বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সন্ধান


"আজ কত তারিখ ? " উত্তরটা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো প্রীতি।নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।ভীষণ অসহায় লাগছে ওর।ফোনের চার্জ শেষ,এতদিন অবধি ফোনটা বেজে ওঠার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতো,আজ মনে হচ্ছে কতদিন শোনেনি ও ফোনের রিং টোন টা।সমস্ত শরীর জুড়ে ক্লান্তি।না পেয়েছে খাবার কিছু,না পেয়েছে ঠিকঠাক পানীয়। দূর দূর অবধি ফাঁকা।কি শুনেছিল,আর কি দেখছে ও!কোন ছোট্ট থেকে যে গল্প শুনে ও বড় হয়েছে,আজ যেনো সবটাই মিথ্যে মনে হচ্ছে।কিন্তু .....না সব গুলিয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচদিন এ ওর হতাশা আর  বেড়েছে।আর এটাযে হিসাব মত পাঁচদিন,সেটা এইমাত্র তারিখটা শুনে বুঝলো।কে জানে আর সেটাও জানতে পারবে কিনা!

এতটা হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া টা কি ভুল হলো!হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে,এত হাঁটাও তো অভ্যেস নেই!প্রথমদিকে ওর পাটা ঠিক ঠাক পড়ছিলই না মাটিতে।কিছুক্ষন পর ধাতস্থ হোয়েছে,তাও সঙ্গে থাকা এই বিশেষ স্টিক টার জন্যই।ভাগ্যিস ওটা নিয়েছিল সাথে।একটু যে জিরোবে,তারও তেমন জায়গা নেই,অগত্যা পর্টেবেল স্ট্যান্ড স্টুল ই ভরসা।প্রীতি ব্যাকপ্যাক থেকে সেটা বের করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো,লিকুইড বেশ কমে এসছে।না এরপর ব্যাবস্থা না হলে, ও বেশিক্ষণ চলতে পারবেনা!হতাশ হয়ে বসে পরলো প্রীতি।রোদ্দুর বেড়ে চলেছে,এরপর ও কি করবে!একটু মাথা গোঁজার জায়গাও নেই,নিজের শীপে পৌঁছিয়ে যাবে,তারও কোনো উপায় নেই।আর পারছেনা চলতে!

প্রীতি ভাবতে থাকলো,ওর বাড়িতে সবাই ভীষণ চিন্তা করবে,বিশেষত ঠাকুমা।প্রীতি ওর ঠাকুমার সাথেই থাকে। ঠাকুমাই ওকে এই নামটা দিয়েছে। নয়ত,এ নাম ওর হবার কথা নয়।এমনিতেই,ঠাকুমা সবার থেকে আলাদা, যার জন্য ওর পরিবারও,প্রীতির চেহারায় ঠাকুমার সাদৃশ্য পুরোমাত্রায় চোখে পড়ে।যদিও ইদানিং বিষয়টা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।ঠাকুমার কাছে তার নিজের অভিজ্ঞতা যা শুনেছে,বিশেষত বাবা হবার পর,এখন তা অনেকই স্তিমিত।যদিও দাদু খুব উচ্চশ্রেণীর হওয়ায়,অনেকটাই সুবিধা হয়েছিল।প্রীতির বাবা মা একটা দূর্ঘটনায় মারা যাবার পর ঠাকুমাই ওর সম্বল।ঠাকুমার কাছ থেকে শুনে শুনে,ওর মনে হত,দেখতেই হবে ওকে সব নিজের চোখে। কিন্তূ এত বিধিনিষেধ,ঘেরাটোপ পেরিয়ে তা অসম্ভব ই ছিলো। কিন্তূ সেটা সম্ভব করবে বলেই ও জিরার সাথে সম্পর্ক টা গড়ে তুলেছিল।যদিও দুজনে একদমই আলাদা।জিরা পিওর, কিন্তূ প্রীতি তা নয়।তবুও সম্পর্কটা হয়েছিল।ইদানিং সব কিছুই অনেক ওপেন। জিরার থেকে ও সব কিছু অ্যারেঞ্জ করেছে।যদিও জিরা ওর আসল উদ্দেশ্য জানতো না। কিন্তূ এত কান্ড করে লাভ কি হলো? ও কি ভুল জায়গায় এসে পড়লো?না!তাও তো না!ওর হাতের গেজেট তো তা বলছেনা!দিন খনের হিসাব তো ঠিকই মিলছে! ও আর ভাবতে পারছেনা। সূর্যের প্রখর তাপ ওকে কিছুই ভাবতে দিচ্ছেনা।মাথাটাও কেমন যেনো করছে,চোখ মুখে ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে।

চোখ খুলতেই প্রীতি দেখলো, ও একটা রেস্টিং সেন্টারে শুয়ে আছে।ঠাকুমা,জিরা,আরো অনেক অচেনা মুখ ঝুঁকে আছে ওর উপর।উঠে বসলো প্রীতি কিন্তু ভীষণ দুর্বল। জিরার দিকে তাকিয়ে ওর ভিতরটা ধক করে উঠলো।ওর জন্য জিরাকে কঠোর শাস্তি পেতে হতে পারে।ঠাকুমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তার কাছেই শুনলেন,স্পেস শিপের গতিবিধি বিচার করে,আর ডাটা অ্যানালাইসিস করে ওর শিপ ত পাবার পর বিশেষ টিমদিয়ে খুঁজে বের করা হয়েছে ওকে।জিরার বাবা ছেলেকে বদনামের থেকে বাঁচাতে এতটা দায়িত্ব নিয়েছেন।তিনদিন পর এনকোয়ারী কমিটির সামনে প্রীতির ডাক পড়লো।মাথা নিচু করে বসলো প্রীতি।উল্টোদিক থেকে প্রশ্ন এলো," সবটা বলো,কোথায় গিয়েছিলে?কেনো গিয়েছিলে?"।প্রীতি ঠিক করেছিল,আজ ও সব বলবে।মাথা নিচু করেই বলতে শুরু করলো," ছোট্ট থেকে ঠাকুমার কাছে শুনেছি পৃথিবীর গল্প,গাছ,রামধনু,পাখি,মানুষ সব।কিন্তু ওর পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না।বাবা মা থাকলে হয়ত সম্ভব হতো। কিন্তূ,সেটা তো হবার নয়।" একটু থেমে বলতে লাগলো," জিরার কোনো দোষ নেই, আমি ত ওর আধুনিক স্পেস শিপটা নিয়েছি,না বলেই।"সব কিছু খুলে বলা সত্ত্বেও বিষয়টা এতো সহজে মিটলো না।জিরার স্পেস শিপের লাইসেন্স বাতিল হলো।প্রীতির ঠাকুমার বিশেষ আবদনে সাজা মুকুব হলো ঠিকই, কিন্তূ পাঁচদিন নিখোঁজ থাকা, ও স্পেস শিপ না বলে ব্যাবহার সহ বেশ কিছু অপরাধে,ওকে আগামী এক বছর গৃহ বন্দির নির্দেশ এলো,।" প্রীতির খুব বেশী দুঃখ ছিলনা,শুধু জিরার জন্যই যা কষ্ট হচ্ছিল।স্পেস শিপ চালাতে ওকে জিরাই শিখিয়েছিল।আর এত দামী স্পেস শিপ কেনার ক্ষমতা জিরার বাবার মত গুটিকয়েক লোকেরই আছে।কিন্তু যা শুনেছিল,পৃথিবীর সাথে তার কোনো মিল নেই।চারিদিকে খাঁ খাঁ ধূসর মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই।এরকম তো ঠাকুমার কাছে ও শোনেনি।ঠাকুমাকে দাদু বিয়ে করেছিলেন,একটা স্পেস মিট আপ এ আলাপ ও প্রেমের পর।যদিও তখন বিষয়টা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল। যার ফলে ও নিজে হাফ ব্লাড।বাবা মা ও ছিলেন বৈজ্ঞানিক,এক বিশেষ অভিযানে দুজনেই প্রাণ হারান। প্রীতিদের এই গ্রহে,সাধারণত দুর্ঘটনা ছাড়া কেউ মারা যায়না।স্বেচ্ছা মৃত্যু নেয় অনেকে,আজকাল এর হার খুব বেড়েছে। আসলে ওদের দিনের হিসাব টাও অন্যরকম।এখানের দশ দিনে পৃথিবীর একবেলা হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর একদিন এখানের প্রায় একুশ দিনের কাছাকাছি।
প্রীতির ঠাকুমার এই গ্রহ অনুযায়ী প্রায় হাজার তিনেক বছর বেঁচে,আর পৃথিবী হিসাবে দেড়শো বছর প্রায়।এর মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে পৃথিবীর,ক্রমাগত বাড়তে থাকা গরম,জলোচ্ছ্বাসে পৃথিবী থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে গেছে।চারিদিকে সব ধুধু প্রান্তর।এর মাঝখানে,দাদুর উপর ঠাকুমাকে বিয়ে করার অপরাধে স্পেস এ যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল।তাই আর যাওয়া সম্ভব হয়নি।দাদুও একটা দুর্ঘটনায় মারা যান।বাবা তখন  বেশ বড়।যদিও প্রীতি জন্মায়নি।ওর ভিতর মানুষ আর এই গ্রহের দুই ধরনের লক্ষণ ই বর্তমান।বিছানায় শুয়ে এইসব ভাবছিল প্রীতি।এমন সময় ঠাকুমা ঢুকলো খাবার  নিয়ে।
সব শুনে ঠাকুমার চোখেও জল।বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রীতি হয়ত অনেক কিছু হারিয়েছে, কিন্তূ অনেক কিছু পেয়েছেও।নিজের শিকড়কে একবার না ছুঁলে হয়ত ও ভিতরে অনেক কল্পনা বয়ে নিয়ে চলতো।

বাইরে একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো প্রীতি।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো জিরা।ওর নীল চোখ,সরু তীক্ষ্ম হাত পা,আর বেগুনি ত্বক,আর সাথে ছোট দুটো নাক আর কান।প্রীতির ক্ষেত্রে বিষয়টা চোখে পড়ার মতো আলাদা।গায়ের চামড়া অনেক ফ্যাকাশে,নাক,কান অনেক টা বড়।হাত পা বেশ সুডৌল।জিরাকে দেখেই প্রীতির বেশ ভয় হলো। ও ভেবেছিল,জিরা ওর মুখ দর্শন করবেনা।জিরা ধীরে ধীরে প্রীতির বিছানার পাশে বসলো,খুব কাছাকাছি মুখটা এনে বললো," খুব অন্যায় করেছ আমায় না জানিয়ে,একবছর পর কিন্তু আমিও যাবো সাথে,লাইসেন্স এর ব্যাপার টা আমার উপর ছেড়ে দাও।বাবা তো আছেনই। বলা যায় না অন্য কোনো জায়গায় সত্যি কিছু পেয়েও যেতে পারি"।জিরার দুষ্টুমি ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে প্রীতি এতদিনে সেটাই অনুভব করলো,যেটা কখনো ওর ঠাকুমা ওর দাদুর জন্য অনুভব করেছিলেন।
সুণীপা
সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু