বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

স্বপ্নে মানবিকতা

আশপাশের সবাইকে মানুষের মর্য্যাদা দেওয়াই মানবিকতা। সুভদ্রা কি বোঝে যে আমিও একজন মানুষ? দেখছিলাম স্বপ্ন মানবিকতার খোঁজে:-

সুভদ্রা আর আমি ক্যানসার হাসপাতালে গেছি শৈলজাকে দেখতে। লম্বা বারান্দা ধ’রে হাঁটছি শৈলজার রুমের দিকে; হঠাৎ কেউ ডাকলো- ‘সুভদ্রা..’; অমনি সুভদ্রা আমার হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেলো ওর দিকে, জিগ্যেস ক’রলো, ‘কল্যাণ, তুমি এখানে?’

সুভদ্রার ধাক্কা সামলে কোনমতে সোজা হ’য়ে দাঁড়ালো কল্যাণ। ফক্সট্রটের মিউজিক নেই, তালে তালে পা মেলানোর তাগিদ নেই; কল্যাণ হাত বাড়ালো সুভদ্রার কোমরের দিকে।

আমি দেখছিলাম বারান্দার ওদিক থেকে, মনের চোখে দেখছিলাম- ইণ্ডিয়ান টিউবের অফিসার্স ক্লাব, বলরুম ডান্সের তালিম শুরু হবে একটু পরেই। সুভদ্রাকে ব’লেছিলাম, ‘চলো ক্লাবে যাই, দুজনে নাচ শিখবো ওখানে।‘ সুভদ্রা ব’লেছিলো, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে নাচতে চাইনা; দরকার নেই আমার শেখার। আমি শুধু দেখবো তোমাদের।‘

ডান্স টিচার প্রথমে আমাদের শেখাচ্ছিলেন কথা ব’লে আর তার নিজের হাত-পা-কোমর নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী ক’রে; সুভদ্রা চুপচাপ ব’সেছিল চেয়ারে, আমরা বাকী সবাই ডান্স ফ্লোরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম ইন্সট্রাক্টরের কথা– পুরুষেরা যে যার স্ত্রীর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল; কেবল চারজন পুরুষের সঙ্গিনী ছিল না; দুজনের বিয়ে হয়নি তখনো, একজনের স্ত্রী বাপের বাড়ীতে; আর শেষজন আমি, স্ত্রী সুভদ্রা অনিচ্ছুক দর্শকের ভূমিকায়।

মৌখিক দীক্ষার শেষ, এবার শুরু হবে নাচ; যেই শুরু হ’লো ফক্সট্রটের টিউন, ঝাঁপ দিলো সুভদ্রা নাচের ফ্লোরে, ভাবলাম সুভদ্রা পাল্টেছে মত– জুটি বাঁধবে আমার সঙ্গে, না– দুরাশা আমার– সুভদ্রা জুটি বাঁধল ব্যাচিলর কল্যাণের সঙ্গে– আমি দাঁড়িয়ে রইলুম প্রতীক্ষায়।

সেই যে সুভদ্রা শুরু ক’রলো কল্যাণের সঙ্গে, চালিয়েই গেলো। আমি কোনোসময় নাচার সুযোগ পেতাম নাচ-শিক্ষয়িত্রী মহিলার সঙ্গে, কদাচিৎ কোনো বন্ধুপত্নীর সঙ্গে। নাচ শেখানোর ক্লাস যখন শেষ হ’য়ে গ্যালো, আমার কারুর সঙ্গে নাচার সুযোগ রইলো না একেবারেই; আমার সময় কাটতো বিলিয়ার্ড রুমে আর সুভদ্রার কল্যাণের সঙ্গে নেচে। এইভাবেই চললো তিন বছর– একটা ভালো কাজ পেয়ে কল্যাণ বাঙ্গালোরে চ’লে যাওয়া পর্য্যন্ত। আমি এখনও ভুলতে পারিনি কল্যাণকে ট্রেন-স্টেশনে বিদায় দেওয়ার কয়েকটা মিনিট– সব বন্ধুদের ঠেলে দূরে সরিয়ে সুভদ্রা গিয়ে দাঁড়ালো ট্রেণের জানলার পাশে, জোর ক’রে ধ’রে রইলো কল্যাণের হাত, ট্রেণ ছাড়ার আগে পর্য্যন্ত।….

 

বারান্দা ধ’রে হেঁটে এসেছি, এখন ওদের খুব কাছাকাছি। রোগীর পোষাকে কল্যাণকে রোগা দেখাচ্ছে;  জিগ্যেস ক’রলো, ‘তোমরা হঠাৎ এখানে?’

আমি তখন মাত্র একহাত দূরে; ব’ললাম, ‘কল্যাণ, ভাবিনি তোমার সঙ্গে দেখা হবে; আমরা এসেছি সুভদ্রার বন্ধুকে দেখতে ৩০৪নং ঘরে।‘

সুভদ্রাকে ব’ললাম, ‘বরং শৈলজাকে দেখে এসো; আমি কল্যাণের খবর নিই।

একটু পরে, কল্যাণকে নিয়ে চ’ললুম ৩০৪-এ, হাসপাতাল প্রতিবেশিনী শৈলজার সঙ্গে পরিচয় করাতে। ৩০৪-এ ঢুকে দেখি- শৈলজা ব্যস্ত মোবাইল ফোনে কথা ব’লতে আর সুভদ্রা হোয়াটসঅ্যাপে।

কল্যাণ ঘরে ঢুকতেই ঘুরে তাকালো দুই মহিলা; থামলো ফোন, স্থগিত হোলো হোয়াটসঅ্যাপ।

‘পরে কথা ব’লবো’– ব’লে ফোন কেটে দিলো শৈলজা; ‘কল্যাণ! তুমিও এখানে!’ বোঝা গেলো না কীসের উচ্ছ্বাস– পুরোনো ঘনিষ্ট বন্ধুকে কাছে পাওয়ার আনন্দে, না, বন্ধুর অসুখের দুশ্চিন্তায়।

‘তোমার ক্যানসার কোথায়?’ জিগ্যেস করলো শৈলজা।

‘প্রস্টেটে’, ব’ললো কল্যাণ, ‘তোমার?’

‘লিম্ফ নোডে’, শৈলজার উত্তর।

 

এরপর যতবার ওদের দেখতে এসেছি, একই ঘরে দেখেছি ওদের। হাজার গল্প আছে ওদের, একে অপরকে বলবার।

কল্যাণ আর শৈলজাকে আমরা আগেও দেখেছি, একসঙ্গে নয়, আলাদা আলাদা, দুজনেই না থেমে, কমা ফুলস্টপের বালাই না রেখে অনর্গল ব’কতে পারে। ওরা দুজনে একজোট হ’লে, কে ব’লবে আর কে শুনবে?

শৈলজার স্বামী বিক্রম আসতো শৈলজার খোঁজখবর নিতে। বিক্রম সাধারণতঃ বেশী বকবক ক’রেনা, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। শৈলজা-কল্যাণ দুজনে মিলে সুরু ক’রলে, বিক্রমের কথা বলার সুযোগ নেই।

কল্যাণের স্ত্রী আল্পনা মুশকিলে পড়তো কল্যাণকে বেডে দেখতে না পেয়ে, নার্সের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতো- কল্যাণ শৈলজার ঘরে। আল্পনা অত্যন্ত পতিব্রতা, নিখুঁতভাবে সেবা ক’রতো স্বামীর; কিন্তু স্বামীকে পরনারীর বিছানায় দেখা এক অসহ্য যন্ত্রণা।

আস্তে আস্তে সুভদ্রারও আগ্রহ চ’লে গেলো শৈলজা বা কল্যাণকে দেখতে যাবার; তাই সুভদ্রা কিছুটা সময় আমার সঙ্গে কাটাতে শুরু ক’রলো; যে কাজে আমাদের দুজনেরই আগ্রহ আছে, বেছে বেছে সেই কাজগুলো করা সুরু ক’রলাম– যেমন দুজনে মিলে স্ক্র্যাবল খেলা, দুজনে মিলে নাতি-নাতনীদের জন্যে বই লেখা ইত্যাদি।

 

প্রায়ই বিক্রম আর আল্পনা একই সময়ে হাসপাতালে আসতো; কিন্তু নিজের নিজের পার্টনারের উদাসীনতা দেখে, চলে যেতো হাসপাতালের রেস্তোরাঁয়। এদের দুজনের কেউই মিশুকে নয়, অনর্গল কথা ব’লতে পারে না; তবু পরস্পরের সঙ্গে কথা না ব’লে পারতো না; আলোচনা ক’রতো ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে, অনুযোগ ক’রতো শোনবার বা শোনাবার মতো কেউ নেই ব’লে।

কিছুদিন এইভাবে কাটানোর পরে, আল্পনা-বিক্রম দুজনেই বুঝলো এখন সময় এসেছে পরস্পরকে সাহায্য করার, একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর। প্রথম নিমন্ত্রণ এলো আল্পনার পক্ষ থেকে, বিক্রমকে ডাকলো মধ্যাহ্নভোজে; কল্যাণ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে বাড়ীতে একাই থাকতো আল্পনা, একমাত্র ছেলে ছিলো দিল্লীতে, তার বৌ আর দুবছরের মেয়েকে নিয়ে। কিছুদিন পরেই প্রত্যুত্তর জানালো বিক্রম; মাংসের টুকরো দিয়ে সুস্বাদু খিচুড়ী বানাতে পারে ও; খেয়ে আল্পনারও খুব ভালো লাগলো। বিক্রমও আজকাল একা ওর বাড়ীতে; একমাত্র ছেলে পিএইচডি ক’রছে আর একটা শহরে।

মাসদুয়েকের মধ্যেই দুই ক্যানসার রোগী, কল্যাণ আর শৈলজার মধ্যে সান্নিধ্য আর অন্তরঙ্গতা অনেক বেড়ে গেলো; সঙ্গে সঙ্গে বিক্রম আর আল্পনাও পরস্পরের নিকট আত্মীয় হ’য়ে উঠলো। একদিন আল্পনা বিক্রমকে একটা পরামর্শ দিলো, ‘জানিনা কবে আমাদের পার্টনাররা বাড়ী ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কিনা। তুমি আমার এখানে থাকা শুরু করো, ভাড়া দিয়ে দাও তোমার বাড়ীটা; মাসে মাসে কিছু টাকা আসবে।‘

বিক্রমের কাছে পরামর্শটা ভালোই লাগলো; নিজের নিজের পার্টনারের জন্য খরচ ক’রে ওরা দুজনেই প্রায় নিঃস্ব। বেশী দেরী না ক’রে বিক্রম এসে উঠলো আল্পনার আস্তানায়; বিক্রমের বাড়ীটা ভাড়া দেওয়া হ’লো; একবাড়ীতে থেকে পরস্পরকে সাহায্য ক’রে সংসার চালাতে গিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে একটা নতুন সম্পর্ক খুঁজে পেলো। যত দিন গেলো, ততই ভরসা ক’রে মনের কথা খুলে ব’ললো ওরা; পরস্পরের উপর আস্থা রেখে একে অপরকে ভালবাসলো; যত্ন নিলো ওরা দেহ-মনের; নিবিড় হ’লো দুজনের সম্পর্ক। শুরুতে বিক্রম থাকতো অতিথিদের ঘরে; মাস পার হবার আগেই আল্পনা ভাবলো কি দরকার রোজ দুটো আলাদা ঘরে বিছানা পাতার আর সকাল হ’লে বিছানা গুছিয়ে রাখার। ঠিক হ’লো বিক্রম রোজ রাতে আল্পনার সঙ্গে এক বিছানায় শোবে, যেমন কল্যাণ শুতো ক’মাস আগে। পরস্পরের পুরো শরীর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্য্যবেক্ষণ ক’রতো ওরা; ওদের দেখাশোনার গাফিলতির জন্যেই হয়তো ওরা পার্টনারদের ক্যানসার ধ’রতে পারেনি সময়মতো। ভালো ক’রে আল্পনাকে দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হ’য়েছে বিক্রম, অনেকটাই আলাদা শৈলজার থেকে,– ওর টলটলে আপেলের মত দুটো বুক, নরম ভারী নিতম্ব, এমনকি অন্দরমহলের দরজাটিও। আল্পনারও ভালো লেগেছে বিক্রমকে, বিশেষ ক’রে বিছানায়, ওর বুকে মাথা রেখে নিজেকে আলগা ক’রে দেওয়া যায়।

 

একদিন রাত ১০টা; আল্পনা আর বিক্রম বিছানায়; সোচ্চার হ’য়ে উঠলো দুজনের মোবাইল ফোন।

বিক্রম পেলো শৈলজার হোয়াটসঅ্যাপ:

‘প্রিয়তম, আমার আর বেশী দিন বাকি নেই। কাল সকালে রওনা হবো স্বর্গের পথে। এই যাত্রায় আমার সঙ্গী হবে কল্যাণ। আমি আধা-মিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার অ্যাকাউন্টে; ভালো থেকো। সুখে কাটুক তোমার বাকী জীবন।‘

কল্যাণ জিমেল পাঠিয়েছে আল্পনাকে:

‘প্রিয়তমা, আমি এসে পড়েছি  শেষ পর্য্যায়ে। কাল শুরু হবে আমার অনন্ত যাত্রা; এই যাত্রায় আমার সঙ্গে থাকবে শৈলজা। আমি $500,000এর চেক পাঠাচ্ছি; জমা দিও তোমার অ্যাকাউন্টে। শরীরের যত্ন নিও।‘

বিক্রম ওর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখালো আল্পনাকে; আল্পনা ওর জিমেল দেখালো বিক্রমকে।

‘ওরা, মনে হয়, স্বামী-স্ত্রী ছিল আগের জন্মে’, বললো বিক্রম; ঐকথাগুলোই আবার বললো আল্পনা; প্রতিধ্বনির মত শোনালো।

‘কাল আমাদের তাড়াতাড়ি উঠতে হবে; নটার মধ্যে পৌঁছোবো হাসপাতালে..’ ব’ললো বিক্রম।

‘অ্যালার্ম দিচ্ছি আমার মোবাইলে;’ জবাব দিলো আল্পনা, ‘তুমি ওদিক ফিরে শোও, আর আমি এদিক ফিরে; ভাবি নিজের নিজের পার্টনারের জন্যে। কী ক’রে যাবে ওরা স্বর্গে? হয়তো ইউথেনেশিয়া ক’রতে চলেছে।‘

বিক্রম ব’ললো, ‘যদি একই বিছানাতে ওরা দুজনেই দেহ রাখে, তবে ওদের একই বিছানায় দাহ করলে খরচ কম পড়বে। আমি ছেলেকে ডাকবো না শৈলজার মুখাগ্নির জন্যে– অন্য পুরুষের সঙ্গে মাকে দেখলে কী হবে ওর মনের অবস্থা?

‘আমিও ডাকবো না আমার ছেলে-বৌ-নাতনীকে’, ব’ললো আল্পনা, ‘ওরা ভাববে, আমি মেটাতে পারিনি কল্যাণের চাহিদা!’

 

বিক্রম আর আল্পনা সশব্যস্ত হ’য়ে দুটি বিরাট ফুলের তোড়া নিয়ে পৌঁছোলো হাসপাতালে; কিন্তু কল্যাণ বা শৈলজার কোনো চিহ্ন নেই; দুই কেবিনেরই দরজা খোলা, বেডগুলো অগোছালো, যেন রোগীরা বিছানা ছেড়ে কোথাও গেছে। বিক্রম আর আল্পনা গেলো হাসপাতাল কর্ত্তৃপক্ষের কাছে; ওদের কাছে কোনো হদিশ নেই শৈলজার বা কল্যাণের; ওদের কাছেই কর্ত্তৃপক্ষ প্রথম শুনলো- দুই রোগীর উধাও হ’য়ে যাওয়ার খবর।

আইনসঙ্গত পার্টনারদের কোনো হদিশ নেই ব’লে, বিক্রম আর আল্পনা ঠিক ক’রলো- একসঙ্গে থাকা চালিয়ে যাবে। ১২ বছর পার হবার পরে হয়তো আইন মেনে নেবে যে ওদের সঙ্গী/সঙ্গিনীরা ফিরবে না কোনোদিন, তখন ওরা বিয়ে ক’রবে। আল্পনা বাড়ীটা বি-এন-বিতে ভাড়া দিয়ে, অন্য এক পাড়াতে বাড়ী ভাড়া ক’রলো, বিক্রমও রইলো ওর সঙ্গে; নতুন পাড়ার প্রতিবেশীরা বিক্রম আর আল্পনাকে স্বামী-স্ত্রী ব’লেই ধ’রে নিল।

 

কী হোলো কল্যাণ আর শৈলজার? কেউ জানেনা ওরা মৃত না জীবিত, যদি জীবিত হয় তবে কোথায় আছে ওরা। এইভাবে ২ বছর কেটে গেলো; বিক্রম আর আল্পনা দুজনেই কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছে বহুদিন, সারাদিন পরস্পরকে রোজই যেন নতুন ক’রে চেনে; এমন সময় ওরা দুজনেই চিঠি পেলো যথাক্রমে শৈলজা আর কল্যাণের কাছ থেকে; চিঠিদুটোর বক্তব্য একেবারে একরকম:-

“প্রিয় বিয়ে-করা সাথী,

আর দুশ্চিন্তা ক’রোনা, নাও প্রাণভরা ধন্যবাদ। রয়েছি নেপালের এক স্বর্গে মনের মানুষকে নিয়ে। এখানে এসে স্বামী-স্ত্রীর মতোই রয়েছি হোটেলের সুইটে, নিশ্চিন্ত পরিতৃপ্তি নিয়ে।

তোমাকে ভুলতে পারবো না কখনও; অনেকবছর ধ’রে আমরা ঘর বেঁধেছি একসঙ্গে, গড়ে তুলেছি সংসার, নিজেদের বাড়ী-গাড়ী ক’রেছি, সৃষ্টি ক’রেছি নতুন প্রজন্মের, আমাদের ছেলের মধ্যে একসঙ্গে বেঁচে থাকবো আমরা আরো অনেক অনেক দিন। বাড়ী আর সম্পত্তি যা আছে তাতে তোমার ভালোই চলবে, দরকার পড়লে আমাদের ছেলেকেও সাহায্য ক’রতে পারবে।

দুজন শেষ পর্য্যায়ের ক্যানসার রোগী কিভাবে খালি হাতে নেপাল পাড়ি দিলো ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হ’চ্ছো; এরকম যে হোতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি কোনোদিন। যখন ডাক্তার জবাব দিলো, আমাদের সব আত্মীয়বন্ধুরা হাল ছেড়ে দিলো, আমরা ভাগ্যদেবতার উপর ভরসা ক’রে লটারীর টিকিট কাটা শুরু ক’রলাম– প্রতি সপ্তাহে একটা ক’রে, যদি কোনো দিন শিকে ছেঁড়ে– শৈশবের স্বপ্নগুলো সত্যি হয়। যখন জোয়ান ছিলাম কোনোদিন লটারীর টিকিট কাটিনি আমরা, ভেবেছিলাম নিজের হাতে গড়বো নিজের ভাগ্য। এখন যখন কিছু করার ক্ষমতা নেই, ভাবলাম সপ্তাহে ১০ ডলার খরচ ক’রলে আমরা গরীব হ’য়ে যাবো না। গরীব হইনি আমরা। একদিন আমরা এক কোটি ডলার জিতে গেলাম; রওনা হলুম পৃথিবীর সবচেয়ে খুশীদেশ নেপালে; ওখান থেকে মনের সুখে মোক্ষলাভের জন্যে। এক কোটি ডলার একবারে নেপালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; এখানের এক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে ওখানে ৯.৯৮ মিলিয়ন ডলার জমা ক’রলাম; বাকী কুড়ি হাজার ডলার দিয়ে কিনলাম নেপালে যাবার টিকিট আর ওখানে সপ্তাহদুয়েকের হোটেল বুকিং।

আমরা ভাবলাম আমাদের বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রীর অধিকার আছে আমাদের লটারীতে জেতা টাকাতে, বিশেষতঃ যখন উভয়েই জীবিত। যখন জানবো আমাদের দিন ফুরোবার বেশী বাকী নেই, তখন সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাবো আমাদের আইনসঙ্গত পার্টনারের হাতে।

আমরা মাত্র ৭ দিনের ওষুধ সঙ্গে নিয়েছিলাম, শীগ্গিরই ওষুধ ফুরোলো। কেমোথেরাপি হয়নি নেপালে আসার কয়েক দিন আগে থেকেই। মোক্ষলাভের অপেক্ষায় শুরু হ’লো আমাদের দুজনের দিন গোণা।

ঠিক তখনই হ’লো অলৌকিক আবির্ভাব এক যোগী পুরুষ মহানন্দের; উনি শেখালেন যোগব্যায়াম আর অতীন্দ্রিয় ধ্যান আমাদের আয়ু বাড়াবার জন্যে, তারই সঙ্গে দিলেন আয়ুর্বেদিক ওষুধ আমাদের শরীর থেকে ক্যানসার নির্মূল করার জন্যে।

এখন বুঝলাম আরও অনেকদিন বাঁচবো আমরা। ওখানের ব্যাঙ্ক থেকে ৯৯৮ মিলিয়ন ডলার নিয়ে এলাম নেপালে, জমি কিনে গড়ে তুললাম শুধু আমাদের আস্তানা নয়, যোগীদের উপাসনা করার জন্যে বিরাট মঠ, যেখানে মহানন্দ ও ওঁর শিষ্যেরা সাধনা ক’রতে পারে আরও অনেক অসুখের নিরাময়ের জন্যে; এঁরা এখন গবেষণা ক’রছেন DNA নিয়ে– কী ক’রে অসুস্থ জিন বদল ক’রে সুস্থ জিন আনা যায় শরীরে।

এখন আমরা দেশে ও বিদেশে অনেক বিজ্ঞাপন দিচ্ছি মরণাপন্ন ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা করানোর জন্যে। পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবস্থা ক’রে নিজের খরচে উড়ে আসতে হবে রোগী আর দরকার থাকলে তার নিকট পরিজনকে; প্রত্যেককে প্রতিদিন ১০০ ডলার ক’রে দিতে হবে মঠে থাকার জন্যে। ওষুধ আর পথ্যের জন্যে কোনো খরচ দিতে হবে না।

এই চিকিৎসা প্রকল্প শুরু হবার সময় নির্দেশ ছিল যে প্রত্যেক ক্যানসার রোগীকে একটা ফিরে যাবার বণ্ডে সই ক’রতে হবে– শরীর থেকে ক্যানসার নির্মূল হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে মঠ ছেড়ে নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই নিয়ম করা হ’য়েছিল নতুন রোগীদের থাকার জন্যে ঘরের ব্যবস্থা ক’রতে।

ইদানীং আমরা এক পুনর্বাসন গ্রাম গড়ে তুলেছি; রোগমুক্ত মানুষেরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে থাকতে পারে এখানে, যদি কেউ বাড়ী ফিরে যেতে না চায়। এই পুনর্বাসন গ্রামটি গড়ে তোলা হয়েছে পঞ্চাশের দশকের জীবনধারার ঐতিহ্য নিয়ে, এ গ্রামের মানুষদের যা দরকার তার অনেকটাই তৈরী হয় এই গ্রামেই কুটির শিল্পের মাধ্যমে; দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধর্মমত ও চিন্তাধারার মানুষেরা হাত মিলিয়ে কাজ ক’রছে গ্রামের জন্যে, পরস্পরের জন্যে; এই গ্রামে থাকার খরচ নিজেদের পরিশ্রমেই মিটিয়ে দিচ্ছে এখানের বাসিন্দারা।

যাতে মঠের এই চিকিৎসার সেবা অব্যাহতভাবে বৎসরের পর বৎসর চলতে থাকে, সেজন্যে মহানন্দ ও অন্য যোগীরা চিকিৎসায় তালিম দিচ্ছেন অনেককেই– শুধু আমরা দুজনে নয়, আরো অনেক আরোগ্য পাওয়া বিভিন্ন বয়সের মানুষ তালিম নিচ্ছি এখানের চিকিৎসক হওয়ার জন্যে। হয়তো একদিন পৃথিবী মুক্ত হবে ক্যানসারের অভিশাপ থেকে....’

 

….টেলিফোনের নিষ্ঠুর চীৎকারে ঘুম ভাঙলো আমার। সুভদ্রা বিছানা থেকে উঠে ফোন ধ’রলো, ‘গুড মর্নিং শৈলজা; ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো আমাদের প্রতি সপ্তাহের কফির আড্ডায়..........’

আমি উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে যখন ফিরলাম, তখনও সুভদ্রার কানে ফোন ধরা; ও চুপচাপ শুনে যাচ্ছে শৈলজার অনর্গল সংলাপ।

একটু পরে ফোন থামলে সুভদ্রা আমার দিকে মুখ ফেরালো, ব’ললো, ‘যত তাড়াতাড়ি পারো, রেডী হ’য়ে নাও। এখুনি আর-পি-এ হসপিটালে যেতে হবে...‘ 

তির্য্যক গত সাত মাস ধ’রে যুঝছে লিম্ফ নোডের ক্যানসার নিয়ে। আমি সুভদ্রার দিকে তাকালাম; ও ব’ললো, ‘রিমি একটু আগে জানিয়েছে, মাত্র কয়েক ঘন্টা আছে তির্য্যকের’,…

 

চমকে গেলাম। জানিনা ওপারে যাওয়ার দিন কখন আসবে আমার…..

সময় পাবো কি সবার মধ্যে মানবিকতা জাগিয়ে তোলার?

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু