বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সাগরিকা



ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ আর স্বচ্ছ জল দেখে মনটা চলে গেল আঠেরো বছর আগের সেই বর্ষণক্লান্ত কালীপুজোর দিনে। তারপর দিনই এখানে এসেছিলাম যখন, তখন আর এখন কত বদলে গেছে এই সাগরিকা ট্যুরিস্ট লজ অ্যান্ড রিসর্ট। ঝাঁ চকচকে থ্রি স্টার হোটেলের মতোই লাগছে সরকারী অতিথিশালা। আর তখন.... মান্ধাতা আমলের বিশাল বিশাল ঘর আর বাথরুম, বিশাল চওড়া বারান্দা দিয়ে একদিক ঘেরা। ঘরের অন্যদিকে যে বারান্দা সেটা মেন রোডের উপর আর তার পাশেই হারবার। হ্যাঁ ডায়মন্ড হারবার।লোডশেডিং, ঘন ঘন বাঁ বিদ্যুৎ আর তুমুল বৃষ্টির সেইদিন টা আজও মনে গাঁথা অবিকল।

.

.

.



কালীপুজোর আগের দিন থেকে এমন বৃষ্টি যে একহাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই দুর্যোগের মধ্যেই শক্তির আরাধনা সেরে পরের দিন সকাল দশটায় পরিচিত একজন রিক্সাওয়ালাকে রাজি করিয়ে মেয়ে কোলে নিয়ে রিক্সায় ডানলপ ব্রীজের নীচে এসে দেখি প্রায় এক কোমর জল। অতি কষ্টে একটা হলুদ ট্যাক্সি যদি বা পেলাম, রিক্সা থেকে নিজেদের ট্যাক্সি তে ট্রান্সফার করতেই ভিজে সপসপে। মেয়ে কে জল থেকে কোনও ক্রমে বাঁচিয়ে চললাম Aharmastreet। ওখানে থাকেন এবার আমাদের দুদিন ভ্রমণের সঙ্গী হবেন যারা। 

ডায়মন্ড হারবার.... হঠাৎ করেই ঠিক হল দুদিনের জন্য যাওয়া। আমরা দুটো ফ্যামিলি যাবো। আমরা ছাড়া আর যে ফ্যামিলি টি যাবে তাদের সাথে আলাপ মেয়ে ভর্তি করাতে গিয়ে স্কুলে। বাবা মা এবং বাচ্চারা একসাথে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। আমাদের দুজনদের মেয়েই কলকাতার ঐ নামী স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। এরপর আলাপ থেকে পারিবারিক বন্ধুত্ব। আর সেই বন্ধুত্বের হাত ধরেই দুই বাড়িতে যাতায়াত, খাওয়া দাওয়া। এরপর ই ঠিক একটা ছোট আউটিং।


কালীপুজোর পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে একরাত থেকে চলে আসতে হবে কারণ দুই পরিবার কে ভাইফোঁটা তে বাড়ি থাকতেই হবে। হোক না একরাত, আমার উত্তেজনা তুঙ্গে। আমি নাম ই শুনেছি কিন্তু যাই নি কখনও...... এও শুনেছি ভীষণ সুন্দর জায়গা। হুগলী নদীর ধারে বন্দর, বন্দর ঠিক নয় পোতাশ্রয়।


Aharmastreet পৌঁছাতেই দেখি মিসেস এবং মিস্টার হান্ডা মেয়ে সমেত রেডি। গাড়ি বদলে সদলবলে রওনা দিলাম গন্তব্যে। দুর্গা নয় কালী কালী বলে। খুব সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত আর মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প চলছে। আমার নজর সবসময় বাইরে। জানলায় চোখ রেখে দেখে যাচ্ছি শহর থেকে শহরতলী হয়ে সবুজ ধানক্ষেতের বুক চিরে চলে যাওয়া সর্পিল রাস্তা। বৃষ্টি ধুয়ে মুছে যেমন সাফ করেছে গাছপালা তেমনি জমা জলের আয়নায় মুখ দেখছে আকাশ যুবতী মেয়ের মতো। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আগের থেকে বুক করে রাখা সরকারি ট্যুরিস্ট লজ সাগরিকা তে। রাস্তার একপাশে বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে হারবার আর ঠিক উল্টো দিকে সাগরিকা। মুখোমুখি প্রেমিক প্রেমিকা যেন। দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। দোতলার নির্দিষ্ট ঘরে জিনিস পত্র নামিয়ে নীচে খাবারের জায়গায় এলাম। নানারকম  মাছের প্রচুর পদ সহ এলাহি ব্যবস্থা খাবারের। ডান হাতের কাজ সেরে ঘরে গিয়ে লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙতেই দেখি সন্ধে হয়ে গেছে। বৃষ্টি তার তেজ আরও বাড়িয়েছে। ঘন কালো আকাশ আর সোনালী বিদ্যুৎরেখা যেন যুদ্ধরত। ঘর থেকেই সেই মুগ্ধকর ভয়ংকর দৃশ্য দেখছি। এর মধ্যেই চা আর চিকেন পাকোড়া এল। একটা ঘরেই দুই ফ্যামিলির ছয়জন বসলাম। এর মধ্যেই দুম করে পাওয়ার অফ। লাল বাল্ব  জ্বলে একটা আলো আঁধারির সৃষ্টি করেছিল বারান্দায় যাও বা সেও ভুতুড়ে অন্ধকারে ডুবে গেল। ঘরে ঢোকার বারান্দার পাশে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে দেখতে পাচ্ছিলাম কি প্রচন্ড আন্দোলন করছে ওরা তুমুল হাওয়া আর বৃষ্টির সাথে। দুদিকে দুরকম দৃশ্য আর পাওয়ার অফ হয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ। এই অবস্থায় দুটো বাচ্চা নিয়ে নীচে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে রাতের খাবার ঘরেই দিতে বলা হল। মাঝে এখন অনেকটা সময়। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে গল্প হচ্ছে। মিস্টার হান্ডা ওনার জীবনের কিছু ভৌতিক বা অলৌকিক গল্প বলতে শুরু করলেন। প্ল্যানচেট। আমি শুনেছি কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা নেই। তাই ভীষণ উৎসাহে শুনতে লাগলাম সবাই। ওনার বলায় আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বাচ্চা দুটো ভয় বা ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে গেছে। আমি আর আমার হাসব্যান্ড শুনছি। মিসেস হান্ডা খেই ধরাচ্ছেন মাঝে মাঝে ওনার কর্তাকে। ঘরের পরিবেশ তখন এমন যে সবকিছু ভীষণ সত্যিই মনে হচ্ছে। একের পর এক ওনার জানা গল্প বা চেনা কারও অভিজ্ঞতা বলে যাচ্ছেন আর আমরা গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছি। এর মধ্যেই রুটি চিকেন স্যালাড হাজির। খাবারের বিরতি। ঘুমন্ত দুটো বাচ্চা কে খাইয়ে আবার শুইয়ে দিলাম। যে যার মায়ের কোল ঘেঁষে সিঁটিয়ে ভুতের ভয়ে। আবার শুরু হল নতুন একটা গল্প। এক মহিলা তার মৃত বাবাকে ডাকতেন ঘর বন্ধ করে। উনি ওনার সব কথা বাবাকেই বলতেন। যে কোনো সমস্যা হলেই বাবা। এবং ওনার বাবা সব শুনে সমস্যার সমাধান করে দিতেন। উনি দরজা খুলে হাসিমুখে বেরিয়ে আসতেন। কখনও একদিন, কখনও দুদিন আবার কখনও সাতদিন পর। এই ঘটনা বছরের পর বছর চলছে।


আমি শুনতে শুনতে কখন যেন আমার বাবার কাছে পৌঁছে গেছি। বাড়িতে বাবার সাথে আমার বন্ধুতা বা সখ্যতা অন্য ভাইবোনের থেকে একদম আলাদা ছিল। ভীষণ ভাবে বাবার সাথে জড়িয়ে ছিলাম আমি। আমার বিয়ের তিনবছর পর হঠাৎ ই বাবা মারা যান। আমি মৃতদেহ দেখতেও পাই নি। তাই বাবা সবসময় আমার কাছে জীবিত।


দপদপিয়ে মোম গলে গলে জ্বলছে। বৃষ্টি বাজ আর বাতাসের দাপট অব্যাহত। মিস্টার হান্ডা বলে চলেছেন। বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে আছে। মিসেস হান্ডা আর আমার হাসব্যান্ড ঢুলু ঢুলু চোখে বসে। আমি বাইরের দিকে তাকিয়েছি একটা বাজ পড়ে আলো হওয়ায় নদীর দিকে। দেখি বাবা দাঁড়িয়ে হাসিমুখে। আমি আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে এগিয়ে চলেছি বাবার কাছে। দরজা ঠেলে বারান্দায়। অন্ধকার, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চমক..... কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবল বাবা আর আমি পাশাপাশি, মুখোমুখি। না বলা কত কথা বলে চলেছি.... বলেই চলেছি.... আমার সব অভিযোগ হাসিমুখেই শুনে যাচ্ছেন বাবা। ঠিক আগের মতোই। আমি যত রাগ করতাম বাবা তত হাসতেন মুচকি মুচকি। আমার আরো রাগ বেড়ে যেত। তখন বাবা মাথায় হাত রাখতেন আর আমি হেসে ফেলতাম। এবারও আমার রেগে যাওয়া তে বাবা মুচকি হেসে হাত রাখলেন হাতে। ওফফফফ্.... কি অসহ্য ঠান্ডা হাত.... তোমার হাত এএএএত ঠা ঠা ঠান্ডা কেন?? বাবাআআআআ... বিদ্যুৎ চমক....


পরদিন সকালে চোখ খুলতে দেখি বিছানায় আমি। রোদ উঠেছে। নীচে লজের স্টাফ রা কালীপুজো করেছে তার ঢাক বাজছে। মানে পুজো আরতি হচ্ছে। বাচ্চাদুটো হুটোপুটি করছে। চারিদিকে মাঈক বাজছে। সব স্বাভাবিক। আমি ফ্যালফ্যালিয়ে দেখছি সব আর ভাবছি গতকাল রাতে.... বাবা.... আর যেন কি সব....

আমার হাসব্যান্ড কে জিজ্ঞেস করতেই বললেন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। জলখাবার খেয়ে বেরোবো কাছাকাছি ঘুরতে। একটা ভাঙা ফোর্ট আছে ওদিকে।

আগের রাত মনের মধ্যে রেখেই রেডি হলাম। বেরিয়ে মিসেস আর মিস্টার হান্ডাকে মর্নিং উইশ করে জানতে চাইলাম গতরাতে ঠিক কি হয়েছিল।

মিসেস হান্ডা :: মেয়েরা নাচবে ঢাকের সাথে। তাড়াতাড়ি চলো।

মিস্টার হান্ডা :: দুপুরে খেয়ে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে র্্যাডিসন ফোর্ট যাবো। ওখানের ভিউটা খুউউউউউউব সুন্দর।চলুন চলুন..


নীচে কালীপুজোর প্যান্ডেল, ঢাকের বাজনা, রোদ্দুর, লোকজন,.....


বেরিয়ে পড়লাম সাগরিকা আর ডায়মন্ড হারবার ছেড়ে.....


আজও জানি না ঠিক কি হয়েছিল সেদিন.... বাবা তো এসেছিলেন সত্যি সত্যিই.... কেউ কেন কিছু বললো না....


আঠেরো বছর পর বদলে গেছে সব। সাগরিকা আর তার সাজগোজ, আমি খুঁজে চলেছি সেই আগের সাগরিকা কে.... যদি আবার একবার দেখা হয় বাবার সাথে....


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু