বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বন্দিনী




ধূসর আকাশে উড়ছে কিছু সাদাটে গাংচিল। একটা পর্দা সরছে চোখের সামনে থেকে৷ হতাশার পর্দা, অবলোকনের সাথে সাথে ঘনিয়ে আসছে সৌন্দর্য, মৃত্যু যে সামনে থেকে বড্ড সুন্দর দেখতে। ছয়তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে এমনটাই মনে হচ্ছে সংযুক্তার। নীচে চলাচলরত গাড়িগুলোকে ছোট্ট ছোট্ট চলমান বাক্সের মত লাগছে। এদিকে ওদিকে সরে যাচ্ছে বাক্সগুলো, কিছুতেই স্থির থাকছেনা। 


আজ, এই নিয়ে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলো সংযুক্তা। পারলো না। ডোরবেলটা তারস্বরে বাজছে, কেউ এলো বোধহয়।


আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দেয় সে। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকবিভাগের কর্মী, তার পাঠানো একটি পাণ্ডুলিপি মনোনীত হয়েছে প্রকাশকের দরবারে। একঝাঁক আশার আলো নিয়ে সেই চিঠি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জীবনের দূত। 


তড়িঘড়ি সইসাবুদ সেরে চিঠিখানা হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকে সংযুক্তা৷ ধপ করে বসে পড়ে সোফায়৷ এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এইতো একটু আগেই... ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে মনে হচ্ছিলো... আর এখন! বাঁচতে ইচ্ছে করছে তার, খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে! ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে ভাইব্রেট করছে, তুলে নিয়ে কানে লাগায় সে। মোহঝর্ণার মতো কানে ভেসে আসে শব্দগুলো, 


" দারুণ লেখেন তো ম্যাডাম আপনি! আজ পর্যন্ত আমরা কোনো নতুন লেখকের বই বিনে পয়সায় করিনি, আপনার বই করতে বাধ্য হচ্ছি। এমন পান্ডুলিপি হাতছাড়া করা যায় না!" 


কাঁপতে কাঁপতে " থ্যাঙ্কিউ " বলে ফোন ছাড়ে সংযুক্তা। এসব কি শুনছে সে! সে নাকি বড্ড ভালো লেখে! কিন্তু...


মনে পড়ে মায়ের কথাগুলো। নিজের প্রথম গল্প লিখে মাকে দেখিয়েছিল বলে একঝাঁক লোকের সামনে তাকে অপমান করেছিলেন তিনি, খিল্লি করেছিলেন, এমনকি তার মানসিক সুস্থতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বাবার কাছে। আর বাবা! অবলীলায় ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তার প্রথম লেখা গল্পের পাণ্ডুলিপি। বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর লিখতোনা সংযুক্তা, চুপচাপ যন্ত্রের মতো কাজ আর পড়াশোনা বাদে আর কোনোকিছুতেই নজর দিতোনা৷ তাও আত্মীয়স্বজন কোনো উপলক্ষে একত্রিত হলেই উঠতো এই প্রসঙ্গ, মানুষগুলোর ব্যঙ্গমাখা হাসি আজও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে তাকে। 


বিয়ের পরে ঋষভ তাকে কোনোদিন লেখালিখিতে বাধা দেয় নি৷ আসলে তার বাধা দেওয়ার সময় ছিলোনা। অফিসের কাজ, আর তারপরে বিছানায় দশমিনিটের হুটোপুটি, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব তার এখানেই শেষ। অখণ্ড একা সময়ে চুপচাপ লিখতো সংযুক্তা, ডাইরিগুলো লুকিয়ে রাখতো আলমারিতে বোঝাই করা শাড়ির ভাঁজে। একদিন কি মনে হতে তারমধ্যে একটা ডাইরিই সে পাঠিয়েছিল প্রকাশকের দপ্তরে, আজ তা মনোনীত হয়েছে। কিন্তু আনন্দ বা দুঃখ কিছুই অনুভূতি হচ্ছে না সংযুক্তার। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে সোফার ওপরে। তবে কি দিনের পর দিন নিজের ইচ্ছেগুলো লুকিয়ে রাখতে রাখতে ভোঁতা হয়ে গেছে তার অনুভূতিগুচ্ছ! কেজানে! 


সোফা ছেড়ে উঠে চুপচাপ চিঠিটা শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখে সংযুক্তা। কাউকে কিচ্ছু জানাবার দরকার নেই। জেনেই বা কি করবে মানুষগুলো!  স্নান সেরে দুগ্রাস ভাত খায় সে। অনেকদিন পর চুলটা পরিপাটি করে বাঁধে। তারপর থালায় আটা নিয়ে মাখতে বসে৷ সন্ধ্যায় বাবা - মা আসার কথা, আতিথেয়তা করতে হবে তো! 


* * * 


আজ ঋষভের সাকসেস পার্টি, অফিসে প্রমোশন হয়েছে তার। আত্মীয়স্বজনে ভরে আছে বাড়ি। সকলেই ঋষভের প্রশংসা করছে, তারিফ করছে সংযুক্তার স্বামীভাগ্যের। মা বাবারও গর্বে ভরে যাচ্ছে বুক, এমন জামাই পেতে ভাগ্য লাগে বৈকি! 


সংযুক্তার আজ দম ফেলার ফুরসত নেই। এত অতিথির খেয়াল রাখা, তাদের খাবারদাবার যোগান দেওয়া, কম কথা নাকি! রান্নাঘর থেকে প্রায় বেরোতেই পারছেনা সে, সেখান থেকেই কানে আসছে অতিথিদের হাসাহাসি - গল্পগাছা। 


--" সংযুক্তার ভাগ্য আছে বটে! বিদেশ চলে যাবে বরের সঙ্গে! আমাদেরগুলোকে দেখ! আজীবন কেরানীগিরি করে গেলো। " মুখ ভেটকে বললেন এক প্রতিবেশিনী। 


--" সেতো বটেই! কিন্তু যাই বল ঋষভের ভাগ্য খারাপ৷ চাকরিতে এত উন্নতি করছে, কিন্তু বউটা বাঁজা! একটা ছেলেপুলেও এতদিনে দিতে পারলো না বেচারীকে। " জবাব দিলেন আরেকজন।


--" ঠিকই বলেছিস রে! বড্ড গুমোর মেয়েটার। আমাদের কারো সঙ্গে কথা বলেনা, মেয়েলি আড্ডাতেও আসেনা। আসবে কিকরে! বাঁজা মেয়েমানুষের আবার কোনো গল্প থাকে নাকি! আমি তো সকালে উঠে ঠাকুরকে ডাকি, ওর মুখ দেখে যেন দিন শুরু না হয়!" মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দেন প্রথমজন। 


রান্নাঘর থেকে সবই কানে আসে সংযুক্তার৷ কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না সে৷ কাজের মেয়ের হাত দিয়ে একপ্লেট স্ন্যাক্স পাঠিয়ে দেয় ড্রইংরুমে। নিজে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রান্নাঘরে। এত ঘৃণা করেন এঁরা তাকে!  শুধুমাত্র বাচ্চা হয়নি বলে! এতে তার কি দোষ! অবশ্য সব দোষ তো তারই, জন্ম থেকেই শুনে আসার পরেও সে বিশ্বাস করতে পারেনি যে সে অপয়া, যমের অরুচি। আজ এতদিন পরে বিশ্বাস হলো তার৷ সত্যিই তো! নয়ত তিন তিনবার মরতে গিয়েও বেঁচে ফেরে কেউ! আচ্ছা, মৃত্যুদেবতাও বোধহয় বড্ড ঘৃণা করেন তাকে, এনাদেরই মতো! 


* * * 


আজই শরীরে প্রথম প্রাণের স্পন্দন টের পেয়েছে সংযুক্তা, বিয়ের প্রায় বছর ছয়েক পরে। বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা বড্ড দুর্বল লাগছিলো তার, বমি পাচ্ছিলো৷ ঋষভই জোর করে তাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে, তিনি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, নতুন প্রাণ আসছে শীঘ্রই!


চুপ করে নিজের ঘরে বসে ছিলো সংযুক্তা। আজকাল আর সে কথাবার্তা প্রায় বলে না বললেই চলে। সেদিনের পার্টির পর থেকে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে সে, নিজের বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানেও যায়নি। বাইরে কোথায় কি হচ্ছে কিচ্ছু খবর রাখেনা সে, বিষাদের অন্ধকার তাকে আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছে, জীবন্ত অক্টোপাসের মতো৷ 


খবরটা দিলো ঋষভই। ড্রইংরুমে খবর দেখছিলো সে। হটাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে এসে বললো, 


" তুমি বই লেখো কখনো বলোনি তো! খবরে দেখলাম এখুনি, পুরস্কার পাচ্ছে তোমার বই। টিভিতে তোমার ছবি দেখাচ্ছে!" 


ভয়ে সিঁটিয়ে যায় সংযুক্তা। বিয়ের সময় মা পইপই করে বুঝিয়েছিলেন, এ বাড়িতে এসে লেখালিখি নামক নাটকটা যেন সে কখনো না করে! ঋষভ এসব পছন্দ করেনা। 


আবার প্রশ্ন করে ঋষভ, 


" কিগো উত্তর দিচ্ছো না যে! তুমি লেখো!" 


" ইয়ে মানে!  ওই একটু...! খুব ভুল হয়ে গেছে আমার! আর লিখবোনা। প্লিজ মেরোনা আমায়, বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিও না! আমি কথা দিচ্ছি আমি আর লিখবোনা!" 


থরথর করে কাঁপতে থাকে সংযুক্তা, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, মুখ দিয়ে ফেনা গড়ায় তার, প্যানিক অ্যাটাকের প্রথম স্টেজ!  ঋষভ তড়িঘড়ি এসে ধরে ফেলে তাকে। 


--" কিসব বলছো! আমি মারবো কেন তোমায়! তুমি লেখো এটা তো খুব ভালো কথা! কাল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমরা দুজন মিলে যাবো কেমন! আর এভাবে উত্তেজিত হয়ো না, বেবীর তো ক্ষতি হতে পারে নাকি!"  নরম গলায় বলে সে। 


--" কি কি কিন্তু... মা বলেছিল, তু তুমি লেখালিখি পছন্দ করোনা। জানতে পারলে আমায় খুব মারবে!" কাঁপতে কাঁপতে বলে সংযুক্তা। 


--" ধুসসস! মারবো কেন! যেটা আমি পারিনা সেটা আমার স্ত্রী করলে রাগবোই বা কেন! যতখুশি লেখো তুমি। আমি তো বেশিরভাগ সময়ই ঘরে থাকিনা, যেটাতে তুমি খুশি হও সেটাই করো। শুধু বেবীর অযত্ন কোরোনা, কেমন!" 


সংযুক্তার মাথায় হাত রাখে ঋষভ। অনেক অনেকদিন পরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সংযুক্তা। অজস্র দুঃখ অপমান খুশি হয়ে তার চোখ বেয়ে ঝরে চলে। বাইরে বসন্তের আগমনী গান গায় একলা কোকিল।।


(সমাপ্ত)

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু