বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কে কোথায় দাঁড়িয়ে

ওহ, কি বৃষ্টিটাই না পড়ছে । সুমনা ভাবল । একে শ্রাবণ মাস তারপর নারসিং হোম থেকে বেরতে দেরী হয়ে গেল । একবার ভেবেছিল বাড়ীতে ফিরবে না । একটা ফোন করে রাতটা এখানেই কাটিয়ে নেবে কিন্ত মা খুব ভাববে । তাছাড়া চারপাশের লোকেরা বিভিন্ন কথা বলে । ট্রেনটা ঠিক সময়ে ধরতে হবে । ভিজতে ভিজতে একটা বাসে উঠে বসল সুমনা । বাসে বসে ভাবছিল সুমনা । জীবনে কি হবে ভেবেছিল আর কি হোল । ছোটবেলা থেকেই লেখা পড়ায় ভাল ছিল সুমনা । ছোট সংসার সুমনা আর তার ভাই সুমন আর মা বাবা । ভালই চলে যাচ্ছিল । বাবা বলত ভাল করে পড় মনা তোকে কমপক্ষে একটা ডবলুবিসিএস অফিসার হতে হবে । দেশে সৎ অফিসারের খুব অভাব । লেখা পড়ার সাথে শরীর চর্চা করত সে । ভাই সুমন অনেকটাই ওর থেকে ছোট । তবু মা বাবা ভাইকে নিয়ে এগিয়ে চলেছিল সুমনার জীবন । বিধি বাম । হঠাৎ অফিসে কাজ করতে করতে বাবার স্ট্রোক হয়ে গেল । বাঁ দিকটা পড়ে গেল । অনেক চেষ্টা করেও যাও ঠিক হোল কিন্তু স্বাভাবিক হল না । কোনরকমে চলতে পারে । কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে অফিস থেকে ছুটি হয়ে গেল বাবার । পুরো পরিবারটা মুখ থুবড়ে পড়ল । পড়া আর হোল না সুমনার । এক কাকুর সাহায্যে এই নারসিং হোমে রিশেপসানিষ্ট এর কাজ জুটে গেল । আর মা পাড়ার দুটো বাড়ীতে রান্নার কাজ নিল । মা মেয়েতে ঠিক করল ভাইটাকে যে করে হোক গ্রাজুয়েট করতেই হবে । এখন ইলেভেনে পড়ছে আর কয়েকটা তো বছর । ভাইটা পড়াশোনায় ভাল । একটু সাহায্য করলে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে । তবুও ভাইটা সকালে বাড়ী বাড়ী খবরের কাগজ দেয় তারপর স্কুলে যায় । এইসব  ভাবতে ভাবতে শিয়ালদা এসে গেল । বাস থেকে নেমে ট্রেন ধরার জন্য দৌড়ল সুমনা ।

যা, হাসনাবাদের গাড়ী তো চলে গেছে । এক ঘণ্টা বসে থাকতে হবে স্টেশনে । ময়লাখোলা পৌছতে প্রায় রাত বারোটা বেজে যাবে । কান্না পাচ্ছিল সুমনার । একে রাত তার ওপর এই একটানা বৃষ্টি । ভগবান আজ কপালে কি দুর্গতি লিখেছেন কে জানে ? বাড়ীতে একটা ফোন করে ব্যপারটা জানাল সুমনা । মা তো শুনেই আঁতকে উঠল । ভাই বলল ও স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবে সাইকেল নিয়ে । অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ট্রেনটা ছাড়ল । জানলার ধারে একটা সিট পেল সুমনা । ট্রেনটায় সেইরকম ভিড় নেই । সবাই প্রায় তার মত আটকে পড়া যাত্রী । বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন লোকের ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা । অনেকে আবার সুমনাকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল মেয়েটার সাহস আছে । এত রাতে একা চলেছে । চোখ বন্ধ করে বসে আছে সুমনা ।

কিছু দিন আগে তাদের নারসিং হোমে মায়ের চিকিৎসা করাতে এসেছিল সঞ্জয় । সঞ্জয় রায় । মা আর ছেলে এই নিয়ে ওদের সংসার । কলেজ স্ট্রীটে একটা বড় বইয়ের দোকান আছে  সঙ্গে পাবলিশিং কোম্পানি ।বই নিয়েই তার জগৎ । বই পড়তে সে ভীষণ ভালবাসে । উত্তর কলকাতায় তাদের বিরাট অবস্থা । সঞ্জয়ের সবসময়  মানুষের পাশে দাঁড়ান স্বভাব । খুব বিনয়ী স্বভাবের । কেন জানিনা সুমনার ভাল লেগেছিল তাকে । সঞ্জয়েরও বোধহয় ভাল লেগছিল সুমনাকে তাই সুযোগ পেলেই তার সাথে গল্প করত । কত নতুন নতুন বিদেশী গল্প শোনাত । মাকে নারসিং হোম থেকে নিয়ে যাবার পর একদিন এসেছিল । সুমনাকে নিয়ে গিয়েছিল সামনের একটা রেস্টুরেন্টে । সেখানে তাদের সাথে অনেক কথা  হয়েছিল । সুমনার বাড়ীর কথা জানতে চেয়েছিল । কিছুই লুকোয়নি সুমনা । সব বলেছিল ।সব শুনে সঞ্জয় তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে বন্ধুর মত তার পাশে থাকবে । সুখের দিনে না পারলেও দুঃখের দিনে অবশ্যই থাকবে । তারপর থেকে ছুটির পর সুমনাকে পৌঁছে দিত শিয়ালদায় । একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।

বারাসাত থেকে অবনী স্যারকে ট্রেনে উঠতে দেখে প্রানে জল এল সুমনার ।একই পাড়ায় বাড়ী । বলল ,স্যার আপনি এখন ? আর বলিশ না মেয়ের বাড়ী গিয়ে আটকে পরেছিলাম । বৃষ্টির জন্য তো বেরতেই পারছিলাম না কিন্ত বাড়ী আমাকে ফিরতেই হবে নইলে তোর কাকিমা সারারাত একা থাকবে । তুই এত দেরী করে যাচ্ছিস ? দেখুন না স্যার বৃষ্টির জন্য একে বেরতে দেরী হয়ে গেল তারপর রাস্তায় জ্যাম । শিয়ালদায় এসে দেখি ট্রেনটা চলে গেছে । এক ঘণ্টা বসে থেকে এই এখন চলেছি । এত কেউ দেরী করে যায় মা । তুই তো জানিস আমাদের ওখানকার অবস্থা । তারপর স্টেশন থেকে অতটা পথ তোকে  হেঁটে যেতে হবে । না বাড়ীতে ফোন করে দিয়েছি । ভাই সাইকেল নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবে ।টেনের একদিকে কতগুলো ছেলে নিজেদের মধ্যে হল্লা জুড়ে দিয়েছে । সেই দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে স্যার বললেন দেখেছিস তো মানুষ কি রকম পশু হয়ে গেছে । ঐ অন্ধ ছেলেটাকে সাহায্য করার জায়গায় ওকে নিয়ে মজা করছে । কথাবার্তার মধ্যে এসে গেল ময়লাখোলা স্টেশন । তুই আমার সাথে সাথে আয় বলে আগে আগে এগলেন অবনী স্যার । স্টেশনে নেমেই সুমনা দেখতে পেল সুমন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে । দাঁড়া আমি আমার সাইকেলটা নেই তারপর একসঙ্গে যাব । বলে সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে এগলেন অবনী বাবু । তারপর তিনজনে দুটো সাইকেল নিয়ে রওনা দিল বাড়ীর পথে ।

বৃষ্টিটা তখন পড়ছে তবে জোরে নয় । ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে যাচ্ছিল বাড়ীর দিকে । হাটখোলায় মদ খাচ্ছিল কয়েকটা ছেলে । এলাকার সমাজবিরোধী বলে সকলে চেনে । ওদের নেতা পঞ্চু  এসে পড়ল সাইকেলের সামনে । চট করে ধরে ফেলল সুমনের সাইকেলের হ্যান্ডেল । আরে সুন্দরী এত রাতে ? কোথা থেকে ফুর্তি করে এলে ? এসনা আমাদের কাছে । আমরাও ফুর্তি করি । একি অসভ্যতা হচ্ছে ? চিৎকার করে উঠলেন অবনী বাবু । এগিয়ে এল রত্ন বলে একটি ছেলে । কেন স্যার আপনি এইসব  লাফড়ার মাঝে  আসছেন ? ফুটে পড়ুন । আমারা জানি ও কলকাতায় ফুর্তি করতে যায় । আজ আমরাও ফুর্তি করব । বলতে বলতেই আরও  তিনজন ঘিরে ধরল ওদের । পঞ্চু অবনী বাবুর সাইকেল তা ধরে টেনে নিয়ে গেল সামনের দিকে । যা ফোট । একদম সোজা যাবি বাড়ী । কোথাও খবর করলে না কবরে পাঠিয়ে দেব । তোমরা বলবে আমি যাব । দেশে আইন কানুন নেই । আজ বৃষ্টি ভেজা রাত আইন কানুন কুপোকাত । বলে উঠল এক ছোকরা । অবনী বাবু সাইকেলটা রেখে ওদের সাইকেল ধরে টেনে বার করার চেষ্টা  করলেন । চলে আয় সুমনা বলে যেই সুমনার দিকে এগিয়েছেন ওমনি পঞ্চু অবনী বাবুর ঘাড় ধরে টেনে মারল এক চড় । তারপর টানতে টানতে নিয়ে সাইকেলে তুলে দিল । পকেট থেকে বার করল একটা ছুরি । ভয়ে সাদা হয়ে গেছেন অবনী বাবু । তুই সাইকেলে  উঠবি কি না ? ওঠ শুয়োয়ের বাচ্চা, নইলে দেব পেটে ভরে । কোনমতে সাইকেলে চড়লেন অবনী বাবু । চালা, চালা সাইকেল । অবনিবাবু প্রানের ভয়ে সাইকেল নিয়ে বাড়ীর দিকে ছুটলেন । বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সুমনা ।

দিদি ছোট, এই বলে সুমনার হাত ধরে দৌড় লাগাল সুমন । বেশী দূর যেতে পারল না । ওরা ওকে ধরে নিল । টেনে নিয়ে যেতে লাগল চালার অন্ধকারের দিকে । প্রানপনে চেঁচাতে লাগল সুমনা । ছটফট করতে লাগল । ছুটে এল সুমন । ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর । ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল প্রানপনে । ওদের একজনের হাতে একটা লোহার রড ছিল । সজোরে সুমনের পিঠে বসিয়ে দিতে গেল ।এই সময় সুমন মাথাটা পিছন দিকে হেলাল । রডটা সপাটে পড়ল সুমনের মাথায় । মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সুমন । ভাই বলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সুমনা ।

এমন সময় কোথা থেকে ছুটে এল পাগলা সমীর । ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর । এক অসম লড়াই বেঁধে গেল । ওরা সমীরকে মেরে মাটিতে ফেলে দিল । পঞ্চু সুমনার হাত ধরে টানল । আজ তার নেশা চড়ে গেছে । মাটি থেকে কোনরকমে উঠে সমীর আবার ঝপিয়ে পড়ল পঞ্চুর ওপর । পঞ্ছু আর বরদাস্ত করতে পারল না । সোজা ছুরি চালিয়ে দিল সমীরের পেটে । অজ্ঞান হয়ে গেল সুমনা । ওরা ওর দেহটাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেল অন্ধকারে ।

পড়ি কি মরি করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন অবনী স্যার । বাড়ীতে এসে আছড়ে পড়লেন । ডেকে তুল্লেন স্ত্রী কে । তিনি কোন কথা বলতে পারছিলেন না । স্ত্রী ঐ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন । পাশের বাড়ী থেকে দুলালকে  ডেকে আনলেন । দুলাল জিজ্ঞাসা করল, স্যার কি হয়েছে ? চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন অবনী বাবু । কাঁদতে কাঁদতে কোনমতে ঘটনাটা বলেলন । একটু শুনেই দুলাল ফোন করতে সুরু করল ক্লাবের ছেলেদের । আধ ঘণ্টার মধ্যে সবাই জড়ো হয়ে ছুটল হাটখোলার দিকে ।

এদিকে অস্বস্তিতে ঘর বার করছে সুমনার মা । বার বার ঘড়ি দেখছেন । এখনও  তো ওরা এল না । আমি কি একবার বেড়িয়ে দেখব । তুমি এই শরীর নিয়ে কোথায় যাবে । নিশ্চয়ই ট্রেন এখনও  এসে পৌঁছায় নি । নিজেকে সান্তনা দিলেন কাবেরী দেবী । এমন সময়  কাঁদতে কাঁদতে কিছু মহিলা নিয়ে ছুটে এলেন অবনী বাবুর স্ত্রী । তাঁকে দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল  সুমনার মার । কি হয়েছে ? শুনেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন তিনি । অন্য মেয়েরা তাঁর সুস্রশা করতে লাগল । পড়শী পরিমল বাবু একটা রিক্সাওয়ালাকে ডেকে তুলে সুমনার বাবাকে নিয়ে রওনা দিলেন হাটখোলার দিকে ।প্রচুর মানুষকে ছুটে আসতে দেখে ওরা পানপনে ছুটে পালাল । সবাই গিয়ে দেখল হাটখোলায় তিনটি দেহ পড়ে আছে । দুটি মৃত আর একটি অর্ধ মৃত । আগেই পুলিশকে জানান হয়েছিল । তারাও এসে পড়ল । সবাই দেখল সুমন আর সমীর মৃত । সুমনা ধর্ষিতা অবস্থায় দূরে পড়ে আছে । পরনের পোশাকগুলো ছড়িয়ে আছে । সুমনাকে  তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হল নিকটবর্তী নারসিং হোমে ।

এইভাবেই ভোর হল হাটখোলায় । সকালে দলে দলে মানুষ ছুটে আসতে লাগল । ছুটে চলে এল রাজনৈতিক দলগুলো । রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা একদম  তলানিতে ঠেকে গেছে এর ওপর বক্তব্যর বন্যা ছুটতে লাগল । সকাল থেকেই দূরদর্শন জমজমাট । সবাই ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিচ্ছে কারন টিআরপি তুলতে হবে । ৩০ ঘণ্টা আজ একটা বিতর্ক অনুষ্ঠান ডেকেছে রাত আট টায় । বিষয় ‘সমাজবিরোধীদের সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তাআছে কিনা  ’ । হাজির থাকবেন সমাজের বুদ্ধিজীবী মহল । অন্যদিকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে সুমনা । বোধশক্তি হারিয়ে সকলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দুটি প্রাণী । 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু