বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

জীবনের জলছবি

জীবনের জলছবি


ট্রেন ছুটে চলেছে ঝমঝম শব্দে।দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে ধানক্ষেত,মাঠ,গাছপালা,রাস্তা। সবুজের বিচিত্র রঙবদলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।মালিনী জানলায় বসে দৃশ্যাবলী দেখছিল আর  মাঝেমাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিল অতীতে,যে অতীত ওর সামনে মেলে ধরেছিল এক রঙিন পৃথিবী সেই বছর সাতেক আগে।

মালিনী তখন সবে লেকচারার হিসাবে একটা কলেজে জয়েন করেছে।কলেজের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে যাচ্ছিল দার্জিলিং বেড়াতে।অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে শ্যামলা সুঠাম সুপুরুষ একজন প্রথম দেখাতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।কথায় কথায় জানতে পারে ওর নাম অর্ণব।অফিস থেকে ক'জন মিলে জলদাপাড়া বেড়াতে যাচ্ছে।অর্ণব একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার।

একসাথে যেতে যেতে পরিচিতি বাড়ে।

এরপর মালিনীরা নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে নেমে দার্জিলিং এর জন্যে গাড়ি ধরতে চলে যায়।অর্ণবদের ট্রেন এগিয়ে যায় ।

দিন পনের পর অর্ণব ওর কলেজে এসে দেখা করে।মালিনীও যেন মনে মনে অর্ণবকে দেখতে চাইছিল।মনে হোল ও যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেছে।

অর্ণব বলল,'চলে এলাম,রাগ করলেন না তো? আপনার ছুটি হলে চলুন একটু চা খেয়ে আসি,যদি আপত্তি না থাকে।'মালিনী ওকে অপেক্ষা করতে বলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বেড়িয়ে আসে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কাছাকাছি একটা কপি শপে।দুকাপ কফি আর স্ন্যাক্সের অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি বসে।অর্ণব বলে,"আপনাদের দার্জিলিং ট্যুর কেমন হোল?"

কথায় কথায় বেশ কিছু সময় পার করে ওরা ফিরে এলো।

এরপর বিকেলের দিকে দুজনে প্রায়ই একসাথে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরত একরাশ খুশির আমেজ নিয়ে। মাঝেমাঝেই নদীর ধারে চলে যেত।কখনো গঙ্গায় নৌকা করে ভেসে বেড়াত রাজহাঁসের মত।উপরে উন্মুক্ত আকাশ,ঝাঁক বেঁধে পাখিদের উড়ে যাওয়া,দূরে গাছের সারি,নদীর স্নিগ্ধ হাওয়া আর বয়ে যাওয়া জলের স্রোত,কুলুকুলু শব্দ যেন ওদের ঘিরে এক মায়াময় পরিবেশ গড়ে তুলত।ওরা দুজনে মগ্ন হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করত আর একে অপরের কাছে জমে থাকা কথা উজার করে দিত।নতুন অনুরাগ ওদের পৃথিবীটা স্বপ্নময় করে তোলে।

এরপর দুজনের বাড়ির মতে চারহাত এক হয়,দুটি পিপাসিত হৃদয় মিলে যায়। ধুমধাম করে বিয়ে হয় ওদের। অর্ণবের বাড়িতে আছেন শুধু বাবা মা।আর মালিনীরা এক ভাই এক বোন।অর্ণবের বাবা মা মালিনীকে সহজেই আপন করে নিলেন।ওর মেধা আর সৌন্দর্যের

সাথে মিশ্রিত নম্র ব্যাবহার ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

বিয়ের পর ওরা হানিমুনে চললো প্যারিস, ভালোবাসার শহরে।চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে যখন নামলো, চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হোল।এসে উঠলো লা মার্কুইস হোটেলে।বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল।দুজনে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হোল।

বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটাপথে পৌঁছে গেল আইফেল টাওয়ার দেখতে।এক ছড়ানো প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময়টি।ফরাসী নাম La Tour Eiffel,ফ্রান্সের প্রতীক।গুস্তাফা আইফেল নির্মিত ৩২০ মিটার তথা ১০৫০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারটি ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছর যাবৎ পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার ছিল।চারটি বিশাল লোহার পিলারের ওপর এটি দাঁড়ানো।১৮০৩৮ খন্ড লোহার তৈরী বিভিন্ন আকৃতির ছোট বড় লোহার তৈরী কাঠামো জোড়া দিয়ে এটি নির্মিত।৩০০ শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল।

অবাক বিস্ময়ে ওরা এসে দাঁড়ায় লিফটে ওঠার লাইনে। ওখানকার মানুষের অতিথিবৎসল ব্যাবহার আর হাসিমুখ ওদের খুশি করে।লিফট ওদের নিয়ে গেল অনেক উঁচু  চারদিকে ঘোরানো এক বারান্দায়।অপার বিস্ময়ে ওরা দেখল বিকেলের প্যারিস শহর সামনে উন্মুক্ত।দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করলো প্রাণ ভরে।মনে হোল ভালবাসার শহর যেন ওদের স্বর্গের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।এ যেন প্রেমের স্বর্গ।ওখানে রাখা দূরবীনে চোখ রাখলে আরো পরিস্কার ভাবে শহরটাকে দেখা যায়,দেখা যায় প্রবহমান সেইন নদীকে।সত্যিই এ এক স্বপ্ননগরী।যুগ যুগ ধরে কত যে কাহিনী রচিত হয়ে চলেছে ভালবাসার এই শহরকে ঘিরে।

এবার ওরা নেমে এলো সামনের বিস্তৃত মাঠে।হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠলো আইফেল।কি অপরূপ সে আলোকসজ্জা।ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে একেকটা আলোর রেখা।আকাশের গায়ে যেন হেলে রয়েছে এক রঙিন আলোকময় অত্যাশ্চর্য।ঠিক রাত আটটায় সেই আলোকমালা রূপ পরিবর্তন করে  আরো মোহময় হয়ে ধরা দিল। পরে জেনে গর্বিত হয়েছিল ,এই আলোকসজ্জায় হাত রয়েছে বাঙালী আলোকচিত্রী প্রয়াত তাপস সেনের।

প্রিয় কবিতা বলে ওঠে মালিনী।মুগ্ধ হয় অর্ণব।কবিতার নাম ,মোহময়ী নগরী


"আইফেল যেন শৌর্যের সাথে উন্নতশীরে জাগে,

কত শতাব্দী পার করে রাখে ঐতিহ্যকে আগে!

প্রান্তরমাঝে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত আলোকোজ্জ্বল বিভাতে

মহান্  বিশালতায় বিধৃত,কে না চায় রূপ হেরিতে?

লিফ্টে উপরে চলা শুরু হয়,প্রতি ধাপে দেখি,এ কি বিস্ময়!

অলিন্দে ঘুরি,দৃশ্য দেখি,সম্মুখে রয়েছে প্যারিস নগরী।

পারী মেলে ধরে অতি অনুপম নদী, নগরীর দৃশ্য,

নগর মিশেছে সাগর বেলায়,যুগে যুগে সে রহস্য!

প্যারিসের যে রূপ বর্ণিত বিশ্বব্যাপী রয়েছে গ্রথিত,

"শবনম"তার একটি মুক্তো,পঠনে মনন ভরে যায়।

ল্যুভর সমৃদ্ধ প্যারিস শহর,যাদুঘরে সেরা সংগ্রহ যত,

শিল্পীপ্রবর লিওনার্দোর 'মোনালিসা'পটও বিধৃত।

আঁকাবাঁকা ঐ সেইন নদীপথ,তীরে শোভে পুষ্পল জনপদ,

অটবীখচিত বাগিচা শ্যামল,ঢালপথে নামে সাগরবেলায়,

নীলাভ ফেনিল সায়রসলিল মিলায় আকাশ নীলিমায়!"

পরদিন সারাদিন কাটালো অত্যাশ্চর্য সব সংগ্রহ সম্বলিত ল্যুভর মিউজিয়ামে,যেখানে আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম  মোনালিসা। পিরামিড আকৃতির এই সংগ্রহশালার গঠনশৈলীও অনুপম।আরো কয়েকদিন ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল প্যারিস গেট,বাস্তিল দুর্গ,আর্ট অফ ট্রয়াঞ্চ গ্যালারি,নটরডম গীর্জা,কনকর্ড টাওয়ার ,আরো সব দর্শনীয় স্থান।তারপর ওরা ফিরে আসে ওদের সুখের নীড়ে।


হঠাৎ শাশুড়ির ডাকে মালিনীর সম্বিৎ ফেরে। বাইরের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে ও স্মৃতির ডানায় ভর করে হারিয়ে গিয়েছিল ভালবাসা ভরা অতীতে,যখন অর্ণব ওর সবটা জুড়ে থাকত,ওকে সোহাগে আদরে ভরিয়ে রাখত।

বাড়ি থেকে আনা গরম কফি দিলেন নন্দিনী তার আদরের বৌমাকে আর স্বামী অরিন্দমকে।

মালিনী টুকরো কথায় মেতে উঠলো এই বয়স্ক দম্পতির সাথে।


একদিন অযাচিতের মত তেমন ভালোবাসা এসেছিল জীবনে,তেমনি একদিন মরুভূমির মত ঊষর হয়ে গিয়েছিল ওর জীবন।এক অভিশপ্ত পরকীয়া কেড়ে নিয়েছিল ওর জীবনের সব শান্তি।বিয়ের পর বছর দুয়েক কেটে গেল ব্যাস্ততায় নিরবচ্ছিন্ন সুখের ঘেরাটোপে।তারপর অর্ণব ট্রান্সফার হোল পুণেতে।মাসে একবার করে বাড়ি ফিরত,নিয়ে যেত মালিনীকে কদিনের জন্য।এরপর আসার ব্যাবধান বাড়তে বাড়তে মাস ছয়েক হতে,মালিনী ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে চলে এল কোন খবর না দিয়ে। সেদিন রোববার ছিল।সোজা অর্ণবের ভাড়া করা ফ্ল্যটে চলে এলো। কলিং বেল বেজে উঠতে অর্ণব দরজা খুলল।মালিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো অর্ণবের বুকে। এতদিনের অদর্শনে হাঁপিয়ে উঠেছিল। কিন্তু অর্ণবের আড়ষ্টভাব ওর দৃষ্টি এড়াল না।অর্ণব আনন্দিত হবার বদলে বলে উঠল,"তুমি হঠাৎ এখানে?"মালিনী বলল,"তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে চলে এলাম। তুমি খুশি হওনি?"অর্ণব নীরব। মালিনী ড্রয়িংরুম পার হয়ে সোজা চলে এল বেডরুমে অর্ণবকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে বলে।

ঢুকেই থমকে গেল।ওদের দু'জনের নিজস্ব বিছানায় ঘুমাচ্ছে এক অচেনা মেয়ে।রাত পোশাক বিস্রস্ত,বিছানা এলোমেলো!

একছুটে বেড়িয়ে এলো মালিনী,অর্ণব অপরাধীর মত চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর সামনে তখন।মালিনীর দুচোখ বেয়ে  বন্যা নেমেছে।ভালোবাসা টুকরো টুকরো হয়ে নিঃশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে ।সারাটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে হৃদয় ভাঙার অদৃশ্য কাঁচের টুকরো।।দমবন্ধ হয়ে আসছে মালিনীর।প্রিয় মানুষটাকে দেখতে দেখতে ও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। গভীর খাদের ধারে ও যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।এখুনি পড়ে যাবে এক অতল গহ্বরে।খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরতে চাইছে অর্ণবকে, কিন্তু পারছেনা ।

ইতিমধ্যে মেয়েটি উঠে এ ঘরে চলে এসেছে।হাতে শাঁখা,সিঁথিতে সিঁদুর।শরীরে গর্ভবতী নারীর সমস্ত চিহ্ন স্পষ্ট।অর্ণবকে জিজ্ঞাসা করল,"কে উনি,কখন এলেন?তোমার আত্মীয়া আসবেন,আমাকে বলনি তো?আমাকে ডাকনি কেন?ছি ছি।উনি কি ভাববেন"।

তিনজনের চোখেই অদ্ভূত শূণ্যতা।

মালিনী আর পারলো না।অর্ণবকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।ওর অনিকে ও কিছুতেই হারাতে পারবেনা।

মেয়েটি এই দৃশ্য দেখে চলে গেল অন্য ঘরে।অর্ণব দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরে বলল,"আমি তোমার কাছে অপরাধী।ক্ষমা চাইছি।পারলে ক্ষমা কোর। পরিস্থিতি আমার আয়ত্তে ছিল না।এই অফিসে জয়েন করার পর শ্রীলার সাথে আলাপ।কখন যেন আমরা কাছে এসে যাই।তোমাকে বা বাবা মাকে কিভাবে ফেস করব,বুঝতে পারছিলাম না।ইতিমধ্যে ও প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।আমরা বিয়ে করি।"


আসলে অর্ণব এখানে আসার কিছুদিন পর ঝকঝকে সুন্দরী নীলনয়না শ্রীলা ওদের অফিসে জয়েন করে। কিছু দিন পর থেকেই শ্রীলার রূপের মোহে অর্ণব আকৃষ্ট হয়।ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।প্রায়ই ছুটির দিনে একসাথে ফ্ল্যাটে সময় কাটাত ওরা।একসময় শ্রীলা প্রেগন্যান্ট হয়।অর্ণবকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।অর্ণব একথা সেকথা বলে এড়িয়ে যেতে থাকে‌।সময় এগোলে ওর শরীরে অনাগত শিশুর লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে।একটা মন্দিরে গিয়ে ওরা এবার বিয়ে করে।

অর্ণব এবার মালিনীর বাঁধন ছাড়িয়ে ভেতরে যায়।মালিনীর শরীরের সব শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।ড্রয়িংরুমের সোফায় কোনমতে বসে পড়ে।ওর কানে আসে ওদের দু'জনের কথা,"তুমি বিবাহিত,আমাকে একবারও বলোনি তো?"

অর্ণব বলে,"তুমি সুযোগ দাওনি বলার।এত উত্তেজিত হয়ো না। তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান।ওর কথা ভাবো।শান্ত হও।একটা মীমাংসায় আসতে দাও।"

আর সহ্য করতে পারেনা মালিনী।কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এই ফ্ল্যাটটা ।অর্ণবকে বলেছিল,এটা আমাদের হানিমুন কটেজ। একদিন একটা ফুটফুটে ছোট্ট পরী আসবে আমাদের মাঝখানে।দু'বছর হতে চললো বিয়ের।আর দেরী কোরবো না অনি।পরম সুখে অর্ণবের বুকে মাথা রেখেছিল সেদিন।অর্ণব আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছিল তার মালাকে।


অনেক কষ্টে স্যুটকেসটা নিয়ে পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো মালিনী।অর্ণব আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে বাধা দিতে চাইল।আর ফিরে তাকালো না মালিনী।ওই দীঘল দুটো চোখের দিকে তাকালে ফেরা যে ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে!

একটা হোটেলে উঠলো সেদিনের মত। পরদিন ফিরে এলো শ্বশুবাড়িতে।

শ্বশুর শাশুড়ি অবাক হয়ে গেছেন ওর এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা দেখে।নিজের ঘরে ঢুকে

দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। উৎকন্ঠিত নন্দিনী আর অরিন্দম আশঙ্কিত হয়ে উঠলেন,ডাকলেন বৌমাকে,"কি হয়েছে মালিনী,আমাদের অর্ণব ভাল আছে তো? দরজা খোল ,মালিনী।"

মালিনী ওনাদের কথা ভেবে দরজা খুলে স্নেহময়ী শাশুড়ির কোলে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বাচ্চা মেয়ের মত।একে একে ওর দুর্ভাগ্যের কথা জানায়।ওনারা দুজনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। শাশুড়ি নন্দিনীর দুচোখ তখন ভরে উঠেছে জলে।অরিন্দম ভাবেন,কোথায় ভুল ছিল ওদের একমাত্র ছেলেকে মানুষ করায়!রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক তিনি।কত ছেলেকে জীবনের পাঠ পড়িয়েছেন। নিজের ছেলের বেলায় তিনি ব্যার্থ!

দুজনে গম্ভীর হয়ে যান। দুদিন পর অরিন্দম ছেলেকে ফোন করে জানান,"তুমি ভুলে যাও আমাদের।বাকি জীবনটা আমার একমাত্র মেয়ে মালিনীকে নিয়ে আমরা কাটিয়ে দিতে পারব।"

নন্দিনী কেঁদে স্বামীকে জানান,তুমি বাবা,তুমি ওকে ছাড়তে পারলেও আমি মা হয়ে কি করে ওকে ছাড়া বাঁচব?"অরিন্দম স্ত্রীর বাৎসল্যে বাদ সাধেননি।বলেন,"তোমাকে আমি বাধা দেব না। তোমার সিদ্ধান্ত তোমার।"

তাই মা ছেলের যোগাযোগ রয়ে যায়।

এরপর আর মালিনী পারেনি এ অসহায় বৃদ্ধ মানুষ দুটোকে ফেলে বাবামায়ের কাছে চিরদিনের মত ফিরে যেতে।

প্রায় পাঁচ বছর ওদের নিয়ে আর নিজের কলেজ নিয়ে গড়ে তুলেছে ওর একার জগৎ।

আবার চিন্তায় ছেদ পড়ল একটা ষ্টেশনে ট্রেন থামায়।

অরিন্দম  বললেন,"বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে,মালিনী গলাটা ঢেকে নাও। তোমার আবার ঠান্ডা লেগে যায় সহজে।"মালিনী বলল,"হ্যা,বাবা"।

আজ অরিন্দম আর নন্দিনী  চলেছেন মালিনী কে নিয়ে নতুন ঠিকানায়। জলপাইগুড়িতে অরিন্দমের বাল্যবন্ধু গৌতম মিত্র থাকেন সপরিবারে।ওনাদের পারিবারিক ব্যাবসা।উনি একমাত্র ছেলে সৌরভকে নিয়ে ব্যাবসা দেখাশোনা করেন।সেখানে ওনাদের পাশেই বাগান ঘেরা একটা বাড়ি কিনেছেন অরিন্দম এখানকার বাড়ি বিক্রি করে। বন্ধু গৌতমই সব ব্যাবস্থা করেছেন। দুই বন্ধুতে বিগত কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকবার কলকাতা জলপাইগুড়ি যাতায়াত করেছেন।অনেক চেষ্টার পর মালিনী ওখানকার কলেজে ট্রান্সফার  পেয়েছে।একটা শুভদিন ঠিক করা হয়েছে দিন দশেক পর। দুদিন পর মালিনীর বাবা মাও এসে পড়বেন। নতুন বাড়ি সবাই মিলে সাজিয়ে তুলবেন।সাজাবেন একটা জীবনকেও নতুন করে।আদরের মালিনীকে বন্ধুপুত্র সৌরভের হাতে তুলে দেবেন ওনারা। তারপর ওর বাড়ির পাশেই কাটিয়ে দেবেন জীবনের শেষ কটা দিন।


কলমে শিখা রায়






পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু