বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

উন্মাদ

পুজোয় কেনা কোলাপুরী পাঞ্জাবিটা পরে বাঙালিবাবু সেজে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল সদ্য  বিড়লা কোম্পানিতে জয়েন করা বি.টেক. ইঞ্জিনিয়ার কৃশ । হাতে আর মাত্র দশ মিনিট , মাইকে অঞ্জলির সময়সূচি ঘোষণা চলছে। হন্তদন্ত হয়ে পাড়ার মোড়ের জাগৃতি সংঘের প্যান্ডেলের দিকে ছুটতে শুরু করল ছেলেটা ।





" এ বাবু, দশটা টাকা দে না বাবু , মুড়ি কিনে খাবো । দে ! দে ! দে ! দে বাবু দে ! " --- ছেঁড়া জামা , রংচটা প্যান্ট পরিহিত অবিন্যস্ত এক ব্যক্তির নোংরা হাত কৃশের সাদা পাঞ্জাবি ধরে দিল সজোরে টান ।



 "ছাড় ! ছাড় ! ফোট শালা ! পাগল কোথাকার ! এই পুজোর বাজারে না জোটেও সত্যি সব । " --- চিৎকার করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল কৃশ । ক্লাবপ্রাঙ্গণের সামনে হঠাৎ এমন চেঁচামেচি শুনে একদল ছেলেও জড়ো হয়েছে সেখানে । তারা প্রায় মারতে উদ্যত অদ্ভুত দর্শন ওই ব্যক্তিটিকে । শত হোক , নতুন চাকরি পাওয়া কৃশ বারোয়ারির পুজো ফান্ডে বিনা বাক্যব্যয়ে চকচকে দুটো গোলাপি নোট জমা করেছে এবার , তোষামোদ তো তাকে করতেই হবে ! শেষমেষ পাড়ার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির মধ্যস্থতায় এ যাত্রায় বেঁচে গেল এলাকার সুপরিচিত রামু পাগলা । দিনেরবেলায় পাড়ার রাস্তাঘাটে এলোমেলো ঘোরাঘুরি আর রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে নাক ডেকে ঘুম ---- এভাবেই বছরগুলো কোনোক্রমে কেটে যাচ্ছে ওর । আপন মনে কি সব যেন বিড়বিড় করে চলে সারাটা দিন । লোক দেখলেই প্রার্থনা করে খাবার অথবা টাকা ; বিনিময়ে জোটে শুধু গালভরা খিস্তি ।





তবে  কৃশ আজ একটু বেশিই ঔদ্ধত্য দেখিয়ে ফেলেছে । সবই আসলে নতুন পাওয়া চাকরিপ্রসূত অহংকার আর মণ্ডপে পৌঁছোনোর তৎপরতার সংমিশ্রিত ফলাফল । তার ওপর মণ্ডপে ওর জন্য দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমান বাসন্তী শাড়ি পরিহিতা, স্বপ্নসুন্দরী রুক্মিণী সেন । এগারো মাস বয়স ওদের সম্পর্কের । এ বছরই প্রথম , পুজোয় দেওয়া কৃশের দশহাজারি শাড়িটা পরে একসাথে অঞ্জলি দেবে দুজন ।





ঘুম থেকে উঠতে আজ আটটা পেরিয়ে গেছে কৃশের । আসলে, নতুন চাকরি ! অষ্টমীর আগে ছুটি ম্যানেজ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কিছুতেই । তার ওপর গতকাল রাতে অফিস থেকে ফিরতেও লেট হয়ে গেছিল অনেকটা ।  ক্লান্তির কারণেই সকালে বিছানা ছাড়তে ঢিলেমি আর তারপর মণ্ডপে পৌঁছতে দেরি বেশ খানিকক্ষণ । রুক্মিণী প্রায় ৩০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিল সেখানে । স্বভাবতই কৃশ ছিল উত্তেজিত । তাড়ার মধ্যে রামুর ডাক আগুনে যেন ঘৃতাহূতি দেয় , বেরিয়ে আসে গালাগালি ।





সকালে একসাথে অঞ্জলির পর ,সারাটা দিন ভিডিও কল আর চ্যাটিং-এ ডুবে , রাতে প্যান্ডেল হপিং কপোত-কপোতীর । গোটা শহরটা চষে তারা  যখন ফুডহাটে ঢুকল, ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই । ডিনার সেরে রুক্মিণীর বাবা-মায়ের খাবারটাও পার্সেল করে দিল দায়িত্ববান কৃশ নিজেই ।  ওয়েটারের পকেটে বিলবাবদ গুঁজে দিল ২০০০টাকার পাঁচটা চকচকে নোট ।





সজোরে হঠাৎ ধাক্কা! রুক্মিণীর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল খাবারের প্যাকেট । এলোমেলো একটা লোক, আধখাওয়া খিচুড়ির বাটি হাতে প্রাণপণ ছুটছিল রাস্তার মাঝখান দিয়ে আর তাকে ধাওয়া করছিল একদল কুকুর । রুক্মিণীর উপস্থিতি খেয়াল করতে না পেরে লোকটি সোজা এসে ধাক্কা খায় ওর গায়ে । সন্ধ্যের পর থেকেই অষ্টমীর প্রসাদ বিতরণ চলছিল রেস্তোরাঁ সন্নিকটস্থ একটি বারোয়ারির প্যান্ডেলে আর সেখান থেকেই এক বাটি খিচুড়ি সংগ্রহ করে অবিন্যস্ত ওই ব্যক্তি । দুর্ভাগ্যবশত , এরপর হঠাৎই তাকে ধাওয়া করতে শুরু করে রাস্তার কিছু কুকুর । ফলস্বরূপ ঘটে যায় এই দুর্ঘটনা । হাজার পাঁচেকের খাবার ধুলোয় গড়াগড়ি যেতে দেখে সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় কৃশের । শুধু অশ্রাব্য গালাগালেই থেমে না থেকে হাত তুলতে যায় লোকটির গায়ে । ততক্ষণে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছেন এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশগণ । তাদের হস্তক্ষেপেই কোনোমতে শান্ত হয় পরিস্থিতি । ইতিমধ্যেই  মাটিতে ছড়ানো খাবারের দখল নিয়ে লড়াইয়ে মেতেছে রাস্তার কিছু কুকুর আর ভীম পাগলা । ও হ্যাঁ , অর্ধউলঙ্গ ওই লোকটির আসল পরিচয় ভীম পাগলা , গোস্বামীপাড়ার রাস্তায় ওর দেখা মেলে দিবারাত্র । 'ফাকিং ব্লাডি শিট , বাস্টার্ড ' --- বলে ধুলোয় ছড়িয়ে থাকা ভীমের খিচুড়িতে থুথু ফেলে আবারও রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেল কৃশ । বেরিয়ে এল আরও বড়ো একটা প্যাকেট হাতে । পুনরায় রুক্মিণীর মা-বাবার জন্য সে নিয়ে এসেছে রঙিন প্যাকেটে মোড়া সুস্বাদু ফিস কবিরাজি ,মাটন বিরিয়ানি , চিকেন রেজালা আর কর্ণেটো আইসক্রিম । একটা ওলা ডেকে খাবার হাতে রুক্মিণীকে ছেড়ে দিল বাড়ির পথে , সাথে আদরবাসার ফ্লাইং কিস ।





আজ মহানবমী । চাকরি পাওয়ার পর এটাই কৃশের প্রথম পুজো । আজকের এই বিশেষ দিনটি দায়িত্ববান ছেলে তাই রেখেছে নিজের বাবা-মায়ের জন্য । যদিও সকাল থেকেই  রুক্মিণীর সাথে চ্যাটিং-এ মজে সে । অস্থিরতা , উদ্দীপনাও আজ একটু বেশি । কাল দশমী । বিজয়ার প্রণামটা সেরেই মা-বাবাকে জানাবে বান্ধবী রুক্মিণীর কথা । কিছুতেই যেন আর তর সইছে না ওর , প্রিয় বন্ধু রোহিতের পরামর্শে গতকাল রাতেই তাই সেরে ফেলা এই মোক্ষম প্ল্যানটি ।


--- " রেডি হয়েছো ? মা-বাবা রেডি হয়েছে ? পিংক শার্টটা পরবে কিন্তু আজ ,ওটায় তোমাকে দারুণ মানায় ।  " -- মেসেজ ঢোকে রুক্মিণীর নম্বর থেকে ।   

--- " হুমম । তোমার নিজের হাতে কেনা পিংক শার্টটাই পরনে , সোনা । এক সেকেন্ড ! এক্ষুনি সেলফি তুলে পাঠাচ্ছি । কিগো ! তুমি আজ আর বন্ধুদের সাথে বেরোলে  না ?" -- রিপ্লাই কৃশের । 

 ---" না গো ! শরীরটা খুব খারাপ । পিরিয়ডসটাও আর হওয়ার সময় পেল না । এই পুজোর মধ্যেই ....... সন্ধ্যাটা আজ শুধু ঘুমিয়েই কাটাবো ভাবছি আর স্বপ্নে প্রেম করব তোমার সাথে । তা তোমরা কোন দিকটায় যাবে , ঠিক করলে কিছু ? " 

 ---"ভাবছি একটা ওলা নিয়ে শ্রীরামপুরটাই ঘুরে আসব একপাক । গাড়িতে চড়ে আগে তো কখনো ঠাকুর দেখার সুযোগ হয়নি মা-বাবার ….. ছোটবেলায় মায়ের মুখে  শুনতাম , মাসিরা নাকি বরাবর পুজোয় গাড়ি নিয়েই ঘোরে । মাকে ফোনে গল্পও করে সেসব । মুখ ফুটে না বললেও অনুভব করতে পারতাম  মায়ের মনের গোপন ইচ্ছে ।  কিন্তু তখন তো অত টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না , তাই এবার ছোট্ট একটা  সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করছি মাকে । " 

 --- "ওকে ! তাই করো , সোনা । তোমাদের খুশিই আমার খুশি । আর জ্বালাবো না এখন , ভালো করে ঘোরো , ডার্লিং । টাটা । " 

 --- " বাই জানু । "





কৃশ ওর মা-বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায় । শ্রীরামপুরের প্ল্যান শুনেই মায়ের মেজাজ তো পুরো সপ্তমে ।  আসলে সত্তরোর্ধ্ব কৃশের বাবার পক্ষে অসুস্থ শরীরে অতটা রাস্তার ধকল নেওয়া রীতিমতো চাপের । অগত্যা মাতৃনির্দেশে টোটোয় চড়েই নিজের শহর বাঁশবেড়িয়ার পুজো ভ্রমণে সওয়ার হলো ওরা তিনজন ।





টোটো এসে থামল বাঁশবেড়িয়ার সেরা মণ্ডপের সামনে । উদ্যোক্তা মুক্তিদূত । এবারের  থিম ' পাগলাগারদ ' । পাগলের ভূমিকায় ক্লাবকর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভাড়া করা সুসজ্জিত জেলখানায় বন্দি কিছু মানুষ । দর্শনার্থীরা নানাভাবে উত্যক্ত করছে তাদের , ছুঁড়ছে বাদাম । থিমটা বেশ মজার । এমন পরিবেশ উচ্চশিক্ষিত কৃশকেও দিল শৈশবের হাতছানি । এরা তো আসলে পাগল নয় , অভিনেতা , ক্ষতি কী ! ---  এই ভেবে মজার ছলে দু'বার মুখ ভেঙালো কৃশ নিজেও ।





মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে টোটোয় উঠতে গিয়ে অকস্মাৎ থমকে গেল তার পা । মুক্তিদূতে আজ বিশাল ভিড় ! কৃশের চোখ আটকে গেছে অপরূপা এক সুন্দরীর দর্শনে।  মেয়েটাকে দেখতে ঠিক যেন রুক্মিণীর মতোই লাগছে । তবে কি ও বেরোলো ?  --- ভাবতে ভাবতে হঠাৎ-ই কৃশ আবিষ্কার করল  , মেয়েটির ডান হাত অন্য একটি ছেলের হাতে গোজা । টয়লেটের অজুহাতে টোটোকে পাঁচটা মিনিট দাঁড়াতে বলে মণ্ডপের ভিড়ে মিশে গেল কৃশ । তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ওই লাভবার্ডসের ওপর । হ্যাঁ , মেয়েটি রুক্মিণীই । প্যান্ডেলের ভিড়ে ঠোঁটজোড়াও কয়েকবার কাছাকাছি এল যুগলের । বিধস্ত কৃশ ফিরে এল টোটোতে ।





গোটা শহর ঘুরে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা ন'টা পেরোলো সেই রাতে । অম্বলের অজুহাতে ডিনার না সেরেই শুয়ে পড়ল কৃশ । আসলে আজ রাতে ওর গলা দিয়ে জল অবধি নামবে না । আকাশ জুড়ে শরৎ হলেও কৃশের মনে ঘোর বর্ষার ইস্পাত কালো মেঘমালা ।





গোটা নবমী নিশি জুড়ে ধুন্ধুমার মেসেজযুদ্ধ চলার পর অবশেষে ভোর চারটে নাগাদ রুক্মিণী স্বীকার করে নেয় যে , মণ্ডপে দেখা ছেলেটির নাম আর্যমান রায় । পেশায় জিম ট্রেনার আর্যের সাথে সাত বছরের প্রেমের সম্পর্ক তার । মাঝে ক'দিন বনিবনা না হওয়ায় দু'বছরের ছোটো কৃশের সাথে ঘনিষ্ঠ হয় সে । উদ্দেশ্য ছিল  , আর্যকে জাস্ট জেলাস ফিল করানো। প্ল্যানটা খেটে গেছে পুরোপুরি । ক্ষমা চেয়ে প্যাচ আপও করে নিয়েছে আর্য । সামনের জানুয়ারিতে ওদের  বিয়ে । আর্য জানে কৃশের সবটাই । কৃশের এই কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার গল্পটা মিরাক্কেলের গ্র্যান্ড ফিনালের চেয়েও ওকে মজা দিয়েছে অনেক বেশি ।





নবমী নিশীথেই সমস্ত সোশ্যাল সাইট এবং কললিস্টে কৃশকে ব্লক করল সদ্য প্রাক্তন রুক্মিণী সেন । অঝোরে ক্রন্দনরত কৃশ অপর একটি নম্বর থেকে ফোন করলে হুমকির সুরে রুক্মিণী জানায় --- "দেখো কৃশ,  ছেলেমানুষি কোরো না । তুমি ফ্লার্টকে প্রেম ভাবলে তার দায় আমার নয় । তাছাড়া এসব আজকাল খুব কমন । ব্রেকআপ এখন জলভাত আর প্রেম হল মিউজিক্যাল চেয়ার । মুভ অন প্লিজ । আর একবার আমাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করলে কিন্তু পুলিশে জানাতে বাধ্য হব । তখন দেখবো তোমার কোন বাপ তোমাকে বাঁচায় । ব্রেকআপের পরও কন্টিনিউয়াস জ্বালিয়ে যাচ্ছো । কাল রাত থেকে একত্রিশ বার ফোন করেছো । ডিসগাস্টিং! আই হ্যাভ নো ফিল ফর ইউ । ওকে ? আমার সাথে কন্ট্যাক্টের আর কোনোরকম চেষ্টা করলে পরের কথাটা লোকাল থানার লকআপে হবে । কয়েকদিন জেলের ভাত খেলেই ব্রেকআপের শোক বাই বাই ব্যাংকক হয়ে যাবে , বাবু  । " --- ফোন কেটে দিল রুক্মিণী ।





দশমীর বিষাদকেও ম্লান করে দিয়েছে রুক্মিণীর এই রংবদল । চোখের জলে মাকে বিদায় জানাল কৃশ । তবে তার কারণ উমার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন নয় ; কারণটা রুক্মিণী সেন । মেয়েটাকে হৃদয় থেকে ভালোবেসে ফেলেছিল বরাবর বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা মুখচোরা ছেলেটা । ছোটো থেকেই বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর কৃশ । মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকে অনেক কষ্টে জোগাড় করা পকেটমানির ভাগ কোনোদিনই বন্ধুদের দিতে চাইত না সে । রাস্তায় সম্বলহীন ভিখারিরা হাত বাড়ালে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ ছিল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গি । বন্ধুবান্ধবও ছিল হাতে গোনা । আসলে আত্মমগ্ন ছেলেটা কোনোদিনই কাউকে আপন করে নিতে পারেনি সেভাবে । তাই ফেসবুকে রুক্মিণীর সাথে কিঞ্চিৎ সখ্যতা গড়ে উঠতে না উঠতেই নিজেকে উজাড় করে দিতে শুরু করে ভালোবাসার জোয়ারে । কর্মজীবনে প্রবেশের পরও রাস্তার বুভুক্ষু উন্মাদকে পাঁচটা টাকা দিতে গিয়ে ভেবেছে পাঁচশো বার , খারাপ ব্যবহার করেছে ছাত্রজীবনের মতোই  --- কিন্তু রুক্মিণীর কারণে পঞ্চাশ হাজারের বিলও তাকে ভাবায়নি পাঁচ সেকেন্ড । এই এগারো মাসে রুক্মিণী যেন মিশে গেছে কৃশের পঞ্চইন্দ্রিয়ে। একজন সুন্দরী নারীর থেকে পাওয়া যত্ন , চুম্বনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য কৃশ আজ তাই প্রেমে পাগল ।





কিন্তু সময় আর স্রোত তো থেমে থাকে না কখনোই । ফিরতেই হয় জীবনের মূলস্রোতে । রুক্মিণীর সাথে যোগাযোগের সমস্ত রকম প্রয়াস বন্ধ করে কাজে মনোনিবেশের একান্ত চেষ্টা শুরু করল কৃশ । অফিসও খুলে গেছে একাদশীতেই । কিন্তু কিছুই যেন ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণে আসছে না একসময় জয়েন্টে ১১০০ রাঙ্ক করা মেধাবী ছেলেটার । একের পর এক প্রোগ্রাম সেটিং-এ ভুল করে চলেছে কম্পিউটার সায়েন্সের কৃতি ছাত্র কৃশ দাশগুপ্ত । সিনিয়র অফিসার অভিমন্যু সান্যাল সতর্কও করে গেলেন বেশ কয়েকবার । কিন্তু কৃশের মনের মাউস যে এখনও বল্গাহারা । অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কোম্পানির বড়ো একটা  ডিল হাতছাড়া হল কৃশের সৌজন্যে । বিড়লা কোম্পানি বরখাস্ত করতে বাধ্য হল ওকে । জীবনদ্বীপে আছড়ে পড়ল সুনামি । রুক্মিণীর চলে যাওয়াটা যদি নিম্নচাপ হয় , চাকরি ছাঁটাই তাতে ঘূর্ণিঝড়ের সামিল ।





দেখতে দেখতে কালিপুজো শেষ ; জগদ্ধাত্রী পুজোও অতিক্রান্ত । কিন্তু উৎসবের মরসুমেও কৃশের বাড়িতে যেন শ্মশানের স্তব্ধতা । শুরুতেই এত বড়ো কোম্পানি থেকে স্যাকড হওয়ায় প্রশ্নের মুখে ওর কেরিয়ার । তার ওপর সংসারে নিত্য টানাটানি তো রয়েইছে । বেসরকারি কোম্পানির প্রাক্তন চাকুরে, বৃদ্ধ বাবার পোস্টঅফিসের স্বল্প সঞ্চয়ের সুদই এখন দিন চালানোর একমাত্র অবলম্বন । গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো , কৃশের এডুকেশন লোনের কিস্তিও দীর্ঘদিন ধরে জমতে জমতে হার মানাচ্ছে হিমালয়কে ।  বাড়িতে বসে সারাদিন গুমরে থাকা ছেলেটা তাই চূড়ান্ত চাপে পুরোপুরি দিশেহারা । ওজন কমেছে অনেক । মুখের প্রতিটি ভাঁজে স্পষ্ট বিষণ্ণতার ছাপ ।





এক বছর পর …



আজ মহাসপ্তমী । জাগৃতি সংঘের এ বছরের থিম বাঁশবেড়িয়া মুক্তিদূতের অনুকরণে নির্মিত  ' পাগলাগারদ' । পাগলরূপী অভিনেতাদের মজাদার কীর্তিকলাপ দেখতে পঞ্চমী থেকেই  উপচে পড়ছে দর্শনার্থীদের ভিড় , সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা জাগৃতির স্বেচ্ছাসেবকদের । এরই মাঝে আজ সন্ধ্যায় ভিড়ঠাসা মণ্ডপে হঠাৎই অনুপ্রবেশ ঘটে এক অর্ধউলঙ্গ ব্যক্তির । সুন্দরী , তন্বী, নববিবাহিতা একটি মেয়ের শাড়ির আঁচল ধরে চেঁচাতে থাকে  -- " রুকু তুমি আমার ! আর কারো না ,তুমি শুধু আমার ! আমার ! " মেয়েটির পরনে বাসন্তীরঙা স্বর্ণকাথান। পাশে দাঁড়ানো ওর স্বামী বেশ হতভম্ব মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিবিশেষের আচরণে । প্রথমটায় তিনি উন্মাদ লোকটিকে পুজো  থিমের অঙ্গ ভাবলেও , পরে কমিটির সদস্যদের অতি সক্রিয়তায় নিশ্চিত হন যে পাগলটি বহিরাগত । উন্মত্ত জনতা হয়তো তাকে মেরেই ফেলতো , কিন্তু পারল না কেবলমাত্র রামু ক্ষ্যাপার জন্য । ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজে রক্তাক্ত হয়েও সে বাঁচিয়ে দিল ওই পাগলটাকে ।




মণ্ডপে বাসন্তী শাড়ি পরিহিতা মেয়েটির আঁচল ধরে টানতে থাকা অপ্রকৃতিস্থ, অর্ধউলঙ্গ  ব্যক্তিটির প্রকৃত পরিচয় ইঞ্জিনিয়ার কৃশ দাশগুপ্ত । রুক্মিণীর সাথে ব্রেকআপ , লোনের চাপ , চাকরি ছাঁটাই ---  অল্প বয়সে এতগুলো আঘাত একসাথে সহ্য করার ক্ষমতা কৃশের ছিল না ।  তাই আজ রাস্তার এক বদ্ধ উন্মাদ সে ।  সাইক্রিয়াটিস্ট থেকে নিউরোলজিস্ট, মিউজিক থেরাপি  থেকে কাউন্সিলিং --- লাভ হয়নি কোনো কিছুতেই ; উপরন্তু , ছেলের চিকিৎসার কারণে কৃশের বাবার সঞ্চয়ের স্বল্পতা বেড়েছে সময়ের সাথে সাথে ।





একসময়ের মুখচোরা , দাম্ভিক , রাস্তার মানসিক ভারসাম্যহীনদের ঘৃণাকারী , বিদ্রুপকারী কৃশের রক্ষাকর্তা এখন একবছর আগে তার হাতে মার খেতে খেতে বেঁচে যাওয়া রামু পাগলা । প্যান্ডেলে গান বাজছে ---


 "ভেঙেচুরে যায় আমাদের ঘরবাড়ি , জং ধরে যায় আমাদের তরবারি ; 

 যত ভাবি আলগোছে জল খেতে যাব , জামা ভিজে যায় আর কতদূর যাব ? "





   


                      সমাপ্ত



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু