বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সত্যিকারের ভূত

               সেদিনের একটা ছোট্ট ভুল অরিত্রর জীবনের গতিপথে একটা পর্বতসমান বাধার সৃষ্টি করেছে যা কখনোই ভোলার নয়। বেশ বড়লোক ঘরের আদুরে সন্তান সে। জীবনের বিচিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতা সে কিছুটাও অর্জন করতে পারে নি, পারেনি সে জানতে বাস্তবতার চরম সত্যতা। সেদিনকার দুর্বিষহ ঘটনা সত্যিই সারা দিনরাত দগ্ধ করে তোলে তার মনকে। ঘটনাচক্রে সে এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমের জলে ভেসে গিয়েছিল। আর এরই এক নিষ্ঠুর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল তাকে।বন্ধুত্বের বাঁধনে আটকে পড়া আমি সেই ঘটনাটির দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চলেছি।

           গ্রামটার নাম শীতলপুর। না তবে মোটেই সে শীতল নয়। নামের সাথে বাস্তবতার এক কণা মিল খুঁজতে সব যুক্তি শেষ হয়ে যায়। শীতলপুর সবসময়ই অগ্নিময়। কারণ একটাই ওই রাজনীতি। যাইহোক আমার বন্ধু অরিত্র বেশ কয়েকদিন থেকে মনের রোগে শীর্ণ দশায় পরিণত হয়েছে। সেদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ হঠাৎ একটা কল ঢুকলো অরিত্রর দামি হ্যান্ডসেটে। নাম্বারটা দেখেই মুখখানা তার আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠল। নতুন প্রেম, নতুন অনুভূতি এ সবকিছু মিলিয়ে তার মনটা বেশ খুশীর স্বর্গরাজ্যে বিরাজমান হতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চলল তাদের নতুন প্রেমের মিষ্টি কথা।পিছন থেকে মায়ের ডাক তার কানের পাশাপাশি ঘোরাঘোরি করলেও কিছুতেই তার কর্ণকুহরে ঢোকার সাহসটি দেখাতে পারলো না। এমনটাই হয় প্রথম প্রথম সকলের ক্ষেত্রে।

            বয়স অল্প, সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পা রেখেছে। সে যা হবে হোক পড়াশোনাটা বেশ মনোযোগ সহকারেই করে অরিত্র। স্কুলের মধ্যে নামকরা ছেলে ।ফোন করতে করতে হঠাৎ একটা বিষাদের করুন অনুভূতি তার মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে ফোনটা নিজের অলক্ষ্যে হাত থেকে নামিয়ে বাইরের জানলা দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পুনরায় রিং শুনে তার ধ্যান ভাঙলো। অনেকবার রিং বাঁচতে দিল স্বেচ্ছায়। হয়তো কলটা সে রিসিভ করতে দ্বিধান্বিত করছিল। শেষমেষ কলটা রিসিভ করতেই হল ভালোবাসার টানে। বেশ রাগান্বিত উচ্চৈঃস্বর---কি হলো উত্তর দাও আমার প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো সারারাত। তুমি আসবে কিনা বলো ? অনিচ্ছা সত্ত্বেও অরিত্রর কন্ঠ থেকে হালকা সর বেরিয়ে এলো---বেশ ঠিক আছে আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো। তুমি ওখানেই থেকো, আমি সব ব্যবস্থা করছি। ওপার থেকে শোনা গেল বেশ রাখছি তবে দেরি করো না যেন। কথা শেষ হতে না হতেই অরিত্রের কপাল থেকে বেরিয়ে এল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু। সেদুম করে বসে পড়ল খাটের উপর। বেশ চিন্তিত চেহারার স্পষ্ট প্রকাশ। হঠাৎ বলে উঠলো না না আমাকে যেতেই হবে নইলে ওর চরম ক্ষতি হতে পারে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।

           ঘোর অমাবস্যার রাত। বর্ষাকাল। সে বছর বর্ষার জলে চারদিক থৈ থৈ করছিল। রাস্তা, মাঠ-ঘাট সবেতেই বর্ষাকালের বলিষ্ঠ লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অরিত্রর বাড়ি থেকে কল এলো আমার কাছে। অনেকটা আপন মনের বন্ধু তাই উনি ভাবলেন হয়তো সে আমার বাড়িতে আসতেই পারে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সব ঘটনা বললেন আমাকে। বুঝতে পারলাম সব কথা, তবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না সে কোথায় পালিয়ে যেতে পারে। মনে মনে একটা চিন্তা করার পর মাথায় এলো সঠিক সম্ভাবনা। বোধ করতে পারলাম কয়েকদিনের প্রেমের আকর্ষণ'ই অরিত্রকে বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য করেছে। ওর মায়ের কথা রাখতে কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়লাম বন্ধুর খোঁজে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে একটু একটু। তবে বৃষ্টির চরম ক্ষমতা এখন অনুভব করতে পারলাম না। হালকা টিপ টিপ বৃষ্টির শব্দে চারিদিক প্রায় জনশূন্য অবস্থা। বেরিয়ে পড়লাম বাইক নিয়ে। সম্ভাবনাময় সেই স্থানের উদ্দেশ্যে যে স্থান যেতে হলে পেরিয়ে যেতে হবে লোকমুখে শোনা ভয়ঙ্কর রাস্তা। রাত্রিবেলা সেস্থান নাকি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

           কয়েকদিন আগে অরিত্রর সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম ও সেই মেয়েটির জন্য সবকিছু করতে পারে। আমার অনুমান অবশ্যই ঠিক হতে চলেছে। বুকে একরাশ আশা নিয়ে এবং ওর মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে যে কাউকে ডেকে নেব সেকথাও মুহূর্তের জন্য মনে হলো না আমার। অরিত্র ফোনটা সুইচড অফ ছিল তাই ওকে কল করার বৃথা চেষ্টা করলাম না। বন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পেরিয়ে গেছে রাস্তাটি। অচেনা অজানা মানুষ এই রাস্তার মধ্যে রাত্রিবেলায় আটকে পড়লে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে পড়বেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাত্রি খুব ঘন নয় তবু অমাবস্যা ও বর্ষণের কারণে যেন মনে হচ্ছে অনেক রাত্রি হয়ে গেছে। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার বাইকের হেডলাইট টা হঠাৎ অফ হয়ে গেল।গাড়ির গতি খুব বেশি না থাকার কারণে এবং ভাগ্যজোরে সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম আমি। টালমাটাল অবস্থায় অন্ধকার বিভীষিকার মাঝে যেন চোখে সর্ষে ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না তখন। মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে আমি যেন মৃত্যুপুরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর কিছুটা দূরে সেই ভয়ংকর স্থান, যে স্থানের কথা অনেকের মুখে শুনেছি পূর্বে। সেখানে নাকি দিনে রাতে ভুতের ছেলেপিলেরা নাচ গান নৃত্য ইত্যাদি করে। শুনতে বেশ হাস্যকর মনে হলেও বাস্তবে সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমি মনের মধ্যে সেই সংশয় এবং সেই ভয়টা উপলব্ধি করতে পারছি।

               বৃষ্টির বর্ষণ আরো জোরে শুরু হলো। কোনরকমে দাঁড়িয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ হয়েছে, বেশ কয়েক সেকেন্ড দীর্ঘশ্বাস পড়েই যাচ্ছিল আমার, শান্তির দীর্ঘশ্বাস। অন্ধকারে বাইক নিয়ে যে অবস্থা হচ্ছিল সে আর বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। মোবাইল কাছে থাকলেও সেটা পকেট থেকে বের করার সাহস পাচ্ছিলাম না তখন। টুলবক্স থেকে রেনকোর্ট বের করে নিজের শরীরটাকে ঢাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগে আমার সম্পূর্ণ শরীর ভিজে গেছে। মাঝরাস্তায় থেমে গেছি আমি। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহস করলাম বাইকটা। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা কালো বিড়াল রাস্তা ক্রস করলো বাইকের সামনে দিয়ে। এখন আমি কি করি ? এই জায়গায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা আমার নেই। হ্যাঁ এই জায়গাটা হল সেই জায়গা যে জায়গাটার ভীতি মনের মধ্যে সুপ্ত ছিল। সারা দেহ সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলো। মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো কে বেশি ভয়ঙ্কর বিড়াল নাকি ভূত ? সারা দেহের লোম খাড়া হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। মনে এটাও ভাবতে শুরু করলাম বিড়ালটাই ভূত নয়তো ? নিজের অবস্থিতি লক্ষ্য করে দেখি আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা ব্রিজের উপর আর শ্মশানটা তার ডান পাশে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চোখ বন্ধ করেরাম নাম জপতে শুরু করলাম। পাশে কেউ কোথাও নেই। পাশাপাশি গ্রামগুলো প্রায় দুই কিমি দূরে। সেই মুহূর্ত ভোলার নয়। বন্ধুর কথা সেই মুহূর্তে আমার মাথা থেকে হারিয়ে গেল। গোলকধাঁধায় এসে গেলাম এই কথা ভেবে ভেবে আমার শরীরের হাড় কথা না ঠান্ডা বড় হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণের জন্য নিজের শরীরটাকে উপলব্ধি করতে পারলাম না, মনে হলো আমি শূন্যে ভাসছি।

                বাইকের লাইট জ্বলছে, আমি প্রাণে সাহস নিয়ে একটু এগিয়ে চলার চেষ্টা করলাম। গিয়ার ফেলতে না ফেলতে সামনে হঠাৎ একটা সাদা কাপড় পরিহিত কেউ যেন ব্রিজের নিচে নেমে গেল। তারপরে শুরু হলো সেই ভৌতিক কান্না। বিকট আওয়াজ। আমি কানে আঙুল দিলাম তবুও সে আওয়াজ আটকে রাখতে পারলাম না। মনে মনে স্থির করলাম আজকে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যুর আগে অন্তত শেষ চেষ্টা করে দেখি। ভূতের হাত থেকে রক্ষা পায় না পায় ভূত দেখে তো মরতে পারবো। কে যেন হঠাৎ আমার মনে সাহস যুগিয়ে দিল। চল এর রহস্য উদঘাটন করে ছাড়বো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাইকের লাইট বন্ধ করুন। স্ক্রিনের ব্রাইটনেস ফুল করে ওই আলোতে ব্রিজ কোর্স করলাম হাঁটতে-হাঁটতে। ভূত আমাকে দেখতেই হবে। মনে মনে এটাও ভাবলাম এর মূলে কোন রহস্য থাকতেই পারে। বৃষ্টি এতটাই বেড়ে গেল যে বৃষ্টির শব্দে কোন কিছু শোনা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে সেই কান্নার আওয়াজ আমার কানে এলো না। মোবাইলটাকে পলিথিন এর মধ্যে ভরে নিলাম। এরপর টুলবক্স থেকে টর্চ লাইট টা বের করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। আমি মরার আগে বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে এবং সাদা কাপড়ের রহস্যের আসল তথ্য জানতে এগিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে। সজোরে টর্চের আলো জ্বেলে ব্রিজের নিচে প্রবেশ করলাম। লাইটের আলোতে সেই সাদা কাপড়ের ব্যাক্তিটির আসল চেহারা আমার চোখে ভেসে উঠলো। মুখে মুখোশ লাগানো একটা মানুষ। আমাকে দেখেই সে পাথরের ঢিল ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে। কোনক্রমে মাথাটা নীচু করে ঢিল টাকে এড়িয়ে গেলাম। এরপর সে কোনরকম বৃথা চেষ্টা না করে পালাতে শুরু করলো। নদীর ধারে ধারে মাঠের রাস্তায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলো। আমি  কিছুক্ষণ পিছু নিলাম কিন্তু আর তার দেখা পেলাম না। আমি নিশ্চিত হলাম ওই ব্যক্তি কোন মতেই ভূত হতে পারে না। কারণ এই রাত্রিবেলা আমাকে একা পেয়ে কোন ভূত নিশ্চয় আমাকে ছেড়ে কথা কইতো না।

            ফিরে এলাম বাইকের কাছে। তাকিয়ে দেখি চারিদিকে কেউ নেই। বৃষ্টিটা অনেক কমে গেছে। আমার বুকে সাহসের সঞ্চার এতটাই বেড়ে গেল যে মনে হলো আমি পৃথিবীতে জয় করে ফেললাম, আমি রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছি। আমি আসল ভূত আবিষ্কার করতে পেরেছি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম আমি। হঠাৎ দেখি একটা কল এলো, রিসিভ করতেই শুনলাম অরিত্র বাড়ি ফিরেছে বাবা তুমি আর চিন্তা করো না। সেদিন রাতে আমি আর অরিত্রর চিন্তা না করে নিজের বাড়ি ফিরে এলাম। আমার অভিজ্ঞতার কথা সকলকে জানালাম। শুনে খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বলল বাহ তোর সাহসিকতার দম আছে।


                              সমাপ্ত















পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু