আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, শোক দেব মেপে
" যদিদং হৃদয়ং মম , তদস্তু হৃদয়ং তব । " --- পুরোহিতমশাইয়ের প্রকৃষ্ট মন্ত্রোচ্চারণের সাথেসাথেই পরিসমাপ্তি ঘটল বিবাহপর্বের । আষাঢ়স্য পঞ্চবিংশতি দিবসেও মুর্শিদাবাদের কুসুমপুরে সূর্য তার প্রবল প্রতাপের সহিত দীপ্তমান । মেঘমঞ্জরিকে অনায়াসে নকআউট করে রবিবাবু এখনও স্বমহিমায় উড়িয়ে চলেছেন নিজের অপরাজেয় জয়ধ্বজা । তাই ক্যালেন্ডারের পাতায় ভরা বর্ষা হলেও কুসুমপুরে এখন প্রখর গ্রীষ্ম । কিন্তু জল না পেলে যেমন ধান বাড়ে না , তেমনি ক্ষেতের ধান না বাড়লে উনুনের আঁচও বাড়ে না কমলের সংসারে । অনাবৃষ্টির অপদেবতাকে তুষ্ট করতে মাঝবর্ষায় তাই নিজের এক বিঘা আবাদি জমিতেই সে সম্পন্ন করল ব্যাংয়ের বিবাহ । কথিত আছে , এতে নাকি তুষ্ট হন স্বয়ং বরুণদেবও । বিবাহের বিপুল ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য কমলের কোনোকালেই ছিল না । শেষমেষ পরিত্রাতা হয়ে হাজির হয় তিনমাস ধরে তিলতিল করে জমানো ছাতা কেনার টাকা ।
চৈত্রের শুরু থেকেই রোদের এবার বড্ড তেজ । তারই মধ্যে মাইল দেড়েক পথ পেরিয়ে রোজ স্কুলে যায় কমলের ছোট্ট ছেলে কৃষ্ণ । তীব্র দহনে ক্লান্ত ছেলেটা বেশ কয়েক মাস ধরেই কৃষক বাবার কাছে আবদার জুড়েছে একটা ছাতার । কমলের আর্থিক অবস্থার যথার্থ বর্ণনায় ' কৃষক' -এর তুলনায় 'প্রান্তিক চাষি ' শব্দটিই অনেক বেশি উপযোগী । দরিদ্র কমল ছেলেকে তাই ছাতা কিনে দিতে পারেনি ঠিকই ; কিন্তু রোজ তিন টাকা করে সে জমাতে শুরু করেছে মাটির ঘটে । উদ্দেশ্য, ছেলের আবদার মেটানো । মাস তিনেক পেরিয়ে ছাতা কেনার টাকা পুরোপুরি জোগাড় হতে না হতেই হাজির হল অনাবৃষ্টির রক্তচক্ষু আর তাকে শান্ত করতেই ছাতার টাকা চলে গেল কলাপাতা আর মঙ্গলঘটে ।
পঞ্চানন পুরুতের মন্ত্রে জোর আছে বলতে হবে । ব্যাংয়ের বিয়ের পরদিনই আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে এল মুষলধারে বৃষ্টি। কোদাল হাতে কমল ছুটল মাঠে , ডোবা থেকে সেচের খাল কাটতে হবে যে । কৃষ্ণ তখন ব্যস্ত উঠোনের জমা জলে কাগজের নৌকো ভাসাতে । ' আয় বৃষ্টি ঝেঁপে , ধান দেব মেপে ' --- লেখা সারিসারি সাদা নৌকো এগিয়ে চলেছে বৃষ্টির জলের স্রোত ধরে । এ যেন কৃষ্ণের উদ্যোগে কাগজখেয়ার বাইচ লড়াই মুর্শিদাবাদের কুসুমপুরে ।
নাহ ! বৃষ্টিটা স্থায়ী হল না একদম । একদিন মুষলধারে বর্ষণের পরই আবারও কাঠফাঁটা রোদ । রীতিমতো মুষড়ে পড়েছে কমল । সাথে ওর আট বছরের ছোট্ট ছেলেটাও ভুগছে এক অজানা বিশ্বাসহীনতায় । মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার সাথে কাটানো বছর তিনেক আগের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যার কথা ।
--- বাবা , বৃষ্টির এই জলগুলো সব কোথায় যায় ?
--- এই তো ! আমাদের বাড়ির উঠোনে জমে ।
--- হুমমম । সে তো দেখতেই পাচ্ছি । কিন্তু তারপর ?
--- তারপর সেখান থেকে নদীতে মানে গঙ্গামাতার কাছে ।
--- ও ! এই সব জল গঙ্গামাতা খেয়ে নেয় ?
--- না রে পাগল ! মা , এই জল থেকে নোংরাগুলো সব শুষে নিয়ে আবারও মেঘ,বৃষ্টি করে পাঠিয়ে দেয় আমাদের কাছে ।
--- ও , বুঝেছি ! অনেকটা ওই জমিদার বাড়ির অ্যাকোয়াগার্ডের মতো ?
--- হুমম । তা কিছুটা বলতে পারিস বটে ! তবে শুধু বিশুদ্ধ জল পাঠানোই নয় রে বাবা , ওই ধুয়ে যাওয়া জলের মধ্যে দিয়েই আমাদের দুঃখ-কষ্ট-অভাব-অভিযোগের খোঁজও নেয় মমতাময়ী মা গঙ্গা ।
--- তুমি মিথ্যে বলছো বাবা ! বৃষ্টির জলের তো চোখই নেই । ও দুঃখ দেখবে কেমন করে ?
--- বৃষ্টি তো দুঃখকে দেখে না কৃষ্ণ । ও পিয়নের মতো শুধু বয়ে নিয়ে যায় । দেখে তো স্বয়ং গঙ্গামা !
--- কিভাবে ?
--- তুই ঘর থেকে খাতার একটা পৃষ্ঠা নিয়ে আয় ।
কৃষ্ণ বাবার কথামতো কাগজ নিয়ে আসে আর কমল তা দিয়ে নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দেয় উঠোনের জলে ।
--- বাবা , এই নৌকোটাও কি গঙ্গামার কাছে যাবে ?
--- হ্যাঁ রে সোনা ! মনের যা কিছু কষ্ট, আক্ষেপ , অভাব , অভিযোগ --- হৃদয় উজাড় করে সব লিখে ভাসিয়ে দিতে হয় এই কাগজের নৌকোয় । নৌকোভর্তি খবর পৌঁছে যায় মা গঙ্গার দরবারে আর তিনি সযত্নে সমাধান করেন সকলের সমস্ত সমস্যার ।
কথাগুলো শুনে গায়ের রোম রীতিমতো খাড়া হয়ে উঠেছে ছোট্ট কৃষ্ণের । প্রতিবছর গঙ্গাপুজোর তিথিতে গ্রামে বিশাল মেলা বসতে সে দেখেছে বটে ; তবে গঙ্গামা যে এতটা জাগ্রত হতে পারে , তা ছিল তার কল্পনার সম্পূর্ণ বাইরে । নিছক মজার ছলে বলা বাবার গল্পগুলোই কৃষ্ণের ছোট্ট জগতে যেন বড্ড বাস্তব । তাই চটপট অতি উৎসাহে বাবার কাছে সে আয়ত্ত করল কাগজের নৌকো নির্মাণের কৌশল ।
সেইমতো এবারও ব্যাংয়ের বিয়ের ঠিক পরদিনই , বছরের একমাত্র বৃষ্টির দিনে দশটি নৌকোতে ছড়া লিখে মা গঙ্গার কাছে সে জানিয়ে দিল অতিবৃষ্টির আবদার । কৃষ্ণের ছোট্ট হাতে এখনও স্মার্টফোন এসে পৌঁছয়নি , তাই মেসেজ সিনের নোটিফিকেশন আসার কোনো উদ্বেগও নেই তার মাথায় । অগাধ বিশ্বাস আর ক্ষণিকের দ্বিচারিতায় ভর করে একই আবদার দশবার লিখে সরল মনে তাই ভাসিয়ে দেওয়া মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে --- "আয় বৃষ্টি ঝেঁপে , ধান দেব মেপে ।" মননে বাসা বেঁধেছিল প্রত্যয় আর প্রত্যাশার এক সোনালি ধানক্ষেত ।
অবশেষে দিন দশেক পর বাংলায় ঘনিয়ে এল প্রবল নিম্নচাপ , সাথে দোসর ঘূর্ণিঝড় ' শাওন ' । সাতদিনের নিরবিচ্ছিন্ন , অবিরাম বারিধারা ছাপিয়ে গেল পূর্বের সমস্ত বর্ষণরেকর্ডকে ; ঠিক যেমন দুকূল ছাপিয়ে ভাগীরথী ভাসিয়ে দিল কুসুমপুরের সমস্ত ক্ষেত । বাদ গেল না কমলেরটাও । ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ার শোকে ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক চাষি কমল এক সন্ধ্যায় গলায় ঢেলে দিল ফলিডল । লোকটাকে আর বাঁচানো যায়নি । বন্যাবেষ্টিত কুসুমপুর পেরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি সদর হাসপাতালে । প্রতিবেশীদের পরামর্শ ও সহায়তায় চোখের জলে কমলের মৃতদেহকে মা গঙ্গার ঠিকানায় ভাসিয়ে দেয় কৃষ্ণ ও তার অসহায় বিধবা মা গীতাদেবী । চারিদিকে তখন থৈ থৈ জল ।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে আরও তিনটে মাস । বন্যার ক্ষত মুছে ফেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মুর্শিদাবাদের সমস্ত জনপদ । পুজো আসতে আর দিনসাতেক বাকি । স্বামীহারা গীতাদেবী এখন এলাকার বেশ কয়েকটি অভিজাত বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন আর তাতেই কষ্টেসৃষ্টে দিন গুজরান হয় মা-ছেলের ।
সামনেই বিধানসভা ভোট । পুজোর আগেই বন্যাকবলিতদের আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী । অনুদানের সেই টাকা আনতে গীতাদেবী ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে রওনা হলেন সদর বহরমপুরে । দুপুরের পরই আকাশ কালো করে ধেয়ে এল আশ্বিনের ঝড় , সাথে পাল্লা দিয়ে প্রবল বৃষ্টি । ঝড়জল মাথায় নিয়েই দেড় মাইল পথ অতিক্রম করে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল কৃষ্ণ । ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছটা । বাড়ির উঠোনে ইতিমধ্যেই জমতে শুরু করেছে বৃষ্টির জল । ব্যাগ থেকে খাতা বের করে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে , নৌকো বানিয়ে সেই জলে ভাসিয়ে দিল কৃষ্ণ , সাথে লেখা --- " আগেরবার আমার আবদারমতো আকাশ থেকে যেমন বৃষ্টি এনে দিয়েছিলে , এবারও আমার বাবাকে প্লিজ এনে দাও না গঙ্গামা !"
ঘন্টাসাতেক প্রবল বর্ষণের পর রাত দশটা নাগাদ বৃষ্টিটা ধরে এল একটু । প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় সে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি গীতাদেবীর । জ্বর গায়ে মায়ের অপেক্ষা করতে করতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট কৃষ্ণ ।
ঘড়িতে তখন ভোর চারটে । শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে নবান্নের পাকা সোনালি ধান কাটছে কমল , পাশে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ ---- স্বপ্নে বাবাকে দেখতে দেখতে কখন যে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে বাবার পাশে , বুঝে উঠতে পারেনি নিজেই । গঙ্গামাতা আবদার রেখেছেন এবারও । সারারাত ভেজা গায়ে থাকার পর ভোররাতে ঘুমের ঘোরেই হাইপোথ্যালামাস ফেল করে স্বপ্নের সোনালি দেশে পাড়ি দিয়েছে কমলপুত্র কৃষ্ণ ।