বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ক্যানভাসে ২০৫০ সালের স্বপ্ন

মনের ক্যানভাসে স্বপ্ন আঁকা শুরু হ’য়েছে জন্মের পর থেকেই, ন’মাস ধ’রে গর্ভে লালন করার পর মার স্বপ্ন যখন সত্যি হ’য়ে পৃথিবীর মাটি ছুঁয়েছিল, তখন থেকে শুরু হ’য়েছিল আমার স্বপ্ন দেখা – সে স্বপ্ন বর্ণনা করার ভাষা আমার তখন জানা ছিল না – হয়তো এখনও নেই। তবু ক্যানভ্যাসের সে ছবিটি এখনও ভুলিনি – ছবিটি বাবার; স্বপ্ন – আমি ‘বাবা’ হবো।

তারপর একদিন বাবার মতো হাঁটতে শিখেছি। বাবার হাত ধ’রে হেঁটেছি শহরের রাস্তায় – দেখেছি বিলবোর্ডে বিরাট আলোকিত কেটলি থেকে লিপটনের চা পড়ছে কাপে – কেটলি খালি হ’য়ে ভর্ত্তি হচ্ছে কাপ; তারপরে আবার ভর্ত্তি হচ্ছে কেটলি, খালি হচ্ছে কাপ – চলেছে একই খেলা। তারপরে দেখেছি – বাবার জুতোটা আমার চাইতে অনেক বড়ো, লেখাপড়ায়-কাজকর্ম্মে বাবা অনেক জানে। বাবা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকতেন, সাতজনের সংসারে অনেক খরচ – দশটা থেকে পাঁচটা চাকরী এ.জি.বেঙ্গলে,-  টিউশনীও ক’রতেন- একটা কাজের আগে সকালে, আর একটা কাজ থেকে ফেরার পরে সন্ধ্যায়। সকালে টিউশনীতে যাবার আগে বাবা যখন দাড়ি কামাতেন, তখন শুনতেন আমি বাংলা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ ঠিক ঠিক ক’রেছি কিনা, শুধরে দিতেন ভুলগুলো; তেমনিই দেখতেন আমার অঙ্ক ঠিকমতো কষা হ’য়েছে কিনা। তখনও আমার স্বপ্ন – আমি ‘বাবা’ হবো; বাবার মতো অনায়াসে ক’রবো সব অঙ্ক, অনায়াসে লিখবো বাংলায়, অনায়াসে লিখবো ইংরেজীতে।

এর পরে অনেক মনীষীর জীবনী পড়েছি, স্বপ্ন দেখেছি রবীন্দ্রনাথ হওয়ার, নজরুল হওয়ার, মাইকেল মধুসূদন হওয়ার, সুভাষ বোস হওয়ার, জগদীশ বোস হওয়ার, বিবেকানন্দ হওয়ার; আর কতজনের নাম ক’রবো, কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না – এক কথায় ব'লতে গেলে – এঁদের মধ্যে ঈশ্বর দেখেছি, না, এঁদের মধ্যে মানুষ দেখেছি, স্বপ্ন দেখেছি আমি সেই মানুষ হবো। কিন্তু কী ক’রে আমার এতো স্বপ্ন সফল হবে তার কোনো ধারণাই ছিল না। স্কুলে পড়ার সময়, অনেক শিক্ষককেই আমার আদর্শ মানুষ ব’লে মনে হ’তো; স্বপ্ন দেখতাম ওঁদের মতো হবো একদিন।

এই স্কুলে পড়ার সময়েই, আরও একজন কাছের মানুষ আমার আদর্শ হ’য়ে উঠলো – সে আমার দাদা। দাদা ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষায় চারটি বিষয়ে লেটার মার্কস বা শতকরা আশির বেশী নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ ক’রেছিল। তাই আমার স্বপ্ন ছিল আমিও অনেক নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ ক’রবো। দাদাকে আমি রোজ দেখেছি অনেক কাছ থেকে। দাদা ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষা দিয়েছিল চক্রবেড়িয়া হাই স্কুল থেকে; আমিও ক্লাস ফাইভ থেকে ভর্ত্তি হ’লাম ঐ একই স্কুলে। আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত যে ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ ক’রবো। এর জন্যে বড় একটা চেষ্টা ক’রতে হবে না আমাকে। প্রত্যেক বছর সব বিষয়ে সবার চাইতে বেশী নম্বর পেয়ে ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট হচ্ছিলাম। পড়াশোনা ছাড়াও আমার ডাক পড়তো স্কুলের অনেক ফাংশানে – আবৃত্তি করার জন্যে; একবার স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমাকে ডাক দিলেন সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করার জন্যে; তারা, মুদারা, উদারাতে গলা উঠিয়ে নামিয়ে আবৃত্তি ক’রলাম – “মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্ ; ইয়ৎ কৃপা ত্বমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্।“

স্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো যখন দাদা এলো বাড়ীতে – ওর সিন্দ্রি ফার্টিলাইজার কোম্পানীর কাজ থেকে ছুটিতে। দাদা এসেই  জানতে চাইলো আমি কী নিয়ে পড়ছি। ক’লকাতার অনেক স্কুলে তখন এগারো ক্লাসের পাঠক্রম শুরু হ’য়েছে – তিন ধরণের পাঠক্রম – সাহিত্য, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান। যে চক্রবেড়িয়া হাই স্কুলে আমি পড়ছিলাম, সেখনে সাহিত্য বা বাণিজ্য নিয়ে পড়তে পারতাম, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না। দাদা এসে ব’ললো যে বিজ্ঞান নিয়ে না পড়লে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া যাবে না। বিজ্ঞান পড়তে হ’লে আমাকে স্কুল বদলে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হ’তে হবে। মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হ’তে গেলে ঐ স্কুলের কোনো শিক্ষকের সার্টিফিকেট চাই। ভাগ্য ভালো যে, একজন শিক্ষক যিনি দাদাকে চক্রবেড়িয়া স্কুলে পড়াতেন, তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক, তাঁর সুপারিশে ভর্তি হ’লাম মিত্র ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু শুরু হোলো আর এক সংগ্রামের, তখন বছরের পাঁচ মাস কেটে গেছে; ক্লাসে বিজ্ঞানের প্রতি বিষয়ে ক্লাস নাইনের সিলেবাসের অর্ধেক পড়ানো হ’য়ে গেছে। এখন ক্লাসের পরীক্ষায় কি ক’রে পাশ ক’রবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।

আমি যেদিন প্রথম মিত্র ইনস্টিটিউশনে গেলাম আর ক্লাসের বন্ধুদের জানালাম যে আমি চক্রবেড়িয়া স্কুল থেকে এসেছি, তখন সবার চোখেই অবজ্ঞা নজরে এল। একটু বাদেই বীজগণিত ক্লাস সুরু হ’লো। আগের স্কুলে আমি বীজগণিত শিখিনি। মাস্টারমশাই দুটো সমীকরণ ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন আর সমাধান ক’রতে ব’ললেন :

সমাধান করো :   X   +  2Y  =  5 …..(১)

                2X    +  3Y  =  8 .....(২) 

আমি দেখলুম অন্য ছেলেরা একটা সমীকরণ থেকে আর একটা সমীকরণ যোগ/বিয়োগ ক’রছে। আমি জানি না কি ক’রতে হবে। মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা ক’রলে আমি ব’ললুম, “X+Y = 3, স্যার”।

আমার চারপাশের ছেলেরা হেসে উঠলো। মাস্টারমশাই শান্তভাবে ব’ললেন, “মনে হচ্ছে তুমি কোনদিন বীজগণিত করোনি। আমি তোমাদের X আর Y এর মান বার ক’রতে ব’লেছি, X+Y এর না। ক্লাসে বীজগণিতের বইয়ের দশম পরিচ্ছেদ পড়ানো হচ্ছে; তোমাকে এর আগের ৯টা পরিচ্ছেদ পড়ে নিতে হবে। যাই হোক, তুমি পেয়েছো X + Y = 3; এই সমীকরণ বাদ দাও (১) সমীকরণ থেকে। তুমি পাবে Y=2; আর X =3–Y = 3-2 = 1

আমি বাড়ি গিয়ে দিদিদের সাথে বীজগণিত শেখার ব্যাপারে কথা ব’ললাম আর বইয়ের ১ থেকে ১০ পরিচ্ছেদের অঙ্কগুলো নিজেই কষে ফেললুম। পরের বারে বীজগণিত ক্লাসে আমার সমাধান ক’রতে কোন অসুবিধা হয়নি।

নবম শ্রেণীর ষান্মাসিক পরীক্ষায় আমি অঙ্কে শতকরা ১০০ নম্বর পেলাম। অঙ্কে ছিল পাটীগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোনমিতি ও জ্যামিতি। বিজ্ঞান বিষয়ে আমি পেলাম শতকরা ৯০ নম্বর, আর সাহিত্য বিষয়ে আমি পেলাম শতকরা ৬৫ নম্বর। আমার দ্বিতীয় স্থান হ’লো ক্লাসে। আমার বিনা-মাইনের পড়া আর এক বছরের জন্য অনুমোদিত হ’লো আর আমাকে সি-সেকশনে পাঠানো হ’লো।  আমি সি-সেকশনের অন্য ভালো ছেলেদের সঙ্গে তাল রাখার চেষ্টা ক’রেছিলাম। বার্ষিক পরীক্ষার ফল বার হ’লে দেখা গেল আমার নাম ক্লাসের অন্য ছেলেদের থেকে সবচেয়ে আগে। প্রতিটি বিষয়েই আমি পেয়েছি সব চেয়ে বেশী নম্বর। 

মিত্র ইনস্টিটিউশনের ক্লাস নাইনে ফার্সটবয় হওয়ার পরে শুরু হ’লো আরো দুটো নতুন স্বপ্ন:  এক - দাদার মতো ইঞ্জিনীয়ার হবো, আর দুই –হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষায় ফার্স্ট  হবো। মিত্র ইনস্টিটিউশন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পাঁচটি স্কুলের একটি; ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস ইলেভেন পর্য্যন্ত আমি এখানে ফার্স্ট হ’য়েছি। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক আগের দিন এক দুর্ঘটনা ঘটলো – বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম একটু দূরে, হঠাৎ ঝড় উঠলো, দৌড়লাম কোথাও আশ্রয় নেবার জন্যে, পড়লাম হোঁচট খেয়ে, ভাঙলো চশমা – ফ্রেমের অনেকটাই আর একটা কাঁচও। তারপরেই শুরু হ’লো তুমুল বৃষ্টি; দাঁড়াতেই হ’লো এক বারান্দার তলায়। যখন বাড়ী ফিরলাম তখন রাত আটটা। মা কাটা জায়গাতে একটু ড্রেসিং ক’রে দিলো; কিন্তু চশমাটা আর পরা গেলো না। পর পর ছ’দিন ধ’রে পরীক্ষা – এর মধ্যে নতুন চশমা ক’রার কোনো সুযোগ নেই, হয়তো খরচ করার মতো অতটা টাকাও নেই বাড়ীতে। অগত্যা কোনো চশমা ছাড়াই সব পরীক্ষা দিতে হ’লো।

হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার কুড়ি দিন পরে খড়্গপুর আই-আই-টিতে অ্যাডমিশন টেস্ট; তার আগে বাবা নতুন চশমা ক’রিয়ে দিয়েছেন। এখানে মূল পরীক্ষা তিন ঘন্টার – তার মধ্যে প্রায় দুহাজার multiple choiceএর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে – হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। এক রাত্তিরের জন্যে ওখানে থাকতে হ’য়েছিল; দাদা আমার সঙ্গে গিয়েছিল। পরের দিন ফিরে আসার আগে রেজাল্ট দেখলাম – আমার রোল নম্বর লিস্টের মধ্যে প্রথম।

এর কিছুদিন বাদে শিবপুরে বি.ই. কলেজের অ্যাডমিশন টেস্ট; হাওড়া থেকে ওখানে যাওয়ার বাসের সংখ্যা খুবই কম; অনেককেই বাসের ছাদে চেপে যেতে হ’য়েছিল। এখানে সফল পরীক্ষার্থীদের তালিকায় আমার স্থান ছিল পঞ্চম।

এর কিছুদিন বাদে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো। সায়েন্স সাবজেক্টে আমার স্কোর সব চাইতে বেশী। কিন্তু বাংলা আর ইংরাজীতে ৫৫% মার্কস পাওয়ায় আমার স্থান কুড়ি নম্বরে। তবে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার স্বপ্ন নিশ্চয় সফল হবে।  রেজাল্ট বেরোনোর কয়েকদিনের মধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্যে নির্বাচিত ছাত্রদের নাম প্রকাশ ক’রলো – সেই তালিকার প্রথমেই আমার নাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম; কারণ এখানে আমার হোস্টেলে থাকার-খাওয়ার খরচ লাগবে না। এছাড়া আমি মাসে ১০০টাকা ন্যাশনাল স্কলারশিপ পাবো আর কোনো মাইনে দিতে হবে না।

পাঁচ বছর ধ’রে  ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে, ইঞ্জিনীয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হোলো। কোনো স্বপ্ন না দেখেই বিশ্ববিদ্যলয়ের জার্নালের সম্পাদক হ’লাম, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বেতার-নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম হ’য়ে ইউনিভার্সিটির ব্লেজার পেলাম। এখানেও একটু আফশোষ রয়ে গেলো – পাঁচ বছর ধ’রে ফার্স্ট হওয়ার পরে অবশেষে সেকেণ্ড হ’য়ে ইঞ্জিনীয়ারিং ডিগ্রি পেলাম।

ইঞ্জিনীয়ার হবার পরের স্বপ্ন- সুখী বিবাহিত জীবনের স্বর্গ। দাদা ও দিদিদের বিয়ে হ’তে হ’তে সাত বছর কেটে গেলো, তারপরে আমারও সেই গতানুগতিক সিদ্ধান্ত।

দিদিদের বিয়ে দেওয়া সহজ হয়নি বিশেষতঃ অহেতুক যৌতুক-দাবীর কারণে। এম.এস.সি.তে ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট মেজদি বাবা-মাকে না জানিয়ে চাকরীর অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছিল পাশের বাড়ীর ঠিকানা দিয়ে। ইন্টারভিউ দিয়ে ম্যাথেমেটিক্স টিচারের চাকরী পাওয়ার পরে মা-বাবার সম্মতি পেয়েছিল অনেক বুঝিয়ে – বিয়ের ঠিক হ’লে যৌতুকের জন্যে খরচ করার প্রতিশ্রতি দিয়ে। বিয়ের পরে অবশ্য চাকরী ছাড়তে হ’য়েছিল ওকে; কিন্তু কয়েক বছরের রোজগার থেকে যৌতুকের ৯০% খরচ মেজদি দিয়েছিল।

 

আমার যখন বিয়ে হ’ল তখন স্ত্রী-স্বাধীনতার আন্দোলন আরো জোরদার, কিন্তু এ আন্দোলনে স্বাবলম্বিনী হবার প্রয়াস নেই; আছে উচ্চশিক্ষার অজুহাতে স্বামীর কর্ম্মস্থলে না গিয়ে ক’লকাতায় থেকে ‘পালি’র মত বিষয়ে এম.এ. পড়া আর কলেজ পালিয়ে নানা পুরুষের যৌন সংসর্গ উপভোগ করা; কারণ, বিবাহিতা নারী গর্ভবতী হ’লে দায়িত্ব নিতে হবে স্বামীকেই।

 

বিয়ের প্রায় দু’বছর পরে, আমার বাবা রয়েছেন টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে গল-ব্ল্যডারের সার্জারীর জন্যে। পুত্রবধূ সুভদ্রা এলো টাটানগরে, কিন্তু শ্বশুরের জন্যে তার চিন্তা নেই, চিন্তা কেবল কি ক’রে ফোন করা যায়। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কলোনী থেকে কলকাতায় ফোন করা যায় না; তাই সুভদ্রা ডাকযোগে চিঠির আদান প্রদান করা শুরু ক’রলো।

এমনই একটা দিনে আমি খুবই ক্লান্ত; আগের রাত্তিরের পুরোটাই কেটেছে হাসপাতালে; সকালে এসে দাড়ি কামিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে অফিসে যাবার জন্যে বেরোবো, সুভদ্রা আমার হাতে একটা চিঠি দিল পোস্ট করার জন্যে। কয়েক ঘন্টা পরে ফিরলাম একটু চান ক’রে ভাত খেয়ে আবার কাজে বেরোবো ব’লে; সেখান থেকে ৪টে নাগাদ যাবো হাসপাতালে বাবার খোঁজখবর/রিপোর্ট নিতে; সেখান থেকে সন্ধ্যে ৬-টার সময়ে যাবো টিসকোর ডেটা-সেন্টারে; তারপরে যাবো হাসপাতালে রাত্রে বাবাকে দেখাশোনা করার জন্যে, যদি দরকার থাকে। লাঞ্চ সেরে ঠিক বেরোতে যাবো সুভদ্রা দাঁড়ালো একটা চিঠি হাতে; চিঠিটার ঠিকানা দেখে বললুম, ‘আজ সকালেই তো পোস্ট করেছি চিঠি এই রবীন্দর গোয়েলকে, আবার এত তাড়াতাড়ি কিসের চিঠি?’

সুভদ্রা বললো, ‘সকালের চিঠিতে একটা জরুরী কথা লেখা হয়নি; তাই আবার লিখতে হোলো?’

 ‘কে তোমার এই রবীন্দর গোয়েল?’

 ‘তোমার জানার দরকার নেই; ও অনেক সাহায্য করে – বাড়ীর লোকের চাইতে বেশী।‘

 

চিঠিটা ব্রীফকেসে ভ’রে বেরিয়ে এলুম বাড়ী থেকে।  নীচের লেটার বক্স খুলে দেখলুম – একটা চিঠি এসেছে রবীন্দর গোয়েলের কাছ থেকেই সুভদ্রাকে লেখা; খামটা নিয়ে ব্রীফকেসে রাখলুম, স্কুটার চালু ক’রে বেরিয়ে পড়লুম।

 

হাসপাতালে স্কুটার পার্ক ক’রে ব্রীফকেস থেকে বার ক’রলাম চিঠিদুটো। প্রথমে পড়লাম রবীন্দর গোয়েলের চিঠিটা – ‘মেরা বাজী জিৎ গয়া’; তার আগে সুভদ্রাকে নিজের কোলে চড়ানোর নিখুঁত বিবরণ। তারপরে সুভদ্রার লেখা ইনল্যাণ্ডটা না খুলে পারলুম না – ‘‘দুঃখিত,  এইমাত্র পিরিয়ড হ’য়েছে। ফিরে গিয়ে ইচ্ছে-পূরণ ক’রবো।‘

 

মনের ক্যানভাসে আঁকা বিবাহিত জীবনের স্বপ্নের উপর চেপে ধ’রলো এই দুটো চিঠি। বিবাহ-বিচ্ছেদ অনেক খরচ-সাপেক্ষ; এছাড়া এতে অনেক সময় খরচ ক’রতে হবে। মাত্র এক বছর আগে ইণ্ডিয়ান টিউব কোম্পানীকে কম্পিউটারাইজ করার দায়িত্ব দেওয়া হ’য়েছে আমাকে, সেজন্যে দিনে দশ ঘন্টা খাটতে হয়; ক’লকাতায় গিয়ে মামলা নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই আমার। সুভদ্রাকে অনুরোধ ক’রলাম বিনা মামলায় ডিভোর্সে রাজী হ’তে; ও রাজী হ’লো না, বললো যে ওর বাবা এ খবর জানলে ওকে কেটে ফেলবে। ভাবলাম, সুভদ্রাকে ডিভোর্স ক’রে অন্য কাউকে বিয়ে ক’রলে সেও এরকম প্রতারণা ক’রতে পারে। তাই আমি গবেষণা শুরু ক’রলাম কীক’রে আজকালকার পরিস্থিতিতে বিয়ের কুসংস্কার নির্মূল ক’রে দেওয়া যায়, আমাদের জীবনধারা অব্যাহত রেখে।

 

আরও কয়েকবছর পরে কানাডার হাইকমিশন, আমার কম্পিউটারের দক্ষতার জন্যে,  আমাকে ঐদেশের নাগরিক হ’তে আমন্ত্রণ জানালো। আমার ছোটবেলায়, কম্পিউটারের তেমন চল ছিল না; স্বপ্নেও ভাবিনি কম্পিউটারের কাজ শিখে কানাডায় যাবো। সুভদ্রার বাবা-মার প্রথমে মত ছিল না, পরে সুভদ্রাকে আমার সঙ্গে কানাডায় যেতে দিলেন।

 

আমি কানাডা থেকে ক’লকাতায় এসেছি কয়েক সপ্তাহের ছুটিতে। আমার দাদা দিল্লীতে থাকে ব’লে আমাকে অনুরোধ ক’রলো, ‘বাবার পৈতৃক বাড়ীর দলিলটা নতুনকাকার কাছে আছে। তুই নতুনকাকার ফ্ল্যাট বাড়ীতে গিয়ে ঐ দলিলটা চেয়ে নিয়ে আয়। এখন বাবার পৈতৃক বাড়ীতে যে খুড়তুতো ভাইরা থাকে তাদের সঙ্গে আলোচনা ক’রে ঐ বাড়ীর জায়গায় একটা অনেক-তলা বাড়ী তৈরী করাবো। এতে খুড়তুতো ভাইদের প্রত্যেকে একটা ক’রে ফ্ল্যাট পাবে।‘

অনেক দিন পরে দেখা ক’রতে এসেছি নতুন কাকার সঙ্গে। ওঁর বাড়ীর দরজায় বেল বাজাতেই বেরিয়ে এলেন নতুন কাকা। আমি অবাক হ’য়ে দেখলাম- অশ্রুমাখা দুচোখ নতুনকাকার; ‘দাদা’ ব’লে আমাকে বুকে নিলেন জড়িয়ে। ঘটনার দিনে আমার বয়সে লেগেছে পঞ্চাশের ধকল, ঐ বয়সে বাবাও কি ছিলেন আমার মতো অবিকল?

আমার ঠাকুর্দা যখন ইহলোক ছেড়ে যান তখন বাবা সবে বি.এ. পাশ ক’রে এ.জি.বেঙ্গলে চাকরীতে ঢুকেছেন। বিধবা মা আর সব ভাইবোনেদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আমার বাবা; নতুনকাকা তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তেন। আমার বাবাকে ‘দাদা’ ব’লে ডাকলেও ভালবাসতেন নিজের বাবার মতো। জানিনা, বাবাকে বা নতুনকাকাকে কি এতো ভালো বেসেছি কখনো? বাবার গর্ব্বে ফুলে উঠলো বুক, মাথা উঁচু হোলো। আমার শিশুমনের ক্যানভাসে যে স্বপ্নটি লেখা হয়েছিল, সেটা আজ অনায়াসে সফল হ’লো – অন্ততঃ নতুনকাকার চোখে আমি ‘বাবা’ হ’তে পেরেছি।

 

একটাই স্বপ্ন আঁকা আছে মনের ক্যানভাসে – সীমান্তহীন বিশ্বে নির্বিবাহ সমাজ। ২০৫০সাল  থেকে মিথ্যে হোক ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ শ্লোকটি, সত্য হোক সে-স্বপ্ন:

এখন বিবাহের আর নেই কোনো দরকার,

বরফে বাঁচিয়ে রাখো শুক্রানু-ডিমের ভাণ্ডার;

       আইভিএফে হবে সন্তানের বিকাশ।

সব তরুণ তরুণীদের নির্বীজন যৌবনে হয়;

হাসপাতালে থাকে শুক্রানু-ডিমের যত সঞ্চয়;

       থাকে নির্বিবাহ প্রেমের নির্ভয় আশ্বাস।

অবাধ প্রেমের অনায়াস দিগ্বিজয়,

তবু অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম নয়;

       স্ত্রী নহে ক্রীতদাসী, নহে স্বামী ক্রীতদাস।।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু