কিন্তু মামা এবং জুতো দুজনেই তাদের স্মৃতির চূড়ান্ত খননপর্ব সমাধা করেও আসল নামটি উদ্ধার করতে সক্ষম হলনা । সেই যুগে মোবাইল ফোন নামক কোনো বস্তুর উদ্ভাবন হয়নি, তাই আমার মত এত সহজে এখন নামোদ্ধার সম্ভব ছিলনা । ওই পাড়ায় অন্য কোনো সহপাঠির বাস ছিলনা, তাই সাহায্য অপ্রতুল ছিল । কিন্তু খুঁজে পেতেই হবে,  ভুটি ছাড়া মাঠে তো নামা যাবে না । কোনো বিকল্প নেই । এবার মান সম্মান বন্ধক রেখে শুরু হল তারস্বরে চিৎকার , ভুটির নাম ধরে । উদ্দেশ্য ছিল শুভঙ্কর তার প্রদত্ত উপাধি শুনতে পেয়ে নিশ্চই সাড়া দেবে । হঠাৎ এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি দরজা খুলে উপস্থিত হলেন ।

 

- কাকে চাই ?

- ইয়ে , ভুটিকে ।

- এই নামে কেউ এখানে থাকেনা ।

- জেলা স্কুলে পড়ে , ক্লাস এইট , এ সেকশন ।

- আমার ছেলেও পড়ে । কিন্তু তার নাম ভুটি না ।

- একবার আপনার ছেলেকে দেখতে চাই ।

- দেখে লাভ নেই , তোমরা যাকে খুঁজছ সে নয় ।

 

দরজা বন্ধ করে দিতে যাবেন, ঠিক সেই সময় 'জুতোর' নাকে গন্ধ এলো একটা,  যা আমাদের সকলের বিশেষ চেনা । ভুটির মোজার গন্ধ । সালফিউরিক এসিডের দ্রবণে পচা ডিম এক সপ্তাহ রেখে দিলে যে গন্ধ বের হয় সেই রকম একটা গন্ধ পরিবহন করত তার মোজা । সম্ভবত বছরে চার বার ধৌতকার্য হত । এই গন্ধ পেতেই জুতো ছুটল দোতলার দিকে । সঙ্গে চিৎকার তার উপাধি সহ । ভদ্রলোক রীতিমত আগের থেকেও দ্বিগুণ কিং- কর্তব্য- বিমূঢ় হলেন । বেশি কিছু না বুঝে মামাও অনুসরণ করল জুতোকে । তিন-চারটি ঘর খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল ছাদের সিড়ি থেকে পদার্পণ করছেন ভুট্টা মহারাজ । যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে জুতো বিষ উদগীরণ করতে লাগল ।

 

জুতো :- এই যে

দেড় কেলানে মাকাল-ষষ্ঠী , কানে কি হাজা হয়েছে ? নাকি , কানের ফুটোয় গুবরে পোকায় বাচ্চা পেরেছে ? এতবার ডাকছি সাড়া দিতে পারিস না ?

 

ভুটি :-

বেশ করেছি ।উল্টোপালটা নামে ডাকাডাকি করছিস বাড়ির সামনে এসে । গায়ে জল ঢালব বলে ছাদে গিয়েছিলাম । পাড়ার লোকে কি ভাববে নাম শুনলে ?

 

নানান  বাদানুবাদের পর শুরু হল হাতাহাতি । অসম্ভব রূপ নিচ্ছে ক্রমশ ।

 

মামা ততক্ষনে ভূপতিত , অবশ্যই হাসতে হাসতে । এই সময় কি - ক - বি ব্যক্তি,  অর্থাৎ ভুটির বাবা এসে অবস্থা সামাল দেন । অবশেষে  অনেক বোঝানোর পর ভুটি ম্যাচ খেলতে রাজি হয় । আমরাও জিতি ম্যাচটা । গোল কিপারের ভূমিকায় ছিলাম আমি ।

 

কিন্তু এরপর থেকে আমাদের বন্ধু জুতো প্রত্যেকের বিদ্যালয় - প্রদত্ত  উপাধি আসল নাম সহ একটা চিরকুটে লিখে রাখত । ঘর পোড়া জুতো থুড়ি গরু বলে কথা ।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু