বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

নদীর কাছে

নদীর কাছে

নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু আঁকাবাঁকা পথ ধরে আপন খেয়ালে‌।দূরে একঝাঁক বক উড়ে যাচ্ছে আকাশের বুকে চিত্র এঁকে।শাল,সেগুন আর দেবদারু গাছের সারি ছায়াময় করে রেখেছে নদীতীর।দূরে একটা নৌকা ভেসে চলেছে।রিনি আনমনা হয়ে প্রককৃতির রূপ দেখছিল অরুণের হাতে হাত রেখে।
প্রায়ই ওরা এই সুন্দর বনবীথি ঘেরা নদীর ধারে আসে।দূজনে মগ্ন হয়ে থাকে নিবিড় ভালবাসায়।
সঙ্গী হয় ছলাৎ ছলাৎ নদীজল, গাছের ছায়ার ফাঁকে রোদের ঝিলিক আর পাখির কাকলি।ভালবাসলে চারদিকের প‌থিবী সুন্দর হয়ে যায়।

রিনি আর অরুণ একই অফিসে নতুন জয়েন করেছে।দুজনেই কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে  সরকারি চাকরিটা পেয়েছে। নতুন চাকরি পাওয়ার আনন্দে ওরা বিভোর।এই অফিসে ওরা আটজন একসাথে জয়েন করে।রিনি প্রতিদিন ট্রেনে করে শহরতলি থেকে আসে।অরুণ আসে বাসে।ওর বাড়ি এই শহরেই। অরুণের দীর্ঘ সুঠাম বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা প্রথম দিনই রিনিকে আকর্ষণ করেছিল।রিনি একটু ছটফটে স্বভাবের।তবে নতুন অফিসে বেশ গাম্ভীর্য বজায় রাখাই পছন্দ করত। জয়েন করার কদিনের মধ্যেই ওদের ট্রেনিং এ পাঠানো হোল দূরে। কদিন পুরো দলটা খুব এনজয় করল। ট্রেনিং এর পর বিকেলে ওরা নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়ত। মেয়েরা মার্কেট ঘুরে পছন্দসই শাড়ি কিনল।ছেলেরাও কেনাকাটা করল।কদিনে সবাই ভাল বন্ধু হয়ে গেল।তবে রিনির প্রতি অরুণের প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ বন্ধুদের চোখ এড়ায় নি।এই দলে চারজন মেয়ে থাকায় মেয়েদের বন্ধুত্বটা বেশ জমে উঠেছিল। ওদের মধ্যে আত্রেয়ী ছিল বেশ সুন্দরী।মালবিকা দীর্ঘাঙ্গী আর চেহারা ও স্বভাবে
মিষ্টি।অনন্যাই ওদের মধ্যে বিবাহিত।ওর শ্বশুরবাড়ি আর সদ্য বিবাহিত বরের গল্প শুনতে ওরা বেশ ভালবাসত।রিনি এক স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ে।লম্বা বেণীতে আর দীঘল চোখের চাওয়ায় ওর শ্যামলা রঙ যেন মায়ায় জড়ায়। ট্রেনিং শেষে সবাই বাড়ি ফিরে এল।শুরু হোল প্রতিদিনের কর্মময় জীবন।
রিনি আর অরুণ প্রতিদিনের দেখাশোনা আর কাজের মধ্যে ক্রমশঃ পরস্পরের প্রতি টান অনুভব করত।অবস্থা এমন হোল যে রিনির ছুটির দিনগুলো ফাঁকা ফাঁকা লাগত।অথচ মুখ ফুটে অরুণকে মনের কথা বলতে পারত না। আশঙ্কা হোত,যদি অরুণ দূরে সরে যায়। এরমধ্যেই একদিন অরুণ ওকে বলল,যদি বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকে,চলো না একটু চা খেতে যাই‌। ক'দিন ধরেই একটা কথা তোমায় বলব ভাবছি।রিনি ঔৎসুক্য চেপে রাজি হোল।দুজনে একটা কফিশপে গেল।একথা সেকথার পর অরুণ বলল,আমি যদি তোমাকে চাই?
রিনির মনের মধ্যে তখন সাতসুরে বীণা বাজছে।ও আনন্দে কি বলবে ভেবে পেল না।শুধু মিষ্টি হেসে সায় দিল।ও যে এতদিন এই স্বপ্নটাই দেখে এসেছে। অরুণের মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজনকেই ও যেন চেয়েছিল।আজ যেন নতুন করে ওকে দেখল।ফর্সা রঙে নীল শার্টে অপূর্ব লাগছিল অরুণকে।কপালের ওপর কয়েকটা অবাধ্য চুল এসে পড়ে আরো মোহময় করে তুলেছে।অরুণও যেন রিনিকে এত কাছ থেকে প্রথম দেখল‌ একদম আপন করে।দুজনের দৃষ্টি দুজনকে ভরিয়ে দিচ্ছিল।
কিছু পরে অরুণ ওকে ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল।
আজ রিনির হৃদয়ের সব চঞ্চলতা শান্ত হয়ে গেছে,সব উদ্বেগ দূর হয়েছে।ওর ভালো লাগা পূর্ণতা পেয়েছে।প‌থিবীর সব আনন্দ ওর আঁচলে ধরা দিয়েছে।বাড়ি ফিরে বাবা মা বোনের সাথে টিফিন করল।বোনকে অন্যদিনের মত পড়ায় সাহায্য করল। কিন্তু অরুণের মুখটা যেন চোখের সামনে ভাসতে লাগল।
রিনি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, গানবাজনা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকত।আজ মনে হোল অন্যদের মত নিজের সাজগোজের দিকেও একটু নজর দিতে হবে।ও ভাবতেই পারেনি এত সহজে অরুণকে পাবে। এতদিন যেন ওকে অধরা মনে হচ্ছিল।
পরদিন অফিসে গিয়ে ব্যাস্ত হয়ে উঠল কতক্ষণে অরুণ আসবে।আজকে অরুণ যেন বেশ সাজগোজ করেছে।হালকা পিঙ্ক শার্টে অনবদ্য দেখাচ্ছিল।যাই হোক,যে যার কাজে মনোনিবেশ করল।ক্রমশঃ বন্ধুদের কাছে বিষয়টা প্রকাশ পেয়ে গেল।ওরা হইচই করে ওদের প্রেমটা সেলিব্রেট করল একদিন সবাই মিলে গঙ্গাবক্ষে লঞ্চভ্রমণে গিয়ে।
আজ এতদিন পর দুজনে নদীর পাড়ে বসে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিল। পাঁচ বছর হয়ে গেল ।কত তাড়াতাড়ি দিন চলে যায়। অরুণের বাড়িতে এই বিয়ে নিয়ে বেশ আপত্তি ছিল প্রথমদিকে।অরুণের বাবা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।আর রিনিরা কায়স্থ।অরুণের দুই দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর ওনারা তখন অরুণের বিয়ের উদ্যোগ নেন,ও তখন বাড়িতে রিনির কথা জানায়।বাবা মাকে ও খুব শ্রদ্ধা করে ।কিন্তু
রিনি ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারেনা।তাই এতদিন ওরা বিয়ে করেনি।অনেক বোঝানোর পর আজ এতদিনে বাবা ছেলের সুখের কথা ভেবে রাজি হয়েছেন।মা বলেছেন রিনিকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে।

এই কথা বলতেই আজ এই নদীতীরে আসা আর খুশিতে ভেসে যাওয়া। নদীর মতই উচ্ছল হয়ে উঠল রিনি।
ওর প্রিয় কবিতা বলে উঠল,
"ভালবাসা অন্তবিহীন আলোর দিশা,
ফেলে আসা কোনো কাহিনীর মুগ্ধ নেশা?
কবিতা ছন্দে তাকে বাঁধবে বলে,
কথাদের ডাক দিল আজ এই বিকেলে!"

ওর চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছিল।অরুণ চোখ ফেরাতে পারছিল না।আর অরুণের দীঘল আঁখিতে রিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলল।দুজন দুজনকে সমস্ত অন্তর দিয়ে স্পর্শ করল।আর কোন অন্তরায় নেমে আসবে না ওদের ভালবাসায়।অরুণ পরম আদরে ওকে কাছে টেনে ভালবাসায় ভরিয়ে দিল।অরুণের বুকে মাথা রেখে রিনি এক পরম আশ্রয় খুঁজে পেল।
তটিনী সাক্ষী রইল এই অনন্ত মিলনের।

শিখা রায়।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু