বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বিদায় বেলার গোলাপ

 অনুগল্প

গল্প - বিদায় বেলার গোলাপ ।

কলমে - সোমা ছবি  চক্রবর্তী 

তারিখ - 15. 02. 2021

( সত্যি ঘটনা অবলম্বনে )


      সকাল বেলা 10  টার সময় কলেজে যাব বলে বাড়ির থেকে বেরিয়েছি । পাড়ার মোড়ে দেখি একটা তেরো - চোদ্দ বছরের ছেলেকে পাড়ার ছেলেরা মারতে উদ্যত হয়েছে । আমি মারামারি একদম পছন্দ করি না ।   ভিড় সরিয়ে ওদের সামনে গিয়ে বললাম - কি হয়েছে? ওকে মারছ কেন? ওরা সমস্বরে সবাই বলে চলল - আরে জানিস না । ও গুলুদার বাড়ি থেকে ভোরবেলা পিতলের ঘটি চুরি করেছে । 


    ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে   বলে উঠল - বিশ্বাস করো দিদি, আমি চুরি করি নি । আমি কোনদিনই চুরি করিনি । পাড়ার ছেলেরা আবার তেড়ে যেতেই আমি ওদের বললাম, তোমরা কি কেউ নিজের চোখে দেখেছো । সবাই বলল- কেউ দেখে নি । পাড়ার অন্য কেউ বলেছে । 


    আমি বললাম, যাও তো সব বাড়ি । তোমাদের কলেজ, অফিস সব কি আজ ছুটি, নাকি কারোর কোন কাজ নেই ? ছেলেটাকে বললাম - স্কুলে পড়িস? বলল - হ্যাঁ, দোকানে খাতা কিনতে এসেছি ।


       পরে জেনেছিলাম, ছেলেটার নাম কালু এবং ও ওয়াগন ব্রেকার । একমাস পরে পাড়ার মোড়ের দোকানে গেছি । দেখি দোকানের সামনের পাতা বেঞ্চে কয়েকটা ছেলের সাথে বসে কালু মুড়ি - চানাচুর খাচ্ছে । আমি ওর দিকে না তাকিয়ে কেনাকাটা করে বেরিয়ে এসে দেখলাম ছোট্ট মেয়ে রিণ্টি পাঁচ ছ' টা গোলাপ ফুল নিয়ে ওর বাবার সাথে দোকানে ঢুকছে । রিণ্টিকে বললাম - আমাকে একটা গোলাপ দে না । ও বলল - উঁ হু তোমাকে কিছুতেই দেব না । আমার খুব ইচ্ছে করছিলো  একটা নেওয়ার । বাড়িতে চলে এলাম । 


     পরদিন সকালে গলা সাধতে বসেছি । শুনলাম কালু ডাকছে, দিদি দিদি করে । ভাবলাম, আবার কি গণ্ডগোল করেছে বুঝি । বাইরে এসে দেখি ওর হাতে পাঁচটা গোলাপ । বলল- দিদি তোমার জন্য ।আমি বললাম, চুরি করে এনেছিস? বলল - না না, আমার বাবা যেখানে মালীর কাজ করে, সেখান থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছি ।


     আমার মনটা কিরকম একটা অনুভূতিতে ভরে গেল ।  ঘরে  ঢোকার পর ছোড়দা বলল- কালু নাকি সবার কাছে বলে বেড়িয়েছে, সুদেবদার (আমার বড়দা ) বোন সেদিন ওকে বিনা দোষে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করেছিল । সেই প্রথম অন্যের জন্য কিছু করতে পেরে মনে একটা তৃপ্তি বোধ করেছিলাম ।


     এরপর মাঝে মাঝে ও আমাকে গোলাপ দিতে আসত । একদিন গোলাপ দিয়ে বলল -দিদি, একটা জিনিস চাইব তোমার কাছে? ভয়ে ভয়ে বললাম - বলে ফেল । বলল- দিদি, তুমি আমায় ভাইফোঁটা দেবে সামনের বার । আমি বললাম - সেতো অনেক দেরি আছে ।এখন তো সবে আষাঢ় ।---- 


    দুর্গা পূজো এসে গেছে । কালু পাড়ার বড়দের সাথে পূজোর চাঁদাও নিতে এসেছিল । আমার সাথে আর কথা হয় নি । 


   এরপর একদিন বিকেলে কলেজ থেকে ফিরছি । দেখলাম, পাড়ার মোড়ে মোড়ে জটলা । শুনলাম আগের দিন শেষ রাতে  ওয়াগন ব্রেকারি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে কালু । এখন ওর ডেড বডি মর্গ থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে । বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে উঠল যেন । ও আমার কাছে ভাইফোঁটা চেয়েছিল । 


    চন্দনাকে বললাম সুধাংশুদার বাগান থেকে আমার জন্য কয়েকটা গোলাপ ফুল নিয়ে আসতে । দাম দিয়ে নেব । 


   কালুর বাড়ি চিনি না । চন্দনাকে সাথে নিয়ে পথে জিজ্ঞেস করতে করতে  দৌড়াতে লাগলাম কালুর বাড়ির উদ্দেশ্যে ।


    প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে ঢুকে দেখলাম, উঠোনে খাটিয়ার ওপর কালুর দেহ শোয়ানো । কেউ কোন  ফুল তো দেয় নি !! কেই বা দেবে । আমি ধীর পায়ে গিয়ে ওর বুকের ওপরে গোলাপ ছড়িয়ে দিয়ে বললাম - কালু, ভাইফোঁটা তো দিতে পারলাম না, গোলাপ দিলাম । আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোকে অনেক বড়ো মনের মানুষ করে জন্ম দেন । ঝাঁপসা চোখ আড়াল করে বেরিয়ে এলাম । চন্দনা ও নীরব ।।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু