বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

দুই নারী

দুই নারী


শহরের সবচেয়ে নামকরা অডিটরিয়ম আজ লোকে লোকারণ্য।দীপা,অত্রি,সুরঞ্জনা,স্নিগ্ধা,অর্ণব,আশীষ,দীপ্ত ওরা সবাই টানটান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত।যথাসময়ে শুরু হোল কনসার্ট,'সপ্তর্ষি সুরসপ্তক' ব্যান্ডের অনুষ্ঠান।একটার পর একটা গানে,যন্ত্রানুষঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল সুর আর শব্দের যুগলবন্দী।"তোমার এলোচুলে দিলাম গোলাপের হাসি,

কি করে যে বলব আমি তোমায় ভালবাসি।"

অথবা

"বেকার জীবনে প্রেমের আগুনে পুড়িয়েছি কত রাত,

চাকরীটা পেয়ে তোমাকে বলব,দেবে কি আমায় সাথ?"

অনুষ্ঠান শেষে হাততালিতে ফেটে পড়ল অডিটরিয়ম।আর দুই নারীর চোখে বইল অশ্রুর বন্যা।

যেন দশ বছর পিছিয়ে গেছে সময়।ওদের সাথে মিশে রয়েছে যেন সপ্তর্ষি গানে, বাজনায়,সাহচর্যে,উৎসাহে,যার কথায় ও সুরে একসময় সেজে উঠেছিল ওদের কলেজ জীবনের "সুরসপ্তক"ব্যান্ড।

ওরা তখন সবাই কলকাতার নামকরা কলেজে ইংলিশ অনার্সের ছাত্র ছাত্রী। সপ্তর্ষির  উদ্যোগে ওরা শুরু করেছিল সুরসপ্তক ব্যান্ড।সপ্তর্ষি,অত্রি আর অর্ণব তিনজনের লেখা কবিতায় সুরারোপ করত সপ্তর্ষি। এভাবেই দীপার সাথে সপ্তর্ষির ঘনিষ্ঠতা কখন যেন ভালোবাসায় পরিণতি পায়।দীপার গীটারে হাত ছিল অসাধারণ। দীপা যখন গীটারে ইমনের ঝালা বাজাত,সপ্তর্ষি সহ বন্ধুরা মোহিত হয়ে যেত। সুরঞ্জনার ছিল চড়া আর সুরেলা গলা,স্নিগ্ধা বাজাতো মাউথ অর্গান।অর্ণব ,আশীষ পার্কাসনে দক্ষ,তেমনি গানেও।

দীপ্ত আর অত্রি একাধিক বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী। কলেজ ফাংশনে বা অন্য জায়গায় ওদের দল মাতিয়ে দিত।

দীপার একঢাল কালো চুল আর টানা টানা দুটো গভীর চোখের মায়ায় সপ্তর্ষি যেন হারিয়ে যেত।আর সপ্তর্ষির ভালো রেজাল্ট,গান, কবিতা আর ছিপছিপে চেহারায় দীপা যেন আবিষ্ট হয়ে থাকত।সুরসপ্তকের মতই এগিয়ে চলছিল ওদের ভালোবাসা।দীপাকে নিয়ে সপ্তর্ষির একের পর এক গান হিট করে গেল।যেমন,

"একদিন স্বপ্নের হাত ধরে,

হারিয়ে যাই চল ঐ দূরে,

যেখানে সুরে লয়ে ছন্দে,

একতারা বাজবে আনন্দে।"


এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল গান আর পড়াশোনা র মধ্যে দিয়ে।একসময় পাশ করে ওরা যে যার মত ছড়িয়ে পড়ল উচ্চশিক্ষা বা চাকরীর খোঁজে।সবাই ব্যাস্ত হয়ে গেল নিজের নিজের জগতে।দীপা ফিরে এল মালদায় নিজের বাড়িতে।ফোনে কথা হোত দুজনের।দু একবার সপ্তর্ষি মালদায় গিয়ে দেখা করে দীপার সাথে।কয়েকমাস দেখা না হলে হাঁপিয়ে ওঠে দীপা। দুজনেই তখন চাকরীর চেষ্টা করে চলেছে।এরপর দীপা একটা স্কুলে চাকরী পায়।বেশ কিছুদিন পর সপ্তর্ষির দিক থেকে যোগাযোগ কোন এক অজ্ঞাত কারণে কমে আসতে থাকে।দীপা উৎকন্ঠিত হয়ে ফোন করে,ফোন বেজে যায়।


কিছুদিন পর বন্ধু সুরঞ্জনার ফোনে জানতে পারে,সপ্তর্ষি বিয়ে করেছে আর শ্বশুরের ব্যাবসায় জয়েন করেছে।দীপা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।ক্রমশঃ অবসাদে ডুবে যেতে থাকে।বাবা মা দিদিরা ওর বিয়ের জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।ও রাজি হয়না।কিছুতেই ভুলতে পারেনা সপ্তর্ষির কথা।ওকে নিয়ে লেখা যত গান, কবিতা সবকিছু ওর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।


একসময় ডুবে যায় নিজে কাজে আর সুরে সুরে।মনের মধ্যে একটুকরো আশা পোষণ করে, একদিন হয়তো সপ্তর্ষি এসে দাঁড়াবে,বলবে,'সুরঞ্জনা তোমায় মিথ্যে বলেছিল'।সপ্তর্ষির প্রিয় গানের সুরগুলো গীটারে বাজায় সন্ধ্যে হলে একের পর এক। ক্রমশঃ রাত গভীর হয়।

এর মধ্যে একবার সুরঞ্জনা আর অত্রির বিয়েতে গিয়ে সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়,সপ্তর্ষি ছাড়া।

বেশ কয়েক বছর এভাবে পার হয়ে যায়।এর মধ্যে দীপা এক কলিগ বান্ধবী পৃথার অনুরোধে ওদের বাড়ি আসে আর ওদের সাথে এক পিকনিকে অংশ নেয়।

শীতের আমেজে সেখানে ওরা গানের আসর বসায়।পৃথা আর অন্য সবাই একে একে গান করে,দীপাও বাদ যায় না।সবশেষে পৃথার সম্পর্কিত এক বোন রিক্তা গেয়ে ওঠে ওর পরিচিত একটি গান।সবাই মুগ্ধ হয় তার নতুন গান শুনে।দীপা অবাক হয়ে শোনে অবিকল সেই সুর,সেই বাণী,"তোমাকে হারালে দিশাহারা হবো,

হৃদয় উজানে নাও বেয়ে যাব----"

ওর বয়সী সুদর্শনা মহিলার সুরেলা কন্ঠে এই গান বিস্মিত করে।গান শেষ হলে জিজ্ঞাসা করে,'আপনি এ গান কোথায় পেলেন?'

মহিলার তখন দুচোখ ভরা জল, কোনভাবে বলল,'এ আমার প্রয়াত স্বামীর গান,ওর কথা,ওরা সুর।'কান্না সম্বরণ করত পারে না রিক্তা।পৃথা ওকে সরিয়ে নিয়ে যায়, শান্তনা দেয়।পৃথার কাছেই দীপা জানতে পারে,মাস কয়েক আগে সপ্তর্ষি দুরারোগ্য ক্যানসারে মারা যায়।

দীপা স্তব্ধ হয়ে যায়।জলভরা চোখে নিয়ে আড়ালে সরে যায়। কোনদিন ভাবেনি,এমন সংবাদ ওকে শুনতে হবে।কোথায় ভেসে যায় এতদিনের জমিয়ে রাখা সব অভিমান।

নিজে থেকেই ও রিক্তার সাথে আলাপ করে,বলে,'আমি সপ্তর্ষির সাথে কলেজে পড়তাম।রিক্তা বলে,সপ্তর্ষি ওকে 'সুরসপ্তকে'র কথা বলেছে।ওর বন্ধু অত্রি,আশীষ,দীপ্ত এদেরকে ও চেনে।সপ্তর্ষির অসুখের সময় ওরা মাঝেমাঝেই এসে ওকে সঙ্গ দিত,ব্যান্ডের গান শোনাত।লাষ্ট ষ্টেজে রোগটা ধরা পড়ায় কিছু করা যায়নি।ওর স্বপ্ন ছিল নতুন করে 'সুরসপ্তক'গড়ে তুলবে।গান যে ওর প্রাণ ছিল!


এরপর ভগ্নহৃদয়ে দীপা ফিরে আসে। সুরঞ্জনাকে ফোন করতেই ও বলে,ওরা সপ্তর্ষির খবর জানতো, কিন্তু দীপাকে জানাতে পারেনি এই দুঃসংবাদ। এরপর দীপা সুরঞ্জনাকে জানায় কিভাবে সপ্তর্ষির স্ত্রীর সাথে ওর দেখা হয়,সব ঘটনা।শেষে বলে,'আমরা সবাই মিলে কি পারিনা ওর স্বপ্নকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে?তুই অত্রিকে বলে দ্যাখ না একবার!আমি ছাড়া তোরা সবাই তো কলকাতাতেই থাকিস।'

সুরঞ্জনা আর অত্রি এবার একে একে সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে।ওরা একদিন একসাথে বসে আলোচনা করে ঠিক করে ছুটির দিনে আবার নতুন করে রিহার্সাল দিলে হয়তো আবার সেটা সম্ভব।সুরসপ্তক তো ওদের সবারই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। কিন্তু প্রধান সমস্যা হোল,সেসব গানের স্বরলিপি তো একমাত্র সপ্তর্ষির কাছে ছিল। সেগুলো কিভাবে পুনরুদ্ধার করা যাবে।দীপাকে সুরঞ্জনা সবটা জানায়।দীপা এবার ওদের রিক্তার সাথে যোগাযোগ করতে বলে।সেইমত দীপ্তরা সপ্তর্ষির বাড়ি গিয়ে ওর স্ত্রী রিক্তাকে ওদের পরিকল্পনার কথা জানায়,ওরা চায় নতুন ভাবে জেগে উঠুক সপ্তর্ষির গানের স্বপ্ন।তাই রিক্তার সাহায্য দরকার।রিক্তা জানায়,সপ্তর্ষির সব স্বরলিপি,গান,কবিতা,সব মিউজিক সিস্টেম সযত্নে রাখা আছে।বন্ধুরা এবার রিক্তাকে সাথে নিয়ে নেমে পড়ে নতুনভাবে সুরসপ্তককে সাজিয়ে তুলতে।

অত্রি আর সুরঞ্জনার বাড়িতে মাসে দুটো রোববার শুরু হয় রিহার্সাল।দীপা চলে আসে ওদের বাড়িতে।পরদিন ফিরে যায়।

এভাবে অনেকদিন ধরে প্রস্তুতির পর ওরা অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়।ব্যান্ডের নতুন নামকরণ করে"সপ্তর্ষি সুরসপ্তক"।


আজ সেই প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। অনুষ্ঠানের অভাবনীয় সাফল্যে সবাই উচ্ছ্বসিত।কিন্তু সবার চোখ অশ্রুসিক্ত।তবু ওদের বিশ্বাস,সপ্তর্ষি যেখানেই থাকুক,ওর স্বপ্নপুরণে ও আজ তৃপ্ত।

এদিকে চোখের জলে ভেসে ওর স্ত্রী রিক্তা অবাক হয়ে দেখলো,ওর মত দীপারও চোখের জল যেন বাঁধ মানছে না,আর বন্ধুরা ওকে ঘিরে রয়েছে!


কলমে শিখা রায়।


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু