বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ল্যাপটপ

নতুন কোম্পানিতে জয়েন করে প্রথম দিনই ল্যাপটপটা হাতে পেয়ে, মনটা একটা অনাবিল আনন্দে ভরে গেলো দেবশঙ্করের| চাকরি সূত্রে, এই তাঁর প্রথম পাওয়া ল্যাপটপ| তাঁর বিশ বছরের কেরিয়ারের পুরোটাই কেটেছে বিভিন্ন কোম্পানির বিজনেস ডেভেলপমেন্টের ফিল্ড রোলে| আর সত্যি কথা বলতে গেলে, এমন কোন কোম্পানিতে কোন কালেই তাঁর কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি যে, ফিল্ড রোলে অফিস ল্যাপটপ পাওয়া যাবে| কিন্তু এবার ব্যাপারটা আলাদা| তাঁর নতুন কোম্পানি 'শপকার্ট' ভারতের অন্যতম বিলিয়ন ডলার ই-কমার্স স্টার্ট-আপ| আর দেবশঙ্কর বাবু তাদের কলকাতা অফিসে জয়েন করেছেন 'এরিয়া বিজনেস ম্যানেজার' হিসেবে|


দেবশঙ্কর দত্ত একা মানুষ| বাবা-মা গত হয়েছেন প্রায় বছর দশ হলো| বিয়ে-থা তিনি করেননি| ভবানীপুরে পৈতৃক বাড়ি| বাড়ি ছাড়াও উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যা পেয়েছেন, তাতে তাঁর মতো ব্যাচেলরের দিব্যি হেসে খেলে চলে যায়| তাই, দু'মাস আগে, করোনার প্ৰভাবে, বিজনেস স্লো-ডাউনের জন্য যখন তিনি তাঁর হসপিটালিটি ফার্মের চাকরিটি খোয়ালেন, দেবশঙ্কর বাবু প্রথমে ভেবেছিলেন ক'টা দিন নিখাদ বিশ্রাম নেবেন| কিন্তু চাকরি খোয়ানোর পর সারাদিন ধরে ক্রমাগত শুধুমাত্র তাঁর চাকর-কাম-রাঁধুনি বনমালীর মুখ দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন| শেষটায় মাস খানেকের মাথায় গিয়ে, নতুন উদ্যমে চাকরির সন্ধান শুরু করলেন তিনি| আর তার ফল মিললো, যখন 'শপকার্ট'-এর এই 'এরিয়া বিজনেস ম্যানেজার'-এর পদের জন্য তিনি সিলেক্টেড হলেন| অবশ্য, খুব বেশি প্রতিযোগিতার মুখে তাঁকে পড়তে হয়নি| কারণ, এই কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল - 'এরিয়া বিজনেস ম্যানেজার'-কে সপ্তাহে অন্ততঃ দু'দিন ফিল্ডে যেতে হবে| আর এই করোনা আতঙ্কে সে শর্তে রাজি হওয়ার ক্যান্ডিডেট এই চাকরির অভাবের বাজারেও খুব বেশি ছিল না| তবে, এই অবস্থার কথা মাথায় রেখে, সপ্তাহের বাকি চার দিন কোম্পানি তাঁকে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এর অপশন দিয়েছে| আর এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' এর জন্য দিয়েছে ল্যাপটপ| 'অফিসের ল্যাপটপ' - যা তিনি অনেক কলিগের হাতে এতদিন দেখে এসেছেন; যা মূলতঃ প্রথাগত ডিগ্রীর অভাবে তাঁর কাছে এদ্দিন ছিল অধরা| অবশেষে, আজ তাঁর সেই স্বপ্ন পূর্ন হয়েছে|

অফিসে প্রথম দিন ইনডাকশন আর ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন পর্ব মিটিয়ে, সন্ধে সাড়ে ছ'টা নাগাদ দেবশঙ্কর বাবু বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন| একটা শাটল অফিসের গেট থেকে, একদম তাঁর বাড়ি অব্দিই যায়| এটার খোঁজ তিনি আগেই নিয়ে রেখেছিলেন| শাটলে চড়ে দেখলেন, একই গাড়িতে বসে আছেন, তাঁর নতুন অফিসের রিজিওনাল অ্যাডমিন সুমিত ঘোষ| দেবশঙ্কর বাবু, যাকে বলে, 'স্বভাবী আলাপী' - তা একেবারেই নন| তাই, সুমিত বাবুকে দেখে মাস্কটা ঠিক করতে করতে, চোখ দিয়ে শুধু একটা হাসি ছুঁড়ে দিলেন| আর সেটা করেই তিনি বুঝলেন, সুমিত বাবু কিন্তু তাঁর মতো অল্প কথার মানুষ মোটেই নন| হাসির উত্তরে সুমিত ঘোষ বলে উঠলেন, " আরে দেবশঙ্কর'দা তো? আমি সুমিত| ইস্ট জোনের অ্যাডমিনটা আমিই সামলাই| এখন আবার চাপটা আরও বেশি| ক'দিন আগে লে-অফ হলো তো| তাই, লোকের সংখ্যা একটু কমে গেছে অ্যাডমিন ডিপার্টমেন্টে| তা অবশ্য, সব ডিপার্টমেন্টেই কম-বেশি, যাকে বলে লোক 'ছাঁটাই'....নানা..ছাঁটাই ফাঁটাই তো আবার বলা যাবে না.. মানে যাকে বলে 'ডাউন-সাইজিঙ' হয়েছে|"
দেবশঙ্কর বাবু মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, "বাপরে! একটা হাসির জবাবে, এ ভদ্রলোক তো একবারে মহাকাব্য শোনাতে শুরু করলেন! 'সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং' ভুলে ইনি না একদম পাশে এসে গল্প জুড়ে দ্যান|"
তাই হয়তো সুমিত ঘোষ করতেন, যদি না, ঠিক তখনই শাটলে এসে উঠতেন এক সাদা জামা পরা, টাক মাথা, মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক| এই আগন্তুককে দেখে সুমিত ঘোষ, দেবশঙ্কর বাবুকে ছেড়ে, ওনাকে বলে উঠলেন," আরে দাদা! কেমন আছেন? আমাদের তো সব ভুলেই গেছেন| মাঝে-সাঝে ভিডিও কল- টিডিও কল করুন...." বাকি কথাগুলো দেবশঙ্কর বাবুর আর কানে ঢুকলো না| অবান্তর বকবকানির কবল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন| দীর্ঘদিন একাকী জীবন-যাপনের ফলে, গায়ে পড়া এই সব মানুষদের তিনি একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেন না|

বাড়ি ফিরে, ভালো করে চান -টান করে, বনমালীর বানিয়ে দেওয়া ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে, একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে, তিনি প্রথমবার তাঁর অফিসের ল্যাপটপটি খুললেন| আর খুলেই বুঝলেন, ল্যাপটপের বাঁ'দিকের হিঞ্জটা বেশ নড়বড়ে| এই হঠাৎ ছন্দপতনে, মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন দেবশঙ্কর বাবু| ঠিক করলেন, কালই তিনি আবার একবার অফিসে যাবেন| বিশ্বজিৎ পাল মানে যে ছেলেটি আজ তাঁকে ল্যাপটপ হ্যান্ডওভার করলো, সে বলেছিলো আই.টি. সাপোর্ট আর অ্যাডমিন টিম এই অবস্থাতেও রোজই অফিসে আসছে| নাঃ! কাল বিশ্বজিৎের সাথে দেখা করাটা বিশেষ দরকার| তাঁর প্ৰথম অফিস ল্যাপটপের এমন খুঁতখুঁতে শুরু, দেবশঙ্কর বাবুর মোটেই পছন্দ হলো না|

"এটা আসলে পুরনো ল্যাপটপ তো| আগের এমপ্লয়ি প্রায় বছর দুই ব্যবহার করেছিলেন| তাই এই অবস্থা আর কি..!" মিনিট দুই ল্যাপটপটা নেড়েচেড়ে বললো বিশ্বজিৎ|
"তা এটা চেঞ্জ করে দেওয়া যাবে না?", একটু বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠেই প্রশ্নটা করলেন দেবশঙ্কর বাবু|
"ল্যাপটপের স্টক আর আছে কি? অ্যাডমিনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন একবার|" নির্লিপ্ত গলায় জানালো বিশ্বজিৎ|
অ্যাডমিন মানে সুমিত ঘোষ| আজ অফিসে এসে, এই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করার ইচ্ছে দেবশঙ্কর বাবুর একেবারেই ছিল না কিন্তু ল্যাপটপের ব্যাপারটা মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না| কি আর করা যাবে?..অগত্যা..
সুমিত বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, একগাল হেসে, ভদ্রলোক আবার কালকের মতো কথার ফোয়ারা শুরু করতে যাবেন, ঠিক তখনই দেবশঙ্কর বাবু তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন,"আচ্ছা! এই ল্যাপটপটা চেঞ্জ করে দেওয়া যাবে কি?"
"চেঞ্জ? ল্যাপটপ? হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! কি যে বলেন মশাই? ল্যাপটপ থাকলে তো চেঞ্জ করবো? লকডাউনের জন্য তো হেড অফিস থেকে নতুন স্টকই আসছে না|"
"একেবারেই হবে না?", দেবশঙ্কর বাবুও নাছোড়বান্দা|
"আরে দাদা| আপনার তো তাও লাক ভালো| পুরনো হলেও ল্যাপটপটা পেয়েছেন| আপনার পরে আজ যে দু'জন জয়েন করলো, তারা তো রীতিমতো তড়পাচ্ছে| হপ্তাখানেকের মধ্যে, হেড অফিস থেকে নতুন স্টক চলে আসবে - এইসব বলে-টলে কোন মতে ঠেকিয়ে রেখেছি| তবে আপনাকে একটা কথা বলে রাখি..", এই বলে এদিক ওদিক একবার ভালো করে দেখে নিলেন সুমিত বাবু আর তারপর বললেন, "আসলে, ওসব নতুন স্টক কবে আসবে, তার কোন ঠিক নেই| হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! যা পাচ্ছেন..নিয়ে নিন..নিয়ে নিন..হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ!"
দেবশঙ্কর বাবু বুঝলেন এঁর সাথে কথা বাড়িয়ে আর কোন লাভ নেই| মনে মনে খানিকটা দমে গিয়ে, "নতুন স্টক এলে, আমাকে একবার জানাবেন|" এই বলে সুমিত ঘোষের কিউবিকল থেকে চটপট বিদায় নিলেন দেবশঙ্কর বাবু|
সোয়াইপ আউট করে অফিস থেকে বেরোতে যাবেন, ঠিক এই সময় পিছন থেকে শুনতে পেলেন, "দেবশঙ্কর দা|" ঘুরে দেখলেন বিশ্বজিৎ তাঁকে ডাকছে|
"সুমিত'দা কি বলছে? স্টক আছে?"প্রশ্ন করলো বিশ্বজিৎ|
ছোট করে ঘাড় নেড়ে 'না' বুঝিয়ে দিলেন দেবশঙ্কর বাবু|
"হুমম..আসুন আপনার ল্যাপটপে এন্টি-ভাইরাসটা ইনস্টল করে দি| কোন চয়েস আছে?"
"এসব ব্যাপার খুব একটা বুঝি না| যা হোক একটা ইনস্টল করে দাও|", অকপটে স্বীকার করলেন দেবশঙ্কর বাবু|
"আচ্ছা, ল্যাপটপটা দিন", বলে মেশিনটা দেবশঙ্কর বাবুর থেকে নিয়ে, তাতে এন্টি-ভাইরাস ইনস্টল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বিশ্বজিৎ|

সেদিন বাড়ি ফিরে, আটটা নাগাদ দেবশঙ্কর বাবু অনুভব করলেন, ল্যাপটপের নতুন না হওয়া আর তার বাঁ হিঞ্জটা নড়বড়ে হওয়ার দুঃখটা বিগত কয়েক ঘন্টায় অত্যাশ্চর্য ভাবে তিনি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন| আর তাই তাঁর টেবলে ঠিক সাড়ে আটটায় বসে, ল্যাপটপটিকে প্রথমবারের জন্য স্টার্ট করলেন দেবশঙ্কর বাবু|

মিনিট পাঁচেক পরে, অস্বাভাবিক ব্যাপারটা তিনি প্রথমবার অনুভব করলেন| ল্যাপটপের কার্সারে তিনি যেন ক্ৰমশঃ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন| তাঁর কাঙ্খিত গতির চেয়ে একটু যেন ধীরে চলছে কার্সার| মিনিট দশেক এ জিনিস চলার পরে, এমন একটা কান্ড ঘটে বসলো, যে তাঁর বিরক্তি ভাবটা উধাও হয়ে গিয়ে তার বদলে একটা সম্পূর্ণ অচেনা অনুভূতি তাঁকে ঘিরে ধরলো| একটা বিশেষ ফোল্ডারের ওপর কার্সারটা কিছুক্ষনের জন্য থামলো| ফোল্ডারটা একজনের নামে - 'সুগত সরকার'| এরপর হঠাৎই দেবশঙ্কর বাবুকে একদম অবাক করে দিয়ে, একটা ডাবল ক্লিক| খুলে গেলো ফোল্ডারটা| 'সুগত সরকার' ফোল্ডারটার মধ্যে রয়েছে একটা সাব-ফোল্ডার - 'মাই ইনকমপ্লিট এসাইনমেন্ট' অর্থাৎ 'আমার অসম্পূর্ন কাজ'| দেবশঙ্কর বাবু আর মিনিট খানেক মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থেকে বুঝতে পারলেন, কার্সার আর নড়ছে না| কিছুক্ষন টানটান প্রতীক্ষার মধ্যে কাটিয়ে তিনি এবার নিজেই 'মাই ইনকমপ্লিট এসাইনমেন্ট' ফোল্ডার'টিতে ক্লিক করে বসলেন| ফোল্ডারটি একদম ফাঁকা| তাতে কিচ্ছু নেই| দেবশঙ্কর বাবু'র অবাক ভাবটা কাটতে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগলো| ব্যাপারটা খুব ভয়ঙ্কর কিছু না হলেও, তাঁর মনের মধ্যে একটা অদ্ভূত অস্বস্তি তিনি অনুভব করতে লাগলেন|

পরের দু'টো দিন, বাড়িতে বসে লিড জেনারেট করার কাজে, বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই চলে গেলো| ল্যাপটপ খোলার আর প্রয়োজন পড়লো না দেবশঙ্কর বাবুর|
তবে, পরের সোমবার, অফিসে গিয়েই তিনি হাজির হলেন বিশ্বজিৎ পালের কাছে| বললেন,"বিশ্বজিৎ, দ্যাখো তো, ল্যাপটপটায় সব ঠিকঠাক আছে কিনা?"
বার দুই তাঁকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে, "দিন", বলে ল্যাপটপটা নিলো বিশ্বজিৎ| মিনিট দশেক, বেশ মনযোগ সহকারে সব দেখে সে জানালো, "সব ঠিকই তো আছে! গন্ডগোল কোথায়?"
এর উত্তরে, দেবশঙ্কর বাবু দু'দিন আগের সন্ধ্যার সব কথাই খুলে বললেন আর তারপর সটান প্রশ্ন করে বসলেন, "আচ্ছা এই সুগত সরকার কে? নামটা শুনেছো? তাঁর নামের ফোল্ডার আমার ল্যাপটপে কি করছে?"
কিছুটা চমকে গিয়ে, এদিক ওদিক দেখে, গলা নামিয়ে বিশ্বজিৎ বললো,"সুগত সরকার আমাদের এক্স-এমপ্লয়ি| হিউমান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন| এই কোভিডের জন্য, লোক কমানোর ড্রাইভে, চাকরি খোয়া গেছে ওনার| আপনার আগে, এই ল্যাপটপটা উনি ব্যবহার করতেন| ওনারই কোন ফোল্ডার হয়তো থেকে গেছে|"
ধোঁয়াশাটা সম্পূর্ণ না কাটায়, নিজের মস্তিষ্কে খানিকটা ধোঁয়া দেওয়ার জন্য, স্মোকিং জোনের দিকে হাঁটা লাগলেন দেবশঙ্কর বাবু| সিগারেটটা বার করে যেই তাতে প্রথম টানটা দিয়েছেন, ওমনি তাঁর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ডান দিক থেকে একটা গলার আওয়াজ ভেসে এলো,"হাই! আমার নাম ইন্দ্র| আমি আপনার পরের দিনই, এখানে জয়েন করেছি|"
"হাই", ছোট করে বললেন দেবশঙ্কর বাবু|
"আমি শুনছিলাম বিশ্বজিৎের সঙ্গে আপনি যখন কথা বলছিলেন| সুগত সরকার কে জানিনা, তবে আপনার ল্যাপটপ অন্য কেউ অপারেট করছে বলছেন যখন, ব্যাপারটা আন-অথোরাইজেড আক্সেস-এর হতে পারে| আর সেটা হলে, আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি| আচ্ছা, আমার পরিচয়টা আপনাকে দেওয়া হয়নি - আমি এ অফিসে জয়েন করেছি 'জোনাল সাইবার সিকিউরিটি হেড' হিসেবে|"
এবার খানিকটা উৎসাহ দেবশঙ্কর বাবু পেলেন, "ওয়েল..মিঃ ইন্দ্র..আপনি পারবেন আমাকে হেল্প করতে? দেখবেন আমার ল্যাপটপটা একবার?"
"শিওর"
"দ্যাট'স সো কাইন্ড অফ ইউ..মানে ল্যাপটপ-ফ্যাপটপ এসবের ব্যাপারে আমার তেমন একটা...."
"নো প্রবলেম...লেট্ মি সি, ইফ আই ক্যান হেল্প ইউ আউট.."

এই বলে স্মোকিং জোন থেকে ফিরে এসে, মিঃ ইন্দ্র, দেবশঙ্কর বাবুর ল্যাপটপটা খুলে বসল| প্রায় আধ ঘন্টা গভীর মনযোগের সাথে ল্যাপটপটার মধ্যে ডুবে থেকে, ইন্দ্র বললো," নাহঃ! সব ঠিকই তো আছে| আন-অথোরাইজেড এন্ট্রির তো কোন চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না| অন্য কোন টেকনিকাল প্রবলেম হয়েছিল হয়তো| যাকগে, আমার মনে হয় না, এ নিয়ে খুব বেশি ঘাবড়ানোর কিছু আছে বলে|"
"থ্যাংক ইউ....থ্যাংক ইউ সো মাচ", বললেন দেবশঙ্কর বাবু|
"ইউ আর ওয়েলকাম", বলে ছোট করে হেসে উত্তর দিলো ইন্দ্র| দেবশঙ্কর বাবু, অনুভব করলেন এখন বেশ হাল্কা বোধ করছেন তিনি| তাঁর এই হাল্কা ভাবটা খানিকটা মাটি হয়ে গেলো, অফিস থেকে বেরোনোর ঠিক আধ ঘন্টা আগে আর সেটার জন্য দায়ী আই. টি. সাপোর্ট টিমের বিশ্বজিৎ পাল|
"দেবশঙ্কর'দা, একটা কথা তখন আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে আর বলি নি|"
"কি কথা?" একটু কৌতূহল মিশিয়ে প্রশ্ন করলেন দেবশঙ্কর বাবু|
"মানে সুগত সরকারের কথাটা..অফিসিয়ালি, ব্যাপারটা আমার আপনাকে বলার কথা নয়.."
"আসল পয়েন্টে এসো..", অধৈর্য্য হয়ে বললেন দেবশঙ্কর বাবু|
"আসলে, চাকরি খোয়া যাওয়ার পর, সুগত'দা ডিপ্রেশনে সুইসাইড করেছিলেন|"
"সে কি কথা?" যেন আকাশ থেকে পড়লেন দেবশঙ্কর বাবু|
"হ্যাঁ..সেই জন্যই ওঁর ল্যাপটপটা হয়তো আপনাকে দিতাম না|"
"কেনো?", এবার একটু সন্দিগ্ধ কন্ঠে প্রশ্নটা করলেন দেবশঙ্কর বাবু|
"মানে একটা ছাঁটাই, একটা আত্মহত্যা এসবের সঙ্গে জুড়ে থাকে অনেক মন খারাপ, হতাশা, ব্যর্থতা আর...আর না জানি আরও কত কিছু...."
"আরও কত কিছু মানে?"
"আমি যাই..আমাকে আবার অনেকটা পথ যেতে হবে..", এই বলে খানিকটা যেনো কথা ঘুরিয়ে, দ্রুত পায়ে, এক্সিট গেটের দিকে হাঁটা লাগালো বিশ্বজিৎ|
দেবশঙ্কর বাবু বেশ বুঝতে পারছিলেন ইন্দ্রর কথায় যে স্বস্তি তিনি পেয়েছিলেন, বিশ্বজিৎের সাথে কথা বলার পরে, সে জায়গাটা নিয়েছে ভীষণ দমবন্ধ করা একটা গুমোট ভাব|

আজও সেই একই শাটলে বাড়ি ফিরছেন তিনি| সুমিত ঘোষ মেতে আছে, সেই টাক মাথা ভদ্রলোকের সাথে| ভালোই হয়েছে| ফালতু বকবক করার মতো মানসিক অবস্থায় তিনি এখন একেবারেই নেই|

বাড়ি ফিরে, ব্ল্যাক কফি হাতে বসে তিনি ঠিক করলেন, ল্যাপটপটা তিনি আজ আবার চালাবেন| একটা অদম্য, প্রগাঢ় আকর্ষণ তিনি অনুভব করছেন যন্ত্রটার প্রতি|

ল্যাপটপটা চালিয়ে, তিনি প্রথমেই 'সুগত সরকার' ফোল্ডারটা ডিলিট করে ফেললেন - একদম পার্মানেন্ট ডিলিট| ফোল্ডারটা ডিলিট করার পরে, একটা অদ্ভূত আত্মবিশ্বাস তাঁর মধ্যে ফিরে এলো| কই, আজ তো আর কোন সমস্যা নেই| ল্যাপটপ তো তাঁর কথা মতো, তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশেই কাজ করে চলেছে| এ'কদিনের জমে থাকা বেশ কিছু জরুরি মেলের উত্তর দিলেন তিনি|

তারপর একটা ডকুমেন্ট খুলে, সেটা মন দিয়ে পড়তে পড়তে কখন যে তন্দ্রা এসে তাঁর চোখে জমাট বেঁধেছে, তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি| ঘুমটা ভাঙলো ঠিক রাত পৌনে একটায়| তিনি বুঝলেন, টেবিলে মাথা রেখে, ল্যাপটপের পাশেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন| ডিনার করা হয়নি| কাজ করছেন বলেই বোধ হয় বনমালী আর তাঁকে বিরক্ত করেনি| রাতের খাবারটা এবার খাওয়া দরকার - এই ভেবে তিনি ল্যাপটপটা শাট ডাউন করতে যাবেন, আর ঠিক তখনই একটা জিনিস দেখে তাঁর রক্ত একেবারে হিম হয়ে গেলো| কোন এক অলৌকিক উপায়ে, ঘন্টাখানেক আগে তাঁর নিজে হাতে ডিলিট করা 'সুগত সরকার' ফোল্ডারটা আবার জ্বলজ্বল করছে| ব্যস্ত হাতে, ফোল্ডারটা আবার ডিলিট করতে গিয়ে অনুভব করলেন, ঠিক প্রথম দিনের মতোই, ল্যাপটপের কার্সার তাঁর অবাধ্য হয়ে পড়েছে| সে তার নিজের খেয়াল মতো ঘুরে চলেছে, এ ফোল্ডার থেকে, সে ফোল্ডারে| আরও মিনিট দশেক এই কান্ড চলার পরে, সেটা গিয়ে থামলো তিনি যেখানে অনুমান করেছিলেন, ঠিক সেইখানে| একটা বিশেষ ফোল্ডারে যার নাম 'সুগত সরকার'| কিছু বোঝার আগেই, সেই ফোল্ডারে একটা ডাবল ক্লিক আর তারপর সেই সাব-ফোল্ডার - 'মাই ইনকমপ্লিট এসাইনমেন্ট'| আর আজ তাতে তিনি দেখলেন, একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট| মুহূর্তে সেটা খুলে গেলো আর আপনা থেকেই তাতে টাইপ হতে থাকলো, "দিস ইজ মাই ল্যাপটপ..ফরএভার ..আই উইল নট এলাও এনিওয়ান টু টাচ দিস.." অর্থাৎ "চিরদিনের জন্য এটা আমারই ল্যাপটপ..কাউকে এটা ছুঁতে দেব না আমি|"

দেবশঙ্কর বাবু বুঝতে পারলেন তিনি দর-দর করে ঘেমে চলেছেন| এদিকে, অশরীরি টাইপিস্ট টাইপ করে চলেছে, " ইফ ইউ ডেয়ার টু টাচ দ্য ল্যাপটপ, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড দ্যাট উইল নট বি এ হ্যাপি এক্সপেরিয়েন্স ফর ইউ.." মানে "কেউ যদি এই ল্যাপটপ ছোঁয়ার ধৃষ্টতা দেখায়, সেটা তার জন্য মোটেই সুখকর হবে না|"

আর স্থির থাকতে পারলেন না, দেবশঙ্কর বাবু| এক দৌড়ে ল্যাপটপের রুম থেকে বেরিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে দম নিলেন তিনি|

সারা রাত সে দরজা আর খোলেননি দেবশঙ্কর বাবু| বনমালী, ডিনার করবেন কিনা জিজ্ঞেস করে নক করায়, তিনি দরজা না খুলেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর খিদে নেই|

পরদিন সকাল হতেই, দেবশঙ্কর বাবুর কথা মতো, বনমালী ল্যাপটপটাকে একটা ব্যাগে পুরে ফেলেছে| সাহসী হিসেবে তাঁর কোনদিনই সুনাম নেই| কিন্তু কাল রাতের ঘটনাটা দেবশঙ্কর দত্তকে মানসিক দিক থেকে একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে| তিনি ঠিক করে নিয়েছেন তিনি কি করবেন| সকাল দশটা নাগাদ, ব্যাঙ্গালোরে তাঁর রিপোর্টিং ম্যানেজার অবিনাশ আইয়ারকে ফোন লাগালেন দেবশঙ্কর বাবু আর জানালেন এ চাকরি তিনি আর করবেন না| আসল কারণটা অবশ্য চেপে গেলেন| শারীরিক অসুস্থতা আর ব্যক্তিগত কারণকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে, কোনমতে আইয়ারকে ইমিডিয়েট রিলিজের জন্য রাজি করাতে সমর্থ হলেন|

এখন দেবশঙ্কর বাবু, অনেকটা হাল্কা বোধ করছেন| আজ অফিসে গিয়ে, বিশ্বজিৎের হাতে ল্যাপটপটা তিনি ব্যাগ সহ ধরিয়ে দিয়েছেন| বিশ্বজিৎ একটু অবাক হলেও, কিছু একটা আন্দাজ করে, তাঁকে আর বিশেষ কোন প্রশ্ন করেনি|

আজ শেষ বারের মতো, সেই শাটলটায় আবার চড়লেন দেবশঙ্কর বাবু| আজ সুমিত ঘোষকে দেখে তিনি নিজেই হাসলেন| নিজেই তাঁকে জানালেন, তাঁর রেজিগনেশনের কথাটা| শুনে সুমিত ঘোষ আকাশ থেকে পড়লেন, "সেকি মশায়..এ বাজারে চাকরি পেয়ে দিন দশেক হতে না হতেই সেটা ছেড়ে দিলেন?"
দেবশঙ্কর বাবু কারণ হিসেবে, সুমিত ঘোষকেও সেই একই কথা বললেন যা তিনি তাঁর ম্যানেজার অবিনাশ আইয়ারকে বলেছেন অর্থাৎ 'হেলথ গ্রাউন্ড'|
শুনে-টুনে সুমিত ঘোষ মন্তব্য করলেন, "তবে, একজন অবশ্য আপনার এই চাকরি ছাড়ায় বেশ খুশিই হবে|"
"কে?" খানিকটা অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলেন দেবশঙ্কর বাবু
"ইন্দ্র মানে ইন্দ্রজিৎ পাল| ঐ যে এখানে সাইবার সিকিউরিটির হেড হিসেবে জয়েন করেছে|"
"তো ইন্দ্র আমার চাকরি ছাড়ায় খুশি কেনো হবে?" এবার দেবশঙ্কর বাবুর গলায় বিস্ময় ঝরে পড়লো|
"আরে ল্যাপটপের জন্য| ও জয়েন করার আগেই তো স্টকের শেষ ল্যাপটপটা আপনাকে দেওয়া হয়ে গেছলো| তাতে ছোকরার রাগ হয়েছিল খুব| ওর কাজিনের ওপর খুব চোটপাটও করেছিল|"
"ওর কাজিন বলতে?"
"কেনো আই.টি. সাপোর্ট টিমের বিশ্বজিৎ পাল| ও-তো ওর নিজের কাজিন| ওর রেফারেন্সেই তো, ইন্দ্রজিৎ এখানে জয়েন করেছে| সেদিন দেখি ব্যাটা, বিশ্বজিৎকে বলছে, ল্যাপটপ যে অফিসে নেই, সেখানে কাউকে রেফার করিস কেনো? অফিসের ল্যাপটপ ছাড়া সাইবার সিকিউরিটির সফটওয়্যার চলবে?"

দেবশঙ্কর বাবুর মাথা ঝিম-ঝিম করছে, "ইন্দ্রর পুরো নাম ইন্দ্রজিৎ পাল?....বিশ্বজিৎ আর ইন্দ্রজিৎ কাজিন?.. দু' ভায়ে মিলে....", কথাগুলো ভাবতে ভাবতে, হঠাৎই একটা প্রশ্ন তাঁর জিভের ডগায় এসে গেলো, "আচ্ছা সুগত সরকার বলে আপনাদের অফিসে কেউ কাজ করতেন?"
"হ্যাঁ..হ্যাঁ..এইচ. আর ডিপার্টমেন্টে ছিলেন|"
"মানে যিনি সুইসাইড করেছিলেন.."
"হেঃহেঃহেঃহেঃ..এই দেখো সুইসাইড করতে যাবেন কেনো? আরে মশাই আপনি তো দেখেছেন সুগত'দাকে| আমাদের সাথে এই শাটলেই বেশ কয়েকবার.."
কথা শেষ হওয়ার আগেই, শাটলে উঠে এসেছেন সেই টাক মাথা, মাঝারি হাইটের, সাদা জামা পরা ভদ্রলোক আর তাঁকে দেখে সুমিত ঘোষ বলে উঠলেন,"আরে! সুগত'দা! কি খবর? এই দ্যাখো শুনলাম তুমি নাকি সুইসাইড করেছো? হেঃহেঃহেঃহেঃহেঃহেঃ...."

জলজ্যান্ত, নিরীহ চেহারার সুগত সরকারকে চোখের সামনে দেখে, দেবশঙ্কর বাবু অনুভব করলেন, ল্যাপটপের অভাবে তাঁর ব্যাগটা হঠাৎ ভীষণ রকম হাল্কা মনে হচ্ছে|

 

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু