বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ছোটবেলার পুজো

           আজ ভাদ্র সংক্রান্তি। আকাশে ঘুড়ির মেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলার অনেক কথা। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, আলাদা করে ঘুড়ি ওড়াতাম না ঠিকই, তবে তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যাওয়া ঘুড়ি উড়ানোর দিনগুলোতে একনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে থাকতাম, ভাই ও বন্ধুদের সাথে যতটা সম্ভব। স্কুলথেকে ফিরে এইকদিন খুব ব্যস্ততায় কাটতো পূজা পরবর্তী অনুষ্ঠানের রিহার্সাল করতে হতো বলে।

 

            বাড়িতে বিশ্বকর্মা পুজো হতো বেশ আয়োজন করে মুর্তিএনে ঢাকঢোল পিটিয়ে। নতুন জামা পরে সকালে অঞ্জলী দিতাম উপোস থেকে। তারপর অতিথি আপ্যায়ন, ভাইবোনদের গল্প আড্ডা, ঢাকের তালে নাচ আর বিকেলে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে অসম্ভব আনন্দে কাটত সারাটা দিন। যে রকমই হোক নতুন জামা পরা দিয়ে সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যেতো আমাদের পুজোর আনন্দ উদযাপন।

 

             তখন মহালয়ার দিন থেকে স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে যেত আর খুলত একেবারে ভাইফোঁটা পেরিয়ে। আত্মীয় স্বজন মানে সপরিবারে সব পিসি জেঠু দের আগমন ঘটত মহালয়ার সাথে সাথেই। সবার জন্য পুজোর কেনাকাটা করতে যেত মা কাকিমা জেঠিমা পিসিরা একসাথে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হত না তাই অপেক্ষা করে কল্পনা করা ছাড়া আর উপায়ও ছিলনা। তবে সময়টা দারুণ হৈচৈ করে কেটে যেত, 'ভাই' মানে আমাদের ঠাকুমার তত্বাবধানে।

 

          প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য সাধ্যমত জামাকাপড় উপহার দিত। তখন বাজেট খুব কম ছিল সবারই এতোগুলো কিনতে হতো বলে। সবার জন্য কেনা শেষ হলে তারপর মা আমাদের জন্য কিনতে শুরু করতেন। ভালো লাগলেও সব কিছু পাওয়া ছিল সাধ্যাতীত। একটা জামা খুব পছন্দ হলে সাধ্যের মধ্যে স্বপ্ন পূরণ করতে মা আর বাবা দুজনে মিলে কাপড়ের ছিট কেটে মিক্স এন্ড ম্যাচ করে সেলাই করে এমন সুন্দর পোষাক তৈরি করে দিতেন যে তা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।

 

          ওদের পরিশ্রম ও চিন্তাধারায় আমাদের জামাগুলোই হত একদম আলাদা আর সুন্দরও। খুব ভালো লাগতো তখন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাকিমণি আলপনা এঁকে দিতেন জামার উপরে। তবে মাঝে মাঝে অভিনবত্ব যে পীড়া দিতনা তা কিন্তু একেবারেই নয়।

 

           এমনিতেই আমরা পিঠোপিঠি তিন বোন বলে বেশিরভাগ সময় আমাদেরকে একেবারে এক ধরনের জামা পরানো হতো। সে বানিয়েই হোক আর কিনেই হোক। বিড়ম্বনা ঘটত তখন, যখন সেই ছিট কাপড়গুলোর অবশিষ্ট টুকরোগুলো দিয়ে সবশেষে খুরতত ভাইয়েরও শার্ট প্যান্ট বানানো হতো। তফাৎ একটাই থাকত কারো কামিজের কাপড়ে কারো সালোয়ার তো কারো সালোয়ারের কাপড়ে কারো কামিজ। আর কারো দুটো কাপড়ের কামিজ। কারো আলপনা ওপরে তো কারো আড়াআড়ি ভাবে। ভাইয়ের বেলাতেও একই ব্যাপার থাকত।  অবশ্য তখন বিড়ম্বনার উপলব্ধি না থাকাতে এটাকেই খুশি মনে পরে নিতাম নতুন কাপড় পরার আনন্দে।

     

           বাড়ির সামনে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা মন্ডপটা ছিল সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পুজোর ফুল আর দূর্বা সংগ্রহ করে দিতে আসতাম ওখানে। কে কার আগে কত বেশি দিতে পারবে, তাতেই ছিল যত বাহাদুরী। তারপর স্নান সেরে শাড়ি পরে যেতাম অঞ্জলি দিতে।

 

            ছোট বেলায় মফস্বলের মেয়েদের শাড়ি পরার আকর্ষণ খুব থাকে। তাই আমাদেরও খুব ছিল তখন। জানিনা আজও তেমনি আছে কি না। শাড়ি পরে বাবাকে দেখালে চোখ ছলছল করত বাবার। দুপুরে ভোগ নেওয়ার সাথে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে মিশন ছিল উৎকৃষ্ট স্থান সবদিক থেকে সব বয়সের জন্যই। বিকেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন জামা কাপড় পরে পায়ে হেঁটে পূজো দেখতে বেরোতাম।

 

           মা ওরা অবশ্য মিশনেই বসতেন। প্যান্ডেলের ভিড় তখন গায়েই লাগতো না। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পূজো দেখে তবে বাড়ি ফিরতাম। নতুন জুতোয় ফোসকাপরা পায়েরচলা একজন আরেক জনকে দেখিয়ে নকল করে মজা করতে করতে বাড়ি ফিরতাম হাসতে হাসতে।

 

            হাতে একটা বন্দুক থাকলে তো আরো মজা। হঠাৎই আওয়াজ করে চমকে দেওয়া যেত অপরিচিতকেও। তাতে কখনো কাউকে রাগ করতে দেখিনি হাসি ছাড়া। ছোট পাহাড়ি জনপদে আড়ম্বর থেকে বেশি আনন্দ ছিল আর ছিল মেয়েদের একা চলাচলের পূর্ণ স্বাধীনতা। তাই ভয়ের কিছু না থাকাতে সন্ধ্যাবেলার ঘোরাঘুরিটা নিজেরাই করতাম অল্প বয়স থেকেই।

          

           গভীর রাতে বাবারা গাড়ি নিয়ে বোরোতেন বাড়ির বড়দের নিয়ে, বিশেষ করে ঠাম্মাকে পূজো দেখানোর জন্য। তখনও চেষ্টা করতাম আমরা বেরোতে যদি না নিদ্রাদেবী ঘারে চেপে বসে না ঘুম পাড়াতেন। খাওয়া দাওয়া টুকটাক বাইরে চললেও রাতের খাবার একসাথে সবাই মিলেই গল্প করতে করতে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তখন এক এলাহী ব্যাপার হতো রান্না ঘরে। এতজন সদস্যের একসাথে খেতে বসাতে বড় রান্না ঘরটাকেও যেন খুব ছোট মনে হতো।

        

            তিনদিন যে কিভাবে কেটে যেত কিছুতেই  বুঝতে পারতাম না আমরা। দশমীর দিন দুপুরের পর যখন মা কে বরণ করতে যেত মা ওরা তখন আমরাও যেতাম সব বইপত্র নিয়ে ঠাকুরের পায়ে ঠেকাতে। খুব কষ্ট হতো দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে জল এসে যেত। বিদায়ের যন্ত্রণা না বুঝেই হয়তো তখন কাঁদতাম মা ওদের দেখে আবার হয়তোবা পরদিন থেকে আবার পড়তে বসতে হবে বলে।

 

               যাত্রা করে এলে শান্তির জল ছিটিয়ে দেওয়া হতো সবার উপর। হাতে বেঁধে দিত বানা। গুরুজনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতাম সবাই।

 

এখনো টিভিতে দশমীর বিসর্জন দেখতে দেখতে চোখে জল চলে আসে। তবে এখন কান্নাটা আসে নিজেকে মাদু্র্গার জায়গায় রেখে। বিসর্জনের সাথে সাথে নিজের জীবনের অনেক ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে অনিচ্ছারূপী অনেক অসুরকে সাথে রাখতে হয় বলেই হয়তবা!

 

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু