বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

নষ্টপ্রেম



(এক)


"But when the melancholy fil shall fall

Sudden from the heaven like a weeping

Cloud,

That fosters the droop-headed flowers

all,

And hide the green hill in an April 

Shroud......" অপূর্ব স্বরে কোথাও বাজছে বাঁশি,কবি কিটসের সেই বিখ্যাত মেলানকোলি সং।চমকে ওঠা রাইসা খুঁজে চলেছে সেই অবাক করা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে।আজ তিনদিন হল সে এসেছে এই পাহাড়ি ছোট্ট শহরটায়,দু বছর হয়ে গেল নীলের সন্ধান নেই,তাকে খুঁজতেই এখানে আসা।দুবছর আগে নিজের করা ভুলের যে এত বড় শাস্তি পেতে হবে তাকে সে স্বপ্নেও ভাবেনি।সবই তো ঠিক ছিল,হটাত আসা ঝড় তছনছ করে দিল সবকিছু,ভেঙে দিল তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের আশ্রয়।আজও একটা তীব্র অপরাধবোধ কুরে কুরে খায় তাকে,তার জন্য শুধু তার জন্য একটা নিষ্পাপ ফুল অকালে ঝরেছে,আজও কানে বাজে নীলের মায়ের কথাটা,--"যদি আগলে রাখতে না পারবি কাছে এসেছিলি কেন?যদি কারো এককথায় নিজের ভালোবাসাকে ছাড়তে পারিস তবে উঁচু গলায় ভালোবাসার দাবীটা করিস না।" হ্যাঁ সে অপরাধী, অপরাধী নীলের পুরো পরিবারের কাছে,সব চেয়ে বড় অপরাধী নীলের কাছে।সব জেনেও তার নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত আজ সব সম্পর্কগুলোকে দাঁড় করিয়েছে খাদের কিনারায়।

আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা ধূসর মেঘের ভেলা,পাইন গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায়।পাহাড়ি রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে একটি ক্ষীণ পাহাড়ি ঝোরা,তার একপাশে একটি পাথরের ওপর বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন এক বৃদ্ধ পাহাড়িয়া মানুষ। পায়ে পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাইসা,চোখে নেমে আসা অশ্রুধারাকে ঠোঁট কামড়ে রোধ করার চেষ্টা করে প্রাণপণ। বাঁশি থামিয়ে বৃদ্ধ সরু চোখে তাকান তার দিকে,তারপর হাত ধরে আচমকা টেনে পাশের পাথরে বসান তাকে।অবাক রাইসাকে প্রায় বাকরুদ্ধ করে পরিষ্কার বাংলায় বৃদ্ধ শুধান,--"কাকে খুঁজতে আসা এই তেপান্তরে?"

--"আপনি বাংলা জানেন?আর জানলেন কিকরে আমি বাঙালি বা কাউকে খুঁজছি!!"

হো হো করে হাসলেন বৃদ্ধ,--"তোমার চেহারা বলে তুমি বাঙালি, আর উতকন্ঠিত চোখ মুখ বলে তুমি নিছক পর্যটক নও।একা কেউ এই পাহাড়ি শহরে ভ্রমনে আসেনা,আর বাংলা?আমার স্ত্রী বাঙালি ছিলেন,তার কৃপায় শেখা।"

--"ছিলেন মানে?তিনি এখন....."

--"নেই।আসলে মন ভরে গিয়েছিল তো তাই বিয়ের  তিন বছরের মাথায় হটাত তিনদিনের জ্বরে কিছু না বলেই চলে গেল।" দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ,হাত বাড়িয়ে অদূরে পাইনগাছের সারির দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন,--"ওইখানে শুয়ে আছে ও গাছের ছায়ায়।আগুনে খুব ভয় ওর,বলেছিল আমি মারা গেলে জ্বালিও না,শুইয়ে দিও মাটির নীচে ছায়াঘেরা বনবীথিতে,যেখানে রোজ খেলা করতে আসে মেঘের দল,সামনে পাহারারত স্বয়ং নগাধিরাজ। কথা রেখেছি আমি।" স্তব্ধ রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করেন বৃদ্ধ,অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রাইসা,কাউকে এতটাও ভালোবাসা যায় যে তার স্মৃতিতে এভাবে একটা গোটা জীবন.....!!তার মনের কথাটা হয়ত পড়তে পেরেছিলেন বৃদ্ধ,স্মিত হেসে তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,--"জীবনটা বড্ড ছোট জানো,ঝগড়া অভিমান এসবের পেছনে খরচ না করে ভালোবাসায় বাঁচো।আমার স্ত্রী বাঁশি শুনতে খুব ভালোবাসত,তাই আমি রোজ আসি তাকে বাঁশি শোনাতে,এভাবেই আসব নিজের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। "

হাত ছাড়িয়ে অপর দিকে হাঁটা শুরু করে রাইসা,চোখে নেমেছে অকাল শ্রাবন।শুনতে পায় বৃদ্ধের স্বর,--"তুমি বললে না তো কাকে খুঁজতে এসেছ এখানে?" বাঁধ ভাঙা চোখের জলকে আটকানোর বৃথা প্রচেষ্টা করতে করতে রাইসা জবাব দেয়,--"যদি কোনোদিন তাকে খুঁজে পাই নিয়ে আসব,প্রকৃতির কোলে স্থাপিত ভালোবাসার সমাধি দেখাতে।" উত্তরের অপেক্ষা না করেই হনহন করে হাঁটতে থাকে সে,ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।দূর থেকে আবার ভেসে আসছে মন কেমনের বাঁশির সুর,এক মৃত ভালোবাসার উদ্দেশ্যে এক প্রেমিকের চুড়ান্ত আত্মনিবেদন।এটাই তো সার্থক পূজার্ঘ,সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে মানুষের,আকাশের উদ্দেশ্যে মাটির,প্রকৃতির উদ্দেশ্যে পুরুষের।সন্ধ্যা নামছে মন খারাপের অন্ধকার জড়িয়ে,বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ।আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘকে সাক্ষী রেখে রাইসার একটাই প্রার্থনা,--"তুই ফিরে আয়।" অলক্ষে হয়ত হাসছেন বিধাতা,গম্ভীর পাহাড়গাত্রে জ্বলে উঠেছে অসংখ্য আলো, দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত সন্ধাপ্রদীপের ন্যায়।।


(২)


উত্তাল নিঃশ্বাসের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে বাইরে মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন, মুষলধারায় বৃষ্টি যেন অন্তহীন ছন্দে তাল মিলিয়ে চলেছে অজান্তেই। ঘরের ভেতরে শঙখ লেগেছে মানব - মানবীর, চাপা উচ্ছ্বাস শীৎকার হয়ে মিশে যাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত মাটিতে। 

দীঘল ছায়ার ওঠানামায় থমকে যাচ্ছে সময়, অবগুণ্ঠিতা কামিনীর লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে অন্ধকার..... তপ্ত প্রশ্বাস যেন অতিকায় ড্রাগনের গ্রাস হয়ে গিলে নিতে চাইছে ধরিত্রী। কম্পিত শয্যায় অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় ভেঙে পড়ছে আকাশ, নগ্নতার অদম্য সমর্পণে।


" রমণের পরেও যদি টান রয়ে যায়, ভেবে নিও ভালোবাসা বেঁচে আছে...!  কার লেখা লাইন বলতো? " রাইসার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল নীল।


--" জানিনা বাপু, অত কি আর মনে থাকে! আচ্ছা... আমার কিছু কথা আছে তোর সঙ্গে, মনেহয় আজকেই সব সেরে নেওয়া দরকার। " অবিন্যস্ত পোশাক সামলে উঠে বসতে বসতে বললো রাইসা।


--" এই সময়ে কথা বলতে নেই, শুধু মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে হয়। দেখো, কিরকম বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে.... এইই ভিজবে আজ! কত্তদিন হলো ভিজিনা তোমার সঙ্গে।" 


--" উফফ! আদিখ্যেতা বন্ধ কর, আমি এমনিতেই খুব টেনশনে আছি। সৌরিন ফিরে আসছে ইউকে থেকে, ওদের ট্যুর শেষ। আমাদের হয়ত আর দেখা হবে না। "


--" কি বলছো তুমি! তুমি যে আমায় বলেছিলে এবার সৌরিন ফিরলে তোমাদের ডিভোর্সের কথা বলবে! তুমি তো আর ওর সঙ্গে সংসার করতে চাও না!" 


--" থাম তুই ! পৃথিবীতে সমাজ বলেও একটা বস্তু আছে। তাছাড়া কোন দোষে ডিভোর্স দেব আমি সৌরিনকে! ফ্যামিলিকে কি বলবো!" খেঁকিয়ে ওঠে রাইসা।


--" এসব কি বলছো তুমি! ডিভোর্স দিতে পারবেনা! আমার কি হবে তবে! মাকে কথা দিয়েছিলে তুমি আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না; ভুলে গেছো!" গলা বেয়ে উঠে আসা কান্নাটুকু গিলে নিয়ে কোনোক্রমে বলে নীল। 


--" দেখ বাবু, আমার সব মনে আছে। কিন্তু সমস্যাটা কি জানিস! আজ যদি সৌরিনকে ছেড়ে তোর কাছে আসি, এ সমাজ ভ্রষ্টা বলবে আমায় ; তোকেও ছিঁড়ে খাবে। " সস্নেহে নীলের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলে রাইসা।


--" এসেছো তো তুমি আমার কাছে। এই ঘর....এই শয্যা....আমার সারা শরীরে তোমার গন্ধ লেগে আছে...অস্বীকার করতে পারবে তুমি? তবে কেন! " নীলের গলা বেয়ে যেন হাহাকার উঠে আসে।


--" অস্বীকার তো করিনি! তবে এসব এখানেই থামা দরকার। তোর জীবন আছে, আমারও। দুজনকেই ভালোভাবে বাঁচতে হবে৷ নিজের বয়সী কাউকে পেয়েই যাবি তোর জন্য একদিন, ততদিন নিজেকে তৈরী কর...সফল হ৷ " পোশাক ঠিক করতে করতে বলে রাইসা।


--" ওহহ, খিদে মিটে গেছে তাই ছেড়ে দিচ্ছো! এতদিন স্বামী - সংসার - সমাজ কারো কথা মাথায় আসেনি! আমি পুরোনো হয়ে গেছি তাইনা!" হিস্টিরিয়া রোগীর মত চিৎকার করে নীল, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে তার জলভরা দুই চোখ। 


--" কিসব বলছিস তুই! তোকে ছুঁয়েছি ভালোবেসেই, খিদে মেটাবার জন্য না....এটা তুই জানিস ভালো করেই। যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের দুজনের ভালোর জন্য, প্লিজ আমায় দুর্বল করে দিস না। ভালো থাক। " চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায় রাইসা।


--" শোনো! চলে তো যাচ্ছো....তবে মাথায় রেখো....একদিন তুমি নিজে আমায় খুঁজতে আসবে। আসতে তোমাকে হবেই! মাকে বলে দিও, তার নষ্টছেলে আর মুখ দেখাবেনা তাকে। তুমি আমায় ধ্বংস করে দিলে রাই.... ধ্বংস করে দিলে! " 


--" প্লিজ পাগলামো করিস না, বাড়ি যা। তুই অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করিস নীল, প্লিজ বোঝ একটু আমায়!" অনুনয় ঝরে পড়ে রাইসার গলায়।


--" কিচ্ছু শুনবো না, কিচ্ছু না! যাও তুমি, বরের সাথে সুখে সংসার করো। কিন্তু মনে রেখো, আমায় খুঁজতে তোমায় আসতে হবেই!"  রাইসার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়গলায় বলে নীল, কোথাও কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে....ঝলসে ওঠে আলো। 


(৩) 


দুবছর....সময়টা কম নয়। আজও যেন ছবির মত মনে আছে সবকিছু। কে জানতো, একটি একুশ বছরের ছেলের ভেতর এতটা জেদ, এতটা দৃঢ়তা থাকতে পারে! রাইসা আজও ভেবে পায় না, কিকরে হয়ে গেল এসব! 


পরিবারের কথায় নীলকে ছেড়ে সৌরিনের কাছে ফিরলেও সংসারটা করতে পারলো কই! কেমন যেন অপরিসীম শূন্যতা গ্রাস করে রেখেছিলো অন্তঃকরণ, কিছুতেই যেন সহজ হতে দেয়নি তাকে। তারপরেই একদিন ঝড়টা এলো, আর তার অভিঘাতে একলপ্তে তুচ্ছ হয়ে গেল সমাজ - সংসার, গৃহিনীকে দাঁড়াতে হলো পথে....নিখোঁজের বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেল শহর। 


" আর অভিমান করিস না, ফিরে আয় প্লিজ! তোকে তোর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমার শান্তি....অনেকতো শাস্তি দিলি....আয় না ফিরে! " রাইসার চোখ বেয়ে জল গড়ায়.....প্রায়শ্চিত্তের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে একটি মেয়ে অনায়াসে নদী হয়ে যায়। 


*            *             *          *       *


পাহাড়ের মেজাজ বোঝা ভারী মুশকিল। কখনো মেঘ - কখনো বা রোদ্দুর। বৃষ্টিকে বড্ড ঘৃণা করে ছোটু, তারচেয়ে বেশি ঘৃণা করে ওই বাঁশিওয়ালা বুড়োটাকে। কেমন আদেখলার মতো বউ এর কবরে বসে প্যাঁ প্যাঁ করে বাঁশি বাজায়, কতবছর হয়ে গেল... বদলে গেল ঋতু....নিয়ম বদলালো না বুড়োর! 


সারাদিন কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে ওঠে ছোটু, হলোই বা দুই লোকের সংসার...কাজ কিছু কম আছে নাকি! বুড়োর গেস্টহাউজের গেস্টদেরও দেখাশুনো করতে হয় , আলাভোলা বুড়োকে কবরের পাশ থেকে তুলে এনে দুমুঠো গেলাতে হয় তাকেই। 


মাঝেমধ্যে সে ভাবে, কিকরে একজন মানুষ ভালোবাসার মৃত্যুর পর তার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে গোটা জীবন বেঁচে নিতে পারে! কই সেতো পারেনি এই দুবছরে বাঁচতে! প্রতিপদে মৃত্যু চাইতে চাইতে হয়ত বাঁচতেই ভুলে গেছে সে, কিন্তু এই বৃদ্ধকে দেখো! বাঁশি বাজিয়ে তোফা আছে! 


আনমনে বৃদ্ধের ঘর গোছায় সে, বিছানার টানটান চাদরটা আরো একবার টেনেটুনে পাতে। দেওয়ালে ঝুলছে এক কমবয়সী মেয়ের ছবি, হাসিহাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে তার বহুদিন আগে ফেলে যাওয়া সংসারের দিকে। এ সংসার সে ছেড়ে গেলেও এ সংসার তাকে ছাড়েনি, ছাড়েননি বৃদ্ধ ; বরং যত দিন গেছে আরো জড়িয়ে নিয়েছেন মায়ায়... আষ্টেপৃষ্টে। 


" তুমি পারতে না রাইসা! পারতে না আমায় আটকাতে! তোমার হাত ছাড়িয়ে আমি আসতে পারতাম বলো! কিন্তু তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমাজ - সংসার, তবে কেন এসেছিলে জীবনে! কারো জীবন গড়ে না দিতে পারো অন্তত তাকে নষ্ট কোরোনা.....শান্তি পাবে না জীবনে, কক্ষোনো না!" অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামে তার, হাত দিয়ে ডলে ডলে স্মৃতিগুলো মুছতে থাকে সে। অনেক কাজ বাকি আছে তার, মাকে মানি অর্ডার পাঠাতে হবে.... বুড়োটা আবার কার সঙ্গে দেখা করে এসেছে গতকাল! তার গল্পই করে চলেছে। অসহ্য! 


ভেতরের ঘরে বসে পাতলা কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে সাধের বাঁশিখানা মোছেন বৃদ্ধ, রক্তে খেলা করে, " sudden from the heven like a weeping cloud..."।  মেঘ বড্ড করেছে আকাশে, বৃষ্টি হবে বোধহয়।। 


(সমাপ্ত)



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু