বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

এক অন্য আভিজাত্য

সবেমাত্র শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করেছে দিঠী।যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান শেষে ঘরে এসে নিজেকে ওজনদার বেনারসী থেকে মুক্তি দিয়ে স্নান সেরে হালকা শাড়িতে জড়িয়ে আয়নার সামনে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছিল।এসি'টা চব্বিশে করা ছিল। দিঠি রিমোটের সাহায্যে আঠেরোতে নামিয়ে দিলো।ফাল্গুন মাসেই যা গরম। শীতকালে বিয়েটা করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। ঐ সময়ে ও কিংবা ওর বর সৌমক কেউই অফিস থেকে ছুটি আদায় করতে পারে নি। দিঠীর মা তো বলেই দিয়েছিলেন - বলিহারি যাই তোদের কাজের বহর দেখে। হ্যাঁ রে এবার থেকে কি অফিস ঠিক করে দেবে তোরা কখন কী করতে পারবি কী পারবি না?  হাসতে হাসতে দিঠী বলেছিল - সময়ের কাজ সময়ে শেষ না করে ফেলে রাখলে চলবে কেন মা ? বিদেশী ক্লায়েন্টরা তো তাদের কাজ বুঝে নেবেই। আমাদের বিয়ের জন্য কি বসে থাকবে ? তাছাড়া কাজের জায়গায় সবাইই কম বেশি কমপ্রোমাইজ করে। 


দিঠী খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। শাশুড়ি মা বলেই দিয়েছেন ওকে ঘরে এসে বিশ্রাম নিতে। তাই কেউ ওর ঘরের দিকে আসেনি কেবলমাত্র জলখাবারটা পৌঁছে দিয়ে যাওয়া ছাড়া। সৌমকও আসেনি । আগামীকাল সকালের আগে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ কালরাত্রি নাকি শুরু হয়ে গেছে

 তাই সে অন্য কোন ঘরে আপাতত। মাঝেমাঝেই হাসাহাসির শব্দ সাথে সৌমকের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে বাইরে কোন ঘর থেকে। সবাই বেশ গল্পের মুডে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে দিঠীর এখন কিছুক্ষণ একা থাকতেই ইচ্ছে করছে। যা ধকল গেছে। মাঝখানে একবার ওর শাশুড়ি এসেছিলেন ওর সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নিতে। দিঠী বলেছে সব ঠিক আছে। কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবে। সৌমকও মাঝে মাঝে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে বৌ অদর্শনে মনের আকুলতার বহিঃপ্রকাশ করে যাচ্ছে।  দিঠীও রসিকতার ছলে উত্তরে -অপেক্ষা করো বৎস। সবুরে মেওয়া ফলে লিখে পাঠিয়ে আপাতত একটা ফ্যাশান ম্যাগাজিন হাতে তুলে তাতে মনোনিবেশ করেছে। 


- এই তুমি কি এখন একটু ঘুমোবে ? দিঠী ঘার ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। ওর বড় জা পৃথা দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিঠী আঁচলটা ঠিক করতে করতে উঠে বসে বলে - না না। আমি যখন তখন ঘুমোতে পারি না। এসো না ভেতরে এসো। পৃথা ভেতরে এসে দিঠীর সামনে বেশ গুছিয়ে বসে খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা দুটো কথা বলার মাঝেই বলে ওঠে - এই তুমি আলমারিতে শাড়ি, জামাকাপড় সব গুছিয়ে ফেলেছ ?


- না গো। সুটকেসেই আছে। এখন ইচ্ছে করছে না।


- ভালোই করেছ। এখন থাক। সবাই চলে টলে গেলে বরং গুছিয়ো। বিশেষ করে কসমেটিক্স। একদম বের কোরো না। দিঠী অবাক হয়। বলে

- কেন বলো তো ?


- আরে আমাদের খুড়ি শাশুড়িকে দেখেছ তো ? ঐযে আশীর্বাদ করল তোমায় একটা ফিনফিনে সোনার চেইন দিয়ে। তাও ওটা সোনার না সোনার জল করা কে জানে। ঠোট ওল্টায় পৃথা। দিঠী চুপ করে শুনছে। পৃথা বলে - ঐ খুড়ি শাশুড়ির মেয়ে মুকুল আর তার ছেলে মেয়ে বুকান আর ডলি, এক্কেবারে হাড় হাভাতে। আমার যখন বিয়ে হয় তখন মুকুল রীতিমত বিবাহিত। দুই বাচ্চার মা। দেখেই বুঝেছিলাম তেমন ঘরে বিয়ে হয়নি মুকুলের। তাই বড্ড লোকের জিনিসের প্রতি ঝোঁক। বিয়ের পরের দিন এই বাড়িতে আসার পর আমিও তোমার মতো নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সেই সময়ে ঐ মুকুল আর ওর মেয়ে আমার ঘরে এসে হাজির। দুজনেই আগ বাড়িয়ে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে চাইলো। আমি কি আর তখন অতো বুঝেছি । তাই সুযোগ দিয়েছিলাম । ওমা সে দেখি মায়ের চোখ চকচক করছে আমার শাড়িগুলো দেখে তো ওদিকে মেয়ে তো আমার সাজগোজের জিনিস গোছাতে গিয়ে সব ব্যবহারই করে নেয় আর কি। সে যে কি মুশকিলেই না পড়েছিলাম। ঐ জন্য দেখলে না এইবার শাশুড়ি মা জোর গলায় বলল কেউ যেন তোমার ঘরে না আসে, সে তো ওদের শুনিয়ে শুনিয়েই।যখনই আসে কিছু না কিছু বাগিয়ে নিয়ে যায়। দিঠী চুপ করে সব শুনল। তবে সে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে তা ঠাওর করতে না পেরে পৃথা -পড়ে আবার কথা হবে। এখন যাই।  তুমি বরং বিশ্রাম নাও। কিছুক্ষণ পরেই লাঞ্চের জন্য তোমাকে ডেকে নিয়ে যাব, কেমন ? বলেই সেখান থেকে নিজেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে গেল।


পৃথা চলে যেতেই দিঠী খাট থেকে নেমে কসমেটিক্সের বাক্স টা আলমারিতে ঢুকিয়ে চাবি ঘুরিয়ে আলমারি বন্ধ করে চাবির গোছা বালিশের নিচে রাখল। জামাকাপড় ঠাসা ট্রলিটাও এক কোণে ঠেলে দিলো। হয়ত পৃথার কথা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে ওর মস্তিষ্কে নয়ত ক্লান্তিতে এখনই কিছু গোছানোর ইচ্ছে হচ্ছে না ওর। কে জানে।


সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে বসে মোবাইল ঘাঁটছিল দিঠী।তার কিছুক্ষণ আগে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর থেকেই বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজন  ঘিরে বসেছিল দিঠীকে বসার ঘরে। পৃথাও ছিল। তবে মুকুল বা তার ছেলেমেয়ে কেউ ছিল না।তারপর বেশ খানিকক্ষণ গল্প গুজবের পর যে যার কাজেও চলে গেছে।দিঠীও ফিরে এসেছে নিজের ঘরে।  এরই মধ্যে একটা রিনরিন কণ্ঠস্বরে দরজার দিকে তাকায় দিঠী। 


- ভেতরে আসব মাইমা ? ডলি দাঁড়িয়ে আছে দরজার ফাঁকে।


সারাদিনের এই সময়টুকুর মধ্যে বাড়ির আত্মীয়দের সাথে আলাপ পরিচয়টা ভালোই হয়ে গেছে দিঠীর। তবে মুকুলের সাথে তেমন কথাবার্তা হয়নি। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো তাকে সকলের ফরমায়েশ খাটতে দেখা গেছে। বুকান সদা হাস্য মুখে কতবার যে দোকান বাজার ঘর করলো তার ইয়ত্তা নেই। মুকুল তো তার মধ্যেই বলছিল - ঠিকঠাক করে সব কাজ করবি বুঝলি? দাদু, মামাদের যেন তোর জন্য লজ্জিত হতে না হয়। পৃথা দিঠীর কানের কাছে মুখ এনে বলে - খোশামোদ করা তো কেউ এদের থেকে শিখুক। কাজকর্ম করে দিয়ে জিনিস আদায় করার মতলব। দিঠী তখন মুগ্ধ হয়ে জানলা দিয়ে দেখছিল বাইরে সিমেন্টের উঠোনে ডলির আলপনা দেওয়া।


দিঠী হাসিমুখে বলল - হ্যাঁ এসো। ডলি দিঠীর সামনে খাটের উপর বসে। ওর মুখে হালকা হাসির আবরণ। দিঠীর দিকে তাকিয়ে থাকে ডলি। দিঠী জিজ্ঞেস করে - কী দেখছ ?

- তোমাকে। খুব সুন্দর দেখতে তুমি। 

- তোমার আলপনাও খুব সুন্দর। তুমিও।

প্রশংসায় তেমন প্রলোভিত হলো না ডলি বোঝাই গেল। বলল - গতকাল তোমাকে খুব ভালো লাগছিল। 

- আমার বান্ধবী মেক-আপ আর্টিস্ট। ও'ই সাজিয়েছিল। কালও সাজাবে।


- আমারও না খুব ইচ্ছে মেক-আপ আর্টিস্ট হওয়ার। তবে টাকাটা একটু বেশি লাগে। বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। 


প্রমাদ গোণে দিঠী। পরবর্তী শব্দগুলোর অপেক্ষায় থাকে।ওর কাছে আসার কারণটা মনে মনে ধারণা করে নেয়। প্রয়োজনে সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই হাত উপুড় করতে দ্বিধা বোধ করবে না দিঠী। এমন কতজনকে নিজের উদারতা দেখিয়েছে ও। মাসতুতো পিসতুতো ভাইবোনদের একমাত্র আবদারের জায়গাতো ও'ই। দিঠী তাদের ইচ্ছে পূরণ করেছে আর তারা করেছে দিঠীর গুণকীর্তন। দিঠী অন্তরে অভ্যন্তরে ডলিরও ইচ্ছে পূরণের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

ডলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে - টিউশনির টাকা থেকে একটু একটু করে জমাচ্ছি জানো। আশা করছি সামনের বছর নিজের টাকাতেই ভর্তি  হতে পারব। দিঠীর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ডলির দিকে। ও বলল - কার কাছে শিখবে বলে ঠিক করলে ?

- এখনো কিছু ঠিক করিনি। সবাই এতো ভালো। ঠিক করতে গিয়ে কেমন যেন গুলিয়ে ফেলি। কি নরম সুরে কথাগুলো বলে যাচ্ছে ডলি। - তুমি এখনো কিছু গোছাওনি মামি? ড্রেসিং টেবিলও তো ফাঁকা। আমি গুছিয়ে দেবো ?


দিঠী যেন আরও কিছু দেখতে চায়। ও দেখতে চায় ডলি কিভাবে সবকিছু গোছাতে গোছাতে হাতিয়ে নেওয়ার মতলব করে। কেমন ওর চোখ লোভে চকচক করে ওঠে ঠিক যেমনটা পৃথা বলে গেছে। বালিশের নিচে থেকে চাবিটা বের করে ডলির হাতে দিয়ে আলমারি দেখিয়ে দেয় দিঠী। 


জামাকাপড়গুলো পরিপাটি করে গোছালো বটে ডলি তবে ওর চোখের কোলে লোভের চকচকানি নজরে পড়ল না তো দিঠীর। এমনকি বিদেশী প্রসাধনগুলোও প্রলোভিত করতে পারল না ডলিকে। দিঠী বলল - তোমার পছন্দ মতো কিছু নিয়ে নিতেই পারো ওখান থেকে। অন্তত একটা লিপস্টিক। 


- না গো। কী হবে বলো অতো দামী জিনিস নিয়ে। কোথায় আর যাই এমন যে ব্যবহার করব। শুধু শুধু পড়ে থেকে নষ্ট হবে। এমনিতেও বাবা বেশি সাজগোজ পছন্দ করে না। তোমাদের বিয়েতে ব্যবহারের জন্য পাড়ার সুকুমার দা'র দোকান থেকে তিরিশ টাকা দিয়ে একটা লিপস্টিক কিনেছি, খুব সুন্দর রঙ'টা, দেখবে? বলেই ডলি একটা হাতে বানানো অতি সাধারণ বটুয়া থেকে দিঠীর খাটের ওপর বের করে রাখল কয়েকটা ততোধিক সাধারণ কয়েকটি প্রসাধন সামগ্রী। এ যেন এক অন্য আভিজাত্য। খাটে পড়ে থাকা তিরিশ টাকার লিপস্টিক,  কুড়ি টাকার নেইলপলিশ আর দশটাকার কাজলের কাছে দিঠীর দামী বিদেশি সামগ্রীর জৌলুসও যেন ফিকে হয়ে আসছে। দিঠী এতক্ষণে ডলির চোখদুটো চকচক করতে দেখল বটে তবে লোভের জন্য নয় আত্মতুষ্টির জন্য। দেখা শেষ হতে ডলি আবার জিনিসগুলো বটুয়াতে ভরে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দিঠী পিছন থেকে ডাক দেয় - ডলি শোনো। ডলি ঘুরে দাঁড়ায়। দিঠী বলতে চাইল বটে-আমার বান্ধবীকে সুপারিশ করলে ও তোমায় বিনা পয়সায় মেক-আপের কোর্স করিয়ে দেবে। কিন্তু কথাটা কিছুতেই বলে উঠতে পারল না ও। ডলির আত্মসম্মান বোধটা যে দিঠীর কাছে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়েছে। তাই ও শুধু বলল - কাল আমার বান্ধবী যখন আমাকে সাজাবে তখন তুমিও থেকো সাথে। আমার ভালো লাগবে। ডলি হালকা হাসে। ওর হাসিতে কি করুণা ধরা পড়ল ? ওর জন্য দিঠীর কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা নজরে পড়ল কি ডলির তাই কি শুধুমাত্র দিঠীকে খুশি করতেই ও যাবার আগে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে গেল ? হয়ত হ্যাঁ ...হয়ত বা নয়। তবে পৃথার একটা কথা সত্যি লাগে দিঠীর কাছে। ডলি,মুকুল আর বুকানের মতো মানুষেরা বাগিয়ে নিতে পারে নিজেদের জন্য কিছু না কিছু আর সেটা হলো স্ব-সম্মানে  মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার। যা যে কোন মূল্যবান পার্থিব বস্তুর থেকেও অনেক বেশি দামী। ডলি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হল পৃথার প্রবেশ। প্রায় হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করল - এই ডলিকে দেখলাম তোমার ঘর থেকে বেরোল। কী বলছিল গো এসে ? নিশ্চয়ই কিছু চেয়েছে। তুমি কিছু দিয়েছ নাকি? দিঠী অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল - কী দেব বলো তো ওকে? আছে কী আমার ওকে দেবার মতো। বরং ও'ই আমাকে কিছু দিয়ে গেল। 

- ও আবার তোমাকে কী দিয়ে গেল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পৃথা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দিঠী বলল - শিক্ষা। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথার মাথায় কিছু ঢুকল না। সে কেবল ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করল আর দিঠী পৃথার রকম সকম দেখে মনে মনে হাসল।

**************                      

ছবি-গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু