বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

দেবীপক্ষ



কালচে আকাশের কোলে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে সাদা মেঘের আস্তরণ। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকা শহরটা আড়মোড়া ভাঙছে একটু একটু করে। 


রেডিওয় মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রে বাতাস মুখরিত, প্রতিটি রোমকূপে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিহরণ। 


বসে আছি শ্মশানঘাটে। পাশ থেকে কলকল শব্দে বইছে পুণ্যতোয়া ভাগিরথী। দু একটা নিভন্ত চিতায় এখনো বেঁচে আছে নশ্বর শরীরের টুকরো অস্তিত্ব। ধোঁয়া উড়িয়ে ভষ্ম হচ্ছে তারা, মাটিতে মেশা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। 


দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর। নদীতে ভাসছে পরিত্যক্ত ফুলমালা, অস্থিকলস। নিজের শেষটুকু ভাসিয়ে আত্মা ছুটে চলেছে পরমাত্মার সন্ধানে, কোনো বিরতি নেই... নিয়মে এতটুকু খামতি নেই। 


আমার অবশ্য এই শ্মশানে আসার উদ্দেশ্য অন্য। ভৈরববাবা এখানেই দেখা করতে বলেছেন আমায়। প্রায় একমাস হলো অশান্তির শেষ নেই। শেষ খড়কুটো হিসাবে আঁকড়ে ধরেছিলাম ভৈরববাবাকেই। প্রথমে পাত্তা দেননি তিনি, বিফল মনোরথে ঘুরে গেছি বারবার৷ কিন্তু পরে বিপদের গুরুত্ব বুঝে তিনি নিজেই যোগাযোগ করেছিলেন। 


আপনারা জানতে চান কি বিপদ হয়েছে আমার! তবে শুনুন, আমায় বাণ মারা হয়েছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বাণ। মেরেছেন আমার স্ত্রী। অবশ্য তিনি কোনো তন্ত্রসাধক নন, বাণ মারার কোনো ক্ষমতাই নেই তাঁর। তবে দুটো টাকার লোভে এমন করা খুচরো তান্ত্রিকের অভাব নেই দেশে। 


বুঝতে পারিনি প্রথমে। যেদিন প্রথমবার রক্তবমি হলো অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত আমিও ছুটে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে। একগাদা টেস্টের রিপোর্ট যখন গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর দিতে পারলো না তখন ভাবতে বসলাম। তবে ততদিনে সমস্যা আরো বেড়েছে। অনর্থক ভয় পাওয়া শুরু করেছি আমি। এমনিতে বন্ধুমহলে আমি বেশ ডাকাবুকো হিসাবেই পরিচিত। কিন্তু প্রদত্ত বিশেষণের সঙ্গে নিজেকে যেন মেলাতে পারছিনা আজকাল। অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে, প্রবল মৃত্যুভয় আচ্ছন্ন করে দেয় সমগ্র চিন্তাশক্তি। মাঝেমাঝেই বুকের বাঁদিকে অসহ্য চিনচিনে ব্যথা, এদিকে ইসিজি রিপোর্ট সম্পূর্ণ নর্মাল। আমার মতো বেপরোয়া মানুষ দিনদিন কেমন যেন খোলসের ভেতরে গুটিয়ে পড়ছিলাম। খিদে - তেষ্টা সবই তিরোহিত হয়েছিল। অতিকষ্টে দেহের খাঁচাটুকু টেনে ধুঁকতে ধুঁকতে অফিসে যেতাম, মুখ চোখ দিনদিন মসীবর্ণ ধারণ করছিলো। 


বুঝতে পেরেছিলেন আমার ধাত্রীমা। সামনের বস্তিতেই তাঁর বাস। একদিন হটাৎ দেখা করতে এসে আমার অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। ওহ, আপনাদের বলা হয়নি... আমার স্ত্রী ধাত্রীমাকে পছন্দ করেন না বিশেষ। তাই এবাড়ির দোর তাঁর জন্য বহুকাল বন্ধ। কষ্ট পেয়েছিলেন ঠিকই, প্রতিবাদ করেননি। সেদিন কি মনে হতে ছুটে এসেছিলেন জানিনা, তবে তিনি না এলে আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তির পথ যে আরো সুগম হতো তা বলাই বাহুল্য। 


জোর করে তিনিই আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন বড়পীরের দরগায়৷ বৃদ্ধ ইমামসাহেব ময়ূরপুচ্ছের ঝালরটি আমার মাথায় বুলিয়ে থম মেরে বসে বেশ কিছুক্ষণ। তারপরে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলেন নিজ অক্ষমতার কথা। আমায় নাকি খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে কোনো দুর্ধর্ষ প্রেতের নশ্বর শরীরভষ্ম খাওয়ানো হয়েছে। সেই প্রেতপ্রভাবেই আজ আমার এই অবস্থা৷ ইমামসাহেব বলেছিলেন, এ কোনো কাছের লোকের কীর্তি। বিশেষ করে যার হাতে হেঁশেলের দায়িত্ব। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চমকে উঠেছিলাম, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল৷


সরমা এমন করতে পারে একথা আমি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারি না। যখন আমার কিচ্ছু ছিল না তখনো ছিল সে, আজ যখন আমি প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী তখনো সেই আছে। এ কেমন করে সম্ভব! 


বাড়ি ফিরেই ফোন করলাম অভিজিৎকে। পুরাতন বন্ধু, নতুন গোয়েন্দা এজেন্সিও খুলেছে নাকি শুনেছি। আমার কাছে সব শুনে সে আমায় অভয় দিলো,  সাতদিনের ভেতরেই প্রকৃত সত্য উদঘাটন করবে সে। 


একি! একি দেখছি আমি! সরমা অন্য কারো সঙ্গে! এও কি সম্ভব! তবে কি আমার সম্পদের লোভে সেই! নাহ, আর দেরী করা যাবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি মরবো না আমি। বাঁচার সাধ আমার প্রবল। 


আকাশটা ফর্সা হচ্ছে ধীরে ধীরে। জাহ্নবীতীরে তর্পণ করতে জড়ো হচ্ছে অজস্র মানুষ। পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করে কামিয়ে নিতে চাইছে কিছু পুণ্যের কড়ি। ঘাটে বসে আত্মসর্বস্ব মানুষের আনাগোনা দেখছি আমি। ভৈরববাবার দেখা নেই। 


আরে ওই তো! 


ছোট ছোট পা ফেলে এদিকেই তো আসছেন! একরাতেই কেমন বুড়িয়ে গেছেন মনে হলো। চলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তাঁর। সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলাম, বাধা দিলেন। অতিকষ্টে ঘাটের সিঁড়িতে উপবেশন করে আনমনে তাকিয়ে রইলেন গঙ্গার দিকে। হরিধ্বনি দিতে দিতে একজোড়া লাশ প্রবেশ করলো শ্মশানে। সেজে উঠলো চিতা। আত্মীয়পরিজন ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাসী মড়া বিদায়ে। 


ভৈরববাবা কেমন মুচকি মুচকি হাসছেন। ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করে কি যেন ছড়িয়ে দিলেন আমার মাথায়। স্মিত হেসে বললেন, " মুক্ত হোজা বেটা!" 


একি সারা শরীর এভাবে জ্বলছে কেন আমার! সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে! ভৈরব বাবা হাসছেন, হো হো করে হাসছেন! ওদিকে জোড়া চিতায় আগুন দেওয়া হয়েছে। ফটফট শব্দে ফাটছে কাঠ। 


গতরাতে নিজে হাতেই মেরেছিলাম সরমাকে। অন্যকারো সঙ্গে ওর সম্পর্কটা মানতে পারিনি, আবার ওকে ছাড়া জীবন ভাবতেও পারিনি। দুজনে পাশাপাশি পুড়ছি তাই, স্বর্গ হোক বা নরক ; যাবো একসাথেই। দেহ ছেড়ে একবার রাতেই এসেছিলাম ভৈরববাবার কাছে, ধুনি জ্বেলে শুয়েছিলেন তিনি। খুব তেষ্টা পেয়েছিল আমার। পিতৃপক্ষের শেষ তো! আমায় আর কে জলদান করবে বলুন! অগত্যা ভৈরববাবার রক্তেই....!  


চারপাশ বড্ড ধোঁওয়া ধোঁওয়া। শরীরটা বহুদিন পরে পালকের মত হালকা লাগছে। ঘুম পাচ্ছে, বড্ড ঘুম পাচ্ছে।। 


(সমাপ্ত)


ছবি ঃ-- @saurav mitra

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু