বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

আঙুলে আঙুল রাখলেও

হ্যালো!

হাই!

চলো।

কোথায়?

লং ড্রাইভে।

এ...খ...ন?

হ্যা... জলদি তৈরি হয়ে নাও। বিকেল হয়ে আসছে। ঠান্ডা ঠান্ডা দিন। বেশ রোমান্টিক ওয়েদার কিন্তু... দারুন লাগবে। আমি আসছি তোমায় পিক আপ করতে।

 

            অরিন্দম আর রূপসার বাঙালি এসোসিয়েশান এর একটা পিকনিকে তাদের প্রথম দেখা। তারপর ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করা থেকে শুরু হয় আলাপ। দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত, সুচাকুরে। অরিন্দম স্থানীয় ছেলে। অতিরিক্ত জেলাশাসক। রূপসার বাবা মা চাকরি সূত্রে থাকেন দিল্লীতে। রূপসার পড়াশোনা থেকে চাকরির শুরু ওখানেই। এখানে কোনো এক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করতে এসেছে বছর খানেক হলো। এমনি প্রাণচঞ্চল হলেও কাজের ব্যাপারে পুলিশে চাকরি বলেই কথায় খান্ত দেয়।

 

            ধানী সবুজ পাড় ওয়ালা গাঢ় নীল শাড়ি, হাতে রূপালী কঙ্কণ, চোখে আলতো কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর কানে ছোট্ট ছোট্ট দুটি রূপোলী ঝুমকো দুল। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশ সেজেছে রূপসা! গমরঙা উজ্জ্বল ত্বকে, আজকের সাজ আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটেই হাসি খেলে গেলো অরিন্দমের প্রতিক্রিয়ায় কথা ভেবে।

            

             অরিন্দমের গায়ের রং খুব একটা ফর্সা না হলেও ওর পেটানো শরীর আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, হালকা সবুজ পাঞ্জাবীর সাথে ব্লুডেনিম, হাতে বড় ডায়েলের রূপোলী ঘরি আর সানগ্লাসে অন্যান্য দিনের চাইতে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছিলো আজকে। অরিন্দমের গাড়ি নিয়ে রূপসাকে পিক আপ করতে এলে দু'জনেই দুজনকে দেখে মুগ্ধ।

 

              পৌঁছতে ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। তাই বিকেলের অনেকটা আগেই বেরিয়ে পড়ে ওরা। পশ্চিম আকাশে সূর্যের মুখোমুখি ঝিরঝির বাতাসের বুক চিরে, অনেক ক্ষন ধরে ছুটে চলে তাদের গাড়ি হাইওয়ে ধরে। বেশ কিছুটা দূর এগিয়ে যাওয়ার পর গাড়িটা রাইটটার্ন নিয়ে উত্তর দিকের একটা সরুরাস্তা ধরে চলতে থাকে গাড়িটা কখনো সোজা কখনো আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। জায়গাটা একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম মনে হচ্ছে। পথের দুধারে ক্ষেতখামার ভরে আছে নানা রকমের সবজি ফুলে ফলে। বেশ খানিকটা গিয়ে ওরা থামে একটা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের কাছে। আজ এসেছে ওরা "শনবিল" ঝিলে, দু'জনে মিলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। শনবিল ঝিলটা মাঠের আরেক প্রান্তে। গাড়ি থেকে নেমে একটু চা আর টুকিটাকি কিছু খেয়ে নেয় ওরা গ্রামের একটি গুমটি দোকান দেখে।

 

             সূর্যাস্ত এখনো বেশ কিছু সময়ের অপেক্ষা। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করেছে মাত্র। মাঠভরা কাঁচা ধানের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঢেউ খেলানো বাতাস, অল্প দূরের পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফিরে এসে আবার ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। রূপসার মুখের চুল শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করে অরিন্দমের পাঞ্জাবিতে দোলা দিয়ে চলে যাচ্ছে আপন মনে। আলবেয়ে দুজনেই এগিয়ে চলেছে হাতে হাত রেখে, প্রজাপতির মতো। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, হেঁটে যেতে যেতে পৌঁছে যায় একসময় ঝিলের ধারে।

      

            এখানে আসার কথা অনেক দিন ধরেই ভাবছিলো ওরা। আজ আসতে পেরে তাই খুব ভালো লাগছে ওদের। সারা সপ্তাহের কর্মব্যস্ততার কারণে এভাবে সময় কাটানোর উপায় খুব কমই বেরোয় ওদের। ঝিলের ধারে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল, আর নানা রকমের পরিযায়ী পাখির সমারোহ! রূপসা তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করে চারদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য আর অরিন্দম উপভোগ করে রূপসার আনন্দ।

       

             ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। একটা নৌকার মাঝিকে ডেকে কথা বলে, তাতে প্রথমে উঠে অরিন্দম, তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় রূপসার দিকে। অরিন্দমের হাতে হাত রেখে রূপসা চড়তে যেতেই ঈষৎ দুলে উঠে নৌকাটা। ভয়ে, উঠেই অরিন্দমকে জাপ্টে ধরে রূপসা। রূপসার মাথায় হাত বুলিয়ে আস্বস্ত করে ভয় কাটানোর চেষ্টা করে অরিন্দম। কিছুটা সামলে নিয়ে, দুজনেই বসে পড়ে খুব সাবধানে নৌকার পাটাতনের উপর। তারপর পরম নিশ্চিন্তে অরিন্দমের কাধে মাথা রাখে রূপসা।

 

         মাঝি দাঁড়ে টান দিলে, ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে হেলে দুলে চলতে থাকে নৌকা সামনের দিকে। যেতে থাকে এগিয়ে ধীরে ধীরে। ঝিলটা আজ প্রায় অনেকটাই ফাঁকা। মাঝি ছাড়া ঘুরতে আসা মানুষজন কেউ তেমন নেই বললেই চলে। এই ফাঁকা পাবার জন্যই তারা সপ্তাহের মাঝামাঝি এই ছুটিটা নিয়েছিলো। নৌকা যখন ঝিলের প্রায় মাঝখানে, তখন খানিক দাঁড় টানা বন্ধ করে কিছুটা সময়ের জন্য নৌকাটাকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করে মাঝি।

 

         অরিন্দম আর রূপসা দেখে‌, গোধূলির আলো মাখা জলের উপর ভেসে বেড়ানো মাছের ঝাঁক। আকাশ জুড়ে আপন কুলায় ফিরে চলা উড়ন্ত বলাকাদের ঝাঁক। আশে পাশের গাছগুলো তখন কিচির মিচির শব্দে মুখর। ঝিলের সীমান্তে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ওরা। আপন মনে গান ধরে রূপসা, অরিন্দম গলা মেলায় তার সাথে।

 

        জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। এবার ওদেরও ঘরে ফেরার পালা। মাঝিকেও নৌকা ভেড়াতে হবে ঘাটে। ঘাটে ফিরে নৌকো থেকে নামতে আবার সেই ভয়। শাড়ি সামলে নামতে গিয়ে টালমাটাল অবস্থা। অরিন্দম রূপসার হাত দুটো, শক্ত করে চেপে ধরে সাবধানে নামায় তাকে।

 

            এতক্ষণ যে মেঘ সূর্যের সাথে খেলা করছিল হঠাৎই ঝরে পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টি ধারায়। আচমকা বৃষ্টিতে হতচকিত দুজনেই ঝটপট আশ্রয় নেয় একটা গাছের নীচে। ততক্ষণে ভিজে গেছে রূপসার শাড়ির নিচের অংশ। গাছের নীচে রূপসার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে অরিন্দম। অরিন্দমের ভেজা চুল পরম যত্নে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে থাকে রূপসা।

 

               মেঘ কাটিয়ে ততক্ষণে তারাদের নিয়ে আকাশ দখলে নেমে পড়েছে পূর্ণ চাঁদ। সম্ভবত পূর্ণিমা। আকাশ থেকে তারই ছটা এসে পড়েছে জলে স্থলে! রূপোলী আলোয় গাছের ছায়ায় দুটো ভালোবাসার মানুষ স্বপ্ন বুনে তাদের সোনালী দিনের। বর্তমান আর ভবিষ্যতের সংঘাতের শুরু হয়তো সেখানেই হয়েছিল তাদের অজান্তেই। সেদিন রূপসার বুকের কাছ থেকে ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধ মাতাল করতে থাকে অরিন্দমকে। রূপসার এলোমেলো ভেজা চুল অরিন্দমের মুখ ঢেকে পূর্ণিমার রাতে এনেছে অমাবস্যার ঘোর। অরিন্দম একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রূপসার মায়াবী কাজলা চোখের দিকে। তার দৃষ্টি আবেশ মাখায় রূপসার মনের গভীরে। রূপসা আস্তে আস্তে মুখটা নামিয়ে এনে অরিন্দমের ঠোঁটে আঁকে একটা দীর্ঘ চুম্বন।

       

          এলার্মের শব্দে কেঁপে ওঠে রূপসা। চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। ফোনটা রেখে দেয় সাথে সাথে। মনে মনে বলে, "পুরনো স্মৃতি আর হাতরে লাভ নেই।" আজ যে আর বেশী চলাফেরা করতে পারে না সেদিনের সেই প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা। সেদিন ফেরার পথে ঠিক করেছিলো তারা পুজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আলাপ করবে পরিবারের সাথে একে অপরের ব্যপারে।

 

              ভাগ্যের কি পরিহাস! বাড়ি ফেরার সময় একটা ভয়ঙ্কর গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রূপসা। তাতে অনেক দিনের জন্য কোমাতে চলে যায় সে। তারপর সুস্থ হলেও পা'দুটো অবস (প্যারালাইসিস) হয়ে যায় রূপসার। সেদিন ওই এক্সিডেন্টে ফোন নাকি ভেঙে চৌচির হয়ে গেছিলো। বাড়িতে কেউ অরিন্দমের ব্যপারে না জানাতে তাকে জানানোর প্রশ্নই উঠেনা। অরিন্দমের ও যোগাযোগ করার অবকাশ থাকে না। তারপর জ্ঞান ফিরতে নিজের এই অবস্থা দেখে নিজে ইচ্ছে করেই আর যোগাযোগ করেনা অরিন্দমের সাথে। বদলে নেয় সীম।

না অতীত না ভবিষ্যত, সমর্পণ করে নিজেকে বর্তমানের কাছে।

 

             অনেক চিকিৎসার পর এখন সে দাঁড়াতে পারলেও হাঁটতে পারেনা তেমন ভাবে কিছুতেই। ভবিষ্যতে ও পারবে কি না জানেনা। তাই যোগাযোগের সম্পুর্ন বন্ধ করতে হারিয়ে যেতে যায় পরিচিতির বাইরে।  কোয়ার্টার ছেড়ে অন্য শহরে চলে যায় রূপসার মা বাবা তাকে নিয়ে। মনে মনে ভাবে, সেদিন অরিন্দমের আবদারে কপট রাগ দেখিয়ে বলা, 'আমি চলেই যাব' কপট অভিমানী কথাটা যে জীবনের সাথে এভাবে জড়িয়ে গিয়ে, ওকে অরিন্দম থেকে এতোটা দূরে করে দেবে, তা আজও ভাবতে কষ্ট হয় রূপসার।

 

             এপোড়া সংসারে সে যতই একা হোক, যতই কষ্ট পাক, পুরোনো বন্ধুকে মনে করা, যোগাযোগ করে মন ভুলানোর নাম এখন শুধুমাত্র বদনাম, পরকীয়া। অরিন্দম যে আজ বিবাহিত। দূরে কোথাও থেকে গান ভেসে আসে

" মনে পড়লেও

আজকে তোমায় মনে করা বারণ।

প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ,

আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ। তোমায় যতো গল্প বলার ছিলো...."

দুচোখ ঝাপসা হয়ে উঠে মুহূর্তে।

 

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু