বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

পঞ্চবল্লভা



পূর্ণিমানিশি, আকাশে দ্যুতি ছড়াচ্ছে জীবন্ত শশীকলা। প্রশস্ত বাতায়নপার্শ্বে একাকিনী বসে রাজমহিষী যাজ্ঞসেনী। কিয়ৎ উদাসীনা, একমনে চেয়ে আছেন ম্লানজ্যোৎস্নার দিকে৷ বাতায়নবর্তিনীর নজর দূরের গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে বহুদূরে কোন অজানার সন্ধানে ব্রতী হয়েছে কেজানে! 


আজ ভ্রাতৃ আদেশে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দূরে গমন করেছেন পার্থ। যাজ্ঞসেনীর একমাত্র প্রেমাস্পদ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে বেছে নিয়েছেন বারোবছরের বনবাসী জীবন। হ্যাঁ বিনাদোষে৷ 


এ কি অভিমান! নাকি আর্যশ্রেষ্ঠর এক অনাবিল ত্যাগের পরিচায়ক! ধর্মরক্ষার্থে এই বিনাদোষে শাস্তির হেতু বুঝে উঠতে পারেন না দ্রুপদসুতা। তিনি ফুঁসছেন। বেদনা - রোষ - ঘৃণা একসঙ্গে খেলা করছে তাঁর পদ্মদলসম মুখমণ্ডলে। কেন! কেন করলেন এমন ধর্মপুত্র! নেহাতই ধর্মরক্ষার দায়ে! নাকি শুধুমাত্র যাজ্ঞসেনীকে নিজ অধিকারে রাখার কুটিল অভিপ্রায়ে! অস্ত্রাগারে মিলনের হেতু কি ছিল! সব্যসাচীর মত ধনুর্ধর অস্ত্রাগারে যখন তখন প্রবেশ করবেন এ তো জানা কথাই! তবে কি সবই পূর্ব পরিকল্পিত! ধর্মপুত্র স্বয়ং অধর্মকর্তা! 


সুদৃশ্য উদ্যানের এককোনে তমালতরুছায়ায় বসে আছেন যুধিষ্ঠির। বিষন্নতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাঁকে। এ কি করে ফেললেন তিনি! প্রিয়তমাকে নিজের করে রাখবার অভিপ্রায়ে প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতাকে সরিয়ে দিলেন প্রাসাদ থেকে! তিনি কি তবে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন কিছুসময়ের জন্য! হয়ত তাই৷ আসলে নিজেকে বরাবরই পার্থের তুলনায় অধম ভেবে এসেছেন তিনি। নিজের মনঃস্তত্ত্বকে অস্বীকার করতে পারবেন না তিনি আজ এই একাকী সন্ধ্যায়৷ হ্যাঁ, তিনি ইর্ষা করেছিলেন। ইর্ষা করেছিলেন তাঁর সৌভাগ্যকে, তাঁর অসীম বীরত্বকে ও... যাজ্ঞসেনীর তাঁর প্রতি দুর্লঙ্ঘ প্রেমকে। 


মাতৃ আদেশে পঞ্চভ্রাতার দারপরিগ্রহে বাধ্য হলেও দ্রৌপদীর মন জুড়ে শুধু অর্জুনের রাজত্ব, টের পেয়েছিলেন তিনি। যে কন্যা স্বয়ম্বরসভায় মৎসআঁখি বিদ্ধ করা বীরশ্রেষ্ঠকে বরমাল্যে বরণ করে, সে যে অন্য কাউকে হৃদয় দিতে সমর্থ হবেনা ; আশ্চর্য কি! 


নিয়মানুসারে প্রথম তিনবছরের জন্য তিনি যাজ্ঞসেনীর অধিকার পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর মনের অধিকার পেয়েছিলেন কি! না পাননি। তিনি লক্ষ্য করেছেন, তাঁর ক্রোড়লগ্না মহিষীর চোখে পার্থের ছায়া, মিলনকালেও উদাসী চোখে শুধু তাঁর কথাই ভেবে যাওয়া। ঈর্ষান্বিত তিনি হবেন না কেন! তাঁর দোষ কি! 


জ্যেষ্ঠভ্রাতা হয়েও তিনি তো জিততে পারেননি দ্রুপদললনাকে, ভাগ্যের ফেরে তাঁকে বিবাহ করেছেন মাত্র। স্ত্রী হিসাবে লাভ করেও তাই অতৃপ্ত তিনি৷ রাত্রিদিন জ্বলছেন এক অদম্য আক্রোশে। কেন! কেন তাঁকে ভালোবাসবেন না যাজ্ঞসেনী!  কেন তাঁর পাশে থেকেও ভেবে যাবেন অন্য কারো কথা! কি নেই তাঁর মধ্যে! হ্যাঁ তিনি পার্থের মত বীরশ্রেষ্ঠ নন, তবুও... ভালো কি তিনি কম বাসেন মহিষীকে! 


আজ এই মনোরম রাতে যেখানে তাঁর স্ত্রীবাহুমধ্যে সুখরজনী যাপনের কথা সেখানে তিনি বসে আছেন এই উদ্যানমধ্যে। কেন!  কারণ দুয়ার রুদ্ধ করেছেন যাজ্ঞসেনী। পার্থের চলে যাওয়ার সময় তাঁর অশ্রুসিক্ত মুখখানি নজর এড়ায়নি ধর্মপুত্রের। কি ছিল ওই মুখে! রাগ ঘৃণা তিতিক্ষা!  নাকি কর্তব্যপালনের নিশ্চয়তা! বুঝতে পারেননি তিনি। চলে যাওয়ার সময় শুধু একবার ফিরে চেয়েছিলেন পার্থ, মুহূর্তখানেকের জন্য চোখাচোখি হয়েছিল প্রিয়তমার সঙ্গে। সময় যেন থমকে গিয়েছিল সেই সময়টুকু। যুধিষ্ঠির অবাক চোখে দেখেছিলেন, কিভাবে নৈঃশব্দ্য হাজার কথা বলতে পারে৷ পুরো পৃথিবী যেন ওই একমুহূর্তে স্থির হয়েছিল দুই মানব মানবীর চোখে৷ আচ্ছা, চন্দ্রমা কি সেইলগ্নে ঢেলে দিয়েছিল তার মুগ্ধজোছনা! কে জানে! 


কালচে মেঘের অন্তরালে চাঁদ ঢেকে গিয়েছে বেশ কিছু সময় হলো, বাতাসে গুমোটভাব বেড়েছে খানিক৷ রুদ্ধদুয়ার উন্মুক্ত করে নূপুরের ছমছম শব্দ তুলে উদ্যানে এসে দাঁড়ালেন যাজ্ঞসেনী৷ ত্রয়োদশী চন্দ্রকলার মত তাঁর মুখমণ্ডলে এখন যান্ত্রিক কর্তব্যপরায়ণতা৷ 


--" নিদ্রা যাবেন না আর্যপুত্র! রাত্রি  শেষ হয়ে এলো প্রায়! " 


প্রিয়ার ডাকে চমকে চাইলেন যুধিষ্ঠির। এতক্ষণ নিজ ভাবনার সমুদ্রে অবগাহন করছিলেন তিনি,  যাজ্ঞসেনীর ডাকে বাস্তবে পতিত হলেন। তবে কি! তবে কি যাজ্ঞসেনীর কোনো ক্ষোভ নেই তাঁর প্রতি! তবে কি পার্থের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ ভালোবাসার কাহিনী ধর্মপুত্রের নিজ মস্তিষ্কপ্রসূত! চোখে জল চলে এলো তাঁর৷ ধরা গলায় বললেন, 


--" তুমি কি আমায় ক্ষমা করেছো প্রিয়ে! বিশ্বাস করো ভ্রাতাকে আমি বনবাসে পাঠাতে চাইনি! শুধুমাত্র সত্যরক্ষার জন্য...!" 


--" সত্যরক্ষার পথে ক্ষমার কোনো ভূমিকা নেই রাজন। এ বিবাহ, বিবাহ সংক্রান্ত নিয়ম সবই ভবিষ্যৎ এর পথ চেয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত মাত্র। আমার বা আপনার এখানে কোনো ভূমিকা নেই৷ ঈশ্বরের আদেশ মনে করে আমাদের সবই গ্রহণ করতে হবে। অনুভূতির দাসানুদাস হয়ে নিয়ম লঙ্ঘন আমাদের শোভা পায় না৷ ঘুমোবেন চলুন, ঝড় আসতে চলেছে। এইসময় বাইরে থাকা কুরুসামাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকে শোভা দেয় না৷ আসুন। " ভেসে এলো যান্ত্রিক উত্তর৷ 


যাজ্ঞসেনীর হাত ধরে নিজ কক্ষের দিকে প্রস্থান করতে করতে যুধিষ্ঠির টের পেলেন, অদ্য হতে মহিষীর হৃদয়ের সকল দুয়ার রুদ্ধ হয়েছে, যা উন্মোচন করার সাধ্য স্বয়ং ঈশ্বরের নেই। কর্তব্যপালনে নিষ্ঠ যাজ্ঞসেনীর হৃদয়ে তাঁর স্থান কোনোদিন হবে না, আজীবন মাথা খুঁড়ে মরতে হবে রুদ্ধদ্বারের এপারে৷ এ ভীষণ শাস্তির থেকে তাঁর মুক্তি নেই, এজন্মে না। 


ওদিকে, নদীধারে ধ্যানমগ্ন তাপস অর্জুনকে দেখে মোহমুগ্ধা হচ্ছেন এক নাগকন্যা। পাতালরাজ্যের সীমানা পেরিয়ে সকল বাধা তুচ্ছ করে তিনি এগিয়ে আসছেন প্রিয়মিলনে৷ শুরু হতে চলেছে এক নতুন অধ্যায়, যাজ্ঞসেনীর দুর্ভাগ্যের অধ্যায়।। 


(সমাপ্ত)

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু