বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কবিতা সংগ্রহ

আহুতি


ভাল থেকো প্রিয়তম,

প্রতিবার তোমার ভাল থাকার জন্য আমি অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছি।

তোমার প্রজাহিতৈষী নামের অন্তরালে রয়ে গেছে আমার যন্ত্রণা।

আমার প্রেমের নির্বাসনে তোমার মহত্ত্ব দীপ্তি পেয়েছে।

আমি নারী,প্রদীপের শিখার মত পুড়ে আলোকিত করেছি তোমার গৌরবকে!

তোমাদের তো স্বর্ণসীতার প্রয়োজন,

রক্ত মাংসের প্রেমিকা নয়, সহধর্মিনী নয়!

তাই তো আমার পাতাল প্রবেশ, ভালবাসার চির নির্বাসন!


তোমরা আপন গরিমাতে মগ্ন,

নারী শুধু বিলাসে ব্যাসনে রন্ধনে প্রয়োজনে!

তাই তো তাকে বাজী রাখা যায় পাশাখেলায়,

অনূঢ়া কন্যাকে পাঠানো যায় বদরাগী ঋষির সেবায়,

রাজার কন্যা দান হয়ে যায় সম্পদের মত!

বার বার হস্তান্তরিত হয়ে চলে সে রমনী!

রাজসভায় রাজবধূর বস্ত্রহরণ হয় নির্দ্বিধায়!

অনিচ্ছুক রাজবধূ প্রেরিত হয় বৃদ্ধ ঋষির শয্যায়!


মন নয়,মান নয়,রূপ নয়,বিদ্যার গৌরব নয়,

একমাত্র সত্য পুরুষের কীর্তি,জয়ধ্বজা!

বিদুষী ক্ষণারা তাই আপন জিহ্বা দিয়ে বিসর্জন

আপনাকে আহুতি দেয় পুরুষের দৃপ্ত অহংকারে।


____________________


ভালবাসার রঙ


একটা দমকা হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিল মেয়েটিকে,

হাওয়াকে সঙ্গী করে বলাকাডানায় উড়িয়ে দিল সে মন! 

মন ভাসতে ভাসতে, হাসতে হাসতে মেঘ হয়ে গেল।

শান্ত উপত্যকা,উপল নদীতট ছুঁয়ে ছেলেটির উঠোনে, কৃষ্ণচূড়ার শাখায়,চন্দনার ঠোঁটে গান হয়ে মুখরিত হোল।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরে পড়ল সারা আঙিনায়!


ছেলেটি বাতায়ন খুলে বৃষ্টির মাতালনাচন দেখল।

উদাস হোল,মন ভিজল বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে।

ডসে ডাকলো মেঘকে,বার্তা পাঠালো অচিন দেশে।

মেঘে মেঘে মিলন হলো,বজ্রপাত হোল হৃদয়ে হৃদয়ে!

বিদ্যুতের ঝলকানিতে ভেসে উঠলো কার অদৃশ্য অবয়ব।

তারপর বৃষ্টিতে ভেসে গেল মনের আঙিনা।


তারপর একদিন ফিরে গেল আগন্তুক।

মেয়েটি আর খুঁজে পেলনা কোথাও তাকে।

সে ডাকলো পাখিকে,পাখি বলল হাওয়াকে,

হাওয়া বলল বৃষ্টিকে,বৃষ্টি বলল মেঘকে!


বন থেকে বনান্তরে,মন থেকে মনান্তরে সাড়া জাগালো।

মন খারাপের রঙে আকাশ নীল হয়ে গেল।

অশ্রুজল নদী হয়ে সাগরে মিললো,

ভেসে গেল ঢেউ এর দোলায় জন্ম থেকে জন্মান্তরে।

ফুল,নদী,মেঘ,পাখি ছড়িয়ে দিল ভালবাসারং রঙ।



______________________


 শব্দ দিয়ে খুঁজি


তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি আস্ত একটা আকাশ পেয়ে গেছি,

যেখানে গোধুলির আলো মিলিয়ে যায় তারার আল্পনায়!

আকাশের বিরাট বুকে সলাজ চাঁদ তার মুখ রাখে ভালবেসে!


তোমাকে ভাবতে ভাবতে আমি এক হাজার কাব্য পেয়ে গেছি,

যেখানে শব্দেরা তোমার অবয়ব আঁকে কল্পনার রঙে,

কখনো সমুদ্রতটে, যেখানে অস্তরাগের সাতরঙা আভায়

উচ্ছল ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে বালুরাশির আদরে।

আকাশের সাথে সাগরের লুকোচুরি খেলা তুমি মুগ্ধ হয়ে দেখ,

দমকা হাওয়ায় অবিন্যস্ত হয় তোমার সুচারু কেশ।


কখনো পাহাড়ি বনবাঙলোর অলিন্দে বা বাতায়নে তুমি মেলে দাও দৃষ্টি দিগন্তের পানে,

তোমার দীঘল আঁখির রূপ বর্ণনায় আমার শব্দেরা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়!

তোমার অধর ওষ্ঠের মৃদু হাসি আমার কল্পনার তুলিকে বিবশ করে দেয়।

তবুও হার না মানা বাক্যেরা নিয়ে আসে চোখের সামনে তোমার বর্ণিল কায়া,

আমাকে নিয়ে চলে তোমার রূপ থেকে রূপান্তরের ছন্দময় আখরমালার বৈভবে।

তবু বার বার ব্যর্থ হয় তোমার অনিন্দ্য সুন্দর রূপ বর্ণনায়!


_______________________


মেঘদূত নিয়ে


ভালবাসা একদিন মেঘ হয়ে উড়ে গিয়েছিল দূর অলকায়,

মেঘের ভেলায় ভেসে দেখেছিল প্রকৃতির রূপের বিন্যাস।

কোথাও নীরব ভাষায় অনিন্দ্য আবেশে সুখবিলাস,

কোথাও সসম্ভ্রমে আসন্ন মেঘোৎসবের অধীর আয়োজন,

পূর্বমেঘে উত্তরমেঘে মন্দ্রিত প্রেমাভিষেক!

বিরহের দহনে দগ্ধ হৃদয়ে মেঘের অদৃশ্য আলিম্পন!

ভালবাসার রিক্ত অভিসারে না পাওয়া হয়েছিল মহান্!

ছন্দেরা হৃদয় রক্তরাগ সিঞ্চিত অশ্রুভরা বেদনাকে করেছিল আলিঙ্গন!

কবিতায় ছত্রে ছত্রে সে যেন এক ছন্দিত বিরহমুক্তি!

ভূমার মাঝে আপন দুঃখের নিঃশর্ত সমর্পন!

যুগ গেছে কত তারপর ব্যর্থ অভিসারের পথ চেয়ে,

হৃদয়ের চোরাবালি রিক্ত করে চলেছে কত মন!

তবু দিগন্ত ভরিয়ে ভরসার মেঘ স্বপ্ন এঁকে চলেছে অনন্তের পটে।

______________


সময়ের চালচিত্রে নারী


আজ থেকে বহুযুগ আগের দর্পণে

প্রতিবিম্বিত নারীর মুখ জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত।

অপালা,লোপামুদ্রা,গার্গী,মৈত্রেয়ী,বৈদিক যুগের বিদুষী ললনা,

দেবীসূক্তের রচয়িতা অম্ভৃনিকন্যা বাক।

পৌরাণিক নারীও পেয়েছেন মর্যাদার স্বীকৃতি।

অপাঙক্তেয় করেনি তখনও নারীকে অন্ধ নীচতা।


তারপর এল ঘোর তমসার যুগ।

অন্ধ সংস্কার মানবের মত অধিকার

পুরুষের কুক্ষীগত করে নারীকে করল গৃহবন্দী।

শিক্ষার আলোকবর্তিকা নিল কেড়ে।

শোষনের যুগ হল শুরু।

বাল্যবিবাহ এর অভিশাপ হয়ে।

কৌলিন্যের অজুহাতে বৃদ্ধের ভার্যা হল ষোড়শী কিশোরী।

তারপর,অনিবার্য আচারবিধিতে আবর্তিত

আজীবন নিষ্ঠুর বৈধব্যপালন।

এল সতীপ্রথা।স্বামীর চিতায় জ্বলে যেত

কচি কচি অনিচ্ছুক প্রাণ।

ঢোল বাদ্যে,উদ্দাম উল্লাসে ডুবে যেত আর্তনাদ।

মরণোত্তর পুরস্কার সতীমাতা নামের অলঙ্কার।


আজ সেই আঁধার পেরিয়ে আবার

এসেছে মুক্তি নারীর জীবনে

নির্ঝর ধারার মত।

জ্ঞানের দুয়ার গেছে খুলে।

তবুও নীচতা আর কামনার কাছে

পরাজিত নারীর জীবন।

পণরূপী শ্বাপদ নারীকে করে বিপন্ন।

রজত,কাঞ্চন কম হলে বধূরা আজও

নির্যাতিত স্বপ্ন দেখানো সেই বঁধুয়ার ঘরে।

পতিগৃহে যেতে গিয়ে যতুগৃহে চলে যায় সবার অলক্ষ্যে।


দিবালোকে অথবা তমিস্রা রজনীতে

লুন্ঠিত হয়ে যায় নারীর সম্মান।

লালসার নখদন্তে ছিন্নভিন্ন হয় নারী

লেলিহান অগ্নিশিখায় নিক্ষিপ্ত কুমারী।

পশুত্বের আস্ফালনে রুদ্ধ হয়ে মানবতা কাঁদে,

পথ এসে থেমে যায় রুদ্ধশ্বাস ধ্বংসের বারুদে।


_____________________

 অরণ্যানী


সুদূর অতীতে যখন ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবসন্তান

শৈশবের দিনগুলো অতিবাহিত করছিল,

সামনে ছিল সীমাহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,

বনানীর বুকে ভয়শঙ্কিত পদসঞ্চার,

তখন ফুলে, ফলে,সৌরভে তাকে সমৃদ্ধ করেছিল মাতা!

মাতৃদুগ্ধসম ফলদানে বুভুক্ষু শিশুটিকে পুষ্ট করেছিল,

মমতার ছায়া দিয়ে ঘুচিয়েছিল ক্লান্তি!

পাতার মর্মরে,শাখাশ্রিত পাখির দুজনে,

শুনিয়েছিল ঘুমপাড়ানি গান।

হিংস্র শ্বাপদের খাদ্য হতে দেয়নি তাকে,

নীরস তরুবরে জ্বলে উঠেছে আগুন।


ক্রমশঃ বল্কল হোল বহন,পর্ণকুটীর বাসস্থান,

পুষ্প আভরণ,তার সৌরভ অঙ্গরাগ।

তারপর অস্ত্র এল দারুনির্মিত।


এল লিপি,পাতার বুকে ফুটল আখর।

কত যুগ গেছে তারপর।

বৃক্ষ যেন পিতরৌ।

আধুনিক নগরীর হর্ম্য,অট্টালিকা,

আসবাব,গৃহসজ্জা অরণি খচিত।


তবু মানব আজ নিজ প্রয়োজনে হেনেছে কুঠারাঘাত।মাতাকে করেছে নির্বাসিত

পৃথিবীর বুক হতে।

বনমাতা তাই ক্ষুব্ধ,ব্যথাতুর।

পৃথিবী হারিয়েছে ভারসাম্য ,

বারিময় মাতৃস্নেহসুধা ক্ষীণধারা!

___________________



পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু