বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অস্তরাগের আলোয়

অস্তরাগের আলোয়


রুমা আর বিদিশার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কলেজে ভর্তি হবার পর।ওরা বেশ ক'জন  মেয়ে তখন বিভিন্ন শহর থেকে এসে ভর্তি হয় কলকাতার নামকরা কলেজে। জীবনে প্রথম থাকতে শুরু করে বাবা মা ভাই বোনকে ছেড়ে হষ্টেলে।মনখারাপের পর্ব শেষ করে ওরা সবাই একে অপরকে ভালবেসে মিলেমিশে থাকার আনন্দ উপভোগ করে।অসুখে বিসুখে একে অপরের সেবাও করে।সবচেয়ে কাজে আসে গ্রুপ ষ্টাডি।ওদের দশজনের একটা দল হয়ে যায়।

কারো বাড়ি থেকে বাবা মা এলে ঐ দশজনের জন্যই খাবার বানিয়ে আনতেন।


দেখতে দেখতে পরীক্ষা চলে আসে।ওরা সবাই ভাল রেজাল্ট করে।কেমন করে যেন তিনটে বছর পার হয়ে যায়।গ্র্যাজুয়েশনের পর যে যার বাড়ি ফিরে যায়।


আজ কয়েক যুগ পর এক পাহাড় ঘেরা ছোট শহরে দুই বন্ধুতে দেখা।প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরে আনন্দিত হয়ে ওঠে দুজনেই। বিদিশার সেই লম্বা বেণী তেমনি আছে।শুধু সোনালী রেখা দেখা দিয়েছে চুলে,আর সুন্দর মুখে কয়েকটা বলিরেখা।তেমনি লম্বা,ফর্সা,স্লিম।আর রুমার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য নিয়ে ও একটু ভারিক্কি হয়েছে।রুমা ওকে জোড় করে ধরে আনে বাড়িতে।এতদিন পরে দেখা হওয়ায় দুজনেই পুরনো দিনের গল্পগুজবে , স্মৃতিচারণায় মেতে উঠল।অন্য বন্ধুদের খবর যেটুকু জানে শেয়ার করল। রাতে বিদিশাকে না খাইয়ে ছাড়ে না।রুমার স্বামী অরুণাভ বিদিশাকে এগিয়ে দিয়ে আসে ওর কোয়ার্টার পর্যন্ত।


রুমা  আর অরুণাভ এই শহরে আসে প্রায় প্রায় পঁচিশ বছর আগে অরুণাভের চাকরীর সূত্রে।জায়গাটা ভাল লেগে যায় দুজনের। অরুণাভ রিটায়ার করেছে বছর দুয়েক হলো।রুমা ওদের বাড়ির কাছাকাছি মিশনারী স্কুলটাতে পড়ায়।সেই সূত্রেই দেখা হয় আজ বিদিশার সাথে।বেশ কিছুদিন হোল বিদিশা মিশনারীর অনাথ আশ্রমে একজন শিক্ষিকা হিসাবে জয়েন করেছে।আগে একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াত।সেই অভিজ্ঞতার নিরিখে খবরের কাগজ দেখে এখানে এপ্লাই করে। মাসখানেক হোল জয়েন করেছে নামমাত্র স্যালারীতে,বলতে গেলে অনারারী সার্ভিস।তবে খাওয়া থাকা ফ্রি।


রুমারা বিয়ের পর বেশ হেসে খেলে সুখেই দিন কাটাচ্ছিল।মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক বেড়াতে চলে যেত।কখনো সমুদ্র,কখনো পাহাড়।পুরীর সমুদ্র তীরে সূর্যোদয় দেখা,মন্দিরে পূজো দেওয়া,সমুদ্রে স্নান,বিকালে সূর্যাস্ত দেখা এসবের আকর্ষণে বেশ কয়েকবার ওখানে গেছে। কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেও যখন সন্তান এল না ,দুজনে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারল,রুমা মা হতে পারবে না।যে জটিলতা আছে,সেটা  সারানো সম্ভব নয়। হতাশায় আচ্ছন্ন হোল রুমা।বছর খানেকের মধ্যে ওরা ঠিক করল দত্তক নেবে।ওদের ওখানকার মিশনারী অরফ্যানেজের বাচ্চাদের কাছ থেকে দেখত বলে ওদের ডিসিশন নেওয়াটা অনেক সহজ হয়েছিল।

অরুণাভর বাবা মায়ের প্রথম দিকে আপত্তি থাকলেও ছেলে বউমার কথা ভেবে ওনারা রাজি হয়ে যান।প্রতি বছর দু একবার করে ওনারা এই পাহাড়ি শহরে ছেলের কাছে এসে কটা দিন আনন্দে কাটিয়ে যান।

এরপর আইনের বিধিনিষেধ পার করে ওরা দত্তক নেয় একটা ফুটফুটে মাস ছয়েকের কন্যাসন্তানকে।ওদের পৃথিবী আবার ভরে ওঠে আনন্দে।শিশুর হাসি,কান্নায় ওদের সুখের ঘর ভরে ওঠে।কখনো অরুণাভের বাবা মা,কখনো রুমার বাবা মা চলে আসেন বেশ কিছুদিন ওদের সাথে কাটিয়ে যান।আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে ওদের আদরের মেয়ে প্রাপ্তি।ঐ মিশনারী স্কুলেই মায়ের সাথে যেতে শুরু করে।

পড়াশোনায় ,খেলাধুলায় পারদর্শী হয়ে ওঠে।একসময় স্কুলের গন্ডী ছেড়ে কলেজে পড়াশোনা র পর ভাল পাত্রের সাথে সাড়ম্বরে বিয়ে হয়ে যায় ।প্রাপ্তির শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব ট্রেনপথে ঘন্টাখানেক। ছুটির দিনে বর পার্থকে নিয়ে হঠাৎ এসে বাবা মাকে সারপ্রাইজ দিতে বেশ মজা পায়।মেয়ে জামাইকে সুখী দেখে রুমা অরুণাভের মন ভরে যায়। 


প্রাপ্তির যখন বছর বারো বয়স,তখনই বাবা মা একদিন অনেক আদরে ভরিয়ে দিয়ে ওর কাছে সত্যটা জানিয়েছিল।ছোট্ট মেয়েটা সব শুনে জলভরা চোখে বাবা মাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরেছিল।যত বড় হয়েছে তত ও বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে।প্রাপ্তির শ্বশুর বাড়িতে বিয়ের আগেই ওরা সবটা জানায়। তাই কখনো কোন জটিলতা ওদের জীবনকে স্পর্শ করেনি ।এই পাহাড়ি সবুজ শহর,ঐ মিশনারী স্কুল,কলেজ,অরফ্যানেজ,গীর্জার প্রার্থনা,আর দূর পাহাড়ের জঙ্গলের শোভা,নিশুতি রাতে জঙ্গল থেকে ভেসে আসা কোন জন্তুর ডাক, ময়ূরের ডাক,সব মিলিয়ে নিবিড় প্রকৃতি ওদের জীবনকে শান্তি দিয়ে ঘিরে রেখেছিল।আর ছিল নিজেদের ছোট্ট বাংলোটায় মনোরম বাগান, পাখপাখালির আসা যাওয়া।সবচেয়ে বেশী ছিল এই শান্ত পরিবেশে সকাল সন্ধ্যা দেবতার পূজো আরাধনা।


কয়েকদিন পর ছুটির দিন দেখে বিদিশাকে সারাদিনের জন্য ডাকে রুমা ওর বাড়িতে।অরুণাভ সেদিন গিয়েছিল মেয়ের বাড়িতে।দুই বন্ধু খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ির বাগানে বসে প্রাণ খুলে পুরনো দিনের গল্পে মেতে ওঠে।বিদিশা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে প্রিয় বান্ধবীর কাছে,যখন রুমা ওর প্রেমিক শাওনের কথা জানতে চায়।ওরা যখন কলেজে পড়ত, তখনই শাওনের সাথে বিদিশার আলাপ থেকে প্রেমে গড়ায়।শাওন তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছে।একটা বন্ধুর বিয়েতে আলাপ হয়েছিল বিদিশার সাথে।বিদিশা ছিল যথেষ্ট সুন্দরী।ওরা মাঝে মাঝেই দেখা করত।ফিরে এসে বন্ধুদের গল্প করত।শাওন ওদের বাড়িতেও নিয়ে যায় বিদিশাকে।

বন্ধুরা বেশ উৎসাহ নিয়ে বিদিশার প্রেমকাহিনী

শুনত।আজ এতদিন পর স্বাভাবিক কৌতুহলেই রুমা শাওনের কথা,ওর জীবনের কথা জানতে চায়। বিদিশার কান্না দেখে ও বলে,আমি না জেনে তোকে কষ্ট দিলাম।তোর বলতে হবে না ।চল আমরা বরং ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিই।

বিদিশা বলে না রে তোকে সব বলব।আর বইতে পারছিনা একা।শুনতে শুনতে রুমার দুচোখে নামল জলের ধারা। বিদিশা বলে চলে,পরীক্ষার পর হষ্টেল থেকে বাড়ি ফেরার আগে দুজনে দেখা করে।শাওন ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়।সেদিন বাড়িতে কেউ ছিলনা।এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিল সবাই।কোন এক ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে ওরা মিলিত হয়। ভুল বুঝতে পারে কদিন পর।শাওনকে সব জানিয়ে বিয়ের জন্য তাড়া দেয়।শাওন বলে, চিন্তা কোরোনা,এটা একটা এক্সিডেন্ট।আমি এবরশনের ব্যাবস্থা করছি,ভয় পেও না।বিদিশা চোখে অন্ধকার দেখে।শাওন অনেক বোঝায় আমরা বিয়ে করব।তবে এক্ষুনি কি ভাবে সম্ভব।এবরশনে রাজি হয়ে তাও প্লিজ।

বিদিশা মেনে নিতে পারেনা।ও বাড়ি ফেরে।মাকে সবটা জানায়।মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। অজানা আশঙ্কায় মা মেয়েকে আগলে রাখে সারারাত চোখের জলে ভেসে। ওর বাবাকে জানাতে ওরা শাওনকে ডাকতে বলে।শাওন আসে । বলে ওকেই বিয়ে করবে কিন্তু কিছু সময় চাই।এদিকে দিন এগিয়ে চলে।বাবা মাও বুঝিয়ে ওকে এবরশনে রাজি করাতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত ওরা খোঁজখবর করে চলে আসে এই শহরের মিশনারী হসপিটালে।ফাদারের সাথে কথা বলে মা মেয়ের কটা মাস এখানেই থাকার ব্যাবস্থা হয়। বিদিশার বাবা বাড়ি ফিরে যায়।যথাসময়ে একটা ফুটফুটে মেয়ে জন্মায়।এর পরেও মাস ছয়েক ওরা ওখানে থাকে।তারপর মিশনারীর অরফ্যানেজে ফাদারের হাতে শিশুকে দিয়ে ওরা ফিরে যায়।শাওন আর কখনো যোগাযোগ করেনি এরপর।


শুরু হয় ওর একা একা পথ চলা।দূরের একটা শহরের প্রাইভেট স্কুলে সামান্য মাইনের শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যায়। দূর থেকেই বাবা মায়ের খবর নেয়।কয়েক বছর পর একবার এখানে এসে ফাদারের কাছে জানতে পারে ওরা চলে যাবার কদিন পরে এক দম্পতি বাচ্চাটাকে দত্তক নেয়।অনেক আশা নিয়ে এসেছিল সন্তানকে চোখের দেখা দেখবে বলে।চোখের জলে ভেসে গেল।ফাদার ওকে শান্তনা দিয়ে বললেন, তোমার তো খুশী হওয়া উচিত তোমার মেয়ে আদরে মানুষ হচ্ছে।সত্যিই ফাদারের কথায় ও সেদিন শান্তি পেয়েছিল।

এই জায়গাটা ওকে খুব টানত।তাই কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখে আর দেরী করেনি।

রুমা অবাক হয়ে বন্ধুর কাহিনী শুনল।এক মূহুর্ত দেরী না করে বের করল পারিবারিক এলবাম। প্রাপ্তির শৈশবের ছবিগুলো মেলে ধরলো বন্ধুর সামনে। বিদিশা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।এতো সেই ছমাসের ছোট্ট মেয়েটা,যাকে চিরদিনের মত বিসর্জন দিয়ে মায়ের সাথে ফিরে গিয়েছিল একদিন সমাজের ভয়ে,কলঙ্কের ভয়ে।

দুই বন্ধুকে ঈশ্বর কি এইজন্যেই এতদিন পর মিলিয়ে দিলেন?

পরদিন অরুণাভ ফিরে এল  বাড়িতে মেয়ে জামাইকে নিয়ে ,ওরা কদিন বাবা মায়ের সাথে থাকবে বলে। অরুণাভকে সব কথা জানাল রুমা।এরপর ওরা অরফ্যানেজে গিয়ে পুরনো রেকর্ড দেখে নিশ্চিন্ত হতে চাইল। বিদিশা,রুমা,অরুণাভ তিনজনকেই আশ্বস্ত করে ওরা জানিয়ে দিলেন ওদের অনুমান সঠিক।

এরপর বিদিশাকে নিয়ে এসে ওরা প্রাপ্তিকে মায়ের হাতে তুলে দিল।এক সবহারানো নারী নিজের মেয়েকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল।চোখে বইল আনন্দাশ্রু।প্রাপ্তিও অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল তার মায়ের দিকে।পরম যত্নে মুছিয়ে দিল চোখ।রুমা অরুণাভের ও তখন দুচোখ ভরা জল।প্রাপ্তির বর পার্থ তো বিস্ময়ে  হতবাক ।প্রণাম করল নতুন মাকে।সন্ধ্যা নেমে এলো ।দূরে গীর্জায় বেজে উঠল ঘন্টাধ্বনি।।তিন নারী ও দুই পুরুষ জীবনের এই আনন্দঘন মূহুর্তে স্মরণ করল ঈশ্বরকে।


শিখা রায়।







পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু