বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

জীবনের কাব্য

বিধাতার উপহার


'তোমাকে ভালবেসে পাগল হয়ে যাবো?

তুমি তো কদিন পর ভুলে যাবে।'পুরনো কথা রোমন্থন করছিল অনন্যা হোটেলের ব্যালকনিতে বসে।সামনে পাহাড়ের সবুজ দৃশ্যাবলী।কার্শিয়াঙের এই কটেজটাতে প্রায় একযুগ আগে ওরা উঠেছিল।পাশের কটেজেই ছিল অরিন্দমরা।

অরিন্দম,এক প্রাণবন্ত মন ভাল করে দেওয়া অস্তিত্ব। সুপুরুষ,উচ্চশিক্ষিত মানুষটি অনন্যার মন কেড়ে নিয়েছিল প্রথম আবির্ভাবেই।পাহাড়ের কোলে শাল সেগুন,পাইনের শাখা যেখানে আকাশের দিকে হাত বাড়ায়,দূরে পাহাড় চূড়ায় যেখানে শুভ্রফেননিভ তুষার চিত্র আঁকে,সেই মনোরম প্রকৃতির কোলে দুজনের প্রথম দুজনকে ভাল লাগা,মন দেওয়া নেওয়া।

তখন অনন্যা সবে এম মিউজ করে এদিক ওদিক অনুষ্ঠানে গান গাইছে।নতুন ক্যাসেট বের করার উদ্যোগ নিচ্ছে।সেই সঙ্গে চাকরির চেষ্টাও করছে।আর বাবা মা ওর বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছেন।

অরিন্দম সবে নতুন চাকরীতে জয়েন করেছে।অরিন্দমের প্রথম পছন্দ কবিতা।নিজে একটু আধটু লেখালেখি করে কয়েকটা পত্র পত্রিকায়। দ্বিতীয় পছন্দ গান।

কয়েকদিন একসাথে ট্যুরিজিমের গাড়িতে অনেকে মিলে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার অবসরে বেশ ভাল আলাপচারিতা হয়েছে দুজনের মধ্যে।অনন্যা অপরূপ সুন্দরী না হলেও ওর চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা আছে,যেটা অরিন্দমকে আকর্ষণ করে।আর অরিন্দমের ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ও অমায়িক ব্যবহার অনন্যার মন ছুঁয়ে যায়।কটা দিন সুন্দর প্রকৃতির মাঝে মধুর আবেশে কেটে যায়।এরপর ফেরার পালা।মন খারাপ লাগছিল অনন্যার ।তবু মেনে নিতে হয়। ফিরে এসে দুজনে যোগাযোগ করে।মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

এর মধ্যে এসে পড়ে অনন্যার জন্মদিন।অরিন্দম ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়।অনেক বিশিষ্ট জনের উপস্থিতিতে অনন্যাকে মঞ্চে ডেকে ওর হাত দিয়ে প্রথম কাব্যগ্রন্থের আবরণ উন্মোচন করে।এরপর উদীয়মান এক সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে সবার সাথে অনন্যার পরিচয় করিয়ে দেয়। উপস্থিত গুণীজনের অনুরোধে অনন্যাকে  গান গাইতে হয়।

অনন্যা আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে।এটা ছিল ওর জন্মদিনের সেরা উপহার।

ও গেয়ে ওঠে"কি গাব আমি কি শোনাব আজি আনন্দধামে"।গান শেষ হতেই করতালিতে ফেটে পড়ে অডিটরিয়াম।

অনুষ্ঠানের শেষে দুজনে ফিরে আসে যার যার বাড়িতে।বাড়ি ফিরে অরিন্দমের দেওয়া রজনীগন্ধার স্টিক সহ ওর কবিতার বই "আমার ভালবাসা"সযত্নে তুলে রাখে।বাড়িতে এই সারপ্রাইজ অনুষ্ঠানের কথা বলে।বোনের মাধ্যমে বাবা মাকে আগেই ও অরিন্দমের কথা জানিয়েছিল।রাতে জন্মদিন উপলক্ষ্যে মায়ের হাতে পায়েস ও স্পেশাল রান্না খেয়ে নিজের ঘরে আসে।অরিন্দমের কবিতার বই পড়তে বসে।একটার পর একটা কবিতা পড়ে আর অবাক হয়ে দেখে ওকে নিয়েই লেখা প্রতিটা ছত্র।অরিন্দমের ভালবাসায় মনে মনে বলে ওঠে"তোমার ভালবাসায় আমি পাগল হয়ে যাব,অরিন্দম!"

বইএর প্রথম কবিতাটা মন কেড়ে নিয়েছিল,"তোমাকে ভালবেসে হারিয়ে যেতে হয়,

          তোমায় ভেবে ভেবে দিবস মিশে যায়,

          সাঁঝের পারাপারে,সুরের খেয়া ধরে,

          সারেমাপাধা ছুঁয়ে,নিষাদে,গান্ধারে----"


ভালই কাটছিল দিনগুলো।এরপর অরিন্দম ট্রান্সফার হয় হায়দ্রাবাদ।চলে যাবার আগে অনন্যা বলে,'তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। বিয়ের জন্য বাবা মা তোমাদের বাড়িতে যেতে চাইছেন।'অরিন্দম বলে, দেখছি, আমার বাড়িতেও সবাই জানে'।এতদিন না দেখে থাকতে হবে ভেবে অনন্যার চোখের জল বাধা মানছিল না।অরিন্দম ওর চোখ মুছিয়ে কাছে টেনে নেয়।বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে বলে'পাগলী একটা,আমি যেন বিদেশ যাচ্ছি।'

এরপর মাস দুয়েক পর ও একবার আসে।মনে হয় যেন কত যুগ পর দেখা হোল।দুজনে আবার ভালবাসার স্রোতে ভেসে যায়।

অরিন্দম ফিরে যাবার পর কয়েক মাসের মধ্যে ক্রমশঃ অরিন্দমের দিক থেকে যোগাযোগ কমে আসে।অনন্যা উৎকন্ঠিত হয়।ফোন করাতে,অরিন্দম জানায়,"আমার অনেক কাজ থাকে"!

একসময় অরিন্দম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।অনন্যার পায়ের নীচে মাটি সরে যায়।ও যত চিঠি দেয়,একটারও উত্তর আসে না।ততবার ফোন করে,একটা দুটো নিয়মরক্ষার কথা বলে অরিন্দম ফোন কেটে দেয়।চোখের জলে ভেসে যায় অনন্যা।কি করবে ভেবে পায়না।অবসাদে ডুবে যেতে থাকে।বাবা মা বোন ওকে এত চুপচাপ দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।এরপর ওনারা  আবার ওর অন্যত্র বিয়ের জন্য সচেষ্ট হন।ও বলে দেয় বিয়ে করবে না।ওর জেদের কাছে বাবা মা নতিস্বীকার করেন।সময় বয়ে চলে।ও এরপর একটা স্কুলে গানের শিক্ষিকা হিসাবে জয়েন করে। কিছুদিন পর বোনেরও বিয়ে হয়ে যায়।ও আরও একা হয়ে যায়।


আজ এত বছর পর স্কুল থেকে ওরা কয়েকজন টিচার একসাথে কার্শিয়াঙ বেড়াতে এসেছে।ও প্রথমে আসতে চায়নি।ওই শহরের সাথে যে ওর স্মৃতি বিজড়িত।কলিগরা জোর করাতে পরে রাজি হয়।এ জায়গায় সাথে যে ওর অচ্ছেদ্য সম্পর্ক।ব্যালকনিতে বসে এসব ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যে হয়ে যায়।শীত করতে থাকে।ঘরে এসে অরিন্দমের কবিতার বই নিয়ে বসে।অরিন্দমের কবি হিসাবে বেশ নাম হয়েছে।ওর নতুন বই বেরোলেই অনন্যা সংগ্রহ করে। আজকাল কবিতাগুলো যথেষ্ট পরিণত,অথচ তার মধ্যে হতাশা ফুটে ওঠে।অনন্যা ভাবে,তাহলে কি অরিন্দম ভাল নেই?জানার কোন উপায় নেই।ও সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে‌।কল্পনা করে,কোন সুন্দরী মেয়ে হয়তো আজ ওর সবটা জুড়ে আছে।সুখে সংসার করছে।


পরদিন ওরা শহর ও আশপাশের দর্শনীয় স্থান দেখতে যায়।একটা স্পটে অনেক লোকের মাঝে একজনকে দেখে ও স্তব্ধ হয়ে গেল।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।এ তো অরিন্দম!ঐ মুখ যে ওর মনে গাঁথা হয়ে আছে।ভুল হতে পারে না।ক্র্যাচ হাতে একটা পায়ে ভর করে ধীর গতিতে এদিকে আসছে ।এখনো কি অসাধারণ সুন্দর তার অরিন্দম।একেবারে সামনে এসে যাওয়াতে অরিন্দম এড়িয়ে যেতে পারলোনা আর।অনন্যার দুচোখ তখন জলে ঝাপসা হয়ে গেছে।ও খুঁজছিল আশেপাশে ওর স্ত্রী আছে কিনা।

বন্ধুরাও এই দৃশ্য দেখে হতবাক।

অরিন্দমই প্রথম কথা বলল,"কেমন আছ অনন্যা ?নতুন জীবন কেমন কাটছে?"

অনন্যা অনেক কষ্টে শুধু বলতে পারল"কিভাবে,কবে এসব হোল?"এভাবে তুমি একা ?বাড়ির লোক কোথায়?"

অরিন্দম বলল,সে অনেক কথা।তোমার যদি সময় থাকে,একটু বসে কথা বলি?"

অনন্যা বন্ধুদের এগিয়ে যেতে বলে বসল ।অরিন্দম বলল,হায়দ্রাবাদ যাবার কিছুদিনের মধ্যে অফিস যাবার সময় একটা এক্সিডেন্টে ওর এই অবস্থা হয়।কদিন জ্ঞান ছিল না।ওর বাইকের সাথে একটা প্রাইভেট গাড়ির মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ হয়েছিল।যখন জ্ঞান ফিরল,নিজেকে আবিস্কার করে হসপিটালের বেডে।একটা পায়ের কোন সাড় নেই।বুঝতে পারে চিরজীবনের মত একটা পা সে হারিয়েছে।পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ওই মূহুর্তে।

একটু ধাতস্থ হতে বাবা মাকে দেখলো।চোখের জলে ভেসে একমাত্র সন্তানের জ্ঞান ফেরার প্রতীক্ষায় ওনারা ব্যাকুল ছিলেন।ওদের দেখে ও প্রথম উপলব্ধি করল,বেঁচে থাকাটাই যেন বিস্ময়!

তারপর একদিন হসপিটাল থেকে ফিরল।কলকাতায় আর ফিরবেনা ঠিক করেছিল বলে বাবা মাও ওর কাছে চলে এলেন।প্রতি বছর বাবা মাকে নিয়ে  এখানে একবার আসে পুরনো দিনগুলোতে ফিরে যেতে।

নিজের অসহায়তার সাথে অনন্যাকে জড়াতে চায়নি বলে,যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল,চেয়েছিল অনন্যা যাতে ওকে অকৃতজ্ঞ ভেবে ভুলে যায়।অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হয়।এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জানতে চায় অনন্যার স্বামী,সংসারের কথা।ওর ফাঁকা সিঁথি চোখ এড়ায়নি। ভেবেছিল,আজকাল অনেকেই এসব মানেনা,হয়তো সেরকম কিছু।অনন্যার একরাশ অভিমান ভরা চোখদুটো থেকে নামে বাঁধভাঙা বন্যা।"তুমি আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে পারলে?কেন এতবড় ভুল করলে?একবার কেন জানালে না?কি করে ভাবলে আমি সুখী হব?"

এতগুলো বছর আমার মন সবসময় তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছে যখন যেখানে গেছি।"কিন্তু স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি তোমাকে এই অবস্থায় দেখব।"

সেদিন পাহাড় জুড়ে নেমে এলো বৃষ্টি।এতদিনের সব ভুল বোঝাবুঝি মুছে গিয়ে পাহাড়ি প্রকৃতির সবুজ অরণ্য ওদের আবার মিলিয়ে দিল।অরিন্দম ওর হারিয়ে যাওয়া প্রিয়াকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল ।ভালবাসার টানে ওরা আবার দুজনে ফিরে গেল বারো বছর আগের নব যৌবনের দিনে।দূরে গীর্জায় পবিত্র ঘন্টাধ্বনী বেজে উঠল।সামনে গাছের ডালে দুটো পাখি ডেকে উঠলো।ওদের মিলনের সাথে তাল রেখে রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি পড়তে থাকলো।শীতল হাওয়ায় ওরা পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে থাকল যেন অনন্তকাল ধরে।কার্সিয়াঙের পাহাড় ওদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার আজ এনে দিয়েছে!মনে হোল,এই মূহুর্তে ওদের থেকে সুখী পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

-----------------___________

 তোমায় দেখেছি সন্ধ্যাতারায়


তোমাকে দেখেছিলাম স্বপ্নে, নদীর তীরে বনছায়ে, ফাল্গুনের রঙে একরাশ খুশির আবহে।

তারপর কতবার কত মেদুর রজনীতে,উদাস প্রাতে,মায়াময় জ্যোৎস্নায় কল্পনাতে তোমাকে দেখেছি।তোমার দীঘল আঁখি,অধর ওষ্ঠ ভরা মৃদু হাসি বার বার ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

ছুটির দিনে টুকটাক ঘরের কাজ সারতে সারতে এসব ভাবছিল মনে মনে তৃষা।

ভালবাসার মানুষটাকে অন্তত একবার চোখের দেখা দেখতে তেয়েছিল মন ভরে।রাজি হয়নি আর্য।আর্যর মনে হয়েছিল দেখা হলে তৃষার আবেগঘন ভালবাসায় ও আরো জড়িয়ে যাবে। ফেসবুকের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল দুজনের।তৃষা আর আর্য আলাপচারিতায় কখন যেন একে অপরের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল।

আর্য মাঝবয়সী সুপুরুষ। একটা সরকারি সংস্থায় দায়িত্বশীল পদে কাজ করে। সাজানো সংসার।

তৃষা একটা স্কুলে চাকরি করে।ওর বিয়ের কদিন  পর বুঝতে পারে,ওকে এ বাড়িতে আনা হয়েছে শুধু নিজেদের স্বার্থে।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির সমস্ত কাজ ও হাসিমুখে করে যেত। নতুন সংসারকে আপন করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্রমশঃ দেখল,বাড়ির সব কাজের লোক একে একে ছাড়িয়ে দেওয়া হোল।সব কাজ করার পরেও সারাদিন অভিযোগের আঙ্গুল উঠত তার প্রতি।প্রথম প্রথম তৃষার স্বামী কোন প্রতিবাদ করতে গেলে,তার প্রতি গঞ্জনা আরো বেড়ে যেত। এসব দেখে ওর স্বামীও নির্বিকার হয়ে যায়। একটানা পরিশ্রমে তৃষা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। এরপর ও কিছু দিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে আসে। লাঞ্ছনা গঞ্জনা থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেয়ে ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ভালবাসা গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি ওদের।এমনকি হানিমুন যাবার পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।দুদিন বাপের বাড়ি থাকলেই ওকে ওরা নিতে আসত। সংসারের কাজ ফেলে পালিয়ে যাবার জন্য কথা শুনতে হোত। তৃষার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।ও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পড়াশোনায় ভাল।এত কাজের অভ্যাস নেই।তার ওপর এত দোষারোপ। ছোটখাটো গৃহস্থালি কাজে কেউ না কেউ ওকে অপদস্থ করে কথা বলত। প্রতিদিন সকাল হলেই ও তটস্থ থাকত,আজকে বাক্যের বাণ কোনদিক থেকে আসবে।ওর স্বামী ভাল চাকরি করত। সারাদিনের ক্লান্তির পর তৃষার কথা ভাবার মত মানসিকতা তার  ছিল না।রাতে স্ত্রীকে কাছে পাওয়া ছাড়া ওর আর কোন কর্তব্য ছিল না। তৃষার অপমান ওকে স্পর্শ করতে না।

একসময় তৃষা বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসে।আর যায় না।ও মনস্থির করে, অপমানের জীবন থেকে মুক্তি পেতে এছাড়া আর কোন পথ নেই।ওর স্বামী কয়েক বার এসেছে ওকে ফিরিয়ে নিতে।ও জানিয়ে দিয়েছে ওখানে আর ফিরবে না। প্রথম প্রথম তৃষার বাবা মা দুজনকে মেলাতে চেষ্টা করেন।তৃষা আলাদা থাকার কথাও বলেছে। কিন্তু এর স্বামী বাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি। এভাবেই ওদের সম্পর্ক অন্যদের স্বার্থের কারণে ভেঙ্গে যায়।

তৃষা এবার রোজগারের চেষ্টা করে।বেশ কিছুদিন চেষ্টায় স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে যায়।ওর স্বামীর আসা ক্রমশঃ বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর ডিভোর্সের নোটিশ আসে।পরে তৃষা শুনেছিল ওর স্বামী মৃন্ময় বিয়ে করেছে কোন ধনীর দুহিতাকে পণের বিনিময়ে।তৃষা বুঝেছিল,ঐ বাড়িতে ওর খামতি ছিল একটাই,ও গরীবের মেয়ে।


আজ এতদিন পর একাকী জীবনে কেউ যদি ভালোবাসার দাবী নিয়ে আসে,তাকে ফেরাতে মন চায়না।আর্যর সাথে ও বন্ধুর মত মনের কথা বলত।আজ পর্যন্ত কেউ ওর মনের কথা জানতে চায়নি।আর্য মরমী বন্ধুর মত পরামর্শ দিত। ভালোলাগার ছোঁয়া না থাকলে কেউ কি এত দরদী হতে পারে?

আর্য নিজের পরিবারকে খুব ভালবাসত।তাই তৃষার মায়ায় কোনভাবেই জড়াতে চায়নি।ও এটাও চায়নি যে,তৃষা ওকে ভালবেসে আবার নতুন করে কষ্ট পাক।তাই নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়ে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে।আর্যর বিচক্ষণতায় ওরা দূরেই অবস্থান করে।


তৃষা সবটাই বোঝে।তবু এই ভালবাসার ছোঁয়াটুকু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাথেয় করে রাখতে চায়।তাই হোয়াটস এপে লিখে জানায়,'তুমি ভাল থেকো,এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই।তবে তুমি না চাইলেও  তোমার ছবি আমার মনের মণিকোঠায় চিরদিন আঁকা হয়ে থাকবে।আমার হৃদয়েই আমি তোমাকে দেখব প্রতিক্ষণ।'

ওর মনে পড়ে যায় ওর প্রিয় কবির কবিতার কয়েকটা লাইন:


"ভালবাসা আঁজলা ভরা তৃষ্ণার জল,

অভিমানে বিদ্ধ হৃদয় চোখ ছলছল!

ভালবাসা হৃদয় চুঁয়ে স্বপ্ন ঝরায়,

ভালবাসা কখন এসে মনকে ভরায়!

ভালবাসা তার আবেশে চিত্র  সাজায়,

ভালবাসা তার দুয়ারে দুহাত বাড়ায়!"

____________: 

নদীর কাছে


নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু আঁকাবাঁকা পথ ধরে আপন খেয়ালে‌।দূরে একঝাঁক বক উড়ে যাচ্ছে আকাশের বুকে চিত্র এঁকে।শাল,সেগুন আর দেবদারু গাছের সারি ছায়াময় করে রেখেছে নদীতীর।দূরে একটা নৌকা ভেসে চলেছে।রিনি আনমনা হয়ে প্রককৃতির রূপ দেখছিল অরুণের হাতে হাত রেখে।

প্রায়ই ওরা এই সুন্দর বনবীথি ঘেরা নদীর ধারে আসে।দূজনে মগ্ন হয়ে থাকে নিবিড় ভালবাসায়।

সঙ্গী হয় ছলাৎ ছলাৎ নদীজল, গাছের ছায়ার ফাঁকে রোদের ঝিলিক আর পাখির কাকলি।ভালবাসলে চারদিকের প‌থিবী সুন্দর হয়ে যায়।


রিনি আর অরুণ একই অফিসে নতুন জয়েন করেছে।দুজনেই কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে  সরকারি চাকরিটা পেয়েছে। নতুন চাকরি পাওয়ার আনন্দে ওরা বিভোর।এই অফিসে ওরা আটজন একসাথে জয়েন করে।রিনি প্রতিদিন ট্রেনে করে শহরতলি থেকে আসে।অরুণ আসে বাসে।ওর বাড়ি এই শহরেই। অরুণের দীর্ঘ সুঠাম বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা প্রথম দিনই রিনিকে আকর্ষণ করেছিল।রিনি একটু ছটফটে স্বভাবের।তবে নতুন অফিসে বেশ গাম্ভীর্য বজায় রাখাই পছন্দ করত। জয়েন করার কদিনের মধ্যেই ওদের ট্রেনিং এ পাঠানো হোল দূরে। কদিন পুরো দলটা খুব এনজয় করল। ট্রেনিং এর পর বিকেলে ওরা নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়ত। মেয়েরা মার্কেট ঘুরে পছন্দসই শাড়ি কিনল।ছেলেরাও কেনাকাটা করল।কদিনে সবাই ভাল বন্ধু হয়ে গেল।তবে রিনির প্রতি অরুণের প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ বন্ধুদের চোখ এড়ায় নি।এই দলে চারজন মেয়ে থাকায় মেয়েদের বন্ধুত্বটা বেশ জমে উঠেছিল। ওদের মধ্যে আত্রেয়ী ছিল বেশ সুন্দরী।মালবিকা দীর্ঘাঙ্গী আর চেহারা ও স্বভাবে

মিষ্টি।অনন্যাই ওদের মধ্যে বিবাহিত।ওর শ্বশুরবাড়ি আর সদ্য বিবাহিত বরের গল্প শুনতে ওরা বেশ ভালবাসত।রিনি এক স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ে।লম্বা বেণীতে আর দীঘল চোখের চাওয়ায় ওর শ্যামলা রঙ যেন মায়ায় জড়ায়। ট্রেনিং শেষে সবাই বাড়ি ফিরে এল।শুরু হোল প্রতিদিনের কর্মময় জীবন।

রিনি আর অরুণ প্রতিদিনের দেখাশোনা আর কাজের মধ্যে ক্রমশঃ পরস্পরের প্রতি টান অনুভব করত।অবস্থা এমন হোল যে রিনির ছুটির দিনগুলো ফাঁকা ফাঁকা লাগত।অথচ মুখ ফুটে অরুণকে মনের কথা বলতে পারত না। আশঙ্কা হোত,যদি অরুণ দূরে সরে যায়। এরমধ্যেই একদিন অরুণ ওকে বলল,যদি বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকে,চলো না একটু চা খেতে যাই‌। ক'দিন ধরেই একটা কথা তোমায় বলব ভাবছি।রিনি ঔৎসুক্য চেপে রাজি হোল।দুজনে একটা কফিশপে গেল।একথা সেকথার পর অরুণ বলল,আমি যদি তোমাকে চাই?

রিনির মনের মধ্যে তখন সাতসুরে বীণা বাজছে।ও আনন্দে কি বলবে ভেবে পেল না।শুধু মিষ্টি হেসে সায় দিল।ও যে এতদিন এই স্বপ্নটাই দেখে এসেছে। অরুণের মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজনকেই ও যেন চেয়েছিল।আজ যেন নতুন করে ওকে দেখল।ফর্সা রঙে নীল শার্টে অপূর্ব লাগছিল অরুণকে।কপালের ওপর কয়েকটা অবাধ্য চুল এসে পড়ে আরো মোহময় করে তুলেছে।অরুণও যেন রিনিকে এত কাছ থেকে প্রথম দেখল‌ একদম আপন করে।দুজনের দৃষ্টি দুজনকে ভরিয়ে দিচ্ছিল।

কিছু পরে অরুণ ওকে ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল।

আজ রিনির হৃদয়ের সব চঞ্চলতা শান্ত হয়ে গেছে,সব উদ্বেগ দূর হয়েছে।ওর ভালো লাগা পূর্ণতা পেয়েছে।প‌থিবীর সব আনন্দ ওর আঁচলে ধরা দিয়েছে।বাড়ি ফিরে বাবা মা বোনের সাথে টিফিন করল।বোনকে অন্যদিনের মত পড়ায় সাহায্য করল। কিন্তু অরুণের মুখটা যেন চোখের সামনে ভাসতে লাগল।

রিনি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, গানবাজনা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকত।আজ মনে হোল অন্যদের মত নিজের সাজগোজের দিকেও একটু নজর দিতে হবে।ও ভাবতেই পারেনি এত সহজে অরুণকে পাবে। এতদিন যেন ওকে অধরা মনে হচ্ছিল।

পরদিন অফিসে গিয়ে ব্যাস্ত হয়ে উঠল কতক্ষণে অরুণ আসবে।আজকে অরুণ যেন বেশ সাজগোজ করেছে।হালকা পিঙ্ক শার্টে অনবদ্য দেখাচ্ছিল।যাই হোক,যে যার কাজে মনোনিবেশ করল।ক্রমশঃ বন্ধুদের কাছে বিষয়টা প্রকাশ পেয়ে গেল।ওরা হইচই করে ওদের প্রেমটা সেলিব্রেট করল একদিন সবাই মিলে গঙ্গাবক্ষে লঞ্চভ্রমণে গিয়ে।

আজ এতদিন পর দুজনে নদীর পাড়ে বসে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিল। পাঁচ বছর হয়ে গেল ।কত তাড়াতাড়ি দিন চলে যায়। অরুণের বাড়িতে এই বিয়ে নিয়ে বেশ আপত্তি ছিল প্রথমদিকে।অরুণের বাবা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।আর রিনিরা কায়স্থ।অরুণের দুই দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর ওনারা তখন অরুণের বিয়ের উদ্যোগ নেন,ও তখন বাড়িতে রিনির কথা জানায়।বাবা মাকে ও খুব শ্রদ্ধা করে ।কিন্তু

রিনি ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারেনা।তাই এতদিন ওরা বিয়ে করেনি।অনেক বোঝানোর পর আজ এতদিনে বাবা ছেলের সুখের কথা ভেবে রাজি হয়েছেন।মা বলেছেন রিনিকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে।


এই কথা বলতেই আজ এই নদীতীরে আসা আর খুশিতে ভেসে যাওয়া। নদীর মতই উচ্ছল হয়ে উঠল রিনি।

ওর প্রিয় কবিতা বলে উঠল,

"ভালবাসা অন্তবিহীন আলোর দিশা,

ফেলে আসা কোনো কাহিনীর মুগ্ধ নেশা?

কবিতা ছন্দে তাকে বাঁধবে বলে,

কথাদের ডাক দিল আজ এই বিকেলে!"


ওর চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছিল।অরুণ চোখ ফেরাতে পারছিল না।আর অরুণের দীঘল আঁখিতে রিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলল।দুজন দুজনকে সমস্ত অন্তর দিয়ে স্পর্শ করল।আর কোন অন্তরায় নেমে আসবে না ওদের ভালবাসায়।অরুণ পরম আদরে ওকে কাছে টেনে ভালবাসায় ভরিয়ে দিল।অরুণের বুকে মাথা রেখে রিনি এক পরম আশ্রয় খুঁজে পেল।

তটিনী সাক্ষী রইল এই অনন্ত মিলনের।

________


অসমাপ্ত প্রেম


দশ বছর আগের ঘটনা।একটা গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে পরেছে তৃণা।অনেক চেষ্টা করেও মনকে ঠিক রাখতে পারছেনা।ব্রেক আপের সুতীব্র কষ্টে ওর মনটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ও নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে।একদিনের জন্যও তুষারকে ভুলতে পারছেনা।

তৃণার জীবনে এই পর্ব নেমে এসেছিল এক শ্রাবণ সন্ধ্যায়।তখন সে ছিল এক উচ্ছল তরুণী।আর আজ সে এক কর্তব্যপরায়ণ গৃহবধূ।স্বামী,সন্তান, শ্বশুর,শাশুড়ি নিয়ে তার কর্মময় দিন যাপন।অথচ এমন বর্ষার দিনে যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে যায় ওর সযত্ন লালিত গাছের পাতারা,যখন দূরে কোথাও একটানা ডাকতে থাকে ঝিঁঝিঁ পোকারা,মন কেমন করা অবসরে মনে পড়ে যায় তুষারের কথা'দেখলে তো,আমি ফোর কাষ্ট করেছিলাম,আজ বৃষ্টি হবে,মিলল তো?কি সুন্দর ঠাণ্ডা হয়ে গেল আবহাওয়া।কি ভাল লাগছে বল!'

তুষারের সাথে সব আলাপচারিতা ওর মনে আছে।

তুষারের সাথে আলাপ হয়েছিল

কলেজে পড়ার সময় একটা ইন্টার কলেজ আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা ও গানের কম্পিটিশনে।

সুপুরুষ তুষার ওর জলদ গম্ভীর কন্ঠে নিজের কবিতা পাঠ করে প্রথম হয়েছিল।সারা অডিটরিয়ম হাততালিতে ফেটে পড়েছিল।

তৃণার মনে আছে কবিতাটা। তুষারের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের কবিতা,যেটা ওর সংগ্রহে আছে:

'স্বপ্নিল বনছায়ে


একদিন আমি কবিতাকে ভালবেসে

নদীর উজানে স্বপ্নকে লিখে যাব।

একদিন আমি আকাশের নীলিমাতে

মেঘপরীদের গান হয়ে ভেসে যাব।

একদিন ঐ তারা ভরা জোৎস্নাতে

শান্ত উপল বনভূমি ছুঁয়ে দিয়ে

পাহাড়ি ঝর্ণাধারার শব্দে মেতে

তোমাকেই শুধু যাব ভালবাসা দিয়ে।


একদিন যদি মধ্যরাত্রি চিরে

স্বপ্নেরা যায় পাহাড়িয়া পথ বেয়ে

ঝুমচাষ দেখে সবুজ কিনারা ধরে,

শাল,পাইনের ছায়াঘেরা বনছায়ে,

আলো আঁধারীর পুষ্পিত বীথিকাতে

ভেসে আসে সুর ললিতে ইমনের মিশে

তোমার আভাস পাব সেই বনানীতে

স্বপ্নের খেয়া ভেসে যাবে কি আবেশে!


একদিন এই ধুলিকণা সাথে নিয়ে

নদী পাহাড়ের উতলা ছন্দে মেতে

লালমাটির আর শাপলা,শালুক গাঁয়ে

চন্দনা,টিয়া ময়নার কাকলিতে

খুঁজে পাব দেখো প্রকৃতির সেই ছবি

তুমি আর আমি যেখানে লিখেছি কথা

গতজনমের আখরে লেখা সে সবই,

আমাদের সেই মরমীয়া চুপকথা!'


ঐ অনুষ্ঠানে তৃণার গানও সবার প্রশংসা আদায় করেছিল।যথারীতি তুষারও মুগ্ধ হয়। দুজনের আলাপ হয়।ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া হয়।

কিছুদিন পর ওরা আবার দেখা করে। তৃণার গানের অনুষ্ঠানে তুষার সব কাজ ফেলে ঠিক উপস্থিত হয়ে যেত।তৃণা ছিল সাহিত্যর ছাত্রী । তুষার নতুন কোন কবিতা লিখলেই ওর না শুনে শান্তি হোত না।এবার তো তৃণাকে নিয়েই ভেসে চলল ওর কাব্যতরণী।

'আমি তোমায় ফাগুন দিলাম

অঞ্জলি ভরা ফুল,

বৃষ্টিধোয়া আষাঢ়,শ্রাবণ

করুক একটু ভুল!'


দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল।ওদের ভালবাসা, ফেসবুক,হোয়াটস এপে বকবকম করে এগিয়ে চলল।তৃণার গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেতে ওকে ফিরে আসতে হোল কলকাতার হষ্টেল ছেড়ে দুর্গাপুরের বাড়িতে। তুষারের বাড়ি কোলকাতায়।চলে আসার আগে দুজনে একটা সারাবেলা কাটাল একসাথে। তুষার তখন এম এস সি পাশ করে চাকরি খুঁজছে।একই সাথে রিসার্চের চেষ্টাও করছে।জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই তখন প্রায়োরিটি।দুজনে দূরে চলে গিয়ে এতদিন না দেখে কিকরে থাকবে,ভেবে চোখের জলে ভেসে গেল তৃণা। তুষার বোঝাল,আমি দুর্গাপুরে গিয়ে ঠিক দেখা করব।কয়েক ঘন্টার তো পথ।তাছাড়া ফোনে তো কথা হবে।তবু কি এক আশঙ্কায় ওর মন মানছিল না।

আসার দিন তুষার ষ্টেশনে এসে বিদায় জানাল। যতদূর দেখা যায় ,চেয়ে রইল তৃণা জল ভরা চোখে।


তৃণা জানতো না এটাই ওদের শেষ দেখা।ফোনের আলাপচারিতা চলতে লাগলো। ক'দিন কথা না হলেই উৎকন্ঠা হোত, তুষার ভাল আছ তো?মাসখানেক পর তুষারের দিক থেকে যোগাযোগ কমে আসতে লাগলো।একসময় ফোন আসা বন্ধ হোল।তৃণা এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরে জেনেছিল, তুষার ভাল চাকরি পেয়েছে  আর ওর বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করা ছিল অনেকদিন আগে। বিয়েও হয়ে গেছে।

ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না, তুষার এভাবে ওকে ঠকাল কেন?এই বিচ্ছেদ ওকে ভিতর থেকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল।ও ক্ষমা করতে পারবেনা তুষারকে কোনদিন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল,কি ভীষণ ভালবাসে এখনো ও তুষারকে। আগের মতই প্রতিদিন ওর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। ভালবাসা হয়তো এমনি হয়।

মনে পড়ে তুষারের কবিতা:

'কাজল কালো দীঘল চোখে এ কোন্ মায়াবিনী

গানের ছলে সুরের জালে হোল হৃদয় রানী?

ভুলতে চেয়ে মনকে কঠিন শিকল পড়াই যত,

শিকল ভেঙ্গে মনপাখিটা দুষ্টুমিতে রত!'


তুষারকে ভোলার জন্য ও গানে ,পড়ায় মনকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে।এরপর বাবামায়ের ঠিক করা পাত্রের সাথে একসময় বিয়ে হয়ে যায়।

ওর স্বামী সৈকত ওর প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। ছুটির দিন হলেই ওরা এদিক ওদিক ঘুরতে বেড়িয়ে যায়।এরকম এক সুন্দর বিকেলে ওরা ইকো পার্কে বেড়াচ্ছিল,হঠাৎ সৈকত আবিষ্কার করে সস্ত্রীক ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধুকে।এগিয়ে গিয়ে অবাক করে দেয়।ওরা দুজনে একসাথে ফিজিক্সে এম এস সি পাশ করে যে যার মত জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে যায়।যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতদিন পরে দেখা হওয়ায় দুজনেই আনন্দে মেতে ওঠে।তৃণাকে ডেকে এনে আলাপ করায়।তৃণা চোখ ফেরাতে পারে না।এ যে ওর হারিয়ে যাওয়া তুষার!এখন যেন আরো সুপুরুষ আর পরিণত দেখাচ্ছে।কোথায় হারিয়ে গেল ওর এতদিনের অভিমান। তুষার একটু অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল।আসলে ওরও যে কতবার দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তৃণাকে।

তৃণা কতদিন ভেবেছে এই জনারণ্যে যদি আরেকবার তুষারকে দেখতে পায়!আজ যেন সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওকে পরম শান্তি এনে দিচ্ছে।

তুষারের স্ত্রীকেও ভাল লাগল।মিশুকে, সুন্দরী,একঢাল চুলে বেশ আকর্ষণীয়।


ওরা আজ একসাথে অনেকক্ষণ সময় কাটাল।তৃণা অবাক হয়ে ভাবে, ভালবাসা মানুষকে যতই দূরে ঠেলে দিক এই পৃথিবীতেই তো বাস।ভালবাসলে একদিন ঠিক দেখা হয়ে যায়!

[10/01, 5:23 PM] Sikha Ray: ভালবাসার পথের ধারে


বিনতা শহরতলির রম্য পরিবেশে গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে, যেখানে প্রতিদিন ফলের গাছে ভীড় করে আসে নাম না জানা কত পাখি আর হাস্নুহানা,গন্ধরাজ,বকুলের গন্ধে ভরে ওঠে বাতাস।আছে একটা পুকুর,সেখানে সাঁতার কাটে রাজহাঁস,ওড়ে মাছরাঙা,বক,শালিখ,চড়ুই। সকাল ,বিকেল বাগানে পায়চারি করে আর পুকুর ধারে বানানো বেঞ্চিতে বসে ওরা প্রকৃতিকে উপভোগ করে।কাছেই দেবমন্দিরে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি।


বিনতার একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে।বউমা ও এক নাতি আছে।নীতার একসময় ভরা সংসার ছিল।কম বয়সে একান্নবর্তী সংসারে বিয়ে হয়েছিল।স্বামী উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে। শ্বশুর শাশুড়ি,দেওর ননদ মিলে প্রায় পনের জনের সংসার।বাড়িতে দোল, দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠান হোত।তখন আরো আত্মীয় স্বজনে বাড়ি গমগম করত।রান্নাঘরে পাতা উনুন ছিল।ওরা জায়েরা মিলে মিশে রান্না করত।একজন মহিলা ছিল গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করার জন্য।এত বড় রান্নাঘর ,একদিক বাটনা বাটা,কুটনো কাটা ,আটা মাখা এসব কাজের ফাঁকে সবাই মিলে গল্পগুজবে হইচই করে সকালটা পার হয়ে যেত।ছেলেমেয়েরা স্কুলে আর পুরুষরা অফিসে চলে গেলে সব কাজ সেরে চলত উল বোনা,বড়ি দেওয়া,গল্পের বই পড়ার ধূম।আর ছিল রেডিওতে, অনুরোধের আসরের গান আর নাটক শোনা,মাঝেমাঝে জায়েরা মিলে সিনেমা দেখতে যাওয়া।বিনতার শাশুড়ির নিয়ম মেনে সব কাজ ঘড়ি ধরে করার অভ্যেসটা পুত্রবধূদের মধ্যে সঞ্চাচিত হয়েছিল।তাই এর মাঝেই ছেলেমেয়েদের পড়ানোটাও ওরা নিজেরাই করত।

এরপর সময়ের পথ ধরে শ্বশুর, শাশুড়ি গত হন।পুরনো বনেদী বাড়ি ফ্ল্যাটে হস্তান্তরিত হয়।ভাইয়েরা ছড়িয়ে যায় সুবিধা মত জায়গায়। নীতার স্বামী মনোরম পরিবেশে বাগানসহ সুন্দর একটা বাড়ি কিনে সল্টলেকে চলে আসে।বিনতার খুব বাগানের শখ। বাড়ির সামনে নানা রকম ফুলগাছ আর পিছনদিকে আম,জাম,পেয়ারা এসব ফলের গাছ লাগানো হোল।মালী এসে সপ্তাহে দুদিন করে বাগানের পরিচর্যা করত।কত যে রঙবেরঙের ফুলে ফুলে ভরে যেত বাগানটা।আর সন্ধ্যাবেলা ব্যালকনিতে বসে তখন ওরা গল্প করত,ফুলের গন্ধে ভরে যেত পরিবেশ। মাঝেমাঝেই দেওর ননদরা সপরিবারে এসে হইহই করে কটা দিন কাটিয়ে যেত।বিনতার ভাই বোনেরাও এসে খুব আনন্দ পেত এমন সুন্দর পরিবেশে।পিছনের বাগানে গাছে বাসা বেঁধেছিল পাখিরা।ভেসে আসত ওদের কাকলি।

একেক সময় মনে হোত যেন ওরা কোন বনের কাছে বেড়াতে এসেছে।

এই বাড়িতে থাকতে থাকতেই ছেলে অনির্বাণ স্কুল পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়।একসময় স্বামী অনিরুদ্ধ রিটায়ার করে। এতদিনে ওরা দুজন যেন বাড়িটার সৌন্দর্য একসাথে উপভোগ করার আর

নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার অফুরন্ত সময় পেল।এবার  যেন ওদের দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা শুরু হয়।

সকালবেলা দুজনে বাগানের মধ্যে মেঠো পথে মর্নিং ওয়াক করে।কানে ভাসে পাখিদের কলতান,একঝাঁক টিয়া আকাশে উড়ে যায়। খেজুর গাছটাতে কাঠঠোকড়া ঠোট দিয়ে ঠুকে আওয়াজ তোলে।কটি পায়রা বকবকম করতে করতে ইতিউতি ডানা ঝাপটায়।বাগানের মধ্যে একজায়গায় পাখিদের জন্য জলের ব্যাবস্থা করা আছে।পাতার ফাঁকে ফাঁকে মিঠে রোদ এসে ছুঁয়ে যায় দুজনকে।ওরা সামনের বাগানে এলে ফুলের গন্ধে আর গোলাপ,চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়ার রঙে মন আনন্দে ভরে যায়। প্রতিবেশীরাও মাঝে মাঝে এই বাগানে এসে সময় কাটিয়ে যায় একরাশ ফুলের মাঝে।ছেলের জন্য একদিক সাজিয়েছে জিম করার  আর ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা।ও বন্ধুদের নিয়ে এখানে খেলে ছুটির দিনে।

এভাবে অনেকগুলো বছর প্রকৃতির মাঝে কাটিয়ে দেয় ওরা।বছরে একবার করে ঘুরতে যার সপরিবারে এদিক ওদিক।ইতিমধ্যে ছেলের বিয়ে হয় ধুমধাম করে।ছেলে অনির্বাণ চাকরি নিয়ে সপরিবারে জার্মানিতে চলে যায়।


বছর দুয়েক আগে হঠাৎ একটা কার্ডিয়াক এটাকে অনিরুদ্ধ মারা যায়। বিনতার আকাশ থেকে প্রেমের তারা খসে পড়ে।ও চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনা অনিরুদ্ধর এতটুকু খারাপ ব্যবহার প্রায় পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবনে। অনিরুদ্ধ শুধু তার প্রতি নয়, পরিবারের সবার প্রতি,সন্তান,ভাই বোন, শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবার প্রতি যত্নশীল ছিল।প্রতিবেশীদের সাথেও ছিল হৃদ্যতা।

মাত্র বাইশ বছর বয়সে ঐ সুপুরুষ স্বল্পভাষী মানুষটার সাথে বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে।যেদিন দেখতে এসেছিল অনিরুদ্ধ দুজন বন্ধুর সাথে,সেদিন প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়েছিল দুজনের।

বিনতা ছিল সুন্দরী,একঢাল চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমর ছুঁত।মায়াবী দুটো চোখ,সামান্য চাপা নাক,ফর্সা রঙে একটা গোলাপী শাড়ি,হালকা প্রসাধনে গোধুলি আলোয় প্রথম দেখাতেই অনিরুদ্ধের মনে ছায়াপাত করেছিল।

ওর স্পষ্ট মনে আছে বাসর ঘরে সবার অনুরোধে ও গেয়েছিল,"আমার পরাণ তাহা চায়, তুমি তাই---" ।অনিরুদ্ধ ওর এই নতুন পরিচয় পেয়ে এতটাই বিমোহিত হয়েছিল,ওর মুখ দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল।সবার প্রশংসায় বিনতার লজ্জারাঙা মুখ আরো রক্তিম হয়ে ওঠে।সেদিন অনিরুদ্ধ শুনিয়েছিল নিজের কবিতা:

       "কে তুমি ডাক দিয়েছ


তুমি আজ হাসলে বলে হাস্নুহানা গন্ধ ছড়ায়,

তুমি যে ডাক দিলে তাই, কাকলি ছন্দে হারায়।

তুমি যে মন ছুঁয়েছো দখিনা তাই বয়েছে,

তোমারই নাম ধরে কি বাঁশরী গান ধরেছে?


ধীরে ঐ মর্মরিত পাতারা পলাশ বনে,

স্থিতধী কোন্ মরমী হৃদয়ে আঘাত হানে?

জলধি ঢেউয়ের দোলায় তীরে যে মিশল এসে,

আকাশের সঙ্গে তারই বিরহের অবকাশে,

চিরদিন অপলকে দুনয়ন দেখে তাকে,

কত না গভীর মায়া আঁচলে ঢেকে রাখে!


তোমারই রূপের মোহে ভ্রমরা মাতাল হোল,

দীঘল ঐ আঁখির পাতে ফুলেরা রঙ ছড়ালো,

তোমাকেই দেখবে বলে পাখিরা পথ হারালো,

সজনী সলাজ হয়ে বাতায়নে মুখ লুকালো!

কি যেন জাগলো মনে,ভুলেছি যে কুল মান,

তোমাকে নিবিড় মনে ভেবেছি আজ দিনমান!


নদী তাই ছুটলো যেন, হয়েছে পাগলপারা,

পারাবত কোটর দ্বারে সাথীকে দিচ্ছে সাড়া!

মালতী কুঞ্জবনে সহকার বৃক্ষশাখায়

ঢলেছে প্রেমসোহাগে, আপনার গন্ধ বিলায়!

আকাশের প্রেমিক বুকে চন্দ্রিমা মুখ রেখেছে,

সোহাগী জোছনা সুখে বনে কি তাই মিলেছে?"


অনিরুদ্ধর স্মৃতি বিনতার মনের মণিকোঠায় চির অম্লান।

অনিরুদ্ধ যখন ওকে একা রেখে চলে গেল তখন একমাত্র ছেলে পরিবার নিয়ে জার্মানিতে বসবাস করে।বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে চলে এসেছিল একাই। ক'দিন থেকে সব কাজ সেরে ফিরে গিয়েছিল।একা এতবড় বাড়িতে মন বসত না আর নীতার। চারদিকে অনিরুদ্ধর স্মৃতি ওকে পাগল করে দিত।দেওর ননদরা,তাদের ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে এসে যেত ওর একাকিত্ব ঘোচাতে।একসময় ওর একান্ত আপন ফুল,পাখিরা ওকে আবার আগের মত সঙ্গ দিয়ে ভরিয়ে রাখতে লাগলো। বাগানে শিউলি,বেলি,জবা,টগর সাঁঝি ভরে তুলে এনে পূজো করত আরাধ্য দেবতার।খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল অনিরুদ্ধ ঠাকুরঘরটা।সব জায়গায় যেন অনিরুদ্ধর হাতের ছোঁয়া।সেই তো প্রতিদিন বাগান থেকে ফুল, তুলসী পাতা এনে সাজিয়ে রাখত বিনতা পূজো করবে বলে।

অবসর সময় বসে অনিরুদ্ধর কবিতার খাতায় একের পর এক কবিতা পড়ত আর স্মৃতিচারণ করত পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্য প্রেমের।


 কিন্তু দিন বদলে যেতে সময় লাগেনা।ছেলে ফোনে মাকে বলতে লাগল,আমি এতদূরে থাকি।একা একা তোমার এভাবে থাকা নিরাপদ নয়। বাড়ি বিক্রির জন্য চাপ দিতে লাগল।বিনতা এই আপন জগত,ফুল,পাখিদের আত্মীয়তা ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু ছেলে এবার মনস্থির করেই এসেছিল।বিনতার কথা শোনেনি।ক'দিন থেকে চড়া দামে ঐ সাধের বাগানবাড়ি বিক্রী করে দেয়।তার আগে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটা গেট টুগেদারে র আয়োজন করে।নিজের সিদ্ধান্ত আত্মীয়দের জানায়।মায়ের জন্য একটা শান্ত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাবস্থা করেছে বলে জানায়।ওর জায়েরা বিনতাকে অনেক যত্ন করে নিয়ে যেতে চায় নিজেদের কাছে।বিনতার ভাই বোনরাও তাই চায়।ওরা বিনতাকে সত্যিই মন থেকে ভালবাসে।বিনতার উদার নম্র ব্যবহার,সবার জন্য দুহাত উজার করে যত্ন করা,ওরা ভুলতে পারেনা।

কিন্তু বিনতা কারো গলগ্রহ হতে চায়নি।

ছেলের সিদ্ধান্ত মেনে চলে আসে এখানে ওর মত আরো অনেক বিনতা,সুজাতা,বিশাখা,অজন্তার কাছে।

বিনতা জীবনের ভালবাসায় ঘেরা একান্নবর্তী পরিবার দেখেছে,স্বামীর অগাধ প্রেম দেখেছে,আত্মীয় প্রতিবেশীর হৃদ্যতা দেখেছে।সে নিজে ভাল বলে জীবনের খারাপ দিকগুলো ওর চোখে পড়ত না।গ্লোবালাইজেশনের ফলে ছেলের দূরে চলে যাওয়া মেনে নেয়,ছেলের উন্নতির কথা ভেবে। কিন্তু বোঝেনি ওর মেধিবী ছেলে কেরিয়ারিষ্ট হতে গিয়ে লাভ লোকসান যতটা বুঝতে শিখেছে,আপনজনদের মনের আভাস পেতে শেখেনি।ওদেরই হয়তো মানুষ করার কোথাও ভুল ছিল!


জীবনের শেষ কটা দিন ওর মত বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সাথে কাটিয়ে দিতে মন্দ লাগেনা এখন আর ।ব্রাহ্ম মূহুর্তে উঠে পূজা ও ধ্যানে ডুবে যায়।এটা ওর দীর্ঘদিনের অভ্যাস।ভোর হতেই দূরে মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে।পবিত্র হয়ে ওঠে মনের আঙিনা।

এর মধ্যেই ওর জায়ের মেয়ে অনিন্দিতা,যে ওর খুব আদরের,একটা  ছেলেকে নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে আসে।সঙ্গে আনে তার মায়ের হাতের তৈরী পিঠে ,পুলি,নারু।ও অন্ততঃ মাসে একবার জেঠিমার কাছে আসবেই।এবার নিয়ে এল প্রেমিক অপূর্বকে জেঠিমার সাথে আলাপ করাতে।দুজনে প্রনাম করে ।বিনতা আদরের নন্দাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব জার্নালিস্ট,একটা নামকরা পত্রিকায় চাকরি করে আর গল্প,কবিতা লেখে।দুজনে বাবা মাকে জানিয়েছে ওদের সম্পর্কের কথা।একটা শুভদিন দেখে দুই পরিবার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবে।কথাবার্তা বলে আর ভদ্র ব্যবহার দেখে বিনতারও অপূর্বকে বেশ পছন্দ হয়। অনিন্দিতা জেঠিমার কাছ থেকে চেয়ে তার জেঠুর কবিতার ডাইরী নিয়ে যায় কদিনের জন্য দুজনে মিলে পড়বে বলে।ওরা যেন এক ঝলক টাটকা হাওয়া বয়ে এনে বিনতার মন ভরে দিয়ে যায়।


ক'দিন পরে ছিল বিনতার জন্মদিন। অনিন্দিতা ওকে ফোনে জানায় আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে আমরা আসব। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সব আয়োজন করে।বিকেলে ও আর অপূর্ব দুজন নামী কবি ও সাহিত্যিক ,টিভির সাংবাদিক আলৈকচিত্রীদের নিয়ে উপস্থিত হয়।বৃদ্ধাশ্রমের সব আবাসিকদের উপস্থিতিতে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের হাত দিয়ে প্রয়াত অনিরুদ্ধ মিত্রের কাব্যগ্রন্থ "ওগো মোর প্রিয়া"র আবরণ উন্মোচিত করে। বিনতাকে মধ্যমণি করে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। অপূর্ব ও অনিন্দিতা বিশিষ্ট অতিথিদের সাথে বিনতার পরিচয় করিয়ে দেয়।বয়স্ক মানুষগুলো এই আনন্দযজ্ঞে সামিল হয়ে ওদের দুজনকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেন।সবকটা খবরের চ্যানেলে এই সুন্দর প্রয়াস সম্প্রচারিত হয়।

অনিন্দিতা জেঠিমাকে বলে এটা আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে তোমার জন্মদিনের উপহার।দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে।ওদের যেন মনে হয় অলক্ষ্যে অনিরুদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছে এই সন্ধ্যায় ওদের পাশে।অদূরের মন্দির থেকে ভেসে আসে সন্ধ্যারতির শব্দ।পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।


অনিন্দিতা আর অপূর্ব অন্য সবার সাথে ফিরে যায়।ওদের পথের দিকে চেয়ে বিনতা প্রাণ ভরে ওদের আশীর্বাদ করে আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যেন ঘরে ঘরে জন্মায় এমন অসংখ্য অনিন্দিতা আর অপূর্ব!

________


 দুই নারী


শহরের সবচেয়ে নামকরা অডিটরিয়ম আজ লোকে লোকারণ্য।দীপা,অত্রি,সুরঞ্জনা,স্নিগ্ধা,অর্ণব,আশীষ,দীপ্ত ওরা সবাই টানটান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত।যথাসময়ে শুরু হোল কনসার্ট,'সপ্তর্ষি সুরসপ্তক' ব্যান্ডের অনুষ্ঠান।একটার পর একটা গানে,যন্ত্রানুষঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল সুর আর শব্দের যুগলবন্দী।"তোমার এলোচুলে দিলাম গোলাপের হাসি,

কি করে যে বলব আমি তোমায় ভালবাসি।"

অথবা

"বেকার জীবনে প্রেমের আগুনে পুড়িয়েছি কত রাত,

চাকরীটা পেয়ে তোমাকে বলব,দেবে কি আমায় সাথ?"

অনুষ্ঠান শেষে হাততালিতে ফেটে পড়ল অডিটরিয়ম।আর দুই নারীর চোখে বইল অশ্রুর বন্যা।

যেন দশ বছর পিছিয়ে গেছে সময়।ওদের সাথে মিশে রয়েছে যেন সপ্তর্ষি গানে, বাজনায়,সাহচর্যে,উৎসাহে,যার কথায় ও সুরে একসময় সেজে উঠেছিল ওদের কলেজ জীবনের "সুরসপ্তক"ব্যান্ড।

ওরা তখন সবাই কলকাতার নামকরা কলেজে ইংলিশ অনার্সের ছাত্র ছাত্রী। সপ্তর্ষির  উদ্যোগে ওরা শুরু করেছিল সুরসপ্তক ব্যান্ড।সপ্তর্ষি,অত্রি আর অর্ণব তিনজনের লেখা কবিতায় সুরারোপ করত সপ্তর্ষি। এভাবেই দীপার সাথে সপ্তর্ষির ঘনিষ্ঠতা কখন যেন ভালোবাসায় পরিণতি পায়।দীপার গীটারে হাত ছিল অসাধারণ। দীপা যখন গীটারে ইমনের ঝালা বাজাত,সপ্তর্ষি সহ বন্ধুরা মোহিত হয়ে যেত। সুরঞ্জনার ছিল চড়া আর সুরেলা গলা,স্নিগ্ধা বাজাতো মাউথ অর্গান।অর্ণব ,আশীষ পার্কাসনে দক্ষ,তেমনি গানেও।

দীপ্ত আর অত্রি একাধিক বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী। কলেজ ফাংশনে বা অন্য জায়গায় ওদের দল মাতিয়ে দিত।

দীপার একঢাল কালো চুল আর টানা টানা দুটো গভীর চোখের মায়ায় সপ্তর্ষি যেন হারিয়ে যেত।আর সপ্তর্ষির ভালো রেজাল্ট,গান, কবিতা আর ছিপছিপে চেহারায় দীপা যেন আবিষ্ট হয়ে থাকত।সুরসপ্তকের মতই এগিয়ে চলছিল ওদের ভালোবাসা।দীপাকে নিয়ে সপ্তর্ষির একের পর এক গান হিট করে গেল।যেমন,

"একদিন স্বপ্নের হাত ধরে,

হারিয়ে যাই চল ঐ দূরে,

যেখানে সুরে লয়ে ছন্দে,

একতারা বাজবে আনন্দে।"


এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল গান আর পড়াশোনা র মধ্যে দিয়ে।একসময় পাশ করে ওরা যে যার মত ছড়িয়ে পড়ল উচ্চশিক্ষা বা চাকরীর খোঁজে।সবাই ব্যাস্ত হয়ে গেল নিজের নিজের জগতে।দীপা ফিরে এল মালদায় নিজের বাড়িতে।ফোনে কথা হোত দুজনের।দু একবার সপ্তর্ষি মালদায় গিয়ে দেখা করে দীপার সাথে।কয়েকমাস দেখা না হলে হাঁপিয়ে ওঠে দীপা। দুজনেই তখন চাকরীর চেষ্টা করে চলেছে।এরপর দীপা একটা স্কুলে চাকরী পায়।বেশ কিছুদিন পর সপ্তর্ষির দিক থেকে যোগাযোগ কোন এক অজ্ঞাত কারণে কমে আসতে থাকে।দীপা উৎকন্ঠিত হয়ে ফোন করে,ফোন বেজে যায়।


কিছুদিন পর বন্ধু সুরঞ্জনার ফোনে জানতে পারে,সপ্তর্ষি বিয়ে করেছে আর শ্বশুরের ব্যাবসায় জয়েন করেছে।দীপা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।ক্রমশঃ অবসাদে ডুবে যেতে থাকে।বাবা মা দিদিরা ওর বিয়ের জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।ও রাজি হয়না।কিছুতেই ভুলতে পারেনা সপ্তর্ষির কথা।ওকে নিয়ে লেখা যত গান, কবিতা সবকিছু ওর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।


একসময় ডুবে যায় নিজে কাজে আর সুরে সুরে।মনের মধ্যে একটুকরো আশা পোষণ করে, একদিন হয়তো সপ্তর্ষি এসে দাঁড়াবে,বলবে,'সুরঞ্জনা তোমায় মিথ্যে বলেছিল'।সপ্তর্ষির প্রিয় গানের সুরগুলো গীটারে বাজায় সন্ধ্যে হলে একের পর এক। ক্রমশঃ রাত গভীর হয়।

এর মধ্যে একবার সুরঞ্জনা আর অত্রির বিয়েতে গিয়ে সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়,সপ্তর্ষি ছাড়া।

বেশ কয়েক বছর এভাবে পার হয়ে যায়।এর মধ্যে দীপা এক কলিগ বান্ধবী পৃথার অনুরোধে ওদের বাড়ি আসে আর ওদের সাথে এক পিকনিকে অংশ নেয়।

শীতের আমেজে সেখানে ওরা গানের আসর বসায়।পৃথা আর অন্য সবাই একে একে গান করে,দীপাও বাদ যায় না।সবশেষে পৃথার সম্পর্কিত এক বোন রিক্তা গেয়ে ওঠে ওর পরিচিত একটি গান।সবাই মুগ্ধ হয় তার নতুন গান শুনে।দীপা অবাক হয়ে শোনে অবিকল সেই সুর,সেই বাণী,"তোমাকে হারালে দিশাহারা হবো,

হৃদয় উজানে নাও বেয়ে যাব----"

ওর বয়সী সুদর্শনা মহিলার সুরেলা কন্ঠে এই গান বিস্মিত করে।গান শেষ হলে জিজ্ঞাসা করে,'আপনি এ গান কোথায় পেলেন?'

মহিলার তখন দুচোখ ভরা জল, কোনভাবে বলল,'এ আমার প্রয়াত স্বামীর গান,ওর কথা,ওরা সুর।'কান্না সম্বরণ করত পারে না রিক্তা।পৃথা ওকে সরিয়ে নিয়ে যায়, শান্তনা দেয়।পৃথার কাছেই দীপা জানতে পারে,মাস কয়েক আগে সপ্তর্ষি দুরারোগ্য ক্যানসারে মারা যায়।

দীপা স্তব্ধ হয়ে যায়।জলভরা চোখে নিয়ে আড়ালে সরে যায়। কোনদিন ভাবেনি,এমন সংবাদ ওকে শুনতে হবে।কোথায় ভেসে যায় এতদিনের জমিয়ে রাখা সব অভিমান।

নিজে থেকেই ও রিক্তার সাথে আলাপ করে,বলে,'আমি সপ্তর্ষির সাথে কলেজে পড়তাম।রিক্তা বলে,সপ্তর্ষি ওকে 'সুরসপ্তকে'র কথা বলেছে।ওর বন্ধু অত্রি,আশীষ,দীপ্ত এদেরকে ও চেনে।সপ্তর্ষির অসুখের সময় ওরা মাঝেমাঝেই এসে ওকে সঙ্গ দিত,ব্যান্ডের গান শোনাত।লাষ্ট ষ্টেজে রোগটা ধরা পড়ায় কিছু করা যায়নি।ওর স্বপ্ন ছিল নতুন করে 'সুরসপ্তক'গড়ে তুলবে।গান যে ওর প্রাণ ছিল!


এরপর ভগ্নহৃদয়ে দীপা ফিরে আসে। সুরঞ্জনাকে ফোন করতেই ও বলে,ওরা সপ্তর্ষির খবর জানতো, কিন্তু দীপাকে জানাতে পারেনি এই দুঃসংবাদ। এরপর দীপা সুরঞ্জনাকে জানায় কিভাবে সপ্তর্ষির স্ত্রীর সাথে ওর দেখা হয়,সব ঘটনা।শেষে বলে,'আমরা সবাই মিলে কি পারিনা ওর স্বপ্নকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে?তুই অত্রিকে বলে দ্যাখ না একবার!আমি ছাড়া তোরা সবাই তো কলকাতাতেই থাকিস।'

সুরঞ্জনা আর অত্রি এবার একে একে সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে।ওরা একদিন একসাথে বসে আলোচনা করে ঠিক করে ছুটির দিনে আবার নতুন করে রিহার্সাল দিলে হয়তো আবার সেটা সম্ভব।সুরসপ্তক তো ওদের সবারই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। কিন্তু প্রধান সমস্যা হোল,সেসব গানের স্বরলিপি তো একমাত্র সপ্তর্ষির কাছে ছিল। সেগুলো কিভাবে পুনরুদ্ধার করা যাবে।দীপাকে সুরঞ্জনা সবটা জানায়।দীপা এবার ওদের রিক্তার সাথে যোগাযোগ করতে বলে।সেইমত দীপ্তরা সপ্তর্ষির বাড়ি গিয়ে ওর স্ত্রী রিক্তাকে ওদের পরিকল্পনার কথা জানায়,ওরা চায় নতুন ভাবে জেগে উঠুক সপ্তর্ষির গানের স্বপ্ন।তাই রিক্তার সাহায্য দরকার।রিক্তা জানায়,সপ্তর্ষির সব স্বরলিপি,গান,কবিতা,সব মিউজিক সিস্টেম সযত্নে রাখা আছে।বন্ধুরা এবার রিক্তাকে সাথে নিয়ে নেমে পড়ে নতুনভাবে সুরসপ্তককে সাজিয়ে তুলতে।

অত্রি আর সুরঞ্জনার বাড়িতে মাসে দুটো রোববার শুরু হয় রিহার্সাল।দীপা চলে আসে ওদের বাড়িতে।পরদিন ফিরে যায়।

এভাবে অনেকদিন ধরে প্রস্তুতির পর ওরা অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়।ব্যান্ডের নতুন নামকরণ করে"সপ্তর্ষি সুরসপ্তক"।


আজ সেই প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। অনুষ্ঠানের অভাবনীয় সাফল্যে সবাই উচ্ছ্বসিত।কিন্তু সবার চোখ অশ্রুসিক্ত।তবু ওদের বিশ্বাস,সপ্তর্ষি যেখানেই থাকুক,ওর স্বপ্নপুরণে ও আজ তৃপ্ত।

এদিকে চোখের জলে ভেসে ওর স্ত্রী রিক্তা অবাক হয়ে দেখলো,ওর মত দীপারও চোখের জল যেন বাঁধ মানছে না,আর বন্ধুরা ওকে ঘিরে রয়েছে!

[25/01, 8:09 AM] Sikha Ray: আপনজন


দীপ আর অনামিকার আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। অনামিকার শাশুড়ি সরমাও সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে পূজোয় বসেছেন। ধূপের গন্ধে আর শঙ্খের ধ্বনিতে চারদিকে পবিত্রতা বিরাজ করছে।আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী।


তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা দুজনে বেড়িয়ে পড়লো। অনামিকার খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে।পরনে নীল ঢাকাই,হালকা কার্ডিগান।আর দীপ পরেছে আকাশী শার্টের সাথে সাদা সোয়েটার।দীর্ঘ গড়ন,ফর্সা রঙ,কপালের উপর উড়ে আসা চুলে দীপকে এত সুপুরুষ লাগছে, অনামিকার ইচ্ছে করছে,পুরনো দিনের মত দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু উপায় নেই।হাইওয়েতে সাবধানে ড্রাইভ না করলে যে কোন মূহুর্তে বিপদ ঘটে যেতে পারে।আর দীপ ওকে দেখে ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে।প্রায় সাত বছর আগে এক গোধুলি লগ্নে যেদিন কনে দেখা আলোয় অনামিকাকে দেখতে গিয়েছিল এক বন্ধুর সাথে,মুগ্ধ হয়েছিল ওর রূপে।তখনই মনস্থির করেছিল, একেই জীবনসঙ্গী করবে।সেদিন অনামিকা পরেছিল একটা গোলাপী তাঁতের শাড়ি।সামান্য গয়না, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক,কপালে ছোট্ট টিপে গৌরবর্ণা অনামিকা অনন্যা হয়ে ধরা দিয়েছিল দীপের কাছে।

গাড়ি ছুটে চলেছে শহরতলির দিকে।দুপাশে গাছের সারি,হালকা শীতের আমেজ।ওরা দুজন যেন এক অদ্ভূত ভাললাগায় ভেসে চলেছে।


পথে এক প্রাচীন শিবমন্দিরে গাড়ি থামিয়ে ওরা প্রবেশ করলো।পূজো দিল।যতবার এই পথে আসে ওরা মন্দিরে প্রণাম করে যায়। পুরোহিত চেনা হয়ে গেছে।প্রসাদ নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো।এরপর এক সুন্দর পরিবেশে গাছপালায় ঘেরা বাগান পার করে গাড়ি এসে থামলো 'মায়ের আশীষ'নামে এক অনাথ আশ্রমের অফিসের সামনে।সেখান থেকে এল একঝাঁক কচিকাঁচার মাঝখানে ওখানকার ইনচার্জ রূপকবাবুর সাথে।ওদের দেখে ছুটে এলো ডলি,রূপা,রাজা,সুধা,অয়ন-একের পর এক আহ্লাদী মুখ।দীপ আর অনামিকা ওদের হাতে তুলে দিল শীতপোষাক,খেলনা,চকলেট,বই,খাতা।এখানকার দুটো বাচ্চার লেখাপড়ার সব দায়িত্ব দীপ নিয়েছে। 

অনামিকার হাত ধরে ওরা নিয়ে বসালো শিমুল গাছের ছায়ায় ঘেরা বেদীতে।একে অন্যের নামে নালিশ, খুনসুটি করার পর একে একে শোনালো ছড়া,গান,দেখালো নাচ। অনামিকার মাতৃহৃদয় খুশিতে ভরে উঠলো।


প্রতিমাসে অন্তত একবার ওরা সপরিবারে এখানে আসে। সারাদিন ওদের সাথে কাটিয়ে বিকেলে ফিরে যায়।কাল সারা বিকাল ধরে ওর শাশুড়ি সুরমা এদের জন্য পিঠে,পুলি,নারু বানিয়েছেন। সেসব খেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ আর ধরেনা। জিজ্ঞেস করেছে,'ঐ ঠাম্মাটা আসেনি কেন?'অনামিকা বলেছে'ওনার একটু কাজ আছে।'আসলে সত্যিই আজ উনি বিশেষ কাজে ব্যাস্ত।


অনাথ আশ্রমটা চালায় পথিক  বলে একটা এন জি ও সংস্থা।এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাচ্চারা বড় হয়, স্কুলে যায়।অনেক মেয়েরা বড় হবার পর এরাই বিয়ের ব্যাবস্থা করেছে।কিছু শিশু নতুন বাবা মা পেয়ে নতুন আশ্রয়ে চলে গেছে। নদীর ধারে আশ্রমটা। দুপাশে  সাজানো ফুলের গাছ,মাঝখানে পায়ে চলার পথ।বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ওরা যখন হাঁটছিল আর ওদের কলরবে নিজেদের ভরিয়ে তুলছিল,নদীর ছলছল শব্দে আর পাখির কাকলিতে তখন সমস্ত পরিবেশ সুন্দর হয়ে ধরা দিচ্ছিল।


বছর দুয়েক আগে দীপের এক বন্ধুর কাছে ওরা এখানকার খবর পায়।প্রথম দিন এসেই খুব ভাল লেগে যায়।তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই আসে শিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে যেন কয়েকদিনের অক্সিজেন নিয়ে ফেরে। কখনো বা সুরমা নানারকম খাবার বানিয়ে বৌমাকে নিয়ে চলে আসেন।ওদের হাসিমুখ,ওদের তৃপ্তি দেখে ওদের মন ভরে যায়।

অনামিকা নদীর দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায়।মন চলে যায় বছর চারেক আগের এক অভিশপ্ত সন্ধ্যায়।তারপর কত জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে। ক্রমশঃ বদলে গেছে চারপাশ।দুঃস্বপ্নের কথা ভুলতে চেয়েছে সে প্রতিমূহুর্তে।


সে দিনটা ছিল এমনই শীতকাল। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামত। অনামিকার ননদ বাবলির বিয়ের সব ঠিকঠাক।দিন দশেক পরে বিয়ে।বাবলি আর অনামিকা বিয়ের কিছু কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছিল।ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে যায়।রিক্সা ধরে যখন ফিরছিল,একটা  অন্ধকার জায়গায় একদল ছেলে জোর করে রিক্সা থামায়।ওরা হতচকিত হয়ে যায়।বাবলিকে টেনে রিক্সা থেকে নামিয়ে মুখ চেপে ধরে আড়ালে নিয়ে যেতে থাকে।রিক্সাওয়ালা বাধা দিতে গেলে তাকে মারধর করে। অনামিকা চিৎকার করতে গেলে ওর মুখ বেঁধে দেয়।তবু রিক্সাওয়ালা আর অনামিকার সমবেত চেষ্টায় বাবলি কোনমতে ছাড়া পায়। অনামিকা বলে 'দৌড়ে পালা।আমি ঠিক চলে আসব।'বাবলি ভয়ে লোক ডাকতে ছুটে যায়।দুজন পথচারীকে পেয়ে সব বলে নিয়ে আসে।ওরা আসতেই অনামাকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। কিন্তু শানবাঁধানো চাতালে পড়ে ওর মাথা ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসে।ও জ্ঞান হারায়।বাবলিরা দেখে,অনামিকার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে আসছে তাজা রক্ত।সবাই মিলে বাড়িতে আনে,নিয়ে যায় নার্সিংহোমে।থানায় এফ আই আর করা হয়।


পরদিন জ্ঞান ফেরে অনামিকার।দীপ ও বাড়ির অন্যদের দেখে ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।দীপ শান্তনা দেয়।ওকে তখন কিছুই জানানো হয় না। চারমাসের গর্ভবতী ছিল সে।ক'দিন পর নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরে।দীপের কাছে জানতে পারে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে,আর ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলায় সেখানেই বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়।

বাবলির বিয়ে একমাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পুরোপুরি সুস্থ হবার পর দীপের কাছেই শোনে,ও আর কখনো মা হতে পারবে না।এই ভয়ঙ্কর সত্যিটা ওরা দুজন মানতে পারছিল না কিছুতেই।তাই দুতিনজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল আশায় বুক বেঁধে।তারপর একসময় নিজেদের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত সেদিনের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে উঠতো অনামিকা,রিক্সাওয়ালা না থাকলে বাবলি বা ওর সর্বনাশ অবধারিত ছিল। কিন্তু ঐ অন্ধকারের সুযোগে পালিয়ে যাওয়া দলটা চিহ্নিত হয়নি। পুলিশ কয়েকজনকে ধরে ওদের ডেকেছিল সনাক্ত করতে।ওরা চিনতে পারেনি।


যত দিন গেছে অনামিকা হতাশায় ডুবে যেতে থাকে। শাশুড়ি সরমা সবসময় ওকে চোখে চোখে রেখেছেন। শ্বশুর ওর পছন্দের জিনিস এনে হাজির করেছেন। বাবলির বিয়ে হয়েছে কাছাকাছি।প্রায়ই ও বরকে নিয়ে চলে আসে, অনামিকাকে নিয়ে সিনেমা যায়,নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়।বাবলির একবছরের বাচ্চাটা অনামিকার খুব আদরের।পুরো পরিবার অনামিকার শূণ্যতাকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে।


এরপর একদিন এখানকার ঠিকানা পায়।এই বাচ্চারাই ওকে অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।এরাই ওদের সবচেয়ে আপনজন।

আজকে অবশ্য ওরা আর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।এদের সাথে যখন অনামিকা ব্যাস্ত রয়েছে,ফুলবাগানে,নদীর ধারে গাছের ছায়ায়,সেই অবসরে দীপ অফিসে বসে আইনের ধাপগুলো একে একে পার করতে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ সেরে ফেলছে।

এরপর মাস ছয়েকের একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ওরা বাড়ির পথে রওনা দিল।ছোটদের কথা দিয়ে এল,খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবে বলে।


দত্তক নেবার বিষয়ে দুজনের সিদ্ধান্ত নিতে যেটুকু সময় লেগেছিল।ওদের এই প্রস্তাবে অনামিকার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি,একবাক্যে সায় দিয়েছেন।বলতে গেলে এই সিদ্ধান্তে ওরা খুশি হয়েছিলেন।সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছিল বাবলি।ওর মনের গভীরে এখনো কাঁটার মত বিঁধে আছে এক হীনমন্যতা,ওকে বাঁচাতে গিয়েই আজ বৌদি নিঃসন্তান।ওর বর অর্ককে অনেকবার একথা বলে ও কষ্টটা শেয়ার করতে চেয়েছে।অর্ক ওকে বুঝিয়েছে,'তোমরা দুজন যে আরো বড় বিপদের থেকে রক্ষা পেয়েছো সেদিন ,সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও।'


আজ গাড়িতে ফিরতে ফিরতে অনামিকা কোলের শিশুটার দিকে চেয়ে পরম শান্তি অনুভব করলো।আর দীপ ভাবছিল,কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পুচকেটাকে কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে।দীর্ঘ পথ যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হোল।


বাড়ি ফিরে দেখে অনামিকার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি,বাবলি অর্ক সবাই মিলে ফুলে ফুলে,খেলনায়,বেলুনে সারা বাড়ি সাজিয়ে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।ওরা পৌঁছতেই শঙ্খ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে ঘরে তুলল নতুন অতিথিকে।

অনেকদিন পর এই উদার পরিবার একত্রিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। অলক্ষ্যে থেকে ঈশ্বরও যেন ওদের আশীর্বাদে ভরিয়ে দিলেন।

_______________

জীবনের জলছবি


ট্রেন ছুটে চলেছে ঝমঝম শব্দে।দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে ধানক্ষেত,মাঠ,গাছপালা,রাস্তা। সবুজের বিচিত্র রঙবদলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।মালিনী জানলায় বসে দৃশ্যাবলী দেখছিল আর  মাঝেমাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিল অতীতে,যে অতীত ওর সামনে মেলে ধরেছিল এক রঙিন পৃথিবী সেই বছর সাতেক আগে।

মালিনী তখন সবে লেকচারার হিসাবে একটা কলেজে জয়েন করেছে।কলেজের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে যাচ্ছিল দার্জিলিং বেড়াতে।অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে শ্যামলা সুঠাম সুপুরুষ একজন প্রথম দেখাতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।কথায় কথায় জানতে পারে ওর নাম অর্ণব।অফিস থেকে ক'জন মিলে জলদাপাড়া বেড়াতে যাচ্ছে।অর্ণব একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার।

একসাথে যেতে যেতে পরিচিতি বাড়ে।

এরপর মালিনীরা নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে নেমে দার্জিলিং এর জন্যে গাড়ি ধরতে চলে যায়।অর্ণবদের ট্রেন এগিয়ে যায় ।

দিন পনের পর অর্ণব ওর কলেজে এসে দেখা করে।মালিনীও যেন মনে মনে অর্ণবকে দেখতে চাইছিল।মনে হোল ও যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেছে।

অর্ণব বলল,'চলে এলাম,রাগ করলেন না তো? আপনার ছুটি হলে চলুন একটু চা খেয়ে আসি,যদি আপত্তি না থাকে।'মালিনী ওকে অপেক্ষা করতে বলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বেড়িয়ে আসে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কাছাকাছি একটা কপি শপে।দুকাপ কফি আর স্ন্যাক্সের অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি বসে।অর্ণব বলে,"আপনাদের দার্জিলিং ট্যুর কেমন হোল?"

কথায় কথায় বেশ কিছু সময় পার করে ওরা ফিরে এলো।

এরপর বিকেলের দিকে দুজনে প্রায়ই একসাথে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরত একরাশ খুশির আমেজ নিয়ে। মাঝেমাঝেই নদীর ধারে চলে যেত।কখনো গঙ্গায় নৌকা করে ভেসে বেড়াত রাজহাঁসের মত।উপরে উন্মুক্ত আকাশ,ঝাঁক বেঁধে পাখিদের উড়ে যাওয়া,দূরে গাছের সারি,নদীর স্নিগ্ধ হাওয়া আর বয়ে যাওয়া জলের স্রোত,কুলুকুলু শব্দ যেন ওদের ঘিরে এক মায়াময় পরিবেশ গড়ে তুলত।ওরা দুজনে মগ্ন হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করত আর একে অপরের কাছে জমে থাকা কথা উজার করে দিত।নতুন অনুরাগ ওদের পৃথিবীটা স্বপ্নময় করে তোলে।

এরপর দুজনের বাড়ির মতে চারহাত এক হয়,দুটি পিপাসিত হৃদয় মিলে যায়। ধুমধাম করে বিয়ে হয় ওদের। অর্ণবের বাড়িতে আছেন শুধু বাবা মা।আর মালিনীরা এক ভাই এক বোন।অর্ণবের বাবা মা মালিনীকে সহজেই আপন করে নিলেন।ওর মেধা আর সৌন্দর্যের

সাথে মিশ্রিত নম্র ব্যাবহার ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

বিয়ের পর ওরা হানিমুনে চললো প্যারিস, ভালোবাসার শহরে।চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে যখন নামলো, চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হোল।এসে উঠলো লা মার্কুইস হোটেলে।বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল।দুজনে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হোল।

বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটাপথে পৌঁছে গেল আইফেল টাওয়ার দেখতে।এক ছড়ানো প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময়টি।ফরাসী নাম La Tour Eiffel,ফ্রান্সের প্রতীক।গুস্তাফা আইফেল নির্মিত ৩২০ মিটার তথা ১০৫০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারটি ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছর যাবৎ পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার ছিল।চারটি বিশাল লোহার পিলারের ওপর এটি দাঁড়ানো।১৮০৩৮ খন্ড লোহার তৈরী বিভিন্ন আকৃতির ছোট বড় লোহার তৈরী কাঠামো জোড়া দিয়ে এটি নির্মিত।৩০০ শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল।

অবাক বিস্ময়ে ওরা এসে দাঁড়ায় লিফটে ওঠার লাইনে। ওখানকার মানুষের অতিথিবৎসল ব্যাবহার আর হাসিমুখ ওদের খুশি করে।লিফট ওদের নিয়ে গেল অনেক উঁচু  চারদিকে ঘোরানো এক বারান্দায়।অপার বিস্ময়ে ওরা দেখল বিকেলের প্যারিস শহর সামনে উন্মুক্ত।দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করলো প্রাণ ভরে।মনে হোল ভালবাসার শহর যেন ওদের স্বর্গের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।এ যেন প্রেমের স্বর্গ।ওখানে রাখা দূরবীনে চোখ রাখলে আরো পরিস্কার ভাবে শহরটাকে দেখা যায়,দেখা যায় প্রবহমান সেইন নদীকে।সত্যিই এ এক স্বপ্ননগরী।যুগ যুগ ধরে কত যে কাহিনী রচিত হয়ে চলেছে ভালবাসার এই শহরকে ঘিরে।

এবার ওরা নেমে এলো সামনের বিস্তৃত মাঠে।হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠলো আইফেল।কি অপরূপ সে আলোকসজ্জা।ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে একেকটা আলোর রেখা।আকাশের গায়ে যেন হেলে রয়েছে এক রঙিন আলোকময় অত্যাশ্চর্য।ঠিক রাত আটটায় সেই আলোকমালা রূপ পরিবর্তন করে  আরো মোহময় হয়ে ধরা দিল। পরে জেনে গর্বিত হয়েছিল ,এই আলোকসজ্জায় হাত রয়েছে বাঙালী আলোকচিত্রী প্রয়াত তাপস সেনের।

প্রিয় কবিতা বলে ওঠে মালিনী।মুগ্ধ হয় অর্ণব।কবিতার নাম ,মোহময়ী নগরী


"আইফেল যেন শৌর্যের সাথে উন্নতশীরে জাগে,

কত শতাব্দী পার করে রাখে ঐতিহ্যকে আগে!

প্রান্তরমাঝে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত আলোকোজ্জ্বল বিভাতে

মহান্  বিশালতায় বিধৃত,কে না চায় রূপ হেরিতে?

লিফ্টে উপরে চলা শুরু হয়,প্রতি ধাপে দেখি,এ কি বিস্ময়!

অলিন্দে ঘুরি,দৃশ্য দেখি,সম্মুখে রয়েছে প্যারিস নগরী।

পারী মেলে ধরে অতি অনুপম নদী, নগরীর দৃশ্য,

নগর মিশেছে সাগর বেলায়,যুগে যুগে সে রহস্য!

প্যারিসের যে রূপ বর্ণিত বিশ্বব্যাপী রয়েছে গ্রথিত,

"শবনম"তার একটি মুক্তো,পঠনে মনন ভরে যায়।

ল্যুভর সমৃদ্ধ প্যারিস শহর,যাদুঘরে সেরা সংগ্রহ যত,

শিল্পীপ্রবর লিওনার্দোর 'মোনালিসা'পটও বিধৃত।

আঁকাবাঁকা ঐ সেইন নদীপথ,তীরে শোভে পুষ্পল জনপদ,

অটবীখচিত বাগিচা শ্যামল,ঢালপথে নামে সাগরবেলায়,

নীলাভ ফেনিল সায়রসলীল মিলায় আকাশ নীলিমায়!"

পরদিন সারাদিন কাটালো অত্যাশ্চর্য সব সংগ্রহ সম্বলিত ল্যুভর মিউজিয়ামে,যেখানে আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম  মোনালিসা। পিরামিড আকৃতির এই সংগ্রহশালার গঠনশৈলীও অনুপম।আরো কয়েকদিন ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল প্যারিস গেট,বাস্তিল দুর্গ,আর্ট অফ ট্রয়াঞ্চ গ্যালারি,নটরডম গীর্জা,কনকর্ড টাওয়ার ,আরো সব দর্শনীয় স্থান।তারপর ওরা ফিরে আসে ওদের সুখের নীড়ে।


হঠাৎ শাশুড়ির ডাকে মালিনীর সম্বিৎ ফেরে। বাইরের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে ও স্মৃতির ডানায় ভর করে হারিয়ে গিয়েছিল ভালবাসা ভরা অতীতে,যখন অর্ণব ওর সবটা জুড়ে থাকত,ওকে সোহাগে আদরে ভরিয়ে রাখত।

বাড়ি থেকে আনা গরম কফি দিলেন নন্দিনী তার আদরের বৌমাকে আর স্বামী অরিন্দমকে।

মালিনী টুকরো কথায় মেতে উঠলো এই বয়স্ক দম্পতির সাথে।


একদিন অযাচিতের মত তেমন ভালোবাসা এসেছিল জীবনে,তেমনি একদিন মরুভূমির মত ঊষর হয়ে গিয়েছিল ওর জীবন।এক অভিশপ্ত পরকীয়া কেড়ে নিয়েছিল ওর জীবনের সব শান্তি।বিয়ের পর বছর দুয়েক কেটে গেল ব্যাস্ততায় নিরবচ্ছিন্ন সুখের ঘেরাটোপে।তারপর অর্ণব ট্রান্সফার হোল পুণেতে।মাসে একবার করে বাড়ি ফিরত,নিয়ে যেত মালিনীকে কদিনের জন্য।এরপর আসার ব্যাবধান বাড়তে বাড়তে মাস ছয়েক হতে,মালিনী ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে চলে এল কোন খবর না দিয়ে। সেদিন রোববার ছিল।সোজা অর্ণবের ভাড়া করা ফ্ল্যটে চলে এলো। কলিং বেল বেজে উঠতে অর্ণব দরজা খুলল।মালিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো অর্ণবের বুকে। এতদিনের অদর্শনে হাঁপিয়ে উঠেছিল। কিন্তু অর্ণবের আড়ষ্টভাব ওর দৃষ্টি এড়াল না।অর্ণব আনন্দিত হবার বদলে বলে উঠল,"তুমি হঠাৎ এখানে?"মালিনী বলল,"তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে চলে এলাম। তুমি খুশি হওনি?"অর্ণব নীরব। মালিনী ড্রয়িংরুম পার হয়ে সোজা চলে এল বেডরুমে অর্ণবকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে বলে।

ঢুকেই থমকে গেল।ওদের দু'জনের নিজস্ব বিছানায় ঘুমাচ্ছে এক অচেনা মেয়ে।রাত পোশাক বিস্রস্ত,বিছানা এলোমেলো!

একছুটে বেড়িয়ে এলো মালিনী,অর্ণব অপরাধীর মত চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর সামনে তখন।মালিনীর দুচোখ বেয়ে  বন্যা নেমেছে।ভালোবাসা টুকরো টুকরো হয়ে নিঃশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে ।সারাটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে হৃদয় ভাঙার অদৃশ্য কাঁচের টুকরো।।দমবন্ধ হয়ে আসছে মালিনীর।প্রিয় মানুষটাকে দেখতে দেখতে ও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। গভীর খাদের ধারে ও যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।এখুনি পড়ে যাবে এক অতল গহ্বরে।খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরতে চাইছে অর্ণবকে, কিন্তু পারছেনা ।

ইতিমধ্যে মেয়েটি উঠে এ ঘরে চলে এসেছে।হাতে শাঁখা,সিঁথিতে সিঁদুর।শরীরে গর্ভবতী নারীর সমস্ত চিহ্ন স্পষ্ট।অর্ণবকে জিজ্ঞাসা করল,"কে উনি,কখন এলেন?তোমার আত্মীয়া আসবেন,আমাকে বলনি তো?আমাকে ডাকনি কেন?ছি ছি।উনি কি ভাববেন"।

তিনজনের চোখেই অদ্ভূত শূণ্যতা।

মালিনী আর পারলো না।অর্ণবকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।ওর অনিকে ও কিছুতেই হারাতে পারবেনা।

মেয়েটি এই দৃশ্য দেখে চলে গেল অন্য ঘরে।অর্ণব দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরে বলল,"আমি তোমার কাছে অপরাধী।ক্ষমা চাইছি।পারলে ক্ষমা কোর। পরিস্থিতি আমার আয়ত্তে ছিল না।এই অফিসে জয়েন করার পর নীলার সাথে আলাপ।কখন যেন আমরা কাছে এসে যাই।তোমাকে বা বাবা মাকে কিভাবে ফেস করব,বুঝতে পারছিলাম না।ইতিমধ্যে ও প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।আমরা বিয়ে করি।"


আসলে অর্ণব এখানে আসার কিছুদিন পর ঝকঝকে সুন্দরী নীলনয়না শ্রীলা ওদের অফিসে জয়েন করে। কিছু দিন পর থেকেই শ্রীলার রূপের মোহে অর্ণব আকৃষ্ট হয়।ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।প্রায়ই ছুটির দিনে একসাথে ফ্ল্যাটে সময় কাটাত ওরা।একসময় শ্রীলা প্রেগন্যান্ট হয়।অর্ণবকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।অর্ণব একথা সেকথা বলে এড়িয়ে যেতে থাকে‌।সময় এগোলে ওর শরীরে অনাগত শিশুর লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে।একটা মন্দিরে গিয়ে ওরা এবার বিয়ে করে।

অর্ণব এবার মালিনীর বাঁধন ছাড়িয়ে ভেতরে যায়।মালিনীর শরীরের সব শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।ড্রয়িংরুমের সোফায় কোনমতে বসে পড়ে।ওর কানে আসে ওদের দু'জনের কথা,"তুমি বিবাহিত,আমাকে একবারও বলোনি তো?"

অর্ণব বলে,"তুমি সুযোগ দাওনি বলার।এত উত্তেজিত হয়ো না। তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান।ওর কথা ভাবো।শান্ত হও।একটা মীমাংসায় আসতে দাও।"

আর সহ্য করতে পারেনা মালিনী।কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এই ফ্ল্যাটটা ।অর্ণবকে বলেছিল,এটা আমাদের হানিমুন কটেজ। একদিন একটা ফুটফুটে ছোট্ট পরী আসবে আমাদের মাঝখানে।দু'বছর হতে চললো বিয়ের।আর দেরী কোরবো না অনি।পরম সুখে অর্ণবের বুকে মাথা রেখেছিল সেদিন।অর্ণব আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছিল তার মালাকে।


অনেক কষ্টে স্যুটকেসটা নিয়ে পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো মালিনী।অর্ণব আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে বাধা দিতে চাইল।আর ফিরে তাকালো না মালিনী।ওই দীঘল দুটো চোখের দিকে তাকালে ফেরা যে ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে!

একটা হোটেলে উঠলো সেদিনের মত। পরদিন ফিরে এলো শ্বশুবাড়িতে।

শ্বশুর শাশুড়ি অবাক হয়ে গেছেন ওর এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা দেখে।নিজের ঘরে ঢুকে

দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। উৎকন্ঠিত নন্দিনী আর অরিন্দম আশঙ্কিত হয়ে উঠলেন,ডাকলেন বৌমাকে,"কি হয়েছে মালিনী,আমাদের অর্ণব ভাল আছে তো? দরজা খোল ,মালিনী।"

মালিনী ওনাদের কথা ভেবে দরজা খুলে স্নেহময়ী শাশুড়ির কোলে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বাচ্চা মেয়ের মত।একে একে ওর দুর্ভাগ্যের কথা জানায়।ওনারা দুজনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। শাশুড়ি নন্দিনীর দুচোখ তখন ভরে উঠেছে জলে।অরিন্দম ভাবেন,কোথায় ভুল ছিল ওদের একমাত্র ছেলেকে মানুষ করায়!রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক তিনি।কত ছেলেকে জীবনের পাঠ পড়িয়েছেন। নিজের ছেলের বেলায় তিনি ব্যার্থ!

দুজনে গম্ভীর হয়ে যান। দুদিন পর অরিন্দম ছেলেকে ফোন করে জানান,"তুমি ভুলে যাও আমাদের।বাকি জীবনটা আমার একমাত্র মেয়ে মালিনীকে নিয়ে আমরা কাটিয়ে দিতে পারব।"

নন্দিনী কেঁদে স্বামীকে জানান,তুমি বাবা,তুমি ওকে ছাড়তে পারলেও আমি মা হয়ে কি করে ওকে ছাড়া বাঁচব?"অরুণ বাবু স্ত্রীর বাৎসল্যে বাদ সাধেননি।বলেন,"তোমাকে আমি বাধা দেব না। তোমার সিদ্ধান্ত তোমার।"

তাই মা ছেলের যোগাযোগ রয়ে যায়।

এরপর আর মালিনী পারেনি এ অসহায় বৃদ্ধ মানুষ দুটোকে ফেলে বাবামায়ের কাছে চিরদিনের মত ফিরে যেতে।

প্রায় পাঁচ বছর ওদের নিয়ে আর নিজের কলেজ নিয়ে গড়ে তুলেছে ওর একার জগৎ।

আবার চিন্তায় ছেদ পড়ল একটা ষ্টেশনে ট্রেন থামায়।

অরিন্দম  বললেন,"বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে,মালিনী গলাটা ঢেকে নাও। তোমার আবার ঠান্ডা লেগে যায় সহজে।"মালিনী বলল,"হ্যা,বাবা"।

আজ অরিন্দম আর নন্দিনী  চলেছেন মালিনী কে নিয়ে নতুন ঠিকানায়। জলপাইগুড়িতে অরিন্দমের বাল্যবন্ধু গৌতম মিত্র থাকেন সপরিবারে।ওনাদের পারিবারিক ব্যাবসা।উনি একমাত্র ছেলে সৌরভকে নিয়ে ব্যাবসা দেখাশোনা করেন।সেখানে ওনাদের পাশেই বাগান ঘেরা একটা বাড়ি কিনেছেন অরিন্দম এখানকার বাড়ি বিক্রি করে। বন্ধুয গৌতমই সব ব্যাবস্থা করেছেন। দুই বন্ধুতে বিগত কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকবার কলকাতা জলপাইগুড়ি যাতায়াত করেছেন।অনেক চেষ্টার পর মালিনী ওখানকার কলেজে ট্রান্সফার  পেয়েছে।একটা শুভদিন ঠিক করা হয়েছে দিন দশেক পর। দুদিন পর মালিনীর বাবা মাও এসে পড়বেন। নতুন বাড়ি সবাই মিলে সাজিয়ে তুলবেন।সাজাবেন একটা জীবনকেও নতুন করে।আদরের মালিনীকে বন্ধুপুত্র সৌরভের হাতে তুলে দেবেন ওনারা। তারপর ওর বাড়ির পাশেই কাটিয়ে দেবেন জীবনের শেষ কটা দিন।

__________________

জীবনের জলছবি


ট্রেন ছুটে চলেছে ঝমঝম শব্দে।দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে ধানক্ষেত,মাঠ,গাছপালা,রাস্তা। সবুজের বিচিত্র রঙবদলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।মালিনী জানলায় বসে দৃশ্যাবলী দেখছিল আর  মাঝেমাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিল অতীতে,যে অতীত ওর সামনে মেলে ধরেছিল এক রঙিন পৃথিবী সেই বছর সাতেক আগে।

মালিনী তখন সবে লেকচারার হিসাবে একটা কলেজে জয়েন করেছে।কলেজের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে যাচ্ছিল দার্জিলিং বেড়াতে।অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে শ্যামলা সুঠাম সুপুরুষ একজন প্রথম দেখাতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।কথায় কথায় জানতে পারে ওর নাম অর্ণব।অফিস থেকে ক'জন মিলে জলদাপাড়া বেড়াতে যাচ্ছে।অর্ণব একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার।

একসাথে যেতে যেতে পরিচিতি বাড়ে।

এরপর মালিনীরা নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে নেমে দার্জিলিং এর জন্যে গাড়ি ধরতে চলে যায়।অর্ণবদের ট্রেন এগিয়ে যায় ।

দিন পনের পর অর্ণব ওর কলেজে এসে দেখা করে।মালিনীও যেন মনে মনে অর্ণবকে দেখতে চাইছিল।মনে হোল ও যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেছে।

অর্ণব বলল,'চলে এলাম,রাগ করলেন না তো? আপনার ছুটি হলে চলুন একটু চা খেয়ে আসি,যদি আপত্তি না থাকে।'মালিনী ওকে অপেক্ষা করতে বলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বেড়িয়ে আসে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কাছাকাছি একটা কপি শপে।দুকাপ কফি আর স্ন্যাক্সের অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি বসে।অর্ণব বলে,"আপনাদের দার্জিলিং ট্যুর কেমন হোল?"

কথায় কথায় বেশ কিছু সময় পার করে ওরা ফিরে এলো।

এরপর বিকেলের দিকে দুজনে প্রায়ই একসাথে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরত একরাশ খুশির আমেজ নিয়ে। মাঝেমাঝেই নদীর ধারে চলে যেত।কখনো গঙ্গায় নৌকা করে ভেসে বেড়াত রাজহাঁসের মত।উপরে উন্মুক্ত আকাশ,ঝাঁক বেঁধে পাখিদের উড়ে যাওয়া,দূরে গাছের সারি,নদীর স্নিগ্ধ হাওয়া আর বয়ে যাওয়া জলের স্রোত,কুলুকুলু শব্দ যেন ওদের ঘিরে এক মায়াময় পরিবেশ গড়ে তুলত।ওরা দুজনে মগ্ন হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করত আর একে অপরের কাছে জমে থাকা কথা উজার করে দিত।নতুন অনুরাগ ওদের পৃথিবীটা স্বপ্নময় করে তোলে।

এরপর দুজনের বাড়ির মতে চারহাত এক হয়,দুটি পিপাসিত হৃদয় মিলে যায়। ধুমধাম করে বিয়ে হয় ওদের। অর্ণবের বাড়িতে আছেন শুধু বাবা মা।আর মালিনীরা এক ভাই এক বোন।অর্ণবের বাবা মা মালিনীকে সহজেই আপন করে নিলেন।ওর মেধা আর সৌন্দর্যের

সাথে মিশ্রিত নম্র ব্যাবহার ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

বিয়ের পর ওরা হানিমুনে চললো প্যারিস, ভালোবাসার শহরে।চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে যখন নামলো, চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হোল।এসে উঠলো লা মার্কুইস হোটেলে।বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল।দুজনে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হোল।

বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটাপথে পৌঁছে গেল আইফেল টাওয়ার দেখতে।এক ছড়ানো প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময়টি।ফরাসী নাম La Tour Eiffel,ফ্রান্সের প্রতীক।গুস্তাফা আইফেল নির্মিত ৩২০ মিটার তথা ১০৫০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারটি ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছর যাবৎ পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার ছিল।চারটি বিশাল লোহার পিলারের ওপর এটি দাঁড়ানো।১৮০৩৮ খন্ড লোহার তৈরী বিভিন্ন আকৃতির ছোট বড় লোহার তৈরী কাঠামো জোড়া দিয়ে এটি নির্মিত।৩০০ শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল।

অবাক বিস্ময়ে ওরা এসে দাঁড়ায় লিফটে ওঠার লাইনে। ওখানকার মানুষের অতিথিবৎসল ব্যাবহার আর হাসিমুখ ওদের খুশি করে।লিফট ওদের নিয়ে গেল অনেক উঁচু  চারদিকে ঘোরানো এক বারান্দায়।অপার বিস্ময়ে ওরা দেখল বিকেলের প্যারিস শহর সামনে উন্মুক্ত।দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করলো প্রাণ ভরে।মনে হোল ভালবাসার শহর যেন ওদের স্বর্গের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।এ যেন প্রেমের স্বর্গ।ওখানে রাখা দূরবীনে চোখ রাখলে আরো পরিস্কার ভাবে শহরটাকে দেখা যায়,দেখা যায় প্রবহমান সেইন নদীকে।সত্যিই এ এক স্বপ্ননগরী।যুগ যুগ ধরে কত যে কাহিনী রচিত হয়ে চলেছে ভালবাসার এই শহরকে ঘিরে।

এবার ওরা নেমে এলো সামনের বিস্তৃত মাঠে।হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠলো আইফেল।কি অপরূপ সে আলোকসজ্জা।ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে একেকটা আলোর রেখা।আকাশের গায়ে যেন হেলে রয়েছে এক রঙিন আলোকময় অত্যাশ্চর্য।ঠিক রাত আটটায় সেই আলোকমালা রূপ পরিবর্তন করে  আরো মোহময় হয়ে ধরা দিল। পরে জেনে গর্বিত হয়েছিল ,এই আলোকসজ্জায় হাত রয়েছে বাঙালী আলোকচিত্রী প্রয়াত তাপস সেনের।

প্রিয় কবিতা বলে ওঠে মালিনী।মুগ্ধ হয় অর্ণব।কবিতার নাম ,মোহময়ী নগরী


"আইফেল যেন শৌর্যের সাথে উন্নতশীরে জাগে,

কত শতাব্দী পার করে রাখে ঐতিহ্যকে আগে!

প্রান্তরমাঝে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত আলোকোজ্জ্বল বিভাতে

মহান্  বিশালতায় বিধৃত,কে না চায় রূপ হেরিতে?

লিফ্টে উপরে চলা শুরু হয়,প্রতি ধাপে দেখি,এ কি বিস্ময়!

অলিন্দে ঘুরি,দৃশ্য দেখি,সম্মুখে রয়েছে প্যারিস নগরী।

পারী মেলে ধরে অতি অনুপম নদী, নগরীর দৃশ্য,

নগর মিশেছে সাগর বেলায়,যুগে যুগে সে রহস্য!

প্যারিসের যে রূপ বর্ণিত বিশ্বব্যাপী রয়েছে গ্রথিত,

"শবনম"তার একটি মুক্তো,পঠনে মনন ভরে যায়।

ল্যুভর সমৃদ্ধ প্যারিস শহর,যাদুঘরে সেরা সংগ্রহ যত,

শিল্পীপ্রবর লিওনার্দোর 'মোনালিসা'পটও বিধৃত।

আঁকাবাঁকা ঐ সেইন নদীপথ,তীরে শোভে পুষ্পল জনপদ,

অটবীখচিত বাগিচা শ্যামল,ঢালপথে নামে সাগরবেলায়,

নীলাভ ফেনিল সায়রসলিল মিলায় আকাশ নীলিমায়!"

পরদিন সারাদিন কাটালো অত্যাশ্চর্য সব সংগ্রহ সম্বলিত ল্যুভর মিউজিয়ামে,যেখানে আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম  মোনালিসা। পিরামিড আকৃতির এই সংগ্রহশালার গঠনশৈলীও অনুপম।আরো কয়েকদিন ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল প্যারিস গেট,বাস্তিল দুর্গ,আর্ট অফ ট্রয়াঞ্চ গ্যালারি,নটরডম গীর্জা,কনকর্ড টাওয়ার ,আরো সব দর্শনীয় স্থান।তারপর ওরা ফিরে আসে ওদের সুখের নীড়ে।


হঠাৎ শাশুড়ির ডাকে মালিনীর সম্বিৎ ফেরে। বাইরের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে ও স্মৃতির ডানায় ভর করে হারিয়ে গিয়েছিল ভালবাসা ভরা অতীতে,যখন অর্ণব ওর সবটা জুড়ে থাকত,ওকে সোহাগে আদরে ভরিয়ে রাখত।

বাড়ি থেকে আনা গরম কফি দিলেন নন্দিনী তার আদরের বৌমাকে আর স্বামী অরিন্দমকে।

মালিনী টুকরো কথায় মেতে উঠলো এই বয়স্ক দম্পতির সাথে।


একদিন অযাচিতের মত তেমন ভালোবাসা এসেছিল জীবনে,তেমনি একদিন মরুভূমির মত ঊষর হয়ে গিয়েছিল ওর জীবন।এক অভিশপ্ত পরকীয়া কেড়ে নিয়েছিল ওর জীবনের সব শান্তি।বিয়ের পর বছর দুয়েক কেটে গেল ব্যাস্ততায় নিরবচ্ছিন্ন সুখের ঘেরাটোপে।তারপর অর্ণব ট্রান্সফার হোল পুণেতে।মাসে একবার করে বাড়ি ফিরত,নিয়ে যেত মালিনীকে কদিনের জন্য।এরপর আসার ব্যাবধান বাড়তে বাড়তে মাস ছয়েক হতে,মালিনী ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে চলে এল কোন খবর না দিয়ে। সেদিন রোববার ছিল।সোজা অর্ণবের ভাড়া করা ফ্ল্যটে চলে এলো। কলিং বেল বেজে উঠতে অর্ণব দরজা খুলল।মালিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো অর্ণবের বুকে। এতদিনের অদর্শনে হাঁপিয়ে উঠেছিল। কিন্তু অর্ণবের আড়ষ্টভাব ওর দৃষ্টি এড়াল না।অর্ণব আনন্দিত হবার বদলে বলে উঠল,"তুমি হঠাৎ এখানে?"মালিনী বলল,"তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে চলে এলাম। তুমি খুশি হওনি?"অর্ণব নীরব। মালিনী ড্রয়িংরুম পার হয়ে সোজা চলে এল বেডরুমে অর্ণবকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে বলে।

ঢুকেই থমকে গেল।ওদের দু'জনের নিজস্ব বিছানায় ঘুমাচ্ছে এক অচেনা মেয়ে।রাত পোশাক বিস্রস্ত,বিছানা এলোমেলো!

একছুটে বেড়িয়ে এলো মালিনী,অর্ণব অপরাধীর মত চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর সামনে তখন।মালিনীর দুচোখ বেয়ে  বন্যা নেমেছে।ভালোবাসা টুকরো টুকরো হয়ে নিঃশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে ।সারাটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে হৃদয় ভাঙার অদৃশ্য কাঁচের টুকরো।।দমবন্ধ হয়ে আসছে মালিনীর।প্রিয় মানুষটাকে দেখতে দেখতে ও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। গভীর খাদের ধারে ও যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।এখুনি পড়ে যাবে এক অতল গহ্বরে।খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরতে চাইছে অর্ণবকে, কিন্তু পারছেনা ।

ইতিমধ্যে মেয়েটি উঠে এ ঘরে চলে এসেছে।হাতে শাঁখা,সিঁথিতে সিঁদুর।শরীরে গর্ভবতী নারীর সমস্ত চিহ্ন স্পষ্ট।অর্ণবকে জিজ্ঞাসা করল,"কে উনি,কখন এলেন?তোমার আত্মীয়া আসবেন,আমাকে বলনি তো?আমাকে ডাকনি কেন?ছি ছি।উনি কি ভাববেন"।

তিনজনের চোখেই অদ্ভূত শূণ্যতা।

মালিনী আর পারলো না।অর্ণবকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।ওর অনিকে ও কিছুতেই হারাতে পারবেনা।

মেয়েটি এই দৃশ্য দেখে চলে গেল অন্য ঘরে।অর্ণব দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরে বলল,"আমি তোমার কাছে অপরাধী।ক্ষমা চাইছি।পারলে ক্ষমা কোর। পরিস্থিতি আমার আয়ত্তে ছিল না।এই অফিসে জয়েন করার পর শ্রীলার সাথে আলাপ।কখন যেন আমরা কাছে এসে যাই।তোমাকে বা বাবা মাকে কিভাবে ফেস করব,বুঝতে পারছিলাম না।ইতিমধ্যে ও প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।আমরা বিয়ে করি।"


আসলে অর্ণব এখানে আসার কিছুদিন পর ঝকঝকে সুন্দরী নীলনয়না শ্রীলা ওদের অফিসে জয়েন করে। কিছু দিন পর থেকেই শ্রীলার রূপের মোহে অর্ণব আকৃষ্ট হয়।ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।প্রায়ই ছুটির দিনে একসাথে ফ্ল্যাটে সময় কাটাত ওরা।একসময় শ্রীলা প্রেগন্যান্ট হয়।অর্ণবকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।অর্ণব একথা সেকথা বলে এড়িয়ে যেতে থাকে‌।সময় এগোলে ওর শরীরে অনাগত শিশুর লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে।একটা মন্দিরে গিয়ে ওরা এবার বিয়ে করে।

অর্ণব এবার মালিনীর বাঁধন ছাড়িয়ে ভেতরে যায়।মালিনীর শরীরের সব শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।ড্রয়িংরুমের সোফায় কোনমতে বসে পড়ে।ওর কানে আসে ওদের দু'জনের কথা,"তুমি বিবাহিত,আমাকে একবারও বলোনি তো?"

অর্ণব বলে,"তুমি সুযোগ দাওনি বলার।এত উত্তেজিত হয়ো না। তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান।ওর কথা ভাবো।শান্ত হও।একটা মীমাংসায় আসতে দাও।"

আর সহ্য করতে পারেনা মালিনী।কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এই ফ্ল্যাটটা ।অর্ণবকে বলেছিল,এটা আমাদের হানিমুন কটেজ। একদিন একটা ফুটফুটে ছোট্ট পরী আসবে আমাদের মাঝখানে।দু'বছর হতে চললো বিয়ের।আর দেরী কোরবো না অনি।পরম সুখে অর্ণবের বুকে মাথা রেখেছিল সেদিন।অর্ণব আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছিল তার মালাকে।


অনেক কষ্টে স্যুটকেসটা নিয়ে পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো মালিনী।অর্ণব আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে বাধা দিতে চাইল।আর ফিরে তাকালো না মালিনী।ওই দীঘল দুটো চোখের দিকে তাকালে ফেরা যে ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে!

একটা হোটেলে উঠলো সেদিনের মত। পরদিন ফিরে এলো শ্বশুবাড়িতে।

শ্বশুর শাশুড়ি অবাক হয়ে গেছেন ওর এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা দেখে।নিজের ঘরে ঢুকে

দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। উৎকন্ঠিত নন্দিনী আর অরিন্দম আশঙ্কিত হয়ে উঠলেন,ডাকলেন বৌমাকে,"কি হয়েছে মালিনী,আমাদের অর্ণব ভাল আছে তো? দরজা খোল ,মালিনী।"

মালিনী ওনাদের কথা ভেবে দরজা খুলে স্নেহময়ী শাশুড়ির কোলে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বাচ্চা মেয়ের মত।একে একে ওর দুর্ভাগ্যের কথা জানায়।ওনারা দুজনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। শাশুড়ি নন্দিনীর দুচোখ তখন ভরে উঠেছে জলে।অরিন্দম ভাবেন,কোথায় ভুল ছিল ওদের একমাত্র ছেলেকে মানুষ করায়!রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক তিনি।কত ছেলেকে জীবনের পাঠ পড়িয়েছেন। নিজের ছেলের বেলায় তিনি ব্যার্থ!

দুজনে গম্ভীর হয়ে যান। দুদিন পর অরিন্দম ছেলেকে ফোন করে জানান,"তুমি ভুলে যাও আমাদের।বাকি জীবনটা আমার একমাত্র মেয়ে মালিনীকে নিয়ে আমরা কাটিয়ে দিতে পারব।"

নন্দিনী কেঁদে স্বামীকে জানান,তুমি বাবা,তুমি ওকে ছাড়তে পারলেও আমি মা হয়ে কি করে ওকে ছাড়া বাঁচব?"অরিন্দম স্ত্রীর বাৎসল্যে বাদ সাধেননি।বলেন,"তোমাকে আমি বাধা দেব না। তোমার সিদ্ধান্ত তোমার।"

তাই মা ছেলের যোগাযোগ রয়ে যায়।

এরপর আর মালিনী পারেনি এ অসহায় বৃদ্ধ মানুষ দুটোকে ফেলে বাবামায়ের কাছে চিরদিনের মত ফিরে যেতে।

প্রায় পাঁচ বছর ওদের নিয়ে আর নিজের কলেজ নিয়ে গড়ে তুলেছে ওর একার জগৎ।

আবার চিন্তায় ছেদ পড়ল একটা ষ্টেশনে ট্রেন থামায়।

অরিন্দম  বললেন,"বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে,মালিনী গলাটা ঢেকে নাও। তোমার আবার ঠান্ডা লেগে যায় সহজে।"মালিনী বলল,"হ্যা,বাবা"।

আজ অরিন্দম আর নন্দিনী  চলেছেন মালিনী কে নিয়ে নতুন ঠিকানায়। জলপাইগুড়িতে অরিন্দমের বাল্যবন্ধু গৌতম মিত্র থাকেন সপরিবারে।ওনাদের পারিবারিক ব্যাবসা।উনি একমাত্র ছেলে সৌরভকে নিয়ে ব্যাবসা দেখাশোনা করেন।সেখানে ওনাদের পাশেই বাগান ঘেরা একটা বাড়ি কিনেছেন অরিন্দম এখানকার বাড়ি বিক্রি করে। বন্ধু গৌতমই সব ব্যাবস্থা করেছেন। দুই বন্ধুতে বিগত কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকবার কলকাতা জলপাইগুড়ি যাতায়াত করেছেন।অনেক চেষ্টার পর মালিনী ওখানকার কলেজে ট্রান্সফার  পেয়েছে।একটা শুভদিন ঠিক করা হয়েছে দিন দশেক পর। দুদিন পর মালিনীর বাবা মাও এসে পড়বেন। নতুন বাড়ি সবাই মিলে সাজিয়ে তুলবেন।সাজাবেন একটা জীবনকেও নতুন করে।আদরের মালিনীকে বন্ধুপুত্র সৌরভের হাতে তুলে দেবেন ওনারা। তারপর ওর বাড়ির পাশেই কাটিয়ে দেবেন জীবনের শেষ কটা দিন।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু