বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

উত্তরণ

 গল্প- উত্তরণ 

  শব্দসংখ্যা - 631 


         মৌ-এর স্বভাব ছিল, সকলের মন যুগিয়ে চলা । আসলে ওর সবসময়ই মনে হতো - এই বুঝি বৌদিরা কিছু মনে করলো, ওর কথাতে বোধহয় বন্ধুরা দুঃখ পেল, ইত্যাদি । আজকালকার মনোবিদরা হয়তো বলবেন - এটা একটা মানসিক সমস্যা । 


      তবে  এর একটা ভালোদিকও ছিল । কারণ ওর এই স্বভাবের জন্য সবাই ওকে ভালোমেয়েই বলতো । হায়ারসেকেন্ডারি পাশ করার আগেই মৌ তার বাবাকে হারালো । তিনদাদা - বৌদি যে যার মতো আলাদা সংসার করতে শুরু করলো । মায়ের সাথে তখন মৌ আর ছোড়দা- বৌদি থাকে। 


              বাবাকে হারিয়ে মৌ মনের দিক থেকে ভীষণ একা হয়ে পড়ল । তিনবৌদি আলাদা হলেও , বৌদিরা সকলেই একে অপরের বাড়িতে গিয়ে একজন অন্যজনের অসাক্ষাতে সমালোচনা করতো । এদিকে মৌও কলেজ ফেরত এক একদিন এক এক বৌদির বাড়িতে যেতো । বৌদিরাও মৌ এর কাছ থেকে অন্যদের সমালোচনামূলক খবরাখবর বের করার চেষ্টা করতো । কিন্তু মৌ কখনও একজনের কথা, অন্যজনকে বলতো না । কিন্তু মুশকিল হ'ল যখন বৌদিরা একে অন্যের অসাক্ষাতে নিন্দে - মন্দ আলোচনা করত, তখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের ঘরের ব্যাপার ঠিকই জেনে যেত । 


             একদিন ছোটবৌদি মৌকে বলল - তুমিই ঘরের সবকথা বড়দি, মেজদি, সেজদিকে লাগাও, নাহলে ওরা জানবে কি করে? মৌ মনে মনে ভাবে, সত্যিকথাটা সে যদি বলে , তাহলে সব বৌদিদের কাছেই সে অপ্রিয় হয়ে যাবে । মৌ উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল । 


              মৌ যখন ইউনিভার্সিটিতে এম. এ .পড়ছে, তখন ওর মা মারা গেলেন । বড়দা ওকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন । বিবাহযোগ্যা বেকার মৌকে নিয়ে বৌদিদের চিন্তা - আমি যদি মৌ এর সম্বন্ধ ঠিক করি, তাহলে অন্য দাদারা খরচ দেবে তো! ! ! 


            যথারীতি পাত্রপক্ষেরই এক আত্মীয়ের যোগাযোগের ভিত্তিতে মৌ এর বিয়ে হয়ে গেল । শ্বশুরবাড়িতে ভাশুর দেওর, দুই জা এবং দুই বড়ো ননদ নিয়ে বড়ো সংসার। 


       মৌ অবাক হয়ে দেখল, এখানে কেউ কারোকে তোয়াক্কা করে চলে না, উল্টে সকলেই ভাবে অন্যেরা তাকে তোয়াজ করে চলবে ।


            মৌ এখানে ব্যক্তিগত ভাবে কারোর প্রশংসা করলে, অন্যেরা তার ওপর রেগে যায় । মৌ এর যেহেতু মন যুগিয়ে চলা স্বভাব, সে যথাসাধ্য সকলকে খুশী করে চলার চেষ্টা করে । এর ফলে একটু ভুলভ্রান্তি হলেই সকলে ওর ওপরে মেজাজ দেখাতে থাকে । স্বামী ভালো হওয়া সত্ত্বেও সে তার নাগাল পায় না । এভাবেই মৌ এর দিন কাটছিলো । 


           বছরখানেক পরে মৌ এর মেয়ে- সন্তান জন্মালে, সে সন্তান, বড়ো সংসার সব সামলাতে গিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে । ননদরা হাসিমুখেই বলে - কি বৌদি, বেশ সারাদিন শুয়ে বসে বাচ্চা নিয়ে থাকো অসুখের ভান করে, ভালোই তো লাগে, কি বলো? 


           স্বামী সকালে অফিসের কাজে বেরিয়ে যায়, আসে রাত ন'টার সময় । তাকে এসব জানানোর ফুরসতই পায় না । মৌকে তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে, দেখা যায় ব্লাড প্রেসার  200 /120 ।প্রচণ্ড হাই প্রেসারের সাথে টেনশনজনিত কারণে অ্যাংজাইটি ডিস্অর্ডার । ডাক্তার প্রেসারের এবং ঘুম ও টেনশন চেকের  ওষুধ দিলেন । এভাবেই মনকে শক্ত করার মধ্যেদিয়েই মেয়েকে বড়ো করে তুললো মৌ । 


          মেয়ে চাকরীসূত্রে যখন ভিন্ রাজ্যে, তখন একদিন হঠাৎই মৌ এর স্বামী মারা গেলেন । মেয়ে মৌকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মৌ স্বামীর ভিটে ছেড়ে মেয়ের কাছে যেতে চাইল না। 


       এদিকে মৌকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে পরিবারের সকলেই তাকে একঘরে করে দিলো । প্রথমে মৌ সকলেরই পায়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করলো । তারপর ও মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলো । ঠিক করলো, আর কাউকেই ও মন যুগিয়ে চলবে না । কি আর হবে, কষ্ট বা মৃত্যু? ও আর কোনকিছুতেই ভয় করবে না । দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে না হয় আত্মহত্যাই করবে! 


            মনকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ায় সে । নাঃ, এখন আর ওর মনে অপরকে  তোয়াজ করার ভাবটা একদমই চলে গেছে । এখন মন খুলে সবার সাথে কথা বলতেও পারছে । 


           এখন সূর্যের আলো গায়ে মেখে নতুনভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত করল নিজেকে। বাইরের খোলা আকাশ, বাতাস, প্রকৃতির রূপ যেন নতুন জীবনের স্পন্দন নিয়ে এল মৌ এর জীবনে। বাইরের সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলল সেই সাধারণ মেয়েটা, যে কিনা ছোটবেলার থেকেই সকলের ভয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল এতদিন। 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু