বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মুক্তি

রিয়ানের জীবনে এক বর্ষণমুখর রাতের অভিজ্ঞতা ওর ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছিল।সেই রাত সে কোনোদিনও ভুলতে পারেনি।এই কাহিনী ওরই জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা!


জোড়া নিম্মচাপের কারণে বিগত তিনদিন টানা ভারী বর্ষণ হয়ে চলেছে।আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।প্রবল বর্ষনের ফলে রাস্তা ভেদ করে উপরের ফুটপাত পর্যন্ত এসে গেছে জল।

"অপদার্থ ছাতাটাকেও এখনই ভেঙে যেতে হলো। অবশ্য একে দোষ দিয়েও লাভটা কি?আমারই ভুল!এটাকে সময়মতো সারিয়ে নিলেই আজ আর এই কান্ড হতো না!যাক গিয়ে এখন ভেবে আর কি হবে?"

কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেড়িয়ে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিয়ান।নিজের মনে মনেই সময়মতো ছাতা সারাতে দিতে ভুলে যাওয়ার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে যাচ্ছে।

তবে আজ অন্যদিনের তুলনায় বৃষ্টির তেজ যথেষ্ট কম।বিগত তিনদিনের তুলনায় তো অনেকটাই কম।তবে এখনও রাস্তায় জলের উল্লাস জারী রয়েছে।আকাশে গুমগুম করে চাপা আওয়াজ হয়ে চলেছে।মাঝে মাঝে মেঘের মাঝ বরাবর বিদ্যুতের ঝিলিক চোখে পরছে।রাস্তায় জলের স্ত্রোতে কয়েকটা কাগজের টুকরো ভেসে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে তারা লুকোচুরি খেলছে।রিয়ান কৌতুহলী হয়ে সেইদিকেই তাকিয়ে ছিল আর যতটা সম্ভব নিজেকে বৃষ্টির থেকে বাঁচাতে একটা দোকানের ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে হেডফোনে গান শুনে যাচ্ছিল।অফিসের অতো কাজের প্রেশার থেকে মুক্তো হয়ে রোজ গান শুনতে শুনতে বাড়ি ফেরাটা রিয়ানের ম্যানডেটরী। সে কোনো নরমাল দিনই হোক আর বজ্রমুখর বৃষ্টির দিনই হোক।

কিন্তু ইদানীং বেশ কয়েকদিন রিয়ানের এফ.এম-এ গান শুনতে বড় বিরক্ত লাগছে।"একে তো মন মতো কোনো গানও দেয় না,তার ওপর আবার কী আজগুবি সব শো চালু হয়েছে! এই ভূত,সেই ভূত নিয়ে আলোচনা",বললো রিয়ান।"এই আধুনিক জগৎ ছেড়ে এরা এখনও বেড়োতে পারলো না।এদের এই আজগুবি শো শুনেই আবার কিছু সবজান্তা মানুষ এসে বলবে,ভগবান যদি থাকেন,শয়তানও তবে থাকবে। পজিটিভ এনার্জী, নেগেটিভ এনার্জী।উফ!!যতসব ভুজরুকি!!"

রিয়ান একেবারে নাস্তিক মানুষ। ভূত তো ছেড়েই দাও,স্বয়ং ভগবান এসেও যদি নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় রিয়ানকে তাতেও রিয়ান যুক্তিতর্ক খুঁজে বেড়াবে এতোটাই ঘোরতর সিরিয়াস নাস্তিক মানুষ সে!!

বাড়িতে এ নিয়ে নিত্যদিন নিত্য অশান্তি লেগেই আছে।কেউ আজ পর্যন্ত রিয়ানের ধারণা থেকে রিয়ানকে একচুলও সরাতে পারেনি।না ভগবানের কনসেপ্ট, না ভূতের কনসেপ্ট কোনোটাই খাটেনি রিয়ানের কাছে।তাই বাধ্য হয়েই বাইপাসের ধারে আলাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে একাই থাকে রিয়ান।না না পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক আছে।শুধু অশান্তির চাপে আর "এখান থেকে অফিস যেতে সুবিধা হবে" এই ছুঁতো মেরে আপাতত বেশ কয়েকটা মাস রিয়ান মানসিক শান্তিতেই আছে।

এফ.এম-এ তো দিব্যি গান হচ্ছিল কিন্তু এবারে দুম করে মাঝেই গান থামিয়ে এমন ভূত নিয়ে  আলোচনা শুরু হলো যে মাঝখান দিয়ে রিয়ানের দিমাগ গেল চটকে।একে তো মরা বৃষ্টি,তার ওপর আবার এইসব! সহ্য করা যায়?তাও কোনোমতে ফোনটা বের করে চ্যানেলটা সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু এ কী ফোন বাবাজী আগে থেকেই হ্যাং হয়ে বসে আছেন। এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া!! আর এই অবস্থাতেই এফ এম-এ চলছে "আপনারা অনেকেই বাইপাস দিয়ে যাতায়াত করেন, অনেকেই রাত করে সেখান থেকে বাড়িও ফেরেন, কিন্তু এখানকার অনেক বাসিন্দাই দাবি করেছেন যে রাত হলেই এখানে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তির উদ্ভব হচ্ছে আজকাল। এই বাইপাসের ধারে রাত হলেই তাকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে ইদানিং। অনেকে তো নিজেই...."

"ধুর" একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে ফোনটা সুইচ অফ করে দেয় রিয়ান। "যত্তসব ফালতু জিনিস!!"

"কি দাদা কোন সমস্যা?"

পাশে একটা লোক অনেকক্ষণ ধরেই রিয়ানকে লক্ষ্য করছিল। এবারে জিজ্ঞেস করেই বসলো।

"আপনাকে তখন থেকেই বড় উত্তেজিত লাগছে! কোনো গুরুতর ব্যাপার নাকি?"

রিয়ান লোকটাকে বলেই ফেলে, "আরে দেখুন না দাদা এই এফ.এম.-এ সব বুজরুকি চালু হয়েছে ।যেন ভুতের প্রমোশন করতে বসেছে।

"কি হয়েছে? "

"এফ এম এ কি একটা ভূতের শো শুরু হয়েছে সেখানে বলে যাচ্ছে বাইপাসের ধারে ফাঁকা রাস্তায় নাকি কোন রহস্যময় ছায়ামূর্তি দেখা গেছে!!মানে ঢপ মারার আর জায়গা পায়না? আমি তো রোজই যাই, কোথায় আমি তো কিছু দেখতে পাই না!!"

" কখনো দেখতে পাননি মানে তো এই নয় যে দেখতে পাবেন না! ব্যাপারটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়! জায়গাটা সত্যিই ভালো নয়, ওখান দিয়ে একা রাতে গেলে মনে হয় যেন অদৃশ্য কিছু পিছু পিছু আসছে!!"

" ও আচ্ছা আপনিও এই দলে? তা সে এসে আপনার ঘাড় মটকায়নি!!?

লোকটা কিছু বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল রিয়ান। পিছন দিয়ে শুনতে পারলে "ও দাদা পারলে একটা ট্যাক্সি করে যান, ও রাস্তা দিয়ে একা যাবেন না!"

কে শোনে কার কথা??!! রিয়ান গটগট করে হাঁটা লাগালো, অন্যদিন হলে বাসে করেই যায় কিন্তু আজ যেন মনে জেদ চেপে গেল রিয়ানের। "আজ হেঁটেই যাবো আমি! দেখি কি হয়!"মনে মনে ঠিক করল রিয়ান। তাছাড়া বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেছে তাই হেঁটে যেতে কোন অসুবিধাই হবে না!

রাগে গজগজ করতে করতে কখন যে বাইপাসের সেই ফাঁকা রাস্তাতে এসে পড়েছে, খেয়ালই করেনি। অন্যদিন দু-একটা গাড়ি থাকে, আজ বৃষ্টির জন্য তাও নেই। শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো বিষন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার নীচ থেকে রিয়ান যেন একা একটা মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।মনের অজান্তেই বিয়ানের গা-টা একটু ছম ছম করে উঠলো!! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে ঝাড়া দিয়ে মনকে আশ্বস্ত করল,ওইসব কিছু না! এফ.এম.-এ গাঁজাখুরি জিনিস শুনে এরকম মনে হচ্ছে, এই ভেবে রিয়ান ওর হাঁটার স্পিডটা বাড়িয়ে দেয়,  ভূত-টুত না হোক যদি কোন ছিনতাইবাজ এসে রিয়ানের ব্যাগ আর দামি ফোন হাতিয়ে চলে যায়, সেই ভয়েই!!

তখন জেদ করে হেঁটে আসলো ঠিকই কিন্তু এখন রিয়ানের মনে হচ্ছে যে এত জেদ না করলেই ভালো হতো, একে তো শরীর ক্লান্ত, তার ওপর অফিসের এত চাপ!! গাড়িও পাওয়া যাবেনা এখন এই রাস্তা দিয়ে! এসব ভাবতে ভাবতেই বড় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল রিয়ান।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা বার করতেই যাচ্ছিল হঠাৎ আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ চমকে উঠল রিয়ান। একে এই রাস্তা এতো শুনশান, তারপর আজ কোনো গাড়ি নেই। রিয়ানের হেঁটে যাওয়ার আওয়াজই বার বার প্রতিফলিত হচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝে এরকম হঠাৎ করে কানের একেবারে কাছে কে নিঃশ্বাস নিলে তা দেখার জন্য পিছনে ঘুরলো, কিন্তু কোথায় কে? পুরো রাস্তা ফাঁকা।রিয়ানের শরীরটা যেন একটা শিরশিরিয়ে ওঠে। "মনের ভুল" ভেবে আবার হাঁটতে শুরু করে রিয়ান। কিন্তু কিছুটা গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়। পায়ের আওয়াজ আসছে  এবারে। এটা রিয়ানের পায়ের আওয়াজ নয়। আলাদা কেউ!! আর অদ্ভুতভাবে সে যেন রিয়ানের পায়ে পায়ে চলছে। রিয়ান থামলে সেও থেমে পড়ছে! দু-তিনবার একই ঘটনা ঘটলে এবার রিয়ানের মাথা যায় গরম হয়।পিছন ঘুরে চেঁচাতে থাকে,"এই এই কে?কে ওখানে? হ্যাঁ? ভয় দেখানো হচ্ছে? রাত বিরাতে মশকরা আমার সাথে!! শুনুন যতই ভয় দেখান এই রিয়ান চৌধুরীকে বাগে আনা অত সহজ নয় বুঝলেন? বেরিয়ে আসুন এক্ষুনি!! কোথায় আপনি? বের হন! লুকিয়ে লুকিয়ে ভয় দেখানো,হুম??!"

" কি দাদাবাবু এত উত্তেজিত কেন?"

কানের কাছে একটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল রিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে দেখলো, অমানসিক রোগা আর লম্বা একটা লোক! শুধু লম্বা বললে ভুল হবে, আশ্চর্যরকম লম্বা!! যেন একটা শিশু তালগাছ আর তার সাথে পাতলা শরীর! পুরোটাই বেমানান!! রাস্তার হালকা আলোয় লোকটার মুখে দেখা গেল কাঁচা পাকা দাড়ি, তার ক্লান্ত-অবসন্ন চোখ দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের জানান দেয়, লোকটার শরীরটা কিছুটা সামনের দিকে ঝোকানো, হয়তো অতিরিক্ত লম্বার কারণেই!! চারপাশে এখন একটাও জীবিত প্রাণীর চিহ্ন নেই।

রিয়ান একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,"আ..ই..ইয়ে মা..মানে আপনি আবার হঠাৎ কোথা দিয়ে উদয় হলেন?"

" হে হে কি যে বলেন দাদা বাবু! আমি তো ওখানে কাজ করি!" হাত তুলে অদূরেই হাইরাইজ বিল্ডিং গুলোর দিকে দেখালো, সেখানে অনেকদিন ধরে কনস্ট্রাকশন চলছে।

" কই কোথায় কাজ হচ্ছে? আমি তো দেখতে পারছি না?"জিজ্ঞেস করে রিয়ান।

"রাতে কাজ হচ্ছে না কদিন দাদাবাবু!!"

" তাহলে আপনি এখানে কেন?"

" আমার মেয়েটা বড়ই অসুস্থ!ওর জন্যই ওষুধ নিতে এসেছি" হাত তুলে ওষুধের প্যাকেটটা দেখালো লোকটা। এবার একটু আস্বস্ত হলো রিয়ান।মনে মনে ভাবলো যাক ওইসব ভূত-টুত কিছুই না!!

লোকটা একটু কেশে আবার তার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলো "যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি আমি আপনার সাথে যেতে পারি? আসলে ফাঁকা রাস্তা তো একা একা হেঁটে যেতে মন চায়না হে হে!!"

রিয়ান কিছুক্ষণ ভাবল, অদ্ভুতরকম হলেও লোকটার মুখ দেখে তো চোর-টোর বলে মনে হচ্ছেনা। আপাদমস্তক খুবই সাধারন একজন লোক। তাও সবাইকে হুট করে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। আজকাল এই অতি সাধারণ মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ানো লোকের অভাব নেই!! এই ভেবেই অফিসের ব্যাগটা আরো একটু চেপে ধরলো"

সেই দেখে লোকটা নিমেষে পাল্টে গিয়ে সেই রকমই ফ্যাসফ্যাসে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, "অ...বুঝেছি আমাকে চোর ভাবছেন? ভাবছেন বুঝি এই রাত বিরেতে ফাঁকা রাস্তায় আপনার ব্যাগ ছিনতাই করে পালাবো? তবে শোনেন আমরা গরিব হতে পারি!! কিন্তু আমরা ছোটো থেকেই খেটে খেতে শিখেছি! চুরি করা আমাদের ধম্মে সইবেনা বুঝলেন?!" এই বলে লোকটা গটগট করে এগিয়ে গেল।

রিয়ান একটু ভুল করে ফেলেছে বুঝতে পেরে লোকটাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে যায়," আরে  শুনছেন!! আরে ও দাদা!! রাগ করলেন কেন? আমি তো এমনিই.." বলতে বলতে লোকটার পাশে এসে চলতে শুরু করে। এবার লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো রিয়ান, বয়স আন্দাজ বছর চল্লিশেক হবে, যদিও বয়স অনুযায়ী লোকটাকে যেন একটু বেশি বয়স্ক লাগে। দেখে মনে হয় না লোকটা তেমন পড়াশোনা জানে, গায়ে পুরনো দোমড়ানো-মোচড়ানো ফতুয়া। হাঁটতে হাঁটতে একটা চেনা সুর গুনগুন করছে লোকটা। তবে কোন গানের সুর তা মনে করতে পারলোনা রিয়ান।

প্রায় কিছুক্ষণ যাওয়ার পর রিয়ানই প্রথম মুখ খুললো "আপনার মেয়ের কি হয়েছে?"

"শ্বাসকষ্ট" ছোট্ট উত্তর। লোকটার রাগ যে এখনো কমেনি তা রিয়ান বুঝতে পেরেছে! তবে ওর কিছু বলার আগেই লোকটা আবার বলতে শুরু করলো "আমার মেয়েটা বড়ই অসুস্থ দাদাবাবু!!মাঝেমাঝেই শ্বাস নিতে পারেনা,বড় বড় হাঁ করে দম নিতে থাকে।আমি কিচ্ছু করতে পারিনা।ওই কি যেন ফুসফুসে ক্যা.."

"ক্যান্সার!!??"

"হ্যাঁ হ্যাঁ ওই!জানেন দাদাবাবু কতো দামী দামী ওষুধ! খাওয়াতে পারিনা"

রিয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো "কেন??!!"

"পয়সা কোথায় দাদাবাবু? ওইতো একটু রাজমিস্ত্রীর হেল্পারের কাজ করি।ওতে আর কতো রোজগার হয়?ওতে সংসার কোনোমতে চলে যায় কিন্তু চুনীর ওষুধ??!!..."

কথা শেষ না করেই লোকটা হাত দিয়ে চোখ মোছে।রিয়ান কিছু বলতে পারেনা,শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।লোকটা আবার কিসব বলতে শুরু করে। রিয়ান কথার মাঝখানে বলে, "আচ্ছা আপনি তো অন্য কাজও তো করতে পারেন,যাতে একটু পয়সা বেশি,না মানে এমন অনেক কাজই তো আছে!"

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর আবার বলে "আমার শরীরেও যে আর শক্তি নেই দাদাবাবু! সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কাজ করি!কি কি কাজ করিনি!!লেবারের কাজ,কুলির কাজ সব সব করেছি।কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই শরীরটা হাল ছেড়ে দিল।অল্পতেই বুক ধড়ফড় করতো, মাথা ঘুরে যেত,সবকিছু ভুলে যেতে লাগলাম। ডাক্তার দেখালাম, কি হয়েছিল কিছুই বুঝলাম না,কি সব খটোমটো নাম বলছিল ডাক্তারবাবু, এও বললো অপারেশন করতে হতে পারে।গরীবের সংসার চলে না তার ওপর আবার অপারেশন হে হে!!

এরপর থেকেই শরীরটা কেমন ভেঙে যেতে লাগলো। কাজ করতে পারতাম না।এইজন্য কাজের জায়গা থেকে একে একে সবাই আমায় বের করে দিল।কত রাত যে না খেয়ে থেকেছি দাদাবাবু কি বলবো!!খিদের জ্বালা আমরা বড়রা না হয় সহ্য করে নিতাম কোনোভাবে কিন্তু ওই একরত্তি শিশুটা? ওর কি দোষ ছিল।বেচারি খিদের জ্বালায় চুনী মা আমার কতো কাঁদতো!!উফ সহ্য করতে পারতাম না।বাইরে বেড়িয়ে যেতাম।রাত দিন নতুন নতুন জায়গায় শুধু কাজ খুঁজে বেড়াতাম।যেকোনো একটা কাজের জন্য কতো মানুষের পায়ে পরেছি!লাথি খেয়েছি কিন্তু কেউ আমায় কাজ দিত না।সবাই তাড়িয়ে দিত।এরই মাঝে চুনী মায়ের শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে।মেয়ের কান্না আর সহ্য করতে না পেরে বউ একদিন তাকে গলা টিপে মারতে গেল!!ভাগ্যিস সেদিন ঠিক সময় এসে পরেছিলাম নাহলে সেদিনই!!"লোকটার চোখেমুখে একটা ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো। লোকটা এক নিঃশ্বাসে বলেই যাচ্ছিল।দেখে মনে হচ্ছিল যেন নিজের কষ্টের কথা অনেককাল বুকে চেপে রেখে দিয়েছে।সেই ভার যেন সে আর বহন করতে পারছেনা।কাউকে বলে একটু হালকা হতে চায়।রিয়ানও তাই আর আটকায়না,চুপচাপ শুনে যায়।

"কি বললবো দাদাবাবু! বউকে আমি খুবই ভালোবাসি কিন্তু সেদিন তার ওই কান্ড দেখে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি।ছুটে গিয়ে বউয়ের গালে বসিয়ে দিলাম সপাটে এক চড়,সে কিছুটা দূরে ছিটকে পরলো।আমি চুনীকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।মেয়েটা যেন কিছুটা স্বস্তি পেল।মুখ খুলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিল।আমি তা দেখে কি যে শান্তি পেলাম কি বলবো!কিন্তু বউয়ের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো,যা পারলো তাই বলে গেল,গালির পর গালি দিয়ে গেল। তাদের খাওয়ানোর নাকি মুরোদ নেই আমার, আমি নাকি আলসি! আসলে ওর কোনো দোষও ছিল না। আমি তো আর আমার রোগের কথা ওকে বলিনি কোনোদিন" এই বলে লোকটা একটু মুচকি হাসলো। কিন্তু রিয়ান লোকটার কথা যত শোনে তত যেন একটা চাপা কষ্ট নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে।

"বউ রাগ করে চলে গেল, তিন দিন কোনো কথা বলেনি, আমিও আর কিছু বলিনি।আমি জানতাম ও নিজের ভুলটা ঠিক বুঝতে পারবে।তারপর ও নিজেই আসবে।আসলে ওর মনটা খুবই ভালো জানেন তো দাদাবাবু! শুধু মাঝেমধ্যে একটু অবুঝের মতো কাজ করে ফেলে এই আর কি!"। রিয়ান যে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।এখনকার যুগে এইরকম অভাবের সংসারেও এমন নিখাদ ভালোবাসার নিদর্শন! লোকটার এই নিখাদ ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধকে মনে মনে সম্মান জানায় রিয়ান।

" এইভাবেই বেশ কাটছিলো দিনগুলো। অভাবের সংসার হলেও কম টাকাতেই কোনোভাবে দিনগুলো কাটছিল।শুধু একটাই দুঃখ রয়ে গেল মেয়েটাকে আর পড়াতে পারলাম না।চুনী পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল,খুব ভালো মাথা ছিল ওর।আমি তো পড়াশোনা করতে পারিনি,শুধু চেয়েছিলাম আমার মেয়েটা পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হোক,কিন্তু ভগবান সেটাও হতে দিল না" এই বলেই লোকটা আকাশের দিকে তাকালো, চোখটা ছলছল করে উঠলো। মুখ দেখে মনে হলো ভগবানের প্রতি অসম্ভব রাগ,ক্ষোভ উগরে দিতে চাইছে যেন।

ঠিক এই সময় আবার আকাশ কাঁপিয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। রিয়ান এবার পড়িমরি করে ছাতাটা বার করার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু রিয়ানকে অবাক করে লোকটাই একটা ছাতা বের করে দুজনের মাথার ওপর ধরলো।কি আশ্চর্য লোকটার হাতে ছাতা ছিল?কই এতোক্ষণ তো চোখে পরেনি।রিয়ানকে আরও অবাক করে লোকটা বললো"আপনার ছাতা তো ভেঙে গেছে দাদাবাবু তাহলে অতো উত্তেজিত হয়ে ছাতা বার করতে যাচ্ছিলেন কেন!!"এই বলেই আবার অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগলো। রিয়ান এবার একটু ভয় পেতে শুরু করলো!! তার মুখ দেখে লোকটা আবার একটু মুচকি হেসে বলে "কি দাদাবাবু ভয় পেলেন নাকি??!!"

"ভ..ভয় কেন পাবো!!হ্যাঁ?? তুমিও না বড় অদ্ভুত " বলেই একটু খুক খুক করে কাশলো রিয়ান।

লোকটার ছাতাটা ধরতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল দেখে রিয়ান নিজেই ছাতাটা ধরে নিল,এইসময় লোকটার হাতের সাথে রিয়ানের হাতের স্পর্শ হয়।সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে রিয়ান।কি অস্বাভাবিক ঠান্ডা হাত!রিয়ানের বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো। চারপাশে নিঝুম।সামনেই বাঁদিকে একটা পানাপুকুর চোখে পড়লো। জলের ওপরটা নিকষ কালো অন্ধকার। রিয়ানের মনে হলো এতোক্ষণ ধরে বয়ে চলা ঠান্ডা হাওয়া যেন আরও এক ধাপ শীতল হলো। রিয়ানের গা-টা শিরশিরিয়ে ওঠে।এইসময় কাছেই একটা বাজ পরার শব্দ হলো। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে আছে। রিয়ান একটু গলা খাকারি দিয়ে বলে "ইয়ে তারপর আর বললেন না তো!" রিয়ান খেয়াল করলো লোকটার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে লোকটা আবার বলল "এইভাবে বেশ কাটছিল দিনগুলো কিন্তু আস্তে আস্তে যত দিন এগোতে থাকলো ততো আমার চুনীটার শরীর খারাপ হতে লাগল, শরীর একেবারে ভেঙে পরলো। আমি সব দেখেও কিছু করতে পারছিলামনা, কিই বা করব? কি ক্ষমতা ছিল আমার?? এরমধ্যে আমার শরীরও আর পেরে উঠছিল না, তাও যোগেশদা আমাকে যতটা পারতো সাহায্য করত। যোগেশদাই আমাকে রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজটা যোগাড় করে দিয়েছিল, এরই মাঝে আমার চুনীটা এত অসুস্থ হয়ে পড়ে যে মেয়েটাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এই হাসপাতালের খরচটাও যোগেশদাই  দিয়েছিল, আমি যোগেশদাকে বলেওছিলাম আস্তে আস্তে সব টাকা শোধ করে দেব" এই সময় আবার বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়ে উঠলো আকাশে, লোকটার গলা এবার ভারী হয়ে উঠল ক্রমেই!" সেই রাতেও এমন ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল, সেই রাতে চুনীর শরীর খুব খারাপ করলো। আমার তো মাথায় হাত! কি করবো বুঝতে পারছিলাম না!! একদিকে বাইরে প্রকৃতির তান্ডব আর একদিকে আমার মেয়ে কোন দিকে যাব কিছুই বুঝিনা। ওই তীব্র ঝড় বৃষ্টির রাতেই ছাতা নিয়ে বের হলাম, যাই হয়ে যাক আমার চুনীর জন্য ওষুধ আমাকে আনতেই হবে। অন্তত ওষুধ খেয়ে সকাল অব্দি যদি তো ওর ব্যথা-বেদনা কিছুটা কমিয়ে রাখা যেত এই ভেবে!! কারণ হাসপাতাল বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে ছিল।অতো ঝড় জলের রাতে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব!!  কিন্তু বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম সমস্ত দোকানপাট বন্ধ!! তাও আমি এদিক ওদিক ঘুরে একটা দোকানের সন্ধান পেলাম, সেখান থেকে চুনীর জন্য ঔষুধ কিনেই দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে, তারপর...." লোকটা একনাগাড়ে বলে চলছিল হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ের আওয়াজে চমকে সামনে তাকাতেই রিয়ান দেখলো বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থতার ভারে শরীর যেন অনেক ভেঙে গেছে!

"চুনী!!" লোকটা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়। এর মানে এই সেই চুনী!! যার কথা এতক্ষণ ধরে এই লোকটা বলছিল। এতক্ষণে রিয়ান খেয়াল করলো বৃষ্টি থেমে গেছে, ছাতাটা বন্ধ করে আবার ওদের দিকে তাকালো রিয়ান। লোকটা মেয়েটাকে যেন কি বলছে, রিয়ান তার মাঝখানে বললো "ভারি মিষ্টি মেয়ে আপনার! লোকটা রিয়ানের দিকে তাকিয়ে একটা সম্মতিসূচক হাসি দিল। তারপর বলল "আপনি খুব ভালো দাদা বাবু! আপনাকে একটা অনুরোধ করি? আপনি আপনার মায়ের কাছে ফিরে যান, আপনার মা আপনার জন্য খুব চিন্তা করে, দিন রাত কাঁদে! আর মাকে কষ্ট দিয়েন না, আপনার কাছে সুযোগ আছে আপনার পরিবারের সাথে থাকার, সে সুযোগটাকে নষ্ট করেন কেন?পরে যদি আফসোস হয় তখন আর কিছু করার থাকবে না!!" রিয়ান চমকে উঠলো লোকটা এসব কি বলছে!! কাঁপা কাঁপা গলায় রিয়ান জিজ্ঞাসা করল "আপনি কি করে জানলেন!"লোকটা আমার মুচকি মুচকি হেসে বললো "আমি সব জানি!" এই বলেই লোকটা বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে সোজা চলে যেতে লাগল। এইবার একটা দৃশ্য দেখে রিয়ানের মুখ দিয়ে তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো!! এ কী করে সম্ভব?? লোকটা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মেয়েটা একনাগাড়ে হেসে যাচ্ছে তখন দিয়ে, নীচের দিকে চোখ পড়তেই রিয়ান দেখলো লোকটার বাঁ পা-টা হাঁটুর কাছ থেকে আর নেই!! কিন্তু লোকটা অনায়াসেই হেঁটে যাচ্ছে, বলা ভালো ভেসে যাচ্ছে! এবার যেন দুজনের দেহ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে, চুনীও মাথা ঘুরিয়ে রিয়ানের দিকে তাকালো!! রিয়ানের সারা শরীর শিউরে উঠলো, চুনীর চোখে কোনো মণী নেই।  সমস্তটাই কালো,যেন এক ভীষণ কালো গহবর!! এবারের চুনীও রিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। রিয়ান যেন সেই জায়গা থেকে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, যে অজাগতিক জিনিস সে এই মূহুর্তে দেখছে তা কি আদৌ সত্যি? নাকি সব রিয়ানের ভ্রম!! কানে ভেসে আসছে আবার সেই ফ্যাসফ্যাসে গলার আওয়াজ, " আমরা সব যন্ত্রণা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে দাদাবাবু! আমাদের আর কোনো কষ্ট নেই, কোনো ব্যথা বেদনা নেই, আমরা সব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে এখন মুক্ত, মুক্ত!!!" স্পষ্ট দেখা গেল আস্তে আস্তে দুজনে বাতাসে মিলিয়ে গেল।রিয়ান আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা, উর্ধশ্বাসে দৌড় দিল বাড়ির দিকে, বাড়ির কাছাকাছি যেতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তারপরেই সব অন্ধকার!!

জ্ঞান ফিরলো সকালে আশীষ বাবুর ডাকে। ইনি রিয়ান যে ফ্ল্যাটে থাকে তারই নীচতলায় থাকেন। তিনি বললেন "কাল রাতে একটা আওয়াজ পেয়ে বাইরে এসে দেখি তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো!!" এক মুহূর্তে রিয়ানের গতকাল রাতের সমস্ত কথা মনে পড়ে গেল। রিয়ান যখন আশিষ বাবুর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিল তখন আশীষ বাবু আবার ডাকলেন রিয়ানকে। রিয়ান পিছন ফিরতেই তিনি বললেন "তোমার জিনিসগুলো নিতেই তো ভুলে যাচ্ছ!! "এই বলে একটা ব্যাগ আর ছাতা রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি!!সেই ছাতা কাল রাতের সেই ছাতাটা!!

আজ আর রিয়ান অফিস গেল না। শরীরটা বড়ই ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ঠিক করল সেই জায়গাটা আবার যাবে যেখানে ওদের দুজনকে রিয়ান শেষবার দেখেছিল। প্ল্যানমতন দুপুরের দিকে রিয়ান সেখানে চলে গেল। ওখানে লোকেদেরকে জিজ্ঞেস করতে করতে সেই লোকটার বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়িটা বেশ পুরনো, টিনের ছাউনি দেওয়া। দরজায় কড়া নাড়তেই এক মধ্যবয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলেন। বিয়ানকে দেখে তিনি একটু অবাক হলেন। রিয়ান কিছু না বলে কালকের ছাতাটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিল। ছাতাটা দেখেই মহিলা আঁতকে উঠলেন। ছাতাটা নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন " আ..আপনি ছাতাটা কোথায় পেলেন?"

"এই ছাতাটা কার?" জিজ্ঞেস করলো রিয়ান।

দেখলাম মহিলাটার চোখ ছল ছল করে উঠলো, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল "ওনার" বলেই ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকালেন।রিয়ানও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেইদিকেই তাকালো। দেখলো কালকের সেই লোকটার ছবি আর তার পাশে তার মেয়ের চুনীর ছবি, তাদের ছবিতে মালা পড়ানো।

" সেদিন রাতে খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছিল। এই ছাতাটা নিয়েই সেদিন তিনি বেরিয়েছিলেন মেয়ের জন্য ওষুধ আনতে, বারণ করেছিলাম এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বেরোতে হবে না, কিন্তু আমার বারণ শোনেননি। মেয়ের কষ্ট তার কাছে সব হল, মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজেই..." কথা শেষ না করেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চাপলেন মহিলা।"কি হয়েছিল সেদিন?" জিজ্ঞেস করলো রিয়ান। মহিলাটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আবার বললেন "সেদিন রাতে হন্তদন্ত হয়ে ফেরার সময় গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয় ওনার, পায়ে প্রচন্ড চোট লাগে যার জন্য ওনার পা কেটে বাদ দিতে হয়। উনি এই শোক বেশিদিন সামলাতে পারেননি। দু'দিনের মাথায় হার্টফেল করে মারা যান আর ঠিক তার পরের দিনই আমাদের মেয়েটাও!" এবারে মহিলাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন।"নিজে তো চলে গেলেন,মেয়েটাকেও সাথে নিয়ে গেলেন।বেঁচে থাকতেই কোনোদিন কাঁধছাড়া করেননি, আর মরার পরেও নয়!!শুধু আমিই পর ছিলাম।আমার কথা কেউ ভাবলো না,সবাই একা করে চলে গেল!!" রিয়ান আর বসে থাকতে পারলো না ওখানে, ছুটে বেরিয়ে এলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো মিসড কল, মা ফোন করেছিল!! সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে রিয়ান।

"হ্যালো, বাবা!!কোথায় ছিলিস??সেই কখন থেকে ফোন করছি!!" মায়ের গলায় চিন্তার সুর!!

"আসলে একটু কাজে আটকে গিয়েছিলাম মা"

" আচ্ছা শোন না আজকে তোর প্রিয় মটন বিরিয়ানি  করেছি, তুই কি..."

" তাই!!! বেশ বেশ তুমি রেডি করো আমি এক্ষুনি আসছি প্লেট সাফ করতে। আর শোনো আমি আজ থেকে তোমাদের সাথেই থাকব। রামদাকে বলো আমার ঘরটা পরিষ্কার করে রাখতে আমি এক্ষুনি আসছি!!"

"তাই!!!! ঠিক আছে বাবা আমি বলে রাখব,তোকে দেখিনি কতদিন হয়ে গেল! আয় দেখি বাবা,ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আয়!!"


রিয়ান ফোন রেখে নিজের বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

কালকের অমন দুর্যোগের পর আজ আকাশ যেন রংবেরঙের খেলায় মেতেছে। মনেই হচ্ছে না কাল পৃথিবীর বুকে এতো বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে।

এখন দুপুর হয়ে আসছে!!রাস্তা এখন অনেকটাই ফাঁকা, কালকের মতো আর ভয় করছে না রিয়ানের।কালকে রাতের সেই ফাঁকা রাস্তার মাঝেই আসতে আসতে সে যেন শুনতে পাচ্ছে চুনির হাসির শব্দ, বাবার সাথে খেলছে ওই একরত্তি মেয়েটা।কোনো কষ্ট নেই তার শরীরে।লোকটার মুখে এখন অমলিন একটা হাসি দেখতে পাচ্ছে যেন রিয়ান।লোকটার একটা পা নেই কিন্তু তা নিয়ে যেন তার আর কোনো আক্ষেপও নেই।সে ব্যাস্ত তার মেয়ের সাথে খেলতে! আজ তাদের আর কোনো কষ্ট নেই,নেই কোনো ক্লান্তি,কোনো যন্ত্রণা!! তারা আজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে!!তারা আজ মুক্ত!!!তারা আজ মুক্ত!!!


(সমাপ্ত)




পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু