বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কা কস্য পরিবেদনা

'কা কস্য পরিবেদনা'



মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, তত আধুনিক হচ্ছে তার জীবনযাত্রার মান। যার আঁচ গিয়ে গায়ে লাগে বাড়ির কর্তার ওপর যখন খামোখা কতগুলো জটিল যন্ত্র বসিয়ে সবচেয়ে গুরুত্ববিহীন স্নানঘরটার পেছনে সবচাইতে বেশী টাকা নয়ছয় করা। তা না হলে কিটিপার্টির আসরে উপবিষ্টা সব হাইফাই বান্ধবীদের সামনে  'ওয়াশরুম' নামের এই বিলাসবহুল কুঠুরিকে প্রেজেন্ট করতে গৃহকর্ত্রীর প্রেস্টিজ নাকি লজঝরে সাইকেলের চাকার মত ল্যাকল্যাক করে পাংচার হয়ে যায়!

স্বামী বেচারার পকেটের ওজনটাকে না মেপে গিন্নি এমন উদাসীনভাব দেখায় যেন 'টাকা মাটি, মাটি টাকা'...  আজ আছে,কাল নেই। কাগজের কী বা ভরসা!  যখন তখন ডিমানিটাইজেশনেরও চাপ। তার চেয়ে এইই ভাল। ঘরটা আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁদের আভিজাত্যবোধের একটা দৃষ্টান্ত রেখে যাবে।

মফস্বলের সহজ জীবনে অভ্যস্ত হরিদাস পালের কাছে এটা কোনওমতেই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না কীসের জন্য মানুষ ওই ছোট্ট একখান ঘরকে নানারকম কলকব্জা দিয়ে সাজিয়ে সাদাসিধে মানুষগুলোর সুখ কেড়ে নেয়!


মফস্বল থেকে সদ্য আগত প্রৌঢ়ত্ব ছুঁইছুঁই গিন্নি মাধুরীর সাথে শপিং করতে বেরিয়ে হরিদাস মনে মনে ফিরে গেল কালজানি নদীর ধারে তার শহরটিতে।

আহা! কী আনন্দ সেখানে! নির্মল বাতাস সারা শরীরে মেখে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে এপাড় ওপাড় হওয়া। পরে অবশ্য বাবা বাড়ির ভেতরে একটা টিউবওয়েল কল বসিয়েছিল। সেটার লম্বা সবুজ রঙের হাতলে চাপ দিলেই মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ঠান্ডা জল বেরোত।

ইশশ্! সেই রকম ঠান্ডা শব্দ যদি গিন্নির মুখ দিয়ে একটু আধটুও বেরোত!


লোহা আর ক্রোমিয়ামের সংমিশ্রণে আজকাল যে ছোট মুখওয়ালা যন্তরগুলো বেরিয়েছে তা যে অনভ্যস্ত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের জীবনে কী ভয়ঙ্কর বিপদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেটা হরিদাস পাল ছাড়া আর কেই বা ভাল জানে! বিয়ের পর নতুন বউয়ের সাথে তার মামাতো বোনের বিয়েতে গিয়ে কী বিপত্তি!


ট্রেন থেকে নেমে প্রচন্ড বেগে যখন জামাকাপড় একশা হবার জোগাড় তখন চারদিকে তাকিয়ে স্নানঘরে কোন সঠিক জায়গাই তার নজরে পড়ল না যেখানে শরীরের বর্জ্যগুলো বর্জন করা যায়। উপায়ান্তর না দেখে দরজা অল্প ফাঁক করে মুখটা সামান্য বাড়িয়ে দরজায় পাহারারতা বৌকে একটানে ভেতরে ঢোকায়।

মাধুরীর শরীর কেঁপে ওঠে লজ্জায়।


" কী ব্যাপার! ছাড়ো!  কেউ দেখে ফেলবে যে! "


সে সপ্রেমে স্বামীর দিকে তাকাতেই দ্যাখে তার ফর্সা টাকে বিন্দু বিন্দু উৎকণ্ঠার ঘাম।


" এখানে ইয়ে..... মানে পায়খানা করব কোথায়?  আর চাপা যাচ্ছে না যে! "


" মরণ!"


মাধুরী তাড়াতাড়ি একটা সাদা চ্যাপ্টা বড় ঢাকনা হাত দিয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে রাখতেই একটা হাঁ করা ছোট্ট কুয়োর মুখ খুলে গেল।


বৌ  বেরিয়ে যেতেই ছুটল কুয়োর কাছে হরিদাস। কিন্তু এবার আরও মুশকিলে পড়ল সে। বসবে কোথায়!  কেমন করে!

আর ভাবার সময় নেই। হরিদাস কুয়োর ওপর চড়ে বসল।  কিছুক্ষণ পরে তার মনে হল....  " ওমা! এ যে একটু একটু নড়ে! বাড়ির পাদানিগুলো তো নড়ে না! রক্ষে কর মা! শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের হাত,পা যেন না ভাঙ্গে!

কিছুক্ষণ পরেই আবার ডাক পড়ে মাধুরীর।


" কী গো! জল কোথা দিয়ে পড়ে? "


মাধুরী কোনমতে নাক টিপে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছোট্ট একটা নব ঘুরিয়ে তখনকার মত তার ক্যাবলাকান্ত স্বামীর সম্মান বাঁচায়।


ঘর্মাক্ত হরিদাস কলের তলায় ধেবড়ে বসে একের পর একের কল ঘোরাতে শুরু করলেই চরম বিপত্তি ঘটে।

গরম জলের অসংখ্য ফোঁটা তার কেশবিহীন সুমসৃণ টেঁকো মাথায় মৌমাছির হূলের মত এমন আকস্মিক আক্রমণ শুরু করল যে বেচারা জামাইয়ের তখন প্রাণান্তকর অবস্থা।

কোনমতে গা মুছে যখন সে ওই অভিশপ্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন তার সারা মাথা বড় বড় ফোস্কায় সুসজ্জিত।

লজ্জায় মাধুরী তার শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে।



হঠাৎ মাধুরীর প্রবল ধাক্কায় হরিদাস বাস্তবে ফিরল।

একটা সুসজ্জিত বাতানুকুল বাথরুম অ্যাকসেসরির  দোকানে মাধুরী হরিদাসকে একটা বিল ধরিয়ে দিল। আঁতকে উঠল হরিদাস।  এক হ্যাঁচকায় স্হূলকায়া গিন্নিকে দোকানের বাইরে টেনে নিয়ে এসে বলল, " এই দুলাখ টাকাটা আমার নকল হৃদপিন্ডের জন্য রাখলে তুমিই বেশীদিন কাটাচচ্চড়ি চিবোতে পারতে।"


মাধুরী চোখ ছোট করে বিলেতফেরত ম্যানেজমেন্ট পাশ ছাত্রীর মত বলল, " বাথটাবে শুয়ে শুয়ে পুরো সাবানের ফেনায় ডুবে গিয়ে তুমি আর আমি যখন হিরো হিরোইনদের মত জলকেলি করব,তখন দেখবে তোমার হৃদপিন্ড এক নতুন যৌবন লাভ করবে।"


হরিদাস রুমাল দিয়ে টাক মুছে বলল," বাথটাব আবার কী!"


গিন্নির ওই বাজখাঁই গলা দিয়ে যেন আজ ডাবরের মধু ঝরছে।


" ওই যে গো কৃত্রিম পুকুর। বাথরুমে বসানো যায়। তুমি তো তোমার গ্রামের নদীকে খুব মিস কর!!  তাই, তোমার কথা ভেবেই ই আর কী এটা বসাচ্ছি। আইডিয়াটা কেমন?  দারুণ...  না!"


হরিদাস মনে মনে তার তরুণী ভার্যার হাত ধরে তার আধুনিক বাথরুমের কৃত্রিম পুকুরে গোলাপের পাপড়ি বিছানো দুধেল সাবানের ফেনায় নিমগ্ন হল।

বিল মিটিয়ে উল্টোদিকের দেওয়ালে প্রতিফলক কাঁচে দুজনের প্রতিবিম্ব দেখে মূর্খ মধ্যবিত্ত বাঙালী হরিদাস পালের স্বপ্নের পৃথিবীটা দুলে উঠল।



             সমাপ্ত।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু