বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

থিম

 অষ্টমীর রাতেই ঘটল বিপর্যয়টা । ঘড়ির কাঁটা সবে আটটা পেরিয়েছে । বাইরে তখন লাখো মানুষের ঢল । হঠাৎই জ্বলে উঠল মূল মণ্ডপের সামনের দিকের বৈদ্যুতিক তার । কয়েক সেকেন্ড আলোর দপদপানি । মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল সব । ছিটকে আসা আগুনে ঝলসে উঠল মাতৃমূর্তির একাংশ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাইনসমেত রেলগাড়ি ।



তারপর পেরিয়ে গেছে তিনটে ঘন্টা । প্রাথমিকভাবে দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও দায়িত্ব সহকারে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে মুক্তিদূতের স্বেচ্ছাসেবকগণ । পুড়ে যাওয়া থিমের মাতৃমূর্তিকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যত্র । পরিবর্তে সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে শাস্ত্রীয় উপাচারের নিমিত্তে নির্মিত মণ্ডপের একপাশে রাখা ফুট তিনেকের সাবেকি দুর্গা প্রতিমা । ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই । সামনে অপেক্ষমান জনসমুদ্র। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে দর্শনার্থীদের । উদ্যোক্তাদের তরফে মাইকে বারংবার আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতি পুরো বিশ বাঁও জলে ।




জনপ্রিয় সংবাদপত্র থেকে লিডিং নিউজ চ্যানেল , প্রখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ক্ষমতাসীন  রাজ্য সরকার --- পুরস্কারের বন্যা এবার মুক্তিদূতে। ইতিমধ্যেই বাইশটা পালক তাদের  স্বর্ণখচিত মুকুটে , অপেক্ষা করছে আরও কয়েকটা । মিডিয়ার ফোকাস জুড়ে শুধুই মুক্তিদূত । পঞ্চমী থেকেই জনারণ্য মণ্ডপে । উদ্যোক্তাদের অভিনব প্রচার কৌশল আর মানুষের মুগ্ধতায় চড়ে মনমাতানো থিমের খবর ছড়িয়ে পড়েছে শহরের কোণায় কোণায় । কলকাতার বাইরে থেকেও ভিড় জমিয়েছেন অনেকে ।




অকস্মাৎ এমন বিপর্যয়ে পুরো মাথায় হাত পুজো কমিটির সদস্যদের । অনেকে চেষ্টা করেও কোনোরকম কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না থিম মেকার সৌমিক সিনহা । বছরের পর বছর ধরে অভিনব সব মণ্ডপ সে উপহার দিয়ে এসেছে দর্শনার্থীদের । বিদেশেও কাজ করেছে প্রচুর । সৌমিক সিনহা সততই যেন মণ্ডপজগতের ফিদা হুসেন । চমকপ্রদ পরিকল্পনা আর চোখ জুড়ানো ফিনিশিংয়ে তার জুড়িমেলা ভার ।

এহেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেরিয়ারে এই প্রথমবার।  মা দুর্গার ছোট্ট মূর্তিটাকে স্বভাবসিদ্ধ তুলির টানে থিম প্রতিমার স্থলাভিষিক্ত করার উপযোগী করে তুললেও বাঁধ সাধল রেললাইন । ভাঙা অংশগুলো জোড়ার যথাযথ কোনো কৌশল মাথায় আসছে না কিছুতেই । তার ওপর টানা তিনঘন্টা ধরে গোটা মণ্ডপ পুরো অন্ধকারে ।  যথাসাধ্য চেষ্টার পর শেষমেষ রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হল সৌমিকের  ইলেকট্রিশিয়ানরা । ইউটিউবে দীর্ঘক্ষণ চোখ রাখার পরও মিলল না সার্কিট মেরামতির কোনো উপযুক্ত পদ্ধতি । ওদিকে রেললাইনের সঠিক মুখগুলোও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । কপালে চিন্তার ভাঁজ শহরের সেরা থিম মেকারের । মধ্য হেমন্তেও গলদঘর্ম  পুজো কমিটির সদস্যরা । লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ভিড়ের মাঝে মণ্ডপ ভেঙে পড়ার মতো অনভিপ্রেত ঘটনা; সবমিলিয়ে সামনের বছর পুজোর লাইসেন্স বাতিল কেবল সময়ের অপেক্ষা মুক্তিদূতের ।




দেশ-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত সৌমিকের এই আকাশচুম্বী সাফল্যের পিছনে ভ্যাবলা ক্ষ্যাপার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই । অনবদ্য সব শৈল্পিক চিন্তাভাবনা সৌমিকের মগজাস্ত্রে ভর করার পর সেটার সার্থক বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ওই আধপাগলা ছেলেটা । নিখুঁত স্কেচে গোটা প্ল্যানটা পুঙ্খানপুঙ্খভাবে ভ্যাবলাকে বুঝিয়ে দেয় সৌমিক ; তারপর ছেনি , হাতুড়ি নিয়ে নেমে পড়ে কাজে । পেন্টিং কিংবা মাটির যাবতীয় কাজ থিম মেকার নিজে করলেও থার্মোকল আর লোহালক্করের সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকে ভ্যাবলার বিশ্বস্ত হাতে । ইলেকট্রিকের কাজেও ওর জুড়িমেলা ভার । প্রায় এক হাজার শ্রমিক সৌমিকের আন্ডারে থাকলেও ভ্যাবলার মতো অমন দক্ষ নয় কেউ । পাগলটা শ্রমিক নাকি জাতশিল্পী --- ভেবে মাঝেমাঝে ঘাবড়ে যায় সৌমিক নিজেই । 




অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও মোট সতেরোটা প্যান্ডেলের কাজ হাতে নিয়েছে জনপ্রিয়তম থিম মেকার সৌমিক সিনহা । গত সালে দশমী পেরোতে না পেরোতেই টাকার থলি নিয়ে ওর জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন মুক্তিদূতের সহসভাপতি । কন্ট্রাক্টে সই করতে তাই আর দেরি করেনি ধুরন্ধর শিল্পী । তারপর মার্চ মাসে গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার থাবা । দুর্গাপুজোর সম্ভাবনা কমতে শুরু করেছিল ক্রমেই । তৈরি হচ্ছিল উদ্যোক্তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার পরিস্থিতি । কিন্তু জুনের শুরুতেই কমিটির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় , পুজো হচ্ছেই । কাজ শুরু করার অনুরোধ জানানো হয় সৌমিককে। 





তারপর টানা সাড়ে চার মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ ধ্বংসের মুখে । মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘক্ষণ মানুষকে আটকে রাখার পর শেষমেষ নিজেদের অপারগতা স্বীকার করে সমবেত দর্শনার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন মুক্তিদূতের সভাপতি । সীমাহীন অপেক্ষায় ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে জনতার । ব্যারিকেড টপকে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করতে শুরু করেছে মণ্ডপের অক্ষত  অংশ । সৌমিকের কলার চেপে ধরলেন মুক্তিদূতের সম্পাদক --- " এতক্ষণ ধরে এসব ছিনালি না করে তোমার হেডমিস্ত্রিকে তো ডাকতে পারতে বাড়া । কোথায় ওই লাটসাহেব ? তুমি তো শালা স্পটেই আসো না । সব নষ্টামি তো ওই পাগলই করেছে । পুরস্কার আর ফুটেজের লোভে তুমি তো সবে কাল থেকে ঘুরঘুর করা শুরু করেছো প্যান্ডেলে । " 

--- " ফালতু কথা বলবেন না একদম । শহর জুড়ে আরও ষোলোটা প্যান্ডেল আছে আমার । পুরস্কার ওরাও পেয়েছে । আর আমি থিমমেকার ; মিস্ত্রি নই । সব প্যান্ডেলেই সমান সময় দিয়েছি আমি । বাকিটা আমার লেবাররা করেছে । ভ্যাবলা আমার টিমের সবথেকে ভালো লেবার । এখানে পুরো দায়িত্বটা ও নিজের কাঁধে নিয়েছে বলেই আমার আসার প্রয়োজন পড়েনি খুব একটা কিন্তু মূল প্ল্যান তো আমারই ছিল । "

--- " তা এই লোডশেডিং ,মণ্ডপ ভাঙার প্ল্যানও কি তোমার ? কত খেয়েছো অপনেন্ট ক্লাবের কাছ থেকে ? " 

--- " মুখ সামলে মুরারিদা । হাতে-কলমে কাজটা কিন্তু ভ্যাবলা করেছে ,আমি না। ও থাকলে আজ হয়তো …. "

--- " তা শালা ফোন করো না ওই ঢ্যামনাকে !  "

--- " ওর ফোন নেই দাদা । "

--- " তাহলে বাঞ্চোদ আমার গাড়িটা নিয়ে যাও ওর বাড়ি ।  মাঝপথে এভাবে পুজো বন্ধ হলে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে ,ভাবতে পারছো ? ওদিকে পাবলিক তো প্যান্ডেল ভেঙে পুলওয়ামা বানিয়ে দিচ্ছে  । "

--- " ওর ঠিকানা জানি না ,স্যার । "

--- " গাঁজা কি ফ্যাদের সাথে মিশিয়ে টেনেছো নাকি বাড়া ? তোমার লেবার আর তুমি ঠিকানা জানো না ? "

--- " আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন মুরারিদা। আপনাকে মিথ্যে বলে কি লাভ আমার ? " 

--- " ও মা গো ! টুরু ন্যাকা ! যাই হোক , পুলিশ হয়তো আমার পুজো তিন বছরের জন্য ব্যান করবে কিন্তু তোমার কেরিয়ার কিভাবে খতম করতে হয় --- সেটাও আমি দেখে নেব আলবাত । উদ্যোগ আমাদের হলেও মণ্ডপ কিন্তু আলটিমেটলি তোমারই তৈরি । " 

--- " সেকথা তো আমি একবারও অস্বীকার করিনি  , দাদা । তবে প্রথম থেকেই আমি কিন্তু  বলেছিলাম স্পেসের ওপর রেললাইন দাঁড় করানোটা ভীষণ মুশকিলের কাজ । আপনি চটে গিয়ে বললেন ,আপনাদের কোন কর্তা নাকি পিডব্লুডি-এর বড়ো ইঞ্জিনিয়ার । বছরে দুটো করে ব্রিজ বানায় । এসব নাকি কেনি আঙুলে সামলে নেবে । "

--- " তোমার ওই পাগলাচোদা মিস্ত্রি তো সদানন্দকে হাতই দিতে দেয়নি কাজে ! সারাদিন শালা মালের বোতল নিয়ে পড়ে থাকত মাঠে । কি যে করেছে , তা তো দেখতেই পাচ্ছি । "

--- " ফাইনাল টেস্টিংয়ের দিন কিন্তু আপনার ক্লাবের লোকেরাও পরখ করে নিয়েছিল পুরোটা । তখন কিছু বলেননি কেন ?  আজও তো দেখলাম তিনঘন্টা ধরে চেষ্টা করলেন ওনারা । সব নাকি রাজ্য সরকারের কারিগরি বিভাগের বড়ো বড়ো আধিকারিক অথচ  থিমের একটা খেলনা রেললাইন জুড়তে গিয়েই বেলুন পুরো ফুটুস দুরুম আর ওই বিদ্যুৎ সচিব না বোসবাবু কি যেন নাম  ---- শালা একটা কানেকশন ঠিকঠাক করে লাগাতে পারে না ; আবার সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটছে প্রতিবার । ইঞ্জিনিয়ার শালা ! " 

--- " ওরা পারছে না বলেই তো তোমার ভ্যাবলাকে ঢাকতে বলছি । কিন্তু তোমার তো দেখছি বাড়া ধনুক ভাঙা পণ । অন্য ক্লাবগুলোর থেকে যা খেয়েছো , তার দশগুণ বেশি দেব আমি ,ভাই । প্লিজ ওকে ফোন করো একটা । সম্মান যে পুরো স্যাকারিন হয়ে গেল। "

--- " আমি ওর ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছুই জানি না , দাদা । মোবাইল ও ইউজও করে না। "

--- " থাম বাড়া । "





মিথ্যে বলেনি সৌমিক । ভ্যাবলার ফোন নম্বর ও জানে না সত্যিই। বাড়ির ঠিকানাও গত দশ বছরে ভ্যাবলা বলতে চায়নি কোনোদিন । প্রবল জোরাজুরির পরও প্রতিবারই ওর পাথরসুলভ মৌনতার কাছে শেষমেষ হার মানতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের যাবতীয় প্রয়াস । বছর দশেক আগে মৌলালির অফিসে সৌমিকের সাথে প্রথমবার দেখা করতে আসে ভ্যাবলা । মুখ দিয়ে সেদিনও মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল ম ম করে । থিমমেকার হিসেবে সেসময় একরকম অখ্যাতই সৌমিক । কাজও পেত হাতে গোনা দু-চারটে । নেশার ঘোরে ভ্যাবলা যেটুকু বলেছিল তার সারমর্ম দাঁড়ায় --- কলকাতার কোনো এক বিখ্যাত ডেকরেটরের আন্ডারে কাজ করত ও । পরপর লসের ধাক্কায় হঠাৎই ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক । ভ্যাবলা তাই কর্মহারা । বাইরে বড়ো পোষ্টার দেখে পেট চালানোর দায়ে অগত্যা যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের সাথে । একটা কাজ পেলে খুব ভালো হয় । প্যান্ডেলের কাজে নিজেকে ভীষণ দক্ষ বলেই দাবি করেছিল ভ্যাবলা । 



সৌমিক তখন এক্কেবারে নতুন এই ব্যবসায় । দুটো বড়ো পুজোর বায়না এলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক লেবার হাতে নেই বললেই চলে । ভ্যাবলাকে টিমে নিতে তাই ভাবতে হয়নি এক মুহূর্তও । মাতাল ভ্যাবলাও নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় সৌমিকের দৈনিক দুশো টাকার প্রস্তাবেই। সাথে সারাদিনের মদ । হাতে মদের বোতল নিয়ে ভ্যাবলা নেমে পড়ল কাজে । প্রতিদিনই তার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হতে থাকল সৌমিক । ক্রমে ভ্যাবলা হয়ে উঠল সৌমিক ক্রিয়েশনের বেস্ট লেবার । প্রতি বছর পুজোর তিনমাস আগে সে হাজির হয় কলকাতায় সৌমিকের অফিসে । কাজ শেষ করে গ্রামের বাড়িতে ফেরে ষষ্ঠীর রাতে । 

সময়ের সাথে সাথে সৌমিকের খ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছে আজ । মাইনে বেড়েছে ভ্যাবলারও । তিনমাস কাজের বদলে আশি হাজার টাকা এখন সৌমিক তুলে দেয় ওর হাতে । সাথে ঢালাও মদের খরচ তো আছেই ।  বহুবার জিজ্ঞেস করেও  বাড়ির ঠিকানাটা কিছুতেই জানতে পারেনি সৌমিক  ।  সুন্দরবনের বেশি একটা শব্দও বেরোয়নি ওর মুখ থেকে । ঘাটায়নি আর সৌমিকও । কত লেবারই তো কাজে আসে প্রতিবার । কজনের ঠিকানাই বা ঠিকঠাকভাবে জানে ও । তবে ভ্যাবলার মতো দক্ষ শিল্পী সৌমিকের টিমে দুটো নেই , রোয়াবও তাই অনেক বেশি । 





দুহাজার কুড়িতে দাঁড়িয়েও মোবাইল নেই এই ভ্যাবলা ক্ষ্যাপার পকেটে । তবে একপক্ষে তা যেন শাপে বরই হয়েছে সৌমিকের জন্য  । মোবাইল থাকলে এতদিনে বড়ো অঙ্কের টোপ দিয়ে ঠিক ওকে দলে ভিড়িয়ে নিত অন্য কোনো প্রখ্যাত থিম মেকার । ভ্যাবলা যেন সৌমিকের কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রেরিত দূত । ভরপেট মদ আর পুরোপুরি স্বাধীনতা পেলেই পাগলটা বেজায় খুশি । সৌমিকও তাই ওর কাজে হস্তক্ষেপ করে না কোনোদিন । স্কেচের পর একটা গোটা মণ্ডপ প্রতিবছর ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার হাতে । মাটির কিংবা ছবির ব্যাপারটা নিজের হাতে নামিয়ে দিয়ে এলেও ভ্যাবলার প্যান্ডেলের ইলেক্ট্রিক বা শোলার কাজে  নাক গলায় না ভুলেও । মহালয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা গোটা কাজ পার্টিকে একবার দেখিয়ে নেয় ভ্যাবলা । কিছু চেঞ্জের প্রস্তাব এলে সেরে ফেলে পরের দিনগুলোতে কিন্তু তার আগে কেউ নাক গলালেই মটকা যায় গরম হয়ে । বোতল ভেঙে তাড়া করতেও ভাবে না দুবার । এভাবেই চলে আসছে আজ প্রায় দশটা বছর । সবথেকে বড় বাজেটের পুজোটা নির্ভয়ে সৌমিক এখন ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার ওপর আর তাতে ফার্স্ট প্রাইজও মিস হয়না কোনোদিন । 





এবছর ভ্যাবলার আসা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল সৌমিক । একেই করোনায় ট্রেন বাস সব বন্ধ । তার ওপর অতিমারিতে বেঁচে আছে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই । যোগাযোগেরও উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না কোনো । সবমিলিয়ে সতেরোটা পুজো হাতে থাকলেও কাজ নামানো নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিল ছেলেটা । যদিও ততদিনে স্কেচ কমপ্লিট প্রায় সবকটারই । রথের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে হঠাৎই সৌমিকের অফিসে এসে হাজির মূর্তিমান ভ্যাবলা । দেখামাত্রই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সৌমিক। এ যেন সাক্ষাৎ ঈদের চাঁদ । এই অতিমারিতেও যে সাইকেল পায়ে উদয় হবে ভ্যাবলার , দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সৌমিক । ভ্যাবলাকে নিয়ে সটান সে হাজির হল মুক্তিদূতের অফিসে । সৌমিকের প্ল্যান শুনেই উল্লাসে ফেটে পড়ল ক্লাবকর্তারা । কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেমন যেন মিইয়ে গেল ভ্যাবলা । থিমটা শুনেই ইতস্ততভাবে বলে উঠল --- " এটাকে কি কিছুতেই পাল্টানো যাবে না সৌমিকবাবু ?" রে রে করে উঠলেন সম্পাদক --- " আরে এই থিমের জন্যই তো কর্পোরেট টাকা দেবে আমাদের । পাগলা নাকি আপনি ? সৌমিক ভাই , তুমি তো পুরো লেজেন্ড আছো , দেখছি ! মাশাল্লাহ প্ল্যানিং বিলকুল । " ভ্যাবলার বিরোধিতার কারণে তাকে প্যান্ডেলের কাজে রাখার ব্যাপারে সম্পাদকমশায় প্রবল আপত্তি জানালেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা শেষমেষ সামলে নিল সৌমিক । মিষ্টিমুখ দিয়ে সমাপ্তিতে পৌঁছল আলোচনা পর্ব ।




গাড়িতে যেতে যেতে এবং অফিসে এসে একপ্রস্থ গোটা ব্যাপারটা সৌমিক ভ্যাবলাকে ব্যাখ্যা করে দিল নিখুঁতভাবে । পরদিন থেকেই অস্ত্র হাতে কাজে লেগে পড়ল ভ্যাবলা । নির্ধারিত দিনের আগেই শেষ হল কাজ । মাঝে সৌমিকও গিয়ে ঢুঁ মেরে এসেছে কয়েকবার । ভ্যাবলার কাজে স্তম্ভিত মুক্তিদূতের কর্তারাও । মণ্ডপ পরীক্ষার জন্য আসা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ইলেকট্রিশিয়ান প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলেই । কিন্তু শিল্পী বরাবরের মতোই নির্বিকার । বোতল হাতে বিস্ফারিত চোখে সে শুনে চলে সব । তারপর ষষ্ঠীর দিন রাতে সকলের অজান্তেই পারিশ্রমিক না নিয়েই উধাও হয়ে যায় সৌমিকের অফিসের একতলার লেবার রুম থেকে ।  পড়ে থাকে বিছানা , ব্যাগ ।দেয়ালে মদের বোতল দিয়ে লিখে দিয়ে যায় --- " পার্ক সার্কাসের বস্তিতে শালা ছড়িয়ে দিস এই টাকা । মৃত্যু নিয়ে খেলছে চুদির পোলা । "




ইতিমধ্যেই মুক্তিদূতের মণ্ডপে এসে হাজির হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী । দর্শক হাঙ্গামায় ভেঙে গুড়িয়ে গেছে সব । গ্রেফতার মুক্তিদূতের তিন বড়ো কর্তা এবং সৌমিক সিনহা । গভীর অন্ধকারে কুলতলির এক নদীর তীরে মদের বোতল হাতে পড়ে রয়েছে ভ্যাবলা । বাড়ি তার ভেসে গেছে বছর বারো আগের আয়লায় । তারপর থেকে ভাড়া থাকা এর ওর কুঁড়েঘরে । গতবছর ফনী এসে খেল বউটাকে। চাষের জমি গেল আমফানের পেটে আর ছেলেটা রেলে কাটা পড়ল লকডাউনে মহারাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে । হতাশ ভ্যাবলা ঠিক করে আর কোনোদিন পা রাখবে না কলকাতায় । করবে না আর থিমের কাজ । যে মায়ের পুজোর আয়োজনে আন্তরিকভাবে  প্রাণপাত করে চলেছে দীর্ঘ দশ বছর ধরে , সেই মা-ই তো ওকে সুখ দিল না কোনোদিন । বরং ধাপে ধাপে এক এক করে কেড়ে নিল সব । প্রখর রোদে সারাটা দিন সাইকেল চালিয়ে সৌমিকবাবুকে কাজ ছাড়ার কথা  জানাতে গিয়ে ভ্যাবলা হাতে পেল নতুন কাজের প্রস্তাব। 

থিমের প্ল্যানটা শুনেই রক্ত চড়ে যায় মাথায় --- " হাঁটল ওরা হাজার মাইল , ফিরবে বাড়ি বলে / ক্লান্ত হয়ে লাইনে শুল , কাটল গলা রেলে । " কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় কোনোমতে । মণ্ডপ নির্মাণে রেখে দেয় মোক্ষম কিছু খুঁত যা সাধারণের চোখে পড়া রীতিমতো অসম্ভব । অষ্টমীর রাতে ভোল্টেজ বাড়তেই ফেল করে সার্কিট । চাপ পড়তেই ভেঙে পড়ে থিমের রেললাইন । সবই আদতে ভ্যাবলার নিখুঁত কৌশলের ফল । এভাবেই নিঃস্ব এক জাতশিল্পী নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে এলিট সমাজের বর্বরোচিত মানসিকতার । গরিবের মৃত্যুকে হাতিয়ার করে কর্পোরেটের পুরস্কার জয়ের পরিকল্পনায় বিছিয়ে দিয়ে যায় কাঁটা ।




ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে । পুলিশ সিল করে দিয়েছে মুক্তিদূতের মণ্ডপ । নদীর তীরে খালি গায়ে পড়ে রয়েছে ভ্যাবলা । স্বপ্নে সে দেখছে হাজার তারার ঝলকানি । পথে মৃত লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ খুলে হাসছে যে…. 




পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু