বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সেটাই সত্যি

 

--- " শালা, মাদারির বাচ্চাটা এবারও হায়েস্ট পেয়ে গেল ! "
--- " শুধু কি হায়েস্ট ? দুটো সেমেই পুরো ৮৫%। যাই বলিস রণিত,মালটা কিন্তু জেনুইন জিনিয়াস ; তোকে পুরো হোয়াইট হাউস করে ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে । " ---  হো হো করে হাসতে থাকে শুভ ।

 

 

দীর্ঘক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে থাকার পর এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে রণিত --- " শুভ,কথাটা হোয়াইট হাউস নয়, হোয়াইট ওয়াশ আর স্কটিশের মতো কলেজে  নিউটন,আইনস্টাইন তুল্য মেধাদের ফুৎকারে ধূলিসাৎ করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গোল্ড মেডেলটা আমি সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাতেই পেয়েছি ,কোনো কুত্তার বাচ্চা এসে দিয়ে যায়নি । রণিত রায় ইজ আ ট্রু চ্যাম্প । আমি কখনো হারিনি আর হারবোও না । নেভার । ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট । পরের দুটো সেম এখনও বাকি । বাদশা এস আর কে-এর ভাষায় , ছবি এখনও অসমাপ্ত বন্ধু ! সো জাস্ট এনজয় দ্য শো,এনজয় দ্য কামব্যাক অফ রণিত রায়।"


 

ক্ষণিকের স্তব্ধতা ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টদের আড্ডায় । সবাই ওরা থার্ড সেম,বোটানি মাস্টার্স । রণিতের বন্ধুরা আগে কখনও এতটা উত্তেজিত হতে দেখেনি ওকে । কলকাতার বিখ্যাত রেস্তোরা  'ব্লু প্যারাডাইস'-এর কর্ণধার, সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী রাজীব রায়ের একমাত্র পুত্র এই রণিত । রেস্তোরাঁর পাশাপাশি মন্দারমণি,চাঁদিপুর এমনকি গোয়াতেও নিজস্ব রিসর্ট আছে রাজীববাবুর । এক কথায়, বিজনেস টাইফুন না হলেও ' বিত্তশালী' , ' ধনবান' প্রভৃতি শব্দগুলোর যথার্থ উদাহরণ তো তিনি বটেই ।


 

এই অবধি পড়ে একটিবারের জন্যও যদি আপনি ভেবে থাকেন যে,  এই রণিত রায় ' বড়লোক বাপের বাউন্ডুলে বালক ', তবে তা নিতান্তই আপনার মস্তিষ্কের নিদারুণ অনুর্বরতার পরিচায়ক । ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ২০১৬ গ্রাজুয়েশন ব্যাচের উদ্ভিদবিদ্যার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছাত্রের নাম রণিত। তার প্রাপ্ত ৮২% স্কটিশের ইতিহাসেও এক নতুন ল্যান্ডমার্ক । কিন্তু সেই রণিতই গত এগারো মাসে রীতিমতো ধরাশায়ী পরপর দুটি সেমে । বিজয়ী সারোণ্যা সেন । দুটো সেমের রেজাল্টের পর দ্বিতীয় স্থানে থাকা রণিতের সাথে সারোণ্যার নম্বরের ব্যবধান ১৮%।



" ভাই,তুই এত চাপ নিস না । কাল কে.এস .স্যারের বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল আছে , থার্ড সেমের প্রথম ক্লাসেই ঐ দেমাগিকে ঘোমটা খুলে খ্যামটা নাচাবো । তুই শুধু কালকের সুপার রিয়েল রিয়েলিটি শোটা দেখ । " --- আবিরের ডান হাতের আশ্বস্ত চাপড় রণিতের পিঠে ।

 

" কালকের খবর কাল হবে। আকাশের হাল বেহাল । সাইক্লোন আক্রান্ত রণিতের মনে প্রকৃতির সাইক্লোন আছড়ে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। তার চেয়ে বাড়ি চল সব । রণিতও বাড়ি গিয়ে বাথরুমে বসে বারো ইঞ্চির বড়ো মোমবাতি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে শোকসভা পালন করুক । বেস্ট অফ ফাক। " --- চোখ টিপলো শুভ। ভেঙে গেল আড্ডা । শুভ,রণিত,শৌভিক,আবির --- দিনের শেষে ক্লান্ত পাখির মতোই সবাই সওয়ার হল বাড়ির পথে ।

 

রণিতের মনটা আজ সত্যিই ভালো নেই । ছেলেবেলা থেকে বরাবর ক্লাসে প্রথম হয়ে আসা ছেলেটা চরমতম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে শেষমেষ মাস্টার্সে এসে এমন ন্যক্কারজনক পরাজয়ের শিকার প্রতিনিয়ত হতে হবে তাকে । এমনটা হওয়ার কথাও ছিল না ।  গ্রাজুয়েশনের রেজাল্ট রণিতের পূর্বের সব সাফল্যকে ছাপিয়ে এভারেস্ট ছুঁয়েছিল অবলীলায় । আকাশচুম্বী এক প্রত্যাশা গ্রাস করেছিল তার অবচেতন মনকে । মাস্টার্সের স্বর্ণপদক আর রণিত রায়ের ব্যবধান মাত্র বাইশটা মাস ! দিন গুনছিল সে । কিন্তু সারোণ্যা নামটাই ওলটপালট করে দিল সব । এস.ডি. স্যারের প্যাথলজির প্রশ্নপত্র যা কিনা সুদূর সাউথ আফ্রিকার ডারবানের বাউন্সি পিচকেও হার মানায়,সেখানেও সারোণ্যা ৯৪% !  আত্মবিশ্বাসের কাঠামোটাই রীতিমতো কম্পমান রণিতের।

 

 

গোটা ইউনিভার্সিটির ইউনিভার্সাল হার্টবিট, সকলের মন সাহারার গুলবাহার প্রেমের শহর নবদ্বীপের কুয়াশা সুন্দরী তনুপ্রিয়া সিনহা ; মাস্টার্স করতে এসেই  তার সঙ্গে প্রথম আলাপ রণিতের । তনুপ্রিয়াও রণিতের  মতোই বোটানিরই ছাত্রী । কুয়াশাকে যেমন ধরা বা দেখা যায় না, চোখের পাতায় কিংবা মনের গহনে আলতো পরশে মেখে নিতে হয়,তনুপ্রিয়াও ঠিক তাই । কুমারী কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথার ওপর যখন সূর্যের প্রথম আলোটা এসে পড়ে , যে হৃদয়স্পর্শী  সোনালি আভা চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হয়, তারই মানবীয় সংস্করণ যেন সযত্নে মুদ্রিত হয়েছে তনুপ্রিয়ার হরিদ্রাভ গাত্রবর্ণে। মায়াময় চোখদুটি তার অবিকল পাথুরে জমির শৃঙ্খলিত স্রোতস্বিনী ।

 

 

 

এই স্বপ্নপরী তনুপ্রিয়াই রণিতের এহেন আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণসমূহের অন্যতম। প্রাণোচ্ছ্বল ,সদাহাস্য মেয়েটির চাহনি,হাসিতে বিদ্ধ রণিত । পড়াশোনায় আহামরি না হলেও তনুর রূপে, গুণে,লাবণ্যে সে ক্লিন বোল্ড ।

 

 

বইপত্রে মুখ গুঁজে তিন বছর ধরে শৈবাল,ছত্রাক, বৃক্ষের প্রেমে মগ্ন থাকা রণিতকে তাই দিনে তিন-চার ঘন্টা হোয়াটস অ্যাপে অন দেখা যায় আজকাল । ফেসবুকে সাড়ে সাতান্নবার চিরুনি তল্লাশি চলে তনুপ্রিয়ার প্রোফাইলে । উদ্দেশ্য,তনুর  রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সম্পর্কে প্রভাত-সূর্যের প্রাত্যহিক উপস্থিতির চেয়েও সুদৃঢ় নিশ্চয়তা । কিন্তু ক্লাসে কেবল পড়াশোনাকেন্দ্রিক আর তার বাইরে নিজেকে জাহির করার অভিপ্রায়ে সোশ্যাল সাইটে অযাচিত খেজুরে আলাপ --- কথার গাড়ি এর বেশি এক মিটারও এগোতে পারেনি রণিত; বরং প্রতিটি প্রচেষ্টায় বারংবার উপলব্ধি করেছে , পোস্টারহাসি বহনকারিণী,পোস্টকার্ড সুন্দরী কথোপকথনে ভীষণ সাবধানী ও হিসেবি।

 

 

" হয়তো তনুর বয়ফ্রেন্ড আছে । হয়তো বা ক্লাসমেটের বেশি এখনও ভাবেই না  আমাকে । " ---- নিজের মনকে বোঝায় হতাশ রণিত। তবুও ক্যারিয়ার সর্বস্ব জীবনে প্রথম ভালো লাগা একটা গভীর রেখাপাত তো করেই যায় । সেই হাতছানি এড়াতে পারেনি না চরম বাস্তববাদী রণিত নিজেও । তনুর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস জানার নানা ফ্যান্টাবুলাস ফন্দিফিকির আর সেটি সিঙ্গেল জানার পর এই স্পেশাল কেয়ার বা দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস বেড়ে যায় বহুগুণ । ফলস্বরূপ,ভাগ বসে পুস্তকপ্রেমে আর বেমালুম ভরাডুবি পরপর দুটো পরীক্ষায় । বোটানি সম্পর্কে অগাধ নির্ভুল কনসেপ্টও ঢেকে দিতে ব্যর্থ হয় তার মনোসংযোগের অপ্রতুলতাকে । 

 

 

পৈতৃক সম্পত্তি বা পরিবারিক ঐতিহ্যের তুলনায় নির্মেদ মেধাই যে তনুর হৃদয়ে সম্মানপ্রাপ্তির একমাত্র চাবিকাঠি,স্বল্প মেলামেশাতেই তা হাঁড়েহাঁড়ে অনুভব করেছে রণিত । পর্যদুস্ত রণিতের সাথে রেজাল্ট নিয়ে একটা কথাও   আজ সোশ্যাল সাইটে বলেনি তনু । নিজে থেকে কথা বলার মুখ রণিতের নিজেরও নেই । সব মিলিয়ে এ যেন গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া।

 

 

--- " সব দুর্ঘটনা,প্রেমরোগ মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বাকি দুটো সেমে যেন তেন প্রকারে নিজের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতেই হবে আমাকে । কাল নতুন সূর্যোদয়ের সাথেসাথেই ফিরে আসার লড়াই শুরু পুরোনো রণিত রায়ের । তবে একথা অস্বীকারের কোনো জায়গাই নেই যে,জেনেটিক্স,প্যাথলজির মতো কঠিন পেপারে যে মেয়ে  ৯০% এর ওপর নম্বর তোলে অবলীলায়, সে সত্যিই আগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষুরধার। লড়াই তাই এবার সেয়ানে সেয়ানে। আতিপাতি টিম ছেড়ে বহুদিন পর আবার অস্ট্রেলিয়ার মুখে পড়েছি। " --- মনে মনে ভাবে রণিত ।

 

নতুন এক আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে সে ---চতুর্থ সেমের রেজাল্টের দিন একবারে ডাবল গোল্ড মেডেল নিয়ে , সবার সামনে হাঁটু মুড়ে প্রোপোজ করে চমকে দেবে তনুকে । তার আগে এই ক'দিন বরং নীরবে বইপত্রের সঙ্গে ঝালিয়ে নেওয়া যাক নিজের পুরনো সখ্যতা ।

 

 

 

 

--- " রোল নম্বর ৫১ ...."
--- " ইয়েস স্যার। "
--- "৫২?"
--- " প্রেজেন্ট প্লিস। "
--- " রোল নম্বর ৫৩?"
--- " অ্যাবসেন্ট। "

" কাল বিকেলে ইউনিভার্সিটির সাইটে সেকেন্ড সেমের রেজাল্ট আপলোড হয়েছে ; আশা করি তোমরা দেখে নিয়েছো সবাই । সারোণ্যাকে নিয়ে আমি ভীষণই উচ্ছ্বসিত, শি হ্যাজ ডান আ স্প্লেনডিড জব । ওর এই সাফল্য রূপকথাকেও হার মানায় । ইউ স্টুডেন্টস , ট্রাই টু ফলো দ্য প্যাশন। আমাদের সৌভাগ্য যে সারোণ্যার মতো একজনকে আমরা ছাত্রী হিসেবে পেয়েছি। নাও,এবার সবাই ব্যাগ গুছিয়ে বায়োকেম ল্যাবে যাও । সূরজ অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছে ওখানে। " --- বিভাগীয় প্রধান সিরাজুল ইসলাম ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথাগুলি বললেন স্বভাবসিদ্ধ  দাম্ভিক মেজাজে । নিঃশব্দে ক্লাস ত্যাগ করলো ওরা সবাই ।



সারোণ্যা সেন,গোটা ইউনিভর্সিটি জুড়ে এখন এই একটা নামেরই জয়জয়কার । বি.এস.সি তে অতি সাধারণ নম্বরপ্রাপ্তা সারোণ্যা এম.এস.সি. এন্ট্রান্সে ৯৫ % মার্কস তুলে অ্যাডমিশন নেয় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে । পরীক্ষার খাতার প্রতিটি পাতায় তার প্রতিভার ছাপ ছিল অতীব সুস্পষ্ট । কিন্তু বড্ড বেশি মুখচোরা মেয়েটি দুটি সেম পেরিয়ে আসার পরও,সহপাঠী তো দুরস্ত,টিচারদের সাথেও আলাপ জমাতে পারেনি বিশেষ । প্রথম এক-আধদিন ব্যাপারটা বেশ সন্দেহের ঠেকলেও ,পরবর্তীতে সমস্তটা জানার পর সবাই অনুমান করে নেয় যে নিজের বিতর্কিত অতীতের কারণেই হয়তো সারোণ্যার এই রহস্যময় নীরবতা ।

 

 

 

হ্যাঁ, সারোণ্যা একজন অ্যাসিড ভিকটিম। মুখের বেশিরভাগটাই ওর কালো কাপড়ে ঢাকা। কলেজ জীবনের শেষদিকে , গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন ,  কোনো এক একাকী রাস্তার নির্জনতার সুযোগে বিচ্ছেদ পরবর্তী প্রতিশোধস্পৃহায় সারোণ্যার মুখে অ্যাসিড ছোড়ে ওর প্রাক্তন প্রেমিক সুজয় । ঘটনাটা বছর দুয়েক আগের । এখানে সবটা জানাজানির পর প্রথম কয়েকদিন সারোণ্যাকে টুকটাক টোন-টিটকিরি সহ্য করতে হলেও,তার পাথরসুলভ মৌনতার কাছে শেষমেষ পরাস্ত হতে বাধ্য হয় বিদ্রুপকারীদের অতিরঞ্জিত সমস্ত উদ্যম ।

বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে শুরু হল কাজ । স্ক্যালপেল দিয়ে আলুর পাতলা স্লাইড কাটতে হবে নিখুঁতভাবে। আবিরের টেবিল সারোণ্যার টেবিলের ঠিক পাশেই । স্পেসিমেন আনতে যাওয়ার অছিলায় সারোণ্যাকে হালকা ধাক্কা দিল আবির,যেন তাড়াহুড়োর বশে ধাক্কাটা জাস্ট লেগে গেছে আর কি ! প্র্যাকটিকালে গভীরভাবে মগ্ন থাকা সারোণ্যার হাত গেল কেঁপে , ধারালো সার্জিক্যাল নাইফ আলুর বদলে ছুটল তর্জনীর ওপর দিয়ে ।

" স্যা- আ -আ -আ- র। "---  চেঁচিয়ে উঠল সারোণ্যা । তার মুখে এতটা জোরালো আওয়াজ কাল অবধি শোনেনি কেউ।

চিৎকার শোনামাত্রই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন কে. এস. স্যার ; কেমিক্যাল স্ট্যান্ড থেকে ১০০%  অ্যালকোহল নিয়ে আঙুলে লাগানোর নির্দেশ দেন সারোণ্যাকে । কিন্তু অ্যালকোহলে আঙুল ছোঁয়াতেই যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়ে মেয়েটা। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে এক বিকট গন্ধ । কাঁদতে থাকে সে ।

" সূরজ,এ তুমি কী করেছো ? অ্যালকোহলের বোতলে কানার মতো ফরমালিন ভরেছো ? আই ক্যানট ইমাজিন জাস্ট ! পনেরো বছর কাজ করার পরও এতটা ইরেস্পোন্সিবল হও কী করে ? ডিসগাস্টিং। যাও, ইমিডিয়েটলি ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এসো । ইসস্,মেয়েটার ইনফেকশন না হয়ে যায় ! " --- ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে বেরিয়ে যান কে.এস.স্যার ।

ততক্ষণে নিজের টেবিল ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে  সারোণ্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তনু । বায়োবক্স থেকে তুলো বের করে অ্যালকোহল দিয়ে পরম স্নেহে ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে নিজের দামি ওড়না ছিঁড়ে বেঁধে দিয়েছে ব্যান্ডেজ । গোটা ক্লাস মুগ্ধ  তনুর এ হেন মানবিক আচরণে । সারোণ্যাও বিস্মিত। তনুর মনের কোমলতা সকলের কাছে সুপরিচিত হলেও,এত যত্ন , মমতা নিয়ে সারোণ্যার শুশ্রূষা স্তব্ধ করে দিয়েছে গোটা ক্লাসকে ।

যদিও পুরো ঘটনাটাই ছিল আদতে সূরজদার ইচ্ছাকৃত। সারোণ্যার সাথে পরীক্ষায় যেহেতু কিছুতেই  পেরে উঠছে না রণিত, তাই তার মতোই  ঈর্ষান্বিত রণিতের বেস্টফ্রেন্ড আবিরও । সেই ঈর্ষার বশবর্তী হয়েই সারোণ্যার টেবিলের  অ্যালকোহলের বোতলে ফরমালিন ভরে রাখার পারিশ্রমিক হিসেবে দু'হাজার আবির টাকা তুলে দেয় সূরজদার হাতে এবং প্র্যাকটিকাল ক্লাসে প্ল্যানমাফিক মারে ধাক্কা । ক্লাস শুরুর আগেই বোতলের মেটেরিয়াল বদলে  রাখতে ভুল করেনি অর্থলোভী সূরজদাও । ফলস্বরূপ,রক্তাক্ত হয় সারোণ্যা।

 

 

আবির ভেবেছিল, রণিতের বৃহস্পতি হয়তো খুলে যাবে এই দুর্ঘটনায় । কিন্তু পরিস্থিতি গেল ১৮০ ডিগ্রি উল্টে ! নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি তনুর অমায়িক মায়া দেখে রণিতের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল লঙ্কাবাঁটার মতোই । কিন্তু বিধি বাম ! স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার অভিপ্রায়ে অতীব স্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য হল নিরুপায় ছেলেটা  ; নিজের খরচেই সামনের মেডিসিন শপ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক এনে তুলে দিল সারোণ্যার হাতে । অসাধারণ রেজাল্টের জন্য  অভিনন্দিতও  করল তাকে । প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে 'ধন্যবাদ' জানিয়েই চুপ হয়ে গেল সারোণ্যা । মোহিত তনু ওষুধের কারণে কৃতজ্ঞতা জানাল রণিতকে । রণিতের আনন্দ  যেন আর বাঁধ মানে না আজ ।


 

সেদিনের মতো সময়ের অভাবে বাতিল হল ক্লাস । এই প্রথম সারোণ্যার সাথে তার সহপাঠীদের বাক্য  বিনিময় ঘটল দু-একটা  । অধিকাংশই মেকি সহানুভূতি দেখালেও নরম মনের মেয়ে তনুর আচরণে আন্তরিকতার ছাপ ছিল রীতিমতো স্পষ্ট

 

ছুটির পর এক সেকেন্ড সময়ও এখন আর  কলেজে নষ্ট করে না রণিত । নিজের প্রতিজ্ঞানুযায়ী অহেতুক সময় অপচয় বাঁচাতে ক্যান্টিনেও যায় না রোজ । ক্লাস বাতিল হতেই বাড়ির পথ ধরে সোজা বইয়ের স্রোতে ডুব সেদিনও ।

 

 

পরদিন সকাল দশটা তিরিশ । শুরু হলো দময়ন্তী ম্যামের মাইক্রোবায়োলজি ক্লাস। গতদিনের ঘটনা যেন স্মৃতিতেই নেই কারো । বড়ো বেশিই আত্মকেন্দ্রিক সবাই  --- মনে মনে ভাবতে থাকে সারোণ্যা । দু'একজন এসে আঙুলের খোঁজ নিলেও তা যে স্রেফ লোকদেখানো নিয়মরক্ষা, সেটা তাদের অভিব্যক্তিতেই চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট । ব্যতিক্রম কেবল তনু । আলতো আদরে দীর্ঘক্ষণ সারোণ্যার ক্ষতে হাত বোলায় সে,যথোপযুক্ত সাহায্য করে ক্লাসের কাজেও।

 

 

দেখতে দেখতে দরজায় হাজির তৃতীয় সেম । ক্রমে সময় এগোলেও তনু ছাড়া আর কারো সাথেই তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি সারোণ্যার । মনখোলা খেয়ালি আড্ডা না হলেও মাঝেমধ্যেই দুজন মজে যায় গল্পে । কেরিয়ারগত হিংসার বশবর্তী হয়েই হোক বা শারীরিক বিকৃতির কারণে, সারোণ্যা যেন সবার কাছেই  চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে আসা কোনো এক অদ্ভুত জন্তু । তনুপ্রিয়াই কেবল ব্যতিক্রম সেখানে , অনেক বেশি আন্তরিক ও প্রকৃত সমব্যথী সে ।




রেজাল্ট আউট হলো তৃতীয় সেমের। সারোণ্যা ৯০% পেয়ে টপ করলেও পিছিয়ে নেই রণিতও । ৮৮%মার্কস নিয়ে সে এবার দ্বিতীয় স্থানে । এমনকি একটা পেপারে তো সারোণ্যার থেকে দশ বেশিও পেয়েছে । রণিত পেল এক বাড়তি অক্সিজেন । শেষ সেমে সারোণ্যাকে হারানোর নেশায় ডুবে গেল একনিষ্ঠ সাধনায় । খোঁচা খাওয়া বাঘ যেন রক্তের স্বাদ পেয়েছে এবার ।





" আজ আমাদের শেষ ক্লাস রে সারোণ্যা। কাল ফেয়ারওয়েল ।  অ্যাবসেন্ট করিস না কাল , প্লিজ । ' একলা চলো ' গানটাকে বাস্তব রূপ দিতে তোর তো আবার জুড়িমেলা ভার । "  --- ছদ্ম অভিমানের সুরে তনুর গলায়।

 

" কেন গো ? আমি আবার কী করলাম সোনা? "---মৃদুহাসে সারোণ্যা ।

 

---- " হ্যাঁ মানছি, তোর ফোন কিংবা সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট  নেই । কিন্তু তা বলে কী দু'বছরে একবারও নিজের বন্ধুর সাথে আউটিং-এ যাওয়া যায় না? নিজের মুখে যে বলবো,সে সাহসও আমার নেই । তুই নিজে থেকে আমার সাথে যেটুকু কথা বলিস,তাতে ছোটোবেলায় শেখা ইংরেজি পরীক্ষার সামারি সেকশনের কথা অজান্তেই যেন মনে পড়ে যায় । "

 

--- " রাগ করে না বাবু , চল,আজ ক্লাস ছুটির পর আমরা গাছতলায় বসে গল্প করবো অনেকক্ষণ। আসলে কি বলতো , আমি তো তোদের সবার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা,তাই আর কী ! কে কিভাবে নেবে ! তার চেয়ে নিজের গন্ডিতে নিজেকে বেঁধে খুশি থাকি নিজের মতো করেই । "

 

" চুপ । একদম চুপ । বন্ধুত্ব কোনোদিন কোনোকিছুর ওপর নির্ভর করে না রে খেপি । সত্যিই যদি তুই আমাকে বন্ধু ভেবে থাকিস , তাহলে এসব কথা আর বলবি না কখনও । আজ ক্লাস ছুটির পর আমরা কফিশপে যাব একসাথে । আমার বেস্টফ্রেন্ড তিনটে সেমে টপ করেছে, ট্রিট দেবো আমি । ওকে ? " --- এক দমে কথাগুলো শেষ করে তনু।

 

" যথা আজ্ঞা,মহারানি । তবে কফিশপ নয়। বড্ড বেশি কৃত্রিমতা , হইচই আর যান্ত্রিকতা সেখানে । আমরা প্রিন্সেপ ঘাট যাবো ।মেঘের সামিয়ানা চিরে নীল গঙ্গার বুকে সিঁদুরে রোদের খেয়ালি বিচরণের সাক্ষী হব আমরা । " --- বেশ উৎসাহিত দেখাচ্ছে সারোণ্যাকে ।





সম্মতিসূচক হালকা ঘাড় নাড়ে তনু নিজেও । ছুটির ঘন্টা বাজতে না বাজতেই ওরা রওনা দেয় প্রিন্সেপ ঘাটের পথে ।





" কিরে,তনু, তোর শরীর খারাপ? এত চুপচাপ থাকার মেয়ে তো তুই নোস । " --- প্রশ্ন বিস্মিত সারোণ্যার ।

 

--- " না। ঠিক আছে। অল ইজ ফাইন।"  

 

--- " না,না । আমার কেমন একটা যেন মনে হচ্ছে,কফিশপটাই বেটার হতো । প্রিন্সেপ ঘাটটা তোর বোধ হয় ঠিক মনে ধরেনি , না ? "

 

--- " না রে,পাগলি। আসলে তোর এই প্রকৃতির বর্ণনা পুরোনো কিছু ঘটনাকে কেমন যেন ভাসিয়ে তুললো চোখের সামনে । বাদ দে ওসব। চল গোলা খাই। " 

--- আলতো হাসে তনুপ্রিয়া।

 

--- " ঠিক আছে । বলিস না বাবা । কী এমন কথা রে যা কিনা বেস্টফ্রেন্ডকেও বলা যায় না? যা থাক ! বলতে হবে না । " --- মুখ বাঁকায় সারোণ্যা ।






চোখের কোলে হালকা হীরককুচি জড়ো হয়েছে তনুর। " তখন আমার ক্লাস টুয়েলভ। আমার সাথে একই টিউশনে ফিজিক্স আর বায়োলজি পড়ত পাশের বয়েজ স্কুলের থার্ড বয় যুধাজিৎ । কেন জানি না, ওকে আমার সবার থেকে আলাদা লাগতো বেশ । ওর সততা , ব্যক্তিত্ব আমায় টানতো চুম্বকের মতোই । সেই থেকে আসতে আসতে শুরু হল বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম । নিজের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। ভর্তি হলাম কৃষ্ণনগরে একই কলেজে। দুজনেরই পছন্দের বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা । শুধু পড়াশোনাই না,আবৃত্তি, কবিতা এমনকি ক্যুইজ ---  সবেতেই যুধা ছিলো ডিস্ট্রিক্ট টপার। তুলির টানে যে কোনো ছবিকে জীবন্ত করে তুলত অনায়াসে । আমাদের সম্পর্কের কথা  ও নিজের বাড়িতে বেমালুম চেপে গেলেও,আমি কিন্তু ঝুঁকি নিয়েও আমার মা-বাবাকে জানিয়ে দিই সব । শোনার পর বকাঝকা থেকে মারধর --- কোনোকিছুই বাকি রাখেনি বাবা । তাও আমি ভীষণ জোর দিয়ে বলি --- যুধা সবার সেরা । পড়া শেষ করেই দারুণ একটা জব পেয়ে ও বিয়ে করবে আমাকে । কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ ঘটে গেল সেই বিপর্যয়। সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা গেলেন কাকু মানে যুধার বাবা । একদিকে সংসার আর অন্যদিকে বিধ্বস্ত কাকিমাকে সামলানো । হয়তো ও আর পেরে উঠছিলো না কিছুতেই । বদলাতে শুরু করে যুধা । একসময় যে ছেলেটা একবেলা আমার সাথে কথা না হলেই অস্থির হয়ে পড়ত , অনায়াসেই  দিনের পর দিন সে কাটিয়ে দিতে শুরু করল একটাও মেসেজ না করেই  । ওর সব দুঃখ-কষ্টকে নিজের অলংকার করে নিতে চেয়েছিলাম আমি। কুঁড়েঘর বা একমুঠো পান্তা --- কোনোকিছুতেই সমস্যা ছিল না আমার ।  কিন্তু দিন এগোনোর সাথেসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ওর খারাপ ব্যবহার। ভালোবাসার কথা বললেই অশ্রাব্য গালাগাল,সাথে নতুন ছেলে খুঁজে নেওয়ার নির্মম আকুতি। দিনের পর দিন ব্যর্থ চোখের বিনিদ্র জলই ছিল আমার একমাত্র সঙ্গী । নিজের প্রিয়তমের কাছে আমি যেন তখন বোঝা ! সরে গেলাম ওর জীবন থেকে । কিন্তু আমি ছেড়ে আসার পর যুধা হয়তো কোনোরকম শূন্যতা অনুভব করে আমার জন্য। যোগাযোগের চেষ্টাও করে নানাভাবে । রাস্তায় আমার পা ধরে ক্ষমাও চায় । কিন্তু ততদিনে আমি বীতশ্রদ্ধ। মন আমার ভুলতে পারেনি ওর দুর্ব্যবহারগুলো । প্রতিবারই যথেচ্ছ অপমান করে  বিতাড়িত করি ওকে । এক ক্লাসে থাকলেও এরপর আর ফিরে তাকাইনি কোনোদিন ।  খোঁজ নেওয়ার কোনোরকম চেষ্টা করি না এখনও । " --- এক নিমেষে কথাগুলো শেষ করেই ছুটে গিয়ে ট্যাক্সি ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তনু রওনা দেয় মেসের পথে । প্রাণপণ ছুঁটেও সারোণ্যা নাগাল পায় না তার ।





আজ ফেয়ারওয়েল । সবাই এলেও অনুপস্থিত তনু । আহেলী কে.এস.স্যারকে জানায় --- " আসার আগে আমি তনুকে ফোন করেছিলাম,স্যার। ওর রুমমেট ফোনটা রিসিভ করেছিল। তনুর খুব জ্বর। কাল কলেজ থেকে ফিরেই সোজা বিছানায়। আজ সকালে ওর মেসের কাকিমা প্যারাসিটামল এনে দিয়েছে ,বললো । " সব শুনেও না শোনার ভান করে সারোণ্যা । 






চতুর্থ সেম শেষ । রেজাল্ট বেরোতে বাকি আর মাত্র কয়েকদিন । বন্ধুত্বগুলোতেও কেমন যেন বিচ্ছেদের সুর । সেদিন সারোণ্যাকে একা ফেলে ঐভাবে চলে আসার পর পরীক্ষা চলাকালীনই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে তনু । সে সব মনে রাখার মেয়ে সরোণ্যা নিজেও নয়। বন্ধুত্বই ওর হৃদয় খাতার সর্বশীর্ষে যে .....





ইতিমধ্যেই পরীক্ষা পরবর্তী ছুটিতে তনু আর রণিতের সম্পর্ক সাজতে শুরু করেছে এক নতুন  রঙে । সামনাসামনি দেখা না হলেও ফোনে রোজ একঘন্টারও বেশি কথা হয় দুজনের । বেস্টফ্রেন্ড সারোণ্যাকে সমস্তটা  জানাতে না পারলে যেন আর তর সইছে না তনুর ।





এরই মাঝে হঠাৎ একদিন বিকেলে বেজে উঠল তনুপ্রিয়ার সেলফোন । ফোন করেছে সারোণ্যা । তনুকে  সে আমন্ত্রণ জানায় নিজের বাড়িতে। বাড়ি বলতে ঝুপড়ি। হ্যাঁ, উত্তর কলকাতার এক প্রান্তিক ঝুপড়িতে টিনের একটা ছোট্ট ঘরে ভাড়া থাকে সারোণ্যা । প্রিয়তম বন্ধুর নতুন ফোন কেনার খবরে আহ্লাদিত তনু তৎক্ষণাৎ হাজির হয় ওর বাড়ি । আসলে সেই যে কবে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তারপর থেকে আর দেখাই হয়নি দুজনের ; কথার ওপর কথা জমতে জমতে যেন এভারেস্ট ছুঁয়ে গেছে । মনটা তাই হাঁসফাঁস করছিল তনুর নিজেরও ।






ক্যাডবেরির প্যাকেট হাতে ,খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই মেরুদণ্ডে হিমেল স্রোত বয়ে গেল তনুর । থমকে গেল হৃদস্পন্দন । গোটা ঘরে সারোণ্যার চিহ্নমাত্র নেই । ঘরময় ছড়িয়ে কেবল  তনুর ছবি আর তারই মাঝে এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে যুধাজিৎ।





" এ কী! তুই? "  --- চিৎকার করে ওঠে তনুপ্রিয়া।

 

" ভয় পাস না তনু। টেবিলের ওপর ঠান্ডা জলের বোতল রাখা আছে। চটজলদি খেয়ে নে । আজ তোকে একটা গল্প শোনাবো রে পাগলি । এক পাগল প্রেমিকের গল্প । " --- অট্টহাসি যুধাজিতের। রীতিমতো স্তব্ধ তনু ।

 

" সারোণ্যা বলে এতদিন তুই যাকে জেনে এসেছিস,সে আসলে আমি । তোর প্রাক্তন প্রেমিক । তোর যুধা। হাজার কান্নার পরও তুই যখন আমার ভুল আর ক্ষমা করলি না কিছুতেই , তোকে ছাড়া জীবনের প্রতিটা দিন যখন বেরঙিন; ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ একদিন পেপারে দেখলাম,চাপড়ায় অ্যাসিড আক্রমণের স্বীকার হয়েছে একটি মেয়ে । সেও তোর-আমার মতোই বোটানি অনার্সেরই ছাত্রী । নাম সারোণ্যা সেন । আমাদের ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট বেরোতে তখনও মাসদুয়েক বাকি । ছুটে গেলাম ওর বাড়ি। চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিতে চাইলাম নিজের কাঁধে আর বিনিময়ে দাবি করলাম ওর পরিচয়। অর্থাৎ সারোণ্যার নাম নিয়েই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবো আমি । চিকিৎসার খরচ টানার মতো সামর্থ্য সারোণ্যার পরিবারের ছিল না। আমার প্রস্তাবে তাই ওরা রাজি হয়ে গেল নির্দ্বিধায় । আমি নিশ্চিত ছিলাম, ভর্তি তুই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেই  হবি । কিন্তু আসল যুধাজিতকে যে তুই ক্ষমা করবি না কিছুতেই ,সেই বিষয়েও কোনোরকম সন্দেহ ছিল না আমার । অগত্যা সারোণ্যার পরিচয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম তোরই সাথে মাস্টার্সে । মেয়েটার  মুখের ৬০%-ই পুড়ে গেছিলো প্রাক্তনের ছোড়া অ্যাসিডে । ছবি ভেরিফিকেশনে সৌভাগ্যবশত কোনোরকম সমস্যাই তাই পোহাতে হয়নি আমায় । আর ফিঙ্গার প্রিন্ট ভেরিফিকেশনের দিন হাজির ছিল সারোণ্যা  নিজেই । মুখের বেশিরভাগটাই ছিল ওর কালো কাপড়ে ঢাকা। ব্যাস,এভাবেই মাস্টার্সে  ভর্তি হয়ে গেল সারোণ্যারূপী যুধাজিৎ। নিখুঁত মেকআপে নিজেকে অ্যাসিড আক্রান্ত সাজাতে খুব একটা সমস্যা যে আমার হওয়ার কথা নয় ,সেটা তুই খুব ভালোভাবেই জানিস। আর ছোটো থেকে  থিয়েটার করার সুবাদে মেয়েদের গলা নকল করাটাও নেহাত মামুলিই ঠেকেছিল আমার কাছে । তবে আমার এই ছদ্মবেশ,শুধু তোকে একটা কথাই জানান দিতে যে --- ভালো আমি তোকে সত্যিই বাসতাম, ভালোবাসি আজও । কিন্তু চাইনি, আমার অনিশ্চিত জীবনে ঢুকে শেষ হয়ে যা তুই নিজেও । তাই সেই অপমান, দুর্ব্যবহার। রেজাল্ট বেরোতে হয়তো আর সপ্তাহখানেক বাকি । জানি,গোল্ড মেডেলটা আমি-ই পাব । আমার চ্যালেঞ্জ ছিল দুটো । এক,সবাইকে আরও একবার বুঝিয়ে দেওয়া --- সেরার সেরা এখনও একজনই এবং সেটা যুধাজিৎ সেন আর দুই,তোর প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা গোটা পৃথিবীকে জানানো। দুটো কাজই প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । মাও বেঁচে নেই আর । এসবের খরচ তুলতে গিয়ে নবদ্বীপের  বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে গতবছর । তাই …….আই লাভ ইউ তনু । ভালো থাকিস রে । চলি । গুড বাই । " --- এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করেই নিজের গলায় বিষমাখানো ধারালো ছুরি চালালো যুধাজিৎ।





রক্তে লাল হয়ে গেছে মেঝে। যুধার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে তনুপ্রিয়া । যুধাজিতের সাদা পাঞ্জাবিতে নিজের হাতে আঁকা ফেব্রিক---

" যদি এক মুহূর্তের জন্যও তোমায় চাই,সেটাই সত্যি॥ "




বাইরে বৃষ্টি নেমেছে । অ্যান্টেনায় বসা দাঁড়কাকটার মত ভিজছে গোটা শহরটাও । এরই মাঝে এক পশলা রোম্যান্টিকতায় আলতো গা ভিজিয়ে অলিতে গলিতে রচিত হচ্ছে --- পরিণতিহীন,নিষ্পাপ হাজার প্রেম কাহিনির প্রচ্ছদ ।

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু