বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মেজপিসী/মেজদি মরেনি

স্নেহের কোয়েল,

হয়তো এখন ভাবছো কী বলার ছিল মেজপিসীকে, কোন্ উপহার তাঁকে দেবে ব’লে ভেবেছিলে কিন্তু দেওয়া হ’য়ে ওঠেনি। প্রিয়জন চলে যাবার আগে আমরা এমন কিছু দিতে চাই তাঁকে, যা তাঁকে মনে ক’রিয়ে দেবে কিছু আপনজনের কথা।

এমনই এক সন্ধ্যায়, তোমার বয়স তখন পাঁচ। কাজের শেষে বাড়ী ফিরে দেখি, তুমি দারুণ ব্যস্ত হ’য়ে ছবির পর ছবি এঁকে চলেছো। আমি বসার ঘরে ব্রীফকেসটা রেখে একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তুমি ছুটে এসে ব’ললে, ‘বাপী, দ্যাখো, এই ছবিটা আমি এঁকেছি মেজপিসীর জন্যে। মেজপিসীকে আরও কতোকি ক’রে দিতে হবে আমাকে, কাল ওঁর চলে যাওয়ার আগে। মেজপিসীকে কালই যেতে হ’বে কেন, বাপী? আরও কিছুদিন থেকে যেতে পারেনা?’

‘কী বললে, কোয়েল?’, আমি বিস্ময়ে হতবাক, ‘আমিতো জানিনা যে মেজপিসী চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? কে ব’লেছে যে মেজপিসী চ’লে যাচ্ছে?’

‘জানোনা তুমি? মা ব’লেছে- মেজপিসী কাল আমাদের বাড়ী ছেড়ে চ’লে যাবে।  মেজপিসী এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে আরও মজায় থাকবে। মা ব’লেছে, কিছু ভালো ছবি এঁকে দিতে – মেজপিসী ওঁর নতুন বাড়ীতে সাজিয়ে রাখবে।‘

‘আমার মনে হয়না, ওঁর কোথাও যাওয়া উচিত এখন। দেখি ওঁর সঙ্গে কথা ব’লে-‘

আমি তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, মেজদি ওঁর জিনিসপত্র গুছোচ্ছে। আমার মনে হোলো, কেউ ওঁকে ব’লেছে, এবাড়ী ছেড়ে যেতে।

ও ব’ললো, ‘খোকন, ভালো যে তুই দেখতে এসেছিস্; আমি কি এখানে কিছু জিনিস রেখে যেতে পারি? আমার সব কিছু নিয়ে কীক’রে যাবো?’

‘তুই কোথায় যাচ্ছিস্, মেজদি? কেন যাচ্ছিস্?’

‘জানিনা কোথায় যাবো? সামান্য কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়বো? কোথায় গার্লস হোস্টেল আছে তার খোঁজ ক’রবো।‘

‘কিন্তু কেন? কেন তোকে বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের বাড়ী ছেড়ে? আমাকে বলিসনি কেন একথা?’

‘সুভদ্রা বলেছে, তুই চাসনা আমি সারা জীবন এখানে থাকি। ও আমাকে বলেছে থাকার মতো কোনো জায়গা খুঁজে নিতে।‘

‘কিছুতেই না। এতবড়ো কথা তোকে বলার আগে, সুভদ্রার উচিত ছিল আমাকে জানানো। তোকে কোথাও যেতে হবেনা। কোথায় যাবি তুই? কোনো রোজগার নেই তোর; থাকা-খাওয়ার খরচ দিবি কিক’রে? সামান্য যাকিছু আছে, সব নিঃশেষ ক’রে দিস না।‘

আমি দৌড়ালাম সুভদ্রার কাছে। সুভদ্রা চা-জলখাবার সাজাচ্ছিলো আমার জন্যে; বললো, ‘তুমি এখানে ছুটে এলে কেন? আমি এখনই তোমার চা নিয়ে যাচ্ছিলাম। খিদে পেয়েছে খুব?’

‘মোটেই না। চায়ের জন্যে আসিনি আমি; এসেছি তোমাকে জিগ্যেস ক’রতে- আমাকে না জানিয়ে কেন মেজদিকে ব’লেছো এবাড়ী ছেড়ে যেতে?’

‘আমি ব’লেছি, মেজদি অনেকদিন এখানে থাকলে ভালো দেখায় না। মেজদিকে ব’লেছি নিজের থাকার মতো কোনো জায়গা খুঁজে নিতে।‘

‘যদি মেজদি এখন অন্য কোথাও গিয়ে থাকে, তাহ’লে ওকে সেখানে ভাড়া দিতে হবে। মেজদি এখন কিছু রোজগার ক’রছে না। বরং, যদি পারো, এখানে কিছু কাজ খুঁজতে সাহায্য করো ওকে। কাজ পেলে ও কোথাও থাকার জন্যে ভাড়া দিতে পারবে; সেপর্য্যন্ত ওকে এখানেই থাকতে দাও। যদি মেজদি চায়, তবে ও তোমাদের কিছু উপহার দিতে পারে। তবে ওর সামান্য সঞ্চয় থেকে বেশি খরচ করা উচিত নয়।‘

‘অবশ্যই সাহায্য ক’রবো, কাছাকাছি যে কটা মেয়ে-স্কুল আছে তার ঠিকানা আর ফোন নম্বর যোগাড় ক’রবো। মেজদি অঙ্কে এম-এস-সি, শ্যামবাজার গার্লস স্কুলে পড়িয়েছে। ও নিশ্চয় এখানেও কিছু পেয়ে যাবে।’
‘ভালো, এখন বলো মেজদিকে একথা। যদি কোয়েল আমাকে না জানাতো, তাহলে মেজদি হয়তো কালই এ-বাড়ী ছেড়ে চলে যেতো আর আমরা জানতেও পারতুম না, মেজদি কোথায় গেছে।'
‘মেজদি, মেজদি’, সুভদ্রা ছুটে গেল মেজদির কাছে। আমিও গেলাম পেছু পেছু।
‘কাল কোনও ফ্ল্যাট খোঁজার দরকার নেই তোমার। তুমি কি এখানে কোনো স্কুলে পড়াতে চাও?’
মেজদি ব’লেছিল, 'অবশ্যই চাই, চাকরি পেতে হবে'।
‘আমি কাছাকাছি স্কুলগুলোর একটা লিস্ট বানাবো, ঠিকানা আর ফোন নম্বর সমেত। আমরা ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রতে পারি বা হেঁটে গিয়েও দেখতে পারি। জিগ্যেস ক’রবো ওদের ম্যাথামেটিক্স টিচার চাই কিনা। তোমার সব ডিগ্রি সার্টিফিকেটের কপি আর বায়োডেটা আছে তো?’
‘ডিগ্রি সার্টিফিকেটের কপি আছে, তবে বায়োডেটা নতুন ক’রে লিখতে হবে। বিয়ের পর থেকে সাত বছর আমি কাজ করিনি।’
সুভদ্রা মেজদিকে নতুন বায়োডেটা তৈরী ক’রতে আন্তরিকভাবে সাহায্য ক’রেছিল আর বেশ কয়েকটি ভালো স্কুলের সাথে যোগাযোগ ক’রেছিল। চার দিনের মধ্যে, মেজদি চারটি স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েছিল; দুটি স্কুল থেকে চাকরীর অফার পেয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল নাম-করা রাইসিনা স্কুল। দুটি স্কুলই মেজদিকে সিনিয়র ম্যাথস্ টিচার হিসেবে নিতে চেয়েছিল। রাইসিনা স্কুলে মাইনে কিছুটা কম হ’লেও, একটি নাম-করা স্কুলে কাজ করার সুযোগ হবে ব’লে আমরা মেজদিকে এই স্কুলে যোগ দিতে পরামর্শ দিয়েছিলাম; মেজদিও দ্বিধা করেনি।
সাত বছর পরে কাজে যোগ দিয়ে অনেক খাটতে হোলো মেজদিকে;  সিলেবাস আর নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের উপর ভিত্তি করে ঠিক ক’রতে হোলো বছরের চল্লিশ সপ্তাহের কোন সপ্তাহে কী পড়াবে। সমস্ত সিনিয়র ক্লাস - নবম, দশম, একাদশ আর দ্বাদশ শ্রেণীর ম্যাথস্ পড়ানোর দায়িত্ব ছিল মেজদির। একদিন মেজদি অবাক হয়ে দেখলো, দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন ছিল দাদার মেয়ে, টুম্পাই। মেজদি জানতো যে, দাদার বাড়ীতে যাওয়া ওর কাছে নিষিদ্ধ; তাই সব সময় টুম্পাইয়ের সাথে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দূরত্ব বজায় রেখেছিল, কখনও জানায়নি যে টুম্পাই ওর ভাইঝি।
 
কোয়েল,
আমি এখনও ভুলতে পারিনি সেই সন্ধ্যেটির কথা, যখন পাঁচ বছরের তুমি আমাকে প্রশ্ন ক’রেছিলে, ‘কাল কেন চ’লে যাবে মেজপিসী? এইটুকু সময়ে আমি কী ক’রে এই ছবিটা এঁকে দেবো ওঁকে?’ তুমি এই প্রশ্ন না ক’রলে জানিনা মেজপিসী কোথায় চ’লে যেতো তার পরের দিন; হয়তো ও এইটাই ভেবে নিতো যে সুভদ্রা আমার কথামতোই ওকে আমাদের বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে ব’লেছে; সুভদ্রাও আমাকে ওঁর চলে যাওয়ার খবর কিভাবে জানাতো তা আমি এখনও অনুমান ক’রতে পারছিনা। অনুমান ক’রতে পারছিনা মেজপিসী কী ক’রতো আমাদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়ে; দিল্লীতে মেজপিসীর ক্যানসারের চিকিৎসা করানোর জন্যে আমি ওঁকে নিয়ে এসেছি ওঁর মেদিনীপুরের শ্বশুরবাড়ী থেকে; শ্বশুরবাড়ীতে ওঁর চিকিৎসা হচ্ছিল না; পাছে মেজপিসীর ছোঁয়াচ লেগে অন্য কারুর অসুখ করে, এই ভয়ে মেজপিসীকে একটা ছোট ঘরে বন্দী ক’রে রেখেছিল; সেখানে মেজপিসীকে নিজেই রান্না ক’রে খেতে হ’তো, ওরা অপেক্ষা ক’রছিল কবে ওর দেহাবসান হবে। মেজপিসী আশা ক’রেছিল, আমার আশ্রয়ে থেকে দিল্লীর ‘এ-আই-আই-এম-এস’এ ওঁর চিকিত্সা হবে। এই অবস্থায় নিরাশ্রয় হ’লে বেঁচে থাকাটাই প্রায় অসম্ভব; শ্বশুর বাড়ী থেকে সাহায্য পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই; বাপের বাড়ীর আশ্রয়ও রইলো না। পাঁচ বছরের কোয়েলের সাবধান করানোর জন্যে, মেজপিসী স্বাবলম্বিনী হ’য়ে শুরু ক’রলো বাঁচার সংগ্রাম।
 
এবারে সংক্ষেপে বলি মেজদির আগের জীবনের কথা।
এক সন্ধ্যায় স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে— মেজদি পাস করেছে, বড়দি ফেল ক’রেছে অঙ্ক আর ইংরেজীতে। বড়দি কোথায় লুকিয়ে ছিল বুঝতে পারিনি, মা বললো— বড়দি নিখোঁজ। দাদা বাইরে গিয়ে বড়দিকে দেখতে পেলো, ও বেরিয়ে পড়েছিলো নিরুদ্দেশ যাত্রায়। দাদা ওর হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে এলো।
বড়দিকে আশ্বাস দিলো মেজদি, ‘আমি তোকে পিছনে ফেলে এগোবো না। তুই পড়াশোনা চালিয়ে যা, আমি পাশে থাকবো, ঠিক পারবি পরের বার। এক বছরে কিছু যায় আসে না। আমি কলেজে ভর্তি হবো না। তুই পাশ করার পরে একসঙ্গে কলেজে যাবো।‘
পরের বছর বড়দি কেবল ইংরেজিতেই ফেল ক’রেছিল, পাস ক’রেছিল কম্পার্টমেন্টালে। তারপরে মেজদি শুরু করেছিল আই.এস.সি, আর বড়দি আই.এ। দু'বছর পর দুজনেই ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দিলো। মেজদি পাস করলো সেকেণ্ড ডিভিসনে; বড়দি পারলো না। বড়দি গিটার শিখতে শুরু ক’রলো। মেজদি বি.এস.সিতে ভর্ত্তি হ’লো। অঙ্কে ফার্স্টক্লাস অনার্স নিয়ে ডিগ্রী পেলো দুবছর বাদে।
আরো দুবছর পরে মেজদি এম.এস.সি.-তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হোলো। মেজদির ইচ্ছে- স্কুলের উঁচু ক্লাসে অঙ্ক পড়াবে। বাবা-মার মত নেই; এখনই ওর মতো শিক্ষিত পাত্র পাওয়া শক্ত; চাকরী ক’রলে বিয়ে দেওয়া আরও কঠিন হবে।  মেজদি কি এখন অপেক্ষা ক’রবে, কবে বাবা-মা ওর জন্য উপযুক্ত ছেলে খুঁজে ওর বিয়ে দেবে ব’লে? ...পাশের বাড়ির মেয়ে, জলি সাহায্য ক’রলো; শ্যামবাজার গার্লস্ হাই স্কুলে মেজদি দরখাস্ত করলো জলির ঠিকানা দিয়ে। ইন্টারভিউ লেটার এলো জলির ঠিকানায়; ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেলো মেজদি। এখন, বাবা-মার সম্মতি পাওয়ার দরকার। মেজদি বাবা-মাকে বোঝালো, ও মাসে মাসে সংসার খরচে টাকা দিতে পারবে, এছাড়া ওর বিয়েতে যৌতুক দেওয়ার দরকার হ’লেও সাহায্য ক’রতে পারবে। বাবা-মা মত না দিয়ে পারেনি।
 

সুযোগ্য পাত্র পাওয়া গেলো— ইঞ্জিনিয়ার তমোজিৎ। তমোজিতের ভাই অভিজিৎ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যা কিছু চাইলো, বাবা রাজি হ’য়ে গেলেন, কতটা সাধ্যের মধ্যে না বুঝেই। বাবা হয়তো ভাবছিলেন, তিনি তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়— প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দাদাকে দিয়েছিলেন বাড়ী কেনার জন্যে, দাদা কথা দিয়েছিল— বোনেদের বিয়ের সমস্ত খরচ দেবে।
বাবার চিঠি পেয়ে, দাদা দেখলো, এতটা খরচ করা ওর সাধ্যের বাইরে। বাবাকে কোনো উত্তর না দিয়ে দাদা অভিজিৎকে সরাসরি চিঠি দিল বাবার হ’য়ে। চিঠি পেয়ে অভিজিৎ বাবাকে জানালো, এখন থেকে বাবার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক গড়তে ও অপারগ।
হতাশ হওয়া সত্ত্বেও মেজদি ব’লতে পারলো না, নিজের সঞ্চয় থেকেই ও অভিজিতের চাহিদা মেটাতে পারতো; ভাবলো আদৌ বিয়ে করার কি দরকার!
 

ছ’মাস পরে, মেজদির বিয়ে হ’লো এম.এ.এল-এল-বি পাশ দীনেশের সঙ্গে; যৌতুক দেওয়া হ’ল মেজদির সঞ্চয় থেকে; মেজদি গেলো মেদিনীপুরে শ্বশুরবাড়ীতে। মেদিনীপুর থেকে প্রতিদিন কলকাতায় যাওয়া-আসা অসম্ভব; শ্বশুরবাড়ীরও আপত্তি ছিল; মেজদিকে শ্যামবাজার গার্লস্ হাই স্কুলের চাকরী ছাড়তে হ’লো। ও জানতে পারলো, দীনেশ কখনও প্র্যাক্টিস করেনি, স্কুলে পড়াতো।
 

এর সাত বছর পরে, মেজদির কাছ থেকে চিঠি পেলাম ওকে মেদিনীপুর থেকে নিয়ে আসার জন্যে। আমি আগেই শুনেছিলাম, মেজদির গলায় যন্ত্রণা হচ্ছে; অপারেশনের পরে বায়োপ্সিতে জানা গেছিল, কিছু ক্যান্সারের টিস্যু রয়ে গেছে, ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলেছিলেন যে ক্যান্সার খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি; এখনও দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সা দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু ওর শ্বশুর-শাশুড়ির মতে, পরিবারের অন্যরাও ওর ক্যান্সারে আক্রান্ত হ’তে পারে; ওনারা মেজদিকে অস্পৃশ্য ভেবেছিলো, চিকিত্সা করার কোনও চেষ্টা করেনি।
মেজদি ওকে আমার দিল্লীর ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিল। ও বলেছিল, একমাত্র আমার কাছেই ও চাইতে পারে, কারণ মা তখন বেঁচে নেই, আর দাদা বাবাকে সাহায্য ক’রতে দেবে না।
 
মেজদির শ্বশুরবাড়ীতে পৌঁছে, আমি তফাৎটা বুঝতে পারলাম। মেজদি আর স্বামীর ঘরে ছিল না;  ছিল একটা ছোট ভাঁড়ারঘরে। মেজদি নিজেই রান্না ক’রতো; আর কেউই সে-ঘরে ঢোকার ঝুঁকি নিতো না। মনে হয়েছিল, শ্বশুর-শাশুড়িরা মেজদির মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছিলো; মেদিনীপুর থেকে মেজদিকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে ওনারা খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন। মেজদি তার সমস্ত জিনিস গুছিয়ে ফেললো, চিরদিনের জন্যে যাওয়ার জন্যে। রওনা হ’লাম দিল্লীর দিকে; ছেলেমেয়েদের ছেড়ে যেতে হ’লো মেজদিকে; বিদায় নেওয়ার অনুমতি ছিলোনা রোগ-সংক্রমণের ভয়ে।
 
দিল্লীতে এসে দাদাকে ফোন ক’রলাম; দাদা মেজদির ক্যানসার নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়; ধমক দিলো আমাকে মেজদিকে শ্বশুড়বাড়ী থেকে চুরি ক’রে নিয়ে আসার জন্যে. বললো ও এই ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেবেনা, মেজদি যেন কখনও ওর বাড়ীতে না যায়, বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
আমাদের ফ্ল্যাটে তিন মাস থাকার পরে এসেছিল সেই সন্ধ্যে, যেদিন পাঁচ-বছরের কোয়েল আমাকে সতর্ক না ক’রে দিলে, তার পরদিন থেকে মেজদি কোথায় থাকতো, কিভাবে থাকতো, আদৌ বেঁচে থাকতো কিনা জানিনা।  সুভদ্রা মেজদিকে ওর বায়োডেটা তৈরী ক’রতে এবং কয়েকটি স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ ক’রতে সাহায্য ক’রলো; মেজদি দুটি স্কুল থেকে চাকরীর অফার পেলো। এর মধ্যে নামী স্কুল রাইসিনাতে কাজ সুরু ক’রলো মেজদি।
 
দিল্লীর অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট থেকে নির্দ্ধারিত হ’লো রেডিও-অ্যাক্টিভ আয়োডিন (RAI) থেরাপির চিকিত্সার দিন। এই খবর পেতেই সুভদ্রা জানালো, ঐসময়ে ওকে বরোদা যেতে হবে, চিকিত্সার সপ্তাহটা ওকে বরোদায় থাকতে হবে। সুভদ্রার বাবা আমাকে বললেন, ‘তুমিও চলে এসো বরোদায়। মেজদিকে ভগবানের হাতে ছেড়ে দাও। হাসপাতালে তোমার দাদার ফোন নম্বর দিয়ে দাও। সেরকম কিছু হ’লে ওরা তোমার দাদাকে জানাবে।‘ উত্তরে আমি ব’লেছিলাম, ‘এই চিকিৎসার জন্যেই মেজদিকে নিয়ে এসেছি দায়িত্ব নিয়ে। এ সুযোগ ছাড়লে খুব বেশী দেরী হ’য়ে যাবে। সুভদ্রা পাশে না থাকলেও চলবে।‘ এক সপ্তাহের থেরাপিতে মেজদি সেরে উঠলো। হাসপাতালে আমাকে  বড় একটা থাকতে হয়নি, যেখানে মেজদি হাঁটাচলা করতে পারতো না, এমন কিছু প্রক্রিয়া বাদে।
  
একজন নির্ভরযোগ্য শিক্ষয়িত্রী হিসাবে মেজদির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সারা দিল্লীতে। অল-ইণ্ডিয়া ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে যাওয়ার সুযোগ না পাওয়া পর্য্যন্ত মেজদি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল। বাবার শেষ অসুখের সময়েও মেজদি অনেক সেবাযত্ন ক’রেছে; সে আর এক সংগ্রাম; একটা আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া ক’রে বাবাকে রাখতে হ’য়েছিল; বাবাকে দেখাশোনা ক’রেছিল মেজদি। মেজদি আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের সুযোগ আসে; তখন সুভদ্রা ও আমার ম্যারেজ সার্টিফিকেটের জন্যে মেজদিই এফিডেভিট ক’রেছিল। দিল্লীতে শেষ রাতেও মেজদি ছিল আমাদের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টে; পরদিন দুটো ট্যাক্সিতে মালপত্র বোঝাই ক’রে আমাদের ক’লকাতা যাবার ট্রেণে তুলতে গিয়েছিল মেজদি ও দুই প্রতিবেশী।
 
কোয়েল, তোমার নিশ্চয় মনে আছে, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমরা দিল্লীতে বেড়াতে এসে উঠেছিলাম মেজপিসীর ফ্ল্যাটে। তোমার বয়ফ্রেণ্ড গ্রেগও ছিল আমাদের সঙ্গে। গাড়ী ভাড়া ক’রে আমরা ঘুরেছিলাম দিল্লী-আগ্রা। এর বছরদুয়েক বাদে গ্রেগ আর তোমার বাঙালী বিয়ে হ’য়েছিল ক’লকাতায়। সেখানে গ্রেগের মা ও দিদিকে শাড়ী পরানোর ভার নিয়েছিলো মেজপিসী।  সিডনীতেও বেড়াতে এসেছিল মেজপিসী, মাসদুয়েক ছিল, ক্যানবেরা আর মেলবোর্ণেও ঘুরেছে। অস্ট্রেলিয়ার স্কুলের মাথামেটিক্সের সিলেবাসও দেখেছে।
 
রাইসিনা স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পরে, দিল্লীতে তার গুণমুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের রেখে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এলো মেজদি। ওর স্বামী চেয়েছিলো যে, মেজদি মেদিনীপুরে ফিরে আসুক, কিন্তু যে বাড়ীতে ও কেবল ঘৃণা পেয়েছে, সেখানে ভালোবাসা চাওয়ার ইচ্ছে হোলোনা ওর। মেজদি একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলো শ্রীরামপুরে, সেখান থেকে ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু ক’রলো। নিজের ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর নিয়ে ওদের আপন করার চেষ্টা ক’রলো; ওর বড় মেয়ের বিয়ে তখনও হয়নি, অথচ ওর ছোটো দুই ভাইবোনের হ’য়ে গেছে। মেজদির শ্বশুড়বাড়ী থেকে ওর তিন ছেলেমেয়েরই মগজধোলাই ক’রেছিল ওদের মায়ের বিরুদ্ধে। শ্রীরামপুরের এক বিশ্বাসযোগ্য ছেলের সঙ্গে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছিল মেজদি। মেজদির স্বামী দীনেশও কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে গেছে মেজদির শ্রীরামপুরের অ্যাপার্টমেন্টে; মেদিনীপুরের আত্মীয়দের চাইতে মেজদির উপরেই তার বেশী ভরসা। এরপরে, মেজদির স্বামীও ইহলোক ছেড়ে গেলেন; যাবার আগে উনি ব্যবস্থা ক’রেছিলেন যাতে ওঁর পেনসনের উত্তরাধিকার মেজদি পায়; তবে মেজদি সেটাকা নিজে না নিয়ে ওঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ভাগ ক’রে দিতো।
 
অশীতিপর হ’য়েও ২০২০এর মার্চ পর্য্যন্ত, মেজদি ওর শ্রীরামপুরের অ্যাপার্টমেন্টে থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে গেছে, শিক্ষার জোরে তাদের স্বাবলম্বী করার জন্যে, সমস্ত অবিচার আর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে। এমন সময়ে ওর মেয়ে বললো, ‘এই বয়সে অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকা ঠিক নয়; রাত-বিরেতে কোনো অপঘাতে কেউ দেখার সুযোগ পাবেনা।‘ মেয়ে শ্রীরামপুরেই থাকে; সেখানে গিয়ে উঠলো মেজদি, অ্যাপার্টমেন্টে তালা দিয়ে। সেখান থেকেও পড়িয়ে গেছে ছেলেমেয়েদের; কোভিডের প্রকোপে সামনা-সামনি ব’সে পড়াতে না পারলে হোয়াটস্-অ্যাপ দিয়ে পড়িয়েছে।
 
২০২১এর ১৩ই ফেব্রুয়ারীতে মেজদিকে ফোন ক’রে জানলাম, সোমবার ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে ওর পেসমেকারের ব্যাটারী পাল্টানো হবে ক’লকাতার এক হাসপাতালে; বাড়ী ফিরে আসবে বুধবারে। বৃহস্পতিবারে মেজদিকে ফোন করাতে উত্তর দিল মেজদির মেয়ের ননদ – উনি বললেন, ব্যাটারী পাল্টানো হ’য়ে গেছে, কিন্তু মেজদি তখনো আই-সি-ইউতে, কারণ ও নাকি ভুলভাল ব’কছে। পরে মেজদির মেয়েকে ফোন ক’রে যতবার খবর নিলাম, একই খবর পেলাম। পরে ২২শে ফেব্রুয়ারীতে মেজদিকে জেনারেল বেডে নিয়ে আসে। ২৫শে ফেব্রুয়ারীতে জানলাম, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে, মেজদি বাড়ী ফিরে এসেছে; কিন্তু তখন ও ঘুমোচ্ছে, কথা বলা যাবেনা।
২৬শে ফেব্রুয়ারীতে মেজদির ফোনেই রিং ক’রলাম; জবাব এলো মেজদির নিজের গলাতেই। তখন ওখানে দুপুর আড়াইটে। আয়া ওকে একটু আগে খাবার দিয়ে গেছে; তার কাছে জলের গেলাস চেয়ে আমার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই কথা ব’লতে শুরু ক’রলো; বলা বাহুল্য আমার গলা শুনে চিনতে ওর কোনো অসুবিধে হয়নি। ও ব’ললো, “আমার ১৫ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারী পর্য্যন্ত ব্ল্যাকআউট হ’য়েছিল সার্জেনের দোষে; ডাক্তারকে জানিয়েছিলাম যে আমার থাইরয়েডের সমস্যার জন্যে পুরো অ্যানাসথেসিয়া করা চলবে না; তা সত্ত্বেও সার্জেন পুরো অ্যানাসথেসিয়া ক’রেছে। এখন আমার অবস্থা ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। আমি প্রমাণ ক’রতে পারছিনা যে কিছু ভুল ব’কছিনা, সব ঠিক বুঝতে পারছি।
বলতো (a+b)^5 = কত?
a^5+5(a^4)b+((5x4)/(2x1))(a^3)(b^2)+((5x4x3)/(3x2x1))(a^2)(b^3)+5a(b^4)+b^5
 অর্থাৎ, a^5+5(a^4)b+10(a^3)(b^2)+10(a^2)(b^3)+5a(b^4)+b^5
আমি বুঝলাম যে সাধারণ মানুষের তুলনায় মেজদি বেশীই বুঝতে পারছে। আনন্দের সঙ্গে ফোন ছাড়লাম, যাতে ও খেয়ে নিতে পারে; আমি নিশ্চিত, শীগ্গিরই সুস্থ হ’য়ে উঠবে ও।
 
২৮শে ফেব্রুয়ারীতে মেজদির মেয়ের ফোন পেলাম- ওর রক্তপরীক্ষা ক’রে ইনফেকশন পাওয়া গেছে, নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করা হয়েছে। ১লা মার্চের খবর- ওর সেপ্টিসেমিয়া হ’য়েছে সম্ভবতঃ, পেসমেকারের ব্যাটারী পাল্টানোর পর থেকেই। এর পরের খবর- ২রা মার্চে সকাল আটটায় মেজদির দেহাবসান হ’য়েছে।  ওর মেয়ে জানালো, ওরা দুই বোনে মেজদিকে বিয়ের বেনারসী পরিয়ে সাজাবে; হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাড়ী, তারপরে মেজদির ফ্ল্যাটে, তারপরে শ্মশানঘাটে। আরও জানালো যে মেজদির হ্যাণ্ডসেট থেকে ফোন নম্বর নিয়ে সব পরিচিতদের জানাচ্ছে।
৫ই মার্চ মেজদির মেয়ে ফোন ক’রেছিল শ্রাদ্ধ করার অনুমতি চাইতে; তখন ও জানালো একশোরও বেশী ছাত্র-ছাত্রী আর তাদের বাবা-মায়েরা এসেছিল শ্রদ্ধা জানাতে, যদিও শ্রীরামপুরের কোনো স্কুলে মেজদি পড়ায়নি। ও আরও বললো, চিকিৎসার সমস্ত খরচ মায়ের টাকাতেই হ’য়েছে; মায়ের কথামতো কটকের ক্যানসার হাসপাতালে একলাখ টাকা জমা ক’রবে। স্থানীয় সাঁইবাবার মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মেজদি ওখানের মেম্বার ব’লে, মন্দির থেকে মেজদির জন্যে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা ক’রবে। মেজদির ছেলেও আমাকে ফোন ক’রে জানালো, ১৫দিন পরে মেজদির শ্বশুরবাড়ীতে শ্রাদ্ধের পূর্ণ অনুষ্ঠান হবে।  
চল্লিশ বছর আগে মেজদির শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে আসার দিনটির থেকে এইদিনটি একেবারেই আলাদা।
 
বিবাহের পরম্পরা যতদিন থাকবে, ততদিন স্বার্থপর আমানুষেরা পরের ঘরের মেয়েদের সযৌতুক বউ হিসেবে ঘরে তুলে তাদের কেনা দাসী হিসেবে খরচ করার সুযোগ নেবে; মেয়েদের আত্মীয়স্বজনেরা ভাববে এটাই ভাগ্য, মেনে নিতে হবে।
                                                                              ******

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু