বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

আনরোম্যান্টিক


নিজের প্রোফাইল বায়ো তে "আনরোমান্টিক" লিখে সেভ করে নিজেই হেসে ফেললো অনুপম।সত্যি লিখলো কি?রাত জেগে তারা দেখা,বৃষ্টিতে ভেজা আর রুহির হাত টা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ঘণ্টার পর ঘন্টা গঙ্গার পাড়ে চুপ করে বসে থাকা দশ বছর আগের অনুপম এটা লিখতে পারতো কি?এটা ভেবেই হাসি পেলো?নাকি তার আড়ালে আরো অন্য কিছু ছিল?কে জানে?নিজেই নিজের প্রশ্নে অস্বস্তিতে পরলো অনুপম।কিছু কিছু সময় আয়নায় নিজেকেই অচেনা মনে হতে থাকে।সময় ক্রমশ থানা বসাচ্ছে চোখের কোণের সূক্ষ রেখায়।এটাও অবশ্য অনুপমের নিজেরই অবজারভেশন।চৌত্রিশ এর টল,ডার্ক,হ্যান্ডসাম,স্বপ্নালু চোখের কলেজ প্রফেসর অনুপম গোস্বামীকে উল্টোদিকের চোখেরা একেবারেই সে নজরে দেখেনা যদিও।কিন্তু প্রতিদিনই কলেজ থেকে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চশমাটা হাতে নিয়ে ও একটা করে নতুন রেখা আবিষ্কার করে।তার সাথে চুলের অলিতে গলিতে চিকচিকে রং ও চোখ এড়ায় না।একদিন মাকে বলেছিল ,"মা আমার চুল পাকছে"। ব্যস্ আর যায় কোথায়,এ সুযোগ মা ছাড়ে?গত দুবছর ধরে ঠারে ঠরে যে কথা বলছিল সেটাই সেদিন সশব্দে সামনে এলো,"সেইজন্যে ই তো বলছি,এবার একটা বিয়ে কর"।"আরে! চুল পাকার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক!""এই জন্যই তোমার সাথে কথা বলিনা,বিরক্তিকর"গজগজ করতে করতে লাইব্রেরির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছিল ও।এই একটাই ভালো লাগার জায়গা অনুপমের।বই ওর বাড়িতেও আছে,কিন্তু লাইব্রেরির নির্জনতা ওকে সবচাইতে বেশী টানে।ইদানিং মোবাইলের দৌলতে কেউ খুব একটা মাড়ায়নাও ওই রাস্তা,তাই আরো বেশিই সুবিধা।নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে রাখার একটা প্রবণতা অনুপমের বরাবরই ছিল,ইদানিং সেটা আরো বেড়েছে।মাঝে মাঝে মনে হয়,রুহি থাকলে জীবনটা হয়তবা অন্যরকম হতো!কে জানে?কি হলে কি হতো,আদৌ কি কেউ বলতে পারে?হয়ত এই নির্জন শান্তি টুকু ও থাকতোনা ওর।অথচ, ও জানে ওর সাথে কথা বলার জন্য,কত ছাত্রী,সহকর্মী,পরিচিতরা মুখিয়ে থাকে।হয়ত তারা ওকে বেশিই 'অ্যাটিটিউড পার্সন' ভাবে।কিন্তু নিজেকে খোলসে রাখাটা ও বড় বেশী অভ্যাসে পরিণত করে তুলেছে।দুএকবার যে সে খোলস থেকে বেরোতে চায়নি তাও নয়,কিন্তু সে অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।আজ এই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা অনুপমের হটাৎ' বায়ো ' পরিবর্তনের একটা বিশেষ বায়ু পরিবর্তন গত কারণ আছে বৈকি!একসপ্তাহ আগে হটাতই ফেসবুক খুলে চমকে গেছিলো অনুপম,ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে রুহি ম্যাডামের থেকে! অ্যাকসেপ্ট করতে দেরী করেনি অনুপম।আর তারপরই ইনবক্স, ইনবক্স থেকে হোয়াটসাপ,বিবিধ জমানো মান অভিমান ,কথা আবেগ পরিবর্তনের পর অবশেষে অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স!রুহি কানাডা থেকে ফিরে আসতে চায় ওর কাছে,আবার সেই পুরনো দিনের ফিরে যেতে চায়,শুরু করতে চায় নতুন করে!না অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স এখানে নয়, এতো অনুপমের স্বপ্ন সত্যি হবার চাইতেও বেশী কিছু।এতটা ভালোবাসা আর চাওয়া জড়িয়ে ছিল রুহিকে ঘিরে যে, যে কোনো সময় যে কোনো ভাবে ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারে অনুপম। ও ঠিকও করে ফেলেছিল,বাড়িতে কথা বলবে।আসুক রুহি,ওকে সসম্মানে কাছে আনবে অনুপম।কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে,প্রবাদ ত প্রবাদ নয়, সত্যির ও পরকাষ্ঠা।পাঁচবছর পর,গতকাল রানা মানে রনেন্দু র ফোন দেখে ও দ্বিগুণ অবাক হয়েছিল। রণেন্দু বিদেশে বহু বছর।কোনো যোগাযোগ নেই।ফোন নম্বরটা চেনেওনি,পরিচয় যখন দিয়েছিল,কয়েক সেকেন্ড ভাবতেও পারেনি অনুপম।"রানা! ও মাই গড!কি মনে করে? "নাম্বার অনুপমের পাল্টায়নি গত অনেকবছর।তাই সেটা ছিলই রানার কাছে। কিন্তু ফোন আসেনি।কি সব হচ্ছে আজ কাল!নিজের মনেই অবাক হচ্ছিল অনুপম।"শোন,আজ যা হয়েছে,তাতে তোকে ফোন না করাটা অন্যায় হতো"বলে শুরু করলো রানা।"আমি এখন কানাডায়,তোর নম্বর ছিল আমার পুরনো ফোনে,দরকার পড়েনি,আর সময়ও পাইনি।"বরাবরই খুব সোজাসুজি কথা বলে রানা,অনেকে পছন্দ না করলেও,রানার এই স্বভাবটা র জন্যই অনুপম ওকে এত পছন্দ করতো।"তোর রুহি ম্যাডামের পাশাপাশি থাকি আমি,নিজেও জানতাম না,ঘটনাচক্রে জানলাম।"কান ক্রমশ গরম হচ্ছিল অনুপমের।"তার হাই পেইড চাকুরে স্বামী(একটু বেশিই টেনে বললো শব্দটা রানা)রিসেশন এ চাকরি হারিয়েছেন,গত দুমাস,অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল,সেই সুযোগে রুহি ম্যাডাম এক প্রবাসী পাঞ্জাবী ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন,এখন তিনি বিবাহিত,যথারীতি বুঝতেই পারছিস,"বলে একটু দম নিলো রানা।অনুপমের ভিতরে তীব্র জলপ্রপাতের শব্দ ওর কান অবধি পৌঁছলনা যদিও।রানা বলে চললো,"হাই লাইফস্টাইল ওকে পাগল করে তুলেছে,যে কোন মূল্যে ওর চাই সব।আমার বলতেও খারাপ লাগছে এরকমও শুনেছি, সী ইজ নাউ এঙ্গেজিং ইন এসকর্ট সার্ভিস।"কানের মধ্যে বোমা ফাটলেও এরকম হতো কিনা সন্দেহ অনুপমের।রানা থামবার পাত্র নয়,বলে চললো,"আজ আমি এটাও শুনলাম, ও কোলকাতা ফিরবে,দেখ তোর ঘাড়ে চাপার চেষ্টা করতে পারে,বলা যায়না!এখন তো তুই কলেজ প্রফেসর,বইয়ের রয়ালিটি ও কম কিছু নয় তোর!সব খবরই রাখি ব্রাদার।"হা হা করে হাঁসে রানা।তারপরই বেশ সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বলে,"আমি জানি তুই কতটা ভালোবাসিস রুহিকে,সাত বছর আগে,তোর যা যা হয়েছিল,কিছুই ভুলিনি আমি,নিজের ভালোথাকার জন্য যারা সব করতে পারে তাদের থেকে দূরে থাকাই ভালো,আমার মনে হলো তোকে সাবধান করা দরকার,তাই ফোন করলাম,ভুল বুঝিসনা"।অনুপম কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।থেমে থেমে কোনরকমে বলেছিল,"হুম্"।তারপর ফোনটা কোনো ভনিতা না করেই কেটে দিয়েছিল।সারারাত এরপরও ভেবেছিল,যাই হোক রুহিকে অ্যাকসেপ্ট করবে ও,ভুল মানুষই করে,কষ্টে আছে রুহি,ওকে অনেক ভালো রাখবে অনুপম।কিন্তু ভোরবেলায় হোয়াটসঅ্যাপের ঘন্টির সাথে রুহির যে ভয়েস মেসেজটা এলো,সেটা সব অনুভূতিকে এক লহমায় ছিড়ে ফেললো,খুব আদুরে গলায় রুহি বলেছে,"শোননা অনি,আমরা তোমাদের বাড়িতে থাকবনা,আলাদা ফ্ল্যাট নেবো,তোমার তো এখন অনেক টাকা,এটুকু তো করতেই পারবে?কি পারবে না!"এরপর সব কিছুর সাথে গত বহু বছর,মাস, ঘণ্টা,ধরে বয়ে নিয়ে আসা ভীষণ রোম্যান্টিক,ভালোবাসায় বিশ্বাসী মানুষটাকে ডিলিট করে বায়ো টা বদলাতে সময় নেয়নি অনুপম।ব্লকিং, ডিলিটিং এর মত প্রগাঢ় কাজগুলো সেরে অনুপম যখন বাইরে এলো,বৃষ্টির পর কনেদেখা আলো ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ,আর ভিতর থেকে ডিলিট হওয়া অনুপম কোথা থেকে যেনো ভিজে নারকেল পাতার মতো সপসপে উজ্জ্বল হয়ে আবারো, হবো না হবো করেও মুগ্ধ হয়েই গেলো।

সমাপ্ত
✍️ সুণীপা

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু