বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

খোকা বড় হ’য়ে গেছে, আর স্কুলে যেতে হবেনা। হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষাও শেষ। এখন রেজাল্ট বেরোনোর পরে কলেজে ভর্ত্তি হ’তে হবে তিনমাস পরে। খোকা ভাবলো এই তিনমাসে ওকে সাবালক হ’য়ে উঠতে হবে। পাশের বাড়ীর খেয়াও এবারে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা দিয়েছে; তার সঙ্গে দেখা ক’রে খোকা ব’ললো, ‘দ্যাখ খেয়া, আমরা দুজনেই এতদিন বাড়ীতে একা একা পড়াশোনা ক’রেছি; তুই বেলতলা স্কুলে মেয়েদের সঙ্গে পড়েছিস, আর আমি মিত্র-স্কুলে ছেলেদের সঙ্গে। তিন মাস পরে যখন আমরা কলেজে যাবো, তখন আমাদের ক্লাসে ছেলে মেয়ে দুই-ই থাকবে। তাই আমাদের অচেনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেশবার ট্রেনিং নিতে হবে।‘

খেয়া বললো, ‘তাহ’লে, আমি আমার স্কুলের পাঁচজন মেয়েকে ডাকি, আর তুই তোর স্কুলের পাঁচজন ছেলেকে ডাক; আমরা বারোজন ছেলেমেয়ে নিয়মিত মেলামেশা শুরু ক’রি। দরকারমতো আমরা ছোটো ছোটো টিম তৈরী ক’রতে পারি কোনো বিশেষ প্রোজেক্টে কাজ করার জন্যে।‘

 

দুদিন পরেই পাঁচজন বন্ধুকে নিয়ে খোকা হাজির হ’লো পাড়ার পার্কের হলঘরে; মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে ছেলেরা খুবই আগ্রহী। কিছক্ষণ পরে খেয়াও হাজির হ’লো; ওর পাঁচ বান্ধবীও উৎসুক চোখে দেখলো ছেলেগুলোকে।

পরস্পরের পরিচয় বিনিময়ের আগেই খোকা ব’লে উঠলো, ‘আমরা আজ এখানে জড়ো হ’য়েছি বড়ো হবার জন্যে, আমরা সবাই হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা দিয়েছি; আশা ক’রি পাশ ক’রবো। তারপরে হয় আমরা কলেজে ভর্ত্তি হবো, নয়তো কোনো চাকরীতে জয়েন ক’রবো। যেখানেই যাই, এক বা একাধিক অচেনা পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ ক’রতে হবে। আজ আমরা এখানে প্রত্যেকে এক অচেনা লোকের সঙ্গে আলাপ ক’রে কাজ ক’রতে শিখবো।‘

কাজ করার জন্যে উৎসাহ থাক্ বা না থাক্ অচেনা মেয়েদের সঙ্গে গল্প করার জন্যে ছেলেরা উসখুস ক’রছিল; তেমনই মেয়েদের আগ্রহেরও কোনো ঘাটতি ছিল না সমবয়সী ছেলেদের চেনবার জন্যে।

 খোকা ব’ললো, ‘মেয়েরা প্লীজ প্রত্যেকে একটা ক’রে ছেলেকে ডেকে নাও, আর তার সঙ্গে আলাপ জমাও। এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তৈরী হবে একেকটা টিম। টিমগুলো খেলবে নানান ধরণের কাজে বা প্রোজেক্টে।‘

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরী হ’য়ে গেলো ছ-টি টিম: খোকা-খেয়া, কাবলী-কায়া, টেনি-রিমি, শুভেন-ইরা, অমর-আভা, এবং বুয়া-ব্রততী।

 

এবারে টিমগুলো ভাবছিল কী ক’রবে ওরা – বেড়াতে গেলে হয় দল বেঁধে; ঘোরার খরচ জোগাড় ক’রতে হবে; নতুন টিম-মেটের সঙ্গে এক রুমে থাকলে হোটেল খরচ কম হবে; ট্যাক্সিতে দুটো টিম একসঙ্গে যেতে পারবে। কেউ একজন ব’ললো, ‘বিদেশে যাবো’। উত্তরে খোকা ব’ললো, ‘দেখছি সবাই বিদেশে ঘুরতে চায়; আমি শুধু বিদেশে ঘুরতে চাইনা, সেখানে থেকে কাজ ক’রতেও চাই। এর জন্যে দেশ-বিদেশের যতো সীমারেখা সব মিটিয়ে দিতে চাই। এসো কাল থেকে আমরা সুরু ক’রবো এই কাজ- এখানেই।‘

 

পরের দিন, সব বিদেশকে স্বদেশ ক’রে নেবার সভায় খোকা ব’ললো,

‘আমরা সবাই পৃথিবীর নাগরিক হ’তে চাই।

‘ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্স, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ - পৃথিবীর সমস্ত দেশ মিলে হোক একটি প্রতিষ্ঠান - পৃথিবী।  পৃথিবীর যে কোনো নাগরিক এই প্রতিষ্ঠানের যে কোনো দেশে বাস করার অধিকার পাবে, পাবে যে কোনো দেশে খেটে কাজ ক’রে রোজগার করার অধিকার।

‘এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়ার জন্যে দরকার হবে না ভিসার, দরকার হবে না কাজ করার অনুমতিপত্রের।

 ‘আমরা ভাবনা-চিন্তা-যুক্তি-তর্ক-আলোচনা ক’রে বের ক’রবো এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ নিয়ে যাবার কী কী উপায় আছে।‘

এখানে সকলের ধ্যান-দৃষ্টি নিবদ্ধ একই লক্ষ্যে - ‘পৃথিবী একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান’। কী ক’রে হবে এই পৃথিবীমাতার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা?

 

দেশের সীমানা ছাড়াই ‘এক পৃথিবী’ বা ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত কী কী করা হ’য়েছে খোকা তার ইতিহাস পর্যালোচনা ক’রলো বন্ধুদের সঙ্গে। ১৯৪৩সালে প্রকাশিত ওয়েনডেল উইলকির লেখা ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ বইটি ওরা মন দিয়ে পড়লো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্ট্যালিন, চিয়াং কাই-শেক, জেনারেল মন্টগোমেরি, জেনারেল চেন্নাল্ট ইত্যাদির সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, যুদ্ধের পরে পৃথিবীকে এক প্রতিষ্ঠান করার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল এই বইটি; বিশ্ব সরকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোচনা ছিল।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটা বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায়, অনেকগুলি সংস্থা চেষ্টা ক’রেছিল যাতে বিশ্বযুদ্ধ আর না হয়। ১৯৩৭সালে দুই বিখ্যাত নারীবাদী শান্তি-প্রেমী, শান্তিপূর্ণ, সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী রোজিকা শুইমার এবং লোলা মাভেরিক লয়েড প্রথম বিশ্ব ফেডারেলবাদী সংস্থার প্রতিষ্ঠা ক’রেছিলেন।  ১৯৪৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব-সরকারের একটি সংবিধানও প্রণীত হ’য়েছিল।
প্রাক্তন ব্রডওয়ের নাচ-গানের কলাকার, সল গ্যারেথ 'গ্যারি' ডেভিস, নিজেকে প্রথম বিশ্ব-নাগরিক হিসাবে ঘোষণা ক’রেছিলেন। মার্কিন নৌবাহিনীর হ’য়ে লড়াই করার সময় তার বড় ভাই মারা গেলে গ্যারি শান্তির প্রচার শুরু করেন। গ্যারি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর যোদ্ধা; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিমানবাহিনীর নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে অনেকেই নিহত হচ্ছেন। ১৯৪৮সালের ২৫শে মে প্যারিসের আমেরিকান দূতাবাসে প্রবেশ ক’রে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব ত্যাগের ঘোষণা করেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের অবাক ক’রে দিয়ে তিনি নিজেকে বিশ্বের নাগরিক হিসাবে ঘোষণা ক’রলেন। ১৯৬০সালে প্রকাশিত ‘My Country is the World’ বইটিতে তিনি লিখেছেন: ‘সবচেয়ে মারাত্মক সীমারেখা মানুষের নিজের হাতে আঁকা - জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম। তুমি এবং আমি মানুষ হিসেবে বন্ধু হ’তে পারি, কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ আলাদা। আমি তাই স্বেচ্ছায় আমেরিকান নাগরিকত্ব এবং জাতীয় রাষ্ট্রের সহ-অংশীদারিত্ব বর্জন ক’রে নিজেকে বিশ্ব-নাগরিক হিসাবে ঘোষণা ক’রেছি’।
খোকা তার টিমগুলিকে ব’ললো: ‘আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে আমাদের কাছে এতো অস্ত্র, গোলাবারুদ, ও অর্থের সংস্থান নেই যেমন উইন্ডেল উইলকি আর গ্যারি ডেভিসের ছিল। তাই যৎসামান্য পরিবর্তন ক’রে অসামান্য ফল পেতে হবে আমাদের। সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা না ক’রেও, আমরা জিতবো অহিংস আইন-অমান্য আন্দোলন দিয়ে’।
 

তরুণ টিমগুলির প্রথম রাজনৈতিক পদক্ষেপ শুরু হ’লো একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠা ক’রে – সংস্থার নাম ‘জপ’ অর্থাৎ ‘জগৎ-পরিবার’ – পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা ক’রবে ‘জপ’ অর্থাৎ ‘জগৎ-পরিবার’ World Organisation [WO] । ‘জপ’-এর দায়িত্ব এবং কর্ম্মসূচীর অনেকটাই মিলবে ইউ-এন-ও এর দায়িত্ব এবং কর্ম্মসূচীর সঙ্গে। কোন্ দেশের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ‘জপ’? ‘জপ’ কি একটি বহু-জাতিক ব্যবসায়ী সংস্থা হবে এবং বহু দেশের ব্যবসায়ীদের তালিকায় ‘জপ’-এর নামের নিবন্ধীকরণ হবে?

টিমগুলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো দেশের ব্যবসায়ীদের তালিকায় ‘জপ’-এর নামের নিবন্ধীকরণের প্রয়োজন নেই।  ফেসবুক বা লিঙ্কড-ইন এর মত পৃথিবীর যে কোনো দেশের মানুষ দেশ-ধর্ম নির্বিশেষে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, বয়স-স্বাস্থ্য নির্বিশেষে, স্ত্রী-পুরুষ, বিবাহিত-অবিবাহিত, বিজ্ঞ-মূর্খ সকলেই ‘জপ’-এর কর্মী হ’তে পারে কেবল দৃঢ় বিশ্বাস চাই ‘পৃথিবী একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান’ – এর মন্ত্রে।  কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার কাজ সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মীর মধ্যে, এরাই স্থির ক’রবে কর্মীদের নির্বাচন এবং বহিষ্করণ – যাতে ‘পৃথিবী একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান’ এর মন্ত্র থেকে ‘জপ’ বিচলিত না হয়।

ঠিক হ’লো ‘জপ’ প্রত্যেক দেশের ভিসা এবং কাজের অনুমতি-পত্র দেওয়ার আইন বিশ্লেষণ ক’রবে।  ‘জপ’-এর  বিচারে যে দেশে প্রবেশ করা এবং সেখানে থেকে কাজ করার নিয়ম কঠিন এবং ব্যয়সাপেক্ষ ব’লে নির্দ্ধারিত হবে সে দেশকে ‘জপ’ অনুরোধ ক’রবে নিয়ম শিথিল করার জন্যে। এর পরেও যদি সেই দেশ ভিসা আর কাজের অনুমতি-পত্র দেওয়ার আইন শিথিল না করে, তবে ‘জপ’ শুরু ক’রবে আইন অমান্য করার গণ-আন্দোলন। কিন্তু কে হবে এই গণ-আন্দোলনের উদ্যোক্তা? কী ক’রে সম্পন্ন হবে এই উদ্যোগ? শিবিরের প্রতিটি সদস্য পেছিয়ে গেলো ব্যর্থতার ভয়ে – গণ-আন্দোলন করার সময় ধরা পড়লে হয়তো বাকি জীবন কাটবে সশ্রম কারাদণ্ডে। কোর্ট-কাছারীতে মামলা ক’রতে ক’রতে হয়তো দেউলে হ’তে হবে। অনেকেই হয়তো সশস্ত্র পুলিশের অত্যাচারে নিহত হ’বে বা জীবনভর পঙ্গু হ’য়ে থাকবে। অনেকেই হ’য়তো কাজ থেকে হ’বে বরখাস্ত; সারাজীবন থাকবে বিপর্য্যস্ত, পর্যুদস্ত হ’য়ে। কোনো কার্য্যকরী সমাধান সম্ভব হ’লো না শিবিরে; কেবল পাওয়া গেলো প্রতিশ্রুতি আইন না ভেঙ্গে কিছু করার জন্যে - ‘পৃথিবী একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান’ গড়ার জন্যে। খোকা হৃদয়ঙ্গম ক’রলো তার এমন কিছু কর্ম্মী চাই যারা সমস্ত স্বার্থকে বলি দিতে পারবে নতুন জগতের স্বপ্নকে রূপায়িত করার জন্যে। খোকা ভাবলো তার পুরোনো বন্ধু বীরু এ যুগের গান্ধী হ’তে পারে অহিংস গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগে।

খোকা নিজেও পারবে না তার জীবন উৎসর্গ ক’রতে তার স্বপ্নের জগৎ গড়ে তোলার জন্যে; এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই খেয়ার। বাকী টিমগুলির অবস্থাও কিছু আলাদা নয়; তাদের প্রত্যেককেই ভাবতে হবে বাড়ীর কথা, পরিবারের কথা; ‘জপ’-এর জন্য নিজের সময় বা নিজের টাকা খরচ ক’রতে কেউ রাজী নয়; বুয়া আর ব্রততী এখন পরস্পরকে বাঁধতে চায় বিবাহের বন্ধনে, তাদের দুজনের ছোট্ট জগৎ তাদের কাছে অনেক দামী; ‘পৃথিবী একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান’ গড়ার জন্যে তাদের ছোট্ট জগৎকে হারাতে চায় না। খোকা তার স্বপ্নের ছবি দেখাল বীরুকে; বীরু সাড়া দিল অনায়াসে, অবিলম্বে। বীরু বুঝলো ‘জপ’-এর সবচেয়ে আগে চাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

বীরু ট্বুইটার ফেসবুকের সামাজিক কথোপকথনে সবিশেষ অভ্যস্ত, পৃথিবীর বহু নাগরিকের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার সম্পর্ক। আল্ট্রালাইটের প্রচার পরিচালকের সহায়তা নিয়ে একটা ১০-মিনিটের ভিডিয়ো তৈরী ক’রলো খোকা; এই ভিডিওতে খোকা দেখালো ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা পৃথিবীর মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ষোগাযোগ রাখছে নিজের আত্মীয়, বন্ধু, শুভাকাঙ্খী সহকর্ম্মীর মত। পৃথিবীর নাগরিক যদি পৃথিবীর যে কোনো অংশে থাকতে এবং পৃথিবীর যে কোনো অংশের জন্যে কাজ ক’রতে পারে, তবে সারা পৃথিবীর মানুষ পরস্পরের উপর আস্থা রেখে আরো ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। ট্বুইটার এবং ফেসবুকে এই ভিডিও প্রকাশ করার সাত দিনের মধ্যেই প্রায় এক কোটি মানুষের সাড়া পেলো বীরু পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে; দশ লাখ মানুষ এগিয়ে এলো বীরুর সঙ্গে সক্রিয় অহিংস আন্দোলনে যোগ দিতে। এতদিন বীরুর সমস্ত কার্য্যকলাপ, গণ-আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল স্বদেশের গণ্ডির মধ্যে; এই প্রথম বীরু স্কাইপের আলোচনা শুরু ক’রলো দেশ বিদেশের উৎসাহী নাগরিকদের সঙ্গে – কে কতটা নির্ভরযোগ্য – কোন কাজের জন্য কে উপযুক্ত – একদল সক্রিয় অহিংস সংগ্রামীকে নিরাপদে অথচ কার্য্যকরীভাবে পরিচালনা করার জন্যে সেনাপতির দায়িত্বে কে কে আস্থাভাজন হবে – ছোট বড় অনেক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে বীরু স্কাইপ ক’রে চললো হাজারেরও বেশী মানুষের সঙ্গে। নির্বাচিত সেনাপতিরা আরও ইন্টারভিউ চালালো তাদের সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্যে। সারা পৃথিবী জুড়ে জাল ফেললো বীরুর সংগঠিত ‘জপ’- সেনাবাহিনী।

বীরু আর তার মন্ত্রী–সেনাপতিরা রচনা ক’রলো ‘জপ’-এর সংবিধানের শ্বেতপত্র; বিভিন্ন দেশের লোক সরবরাহ বা মানুষ পাচার করার সমস্ত সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শুরু ক’রলো ‘জপ’। মানুষ পাচারের নানা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু হ’লো – (১) নৌকা বোঝাই ক’রে বিদেশে লোক পাচার, (২) বিনা অনুমতিতে বিমান থেকে ছত্রী বাহিনীর অতর্কিত অবতরণ, (৩) বিদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্র, (৪) মানুষ এবং জিনিষের বেআইনী সরবরাহের জন্যে দুই দেশের সীমারেখার নীচে গুপ্ত সুড়ঙ্গ, (৫) বেআইনী সীমা পেরিয়ে ভিসা ছাড়াই একদেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া।

বিভিন্ন সন্নিহিত বা লাগোয়া দেশের মধ্যে স্থল-সীমারেখার পরিসংখ্যান সংগ্রহ ক’রলো বুয়া আর ব্রততী। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থল সীমারেখা আছে। দীর্ঘতম স্থল সীমারেখা কানাডা আর আমেরিকার মধ্যে – ৮,৮৯১ কি.মি.।

দুই দেশের মধ্যে একটানা সীমারেখার দৈর্ঘ্য নীচে দেওয়া হ’লো:

কাজাকস্তান আর রাশিয়া – ৬,৮৪৬ কি.মি.

কানাডা আর ইউ-এস-এ - ৬,৪১৪ কি.মি.

আর্জেন্টিনা আর চিলি –    ৫,১৫০ কি.মি.

প্রতিটি পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্যে যত স্থল-সীমারেখা আছে পৃথিবীর মানচিত্রে সব মেপে দেখলো বুয়া আর ব্রততী। আমেরিকা যু্ক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর মধ্যে স্থল-সীমারেখা ৩,১৪১ কি.মি.। বীরু পরিকল্পনা ক’রলো এই সীমারেখার দুইপাশে ‘জপ’-এর কর্মীরা বাড়ী তৈরী ক’রবে। এক কর্মীর বাড়ী হবে মেক্সিকোতে, আর এক কর্মীর বাড়ী আমেরিকা যু্ক্তরাষ্ট্রে। এই দুই বাড়ীর ভিতের তলায় গড়ে তোলা হবে চোরা সুড়ঙ্গ যাতে মানুষ আমেরিকা যু্ক্তরাষ্ট্রের বাড়ীতে ঢুকে সুড়ঙ্গ দিয়ে মেক্সিকোর বাড়ীতে পৌঁছায়, সেখান থেকে মেক্সিকোর যে কোনো জায়গায় যেতে পারে। অন্য দিক থেকে চলা শুরু ক’রলে -  মানুষ মেক্সিকোর বাড়ীতে ঢুকে সুড়ঙ্গ দিয়ে আমেরিকা যু্ক্তরাষ্ট্রের বাড়ীতে পৌঁছাবে, সেখান থেকে আমেরিকা যু্ক্তরাষ্ট্রের যে কোনো জায়গায় যেতে পারে। এই ধারণের ৩০০ জোড়া বাড়ী যদি তৈরী হয় ৩,১৪১ কি.মি. সীমারেখার দুইপাশে, তবে ৩০০টি পথ থাকবে এদেশ থেকে ওদেশে যাওয়ার জন্যে। দরকার মতো ‘জপ’-এর কর্মীরা এদেশ থেকে ওদেশে যাওয়া আসা ক’রবে।

ঠিক এইভাবেই অজস্র সুড়ঙ্গ-জোড়া বাড়ী তৈরী হবে নর্থ কোরিয়া আর পিপ্লস্ রিপাবলিক অফ চায়নার ১,৪১৬কিমি সীমারেখার দুইপাশে, নর্থ কোরিয়া আর সাউথ কোরিয়ার ২৩৮কিমি সীমারেখার দুইপাশে, নর্থ কোরিয়া আর রাশিয়ার ১৯কিমি সীমারেখার দুইপাশে। ঠিক এইভাবেই অজস্র সুড়ঙ্গ-জোড়া বাড়ী তৈরী হবে লাওস আর বার্মার ২৩৫কিমি সীমারেখার দুইপাশে, লাওস আর পিপ্লস্ রিপাবলিক অফ চায়নার ৪২৩কিমি সীমারেখার দুইপাশে, লাওস আর কাম্বোডিয়ার ৫৪১কিমি সীমারেখার দুইপাশে, লাওস আর থাইল্যাণ্ডের ১,৭৫৪কিমি সীমারেখার দুইপাশে, লাওস আর ভিয়েৎনামের ২,১৩০কিমি সীমারেখার দুইপাশে। একই ভাবে জোড়া বাড়ী তৈরী হবে ভারতবর্ষ এবং আফঘানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, বার্মা, পিপ্লস্ রিপাবলিক অফ চায়না, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সীমারেখার দুইপাশে। একই ভাবে জোড়া বাড়ী তৈরী হবে রাশিয়া এবং আজারবাইজান, বেলারস, এস্টোনিয়া, ফিনল্যাণ্ড, পিপ্লস্ রিপাবলিক অফ চায়না, জর্জিয়া, কাজাকস্তান, নর্থ কোরিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মঙ্গোলিয়া, নরওয়ে, পোল্যাণ্ড এবং ইউক্রেনের সীমারেখার দুইপাশে।

অমর পরামর্শ দিল বিভিন্ন দেশের ‘জপ’-এর সমর্থকদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে। ভিন্ন জাতের ছেলেমেয়েদের বিয়ে শুরু হবার পর থেকে জাত-ভেদ জাতিভেদ অনেক কমে গিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের বিয়ে শুরু হ’লে দেশ-বিদেশের সীমারেখা লোকে ভুলে যাবে। আভা আপত্তি ক’রলো এ প্রস্তাবে; কারণ ইদানীং কিছু অন্য দেশের মেয়েরা এদেশের ছেলেদের বিয়ে ক’রেছে শুধু এদেশে দুবছর কাটানোর সুযোগের জন্য; দুবছর এদেশে থাকার পর যখন তারা এদেশে পাকাপাকি থাকার অধিকার পাবে, তখন তারা এদেশীয় স্বামীদের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ক’রে নিজের দেশের ছেলেদের বিয়ে ক’রবে এবং এদেশে নিয়ে আসবে; অর্থাৎ অন্য দেশের ছেলে মেয়েরা বিয়ে ক’রবে নিজেদের মধ্যে, কিন্তু থাকবে এদেশে এসে। বীরুর কাছে বিক্রমের প্রস্তাব খারাপ লাগলো না, কারণ এভাবে একদেশ থেকে অন্য দেশে অনেকে যেতে পারবে, যদিও দেশবিদেশের সাংস্কৃতিক মিলন হ’তে সময় লাগবে।

শুভেন আর ইরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে লোক নিয়ে যাবার জন্যে paratrooper বা ছত্রীসৈন্যের উপযোগ করার প্রস্তাব দিলো। Parachute বা বিমানছত্রের সাহায্যে বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়ে বিদেশের মানুষ দেশে ঢুকবে, সেখানে বাস করার জন্যে। AIRBORNE বা ‘বাতাস-বাহিত’ শব্দটি paratrooper বা ছত্রীসৈন্যের কাছে মন্ত্রের মতো। বাতাসের বেগে ধাওয়া ক’রতো উন্মাদ ছত্রীসৈন্য, পারলে এখনও করে। এক ছত্রী সেনাপতির আদেশ তার ছত্রীসৈন্যদের উদ্দেশ্যে,-

‘তোমরা যারা বাতাসের সন্তান,

মন খুলে করো আপনারে দান।

উড়বো আমরা, যায় যাক্ প্রাণ।

জিতে ফিরবো, ওড়াবো নিশান।‘

বীরু ভেবে দেখলো ছত্রীসৈন্যের বাহিনী দিয়ে ব্যাপকভাবে বিদেশে অবতরণ করা সম্ভব নয়। মালবাহী বিমানের আয়তন খুব বেশী নয়। ২০জনের বেশী লোক একসঙ্গে ঝাঁপ দিতে পারবে না। এছাড়া র‍্যাডারের চোখ এড়িয়ে বিদেশের আকাশে ঢোকা সহজ নয় কোনো বিমানের পক্ষে।

 

ঠিক এই সময়েই এক স্বামী মোকদ্দমা দায়ের ক’রলো, স্বামীর দেশের এক বিচারালয়ে, তার অধুনা অন্যদেশ নিবাসিনী বিবাহিতা স্ত্রীর বিরুদ্ধে, স্বামীর দেশে জন্মানো চার কন্যার জিম্মা বা অভিভাবকত্বের দাবী নিয়ে। দুই জড়িত দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমঝোতা মেনে চলতে হবে স্বামীর দেশের বিচারালয়কে। স্ত্রী এবং তার মেয়েরা তাদের বর্ত্তমান দেশের অধিবাসীদের কাছে আবেগভরা আবেদন জানালো চার কন্যাকে তাদের পিতার দেশে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে।

স্ত্রীর দেশেই পুরুষের-অধিকার সংস্থা জানালো যে চার কন্যার মাতার জন্যে দেশ জুড়ে প্রতীয়মান সমবেদনা বা সহানুভূতি থেকে বোঝা যায় এই ধরণের পরিস্থিতিতে পুরুষ নিতান্তই অসহায়। অনেক নারীই তাদের সন্তানদের অপহরণ ক’রে, সন্তানদের পিতাকে পিছনে ফেলে রেখে অন্য বাড়ীতে উঠে যায়,-  কোন সময় একই দেশের অন্য বাড়ীতে,  কোনো সময় অন্য কোনো দেশের বাড়ীতে।

খোকার বিচারে সারা পৃথিবী জুড়ে যদি একটাই দেশ হ’তো, তবে সন্তানের অভিভাবকত্বের দাবীর মামলা পৃথিবীর যে কোনো বিচারালয়ে করা সম্ভব হ’তো; হয়তো ইন্টারনেটের স্কাইপ-কোর্টের ভার্চুয়াল বিচারালয়ে বিচার সম্ভব হোতো।

 

ঠিক এই সময়েই এক জার্মান পুরুষ পুলিশকে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হ’লো না কারণ তার অটিস্টিক মেয়েকে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে আসা চ’লবে না; যদিও ২৫বছরের অটিস্টিক মেয়েটি জার্মানীতে দুটি প্রতিষ্ঠানে সবেতন কাজে নিযুক্ত আছে; এছাড়া স্বতঃপ্রবৃত্ত হ’য়ে স্কাউটের কাজ ক’রছে। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম তীরের পুলিশবাহিনীতে তাকে যোগদান ক’রতে বলা হ’য়েছিল; কিন্তু তার মেয়ে অটিস্টিক একথা জানার পরে অস্ট্রেলিয়ার সরকার চাকুরীর প্রস্তাব প্রত্যাহার ক’রে নেয়।

খোকা আর বীরু ভাবলো, যদি সারা পৃথিবীটা একটাই দেশ হ’তো, জার্মান আর অস্ট্রেলিয়া একই দেশ হ’তো তবে অটিস্টিক মেয়েটির অস্ট্রেলিয়াতে থাকতে দিতে আপত্তি হোতো না।

 

ঠিক এই সময়েই নৌকা বোঝাই শরণার্থীরা পাড়ি দিচ্ছিল গরীব দেশ থেকে সমৃদ্ধ দেশের দিকে; নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য না রেখে বোঝাই করা হচ্ছিল মানুষ পাচারের চোরাই নৌকো; ডুবছিল নিরুপায় মানুষেরা সমৃদ্ধ দেশের ত্রাণ-বাহিনীর সাহায্য আসার আগেই। অস্ট্রেলিয়ার এক কোটিপতির উক্তি – সংশ্লিষ্ট সমৃদ্ধ দেশগুলির উচিত শরণার্থীদের বিমানে উড়ে আসতে দেওয়া। শরণার্থীরা মানুষ পাচারের চোরাই নৌকোর জন্যে যে ভাড়া দেয় তার দশভাগের একভাগ ভাড়া দিয়ে বিমানে উড়ে আসতে পারবে, যদি এদের ভিসা ছাড়াই উড়ে আসতে দেওয়া যায়। সমৃদ্ধ দেশের বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরেই যাচাই করা হবে শরণার্থীর immigration বা অভিবাসনের যোগ্যতা; যোগ্যতা না থাকলে অনতিবিলম্বে ফেরৎ পাঠানো হবে শরণার্থীকে তার নিজের দেশে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে মানুষকে একদেশ থেকে অন্যদেশে নিরাপদে পরিবহন করার জন্যে; সমৃদ্ধ দেশের ত্রাণ-বাহিনীর খরচও অনেক বাঁচবে এতে।

 

ঠিক এই সময়েই প্রতিদিন বারবার মানুষের অনন্যতা [Identity] অপহরণ ঘটছিল; অজস্র নকল মানুষের মধ্যে আসল মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না; আসল মানুষ নিজের অনন্যতা প্রমাণে অসমর্থ হচ্ছিল; অনন্যতা অপহরণের কলাকৌশল কাজে লাগলো বীরুর কমরেডদের ক্যামোফ্লেজ ক’রতে – অনেকেরই হ’লো অবিকল এক নাম, একই রকমের হস্তলিপি, একই রকমের ভাবভঙ্গী, এমনকি কণ্ঠস্বরও। যদি এইধরণের একজন ক-দেশ থেকে খ-দেশে যায়, তবে নকল একজন তার হ’য়ে কাজ ক’রবে, যেন সেই একজন কোথাও যায় নি। সব কমরেডই যেন সর্ব্বত্র বিদ্যমান এবং সর্ব্বদেশেই সর্ব্বশক্তিমান।

 

এর পরে এলো সেইদিন – এই সালের ১৫ই আগস্ট – পৃথিবী জুড়ে শুরু হ’লো এক নতুন যুগ।

১৫ই আগস্ট ওয়েলিংটনের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক অভিনব ইতিহাস লেখা হ’লো। দিনের প্রথম বিমান ওড়ার কথা সকাল ৬টায় ফিলাডেলফিয়া যাবার জন্যে। ভোর আড়াইটের সময় খুললো ৪টে ইকনমি ক্লাসের আর ২টি বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাসের চেক-ইন কাউন্টার। যাত্রীদের ২-টি লাইন – ১টি ইকনমি ক্লাসের আর ১টি বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাসের। ইকনমি ক্লাসের লাইন থেকে ৪-জন যাত্রীর ডাক পড়লো আর বিজনেস-ফার্স্ট ক্লাসের লাইন থেকে ২-জনের।

‘অনুগ্রহ ক’রে আপনার টিকিট আর পাসপোর্ট দেখান’। একসঙ্গে ব’ললো ৬-টি চেক-ইন কাউন্টারের ৬-জন বিমানসংস্থার কর্মী সামনের ৬-জন যাত্রীকে।

প্রত্যেক চেক-ইন কাউন্টারে অপেক্ষমান যাত্রী জমা দিলো তার পাসপোর্ট আর কাগজপত্র। বিমানসংস্থার কর্মী ই-টিকিট দেখার পর ব’ললো- ‘তাহলে আপনি যাচ্ছেন ফিলাডেলফিয়া’। পাসপোর্টের ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে নিলো যাত্রীর মুখ। সব ঠিকঠাক। তারপরে নজর দিল পাসপোর্টে ইউএসএ যাবার ভিসার দিকে। ভিসার কোনো হদিশ নেই।

‘এই পাসপোর্টে ইউএসএ যাবার ভিসা নেই। পুরোনো পাসপোর্টে ভিসা থাকলে দেখান’।  বিমানসংস্থার কর্মী জিগ্যেস ক’রলো।

‘ইউএসএ যাবার ভিসার দরকার নেই আমার, আমি পৃথিবীর নাগরিক’- যাত্রীর উত্তর এলো।

‘না মশায়,’ বিমানসংস্থার কর্মী উত্তর দিলো, ‘পাসপোর্ট অনুযায়ী আপনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। ভিসা ছাড়া আপনাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া হবে না। কোনো মাল আছে কি আপনার সঙ্গে?’

‘না, আমার সঙ্গে যাবে কেবল এই কেবিন ব্যাগটা’। উত্তর দিলো যাত্রী।

‘আপনি প্লিজ একটু পাশে দাঁড়ান আর আপনার পরের যাত্রীকে এগিয়ে আসতে দিন’ এ কথা ব’লেই বিমানসংস্থার কর্মী মুখ ফেরাল অন্য চেক-ইন কাউন্টারগুলোর দিকে। ঠিক একই কথার যেন প্রতিধ্বনি শুনলো বাকি পাঁচটা কাউন্টার থেকে।

যে-ক’জন যাত্রী হাজির হ’য়েছে চেক-ইন করার জন্যে, তাদের কারও কাছেই একটা কেবিন ব্যাগ ছাড়া আর কোনো সুটকেশ নেই। কারও পাসপোর্টেই নেই আমেরিকা যাওয়ার ভিসা। কেউই সরে দাঁড়াল না পরের যাত্রীর জন্যে পথ ক’রে দিতে। বিমানসংস্থার কর্মীরা যাত্রীদের লাইনের দিকে তাকালো– কারও সঙ্গেই নেই কোনো ভারী ব্যাগ, সবাই যেন লাইন দিয়েছে বাসে ওঠার জন্যে, বিমানে চড়ার জন্যে নয়।

 

প্রত্যেক কাউন্টারেই যাত্রী তার টিকিট আর পাসপোর্ট দেখিয়েছে, কিন্তু কারও সঙ্গে ভিসা নেই গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্যে। বিমানসংস্থার কর্মীরা এরকম ঘটনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। ওদের মধ্যে একজন বসকে ফোন ক’রলো নির্দেশ চেয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর ডাক পড়লো– যে যাত্রীরা চেক-ইন কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাশ না নিয়ে নড়তে চায়নি, তাদের গ্রেপ্তার করা হ’লো। ছয়জন যাত্রী গ্রেপ্তার হ’লো। এগিয়ে এলো আরো ছয়জন। তাদের কারও কাছেও ভিসা নেই। তারাও কেউ কাউন্টার থেকে সরে দাঁড়ালো না পেছনের যাত্রীর জন্যে। তারাও গ্রেফতার হ’লো।

এরপরে এগিয়ে এলো আরও ছয়জন যাত্রী। তাদেরও একই অবস্থা পাসপোর্ট-ভিসার। একই রকম আচার-আচরণ।  তারাও গ্রেফতার হ’লো। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হ’য়েই চললো।  অবশেষে যে ২১৫ জন যাত্রী এসেছিল বিমানে চড়ার জন্যে তাদের সকলেই গ্রেফতার  হ’লো। বোর্ডিং পাশ দেওয়া হ’লো না কোনো যাত্রীকে। কোনো ভারী মালপত্র উঠলো না লাগেজ বেল্টে, বিমানের খোল বা হোল্ডে যাবার জন্যে।

ভারী মালপত্র বিমানের খোলে পাঠায় যে বিমানকর্মীরা, তারা চিন্তিত হ’য়ে উঠলো চেক-ইন কাউন্টার থেকে কোনো মাল তাদের কাছে আসছে না ব’লে। নিজেদের কাজের জায়গা থেকে তারা চলে এলো চেক-ইন কাউন্টারের কাছে, সেখানে কী হ’চ্ছে দেখবার জন্যে। ফ্লাইট-ক্রু’এর কাছে খবর গেলো দেরি ক’রে আসার জন্যে, কারণ বিমানে চড়ার ম’তো যাত্রী এখনও কেউ তৈরি নেই। বিমানবন্দরে আসার আগে তারা যেন ফোন ক’রে খবর নেয়। ফ্লাইট বাতিল হ’লো। সমস্ত যাত্রীকে গ্রেফতার করা হ’লো।

 

ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে এর পরের উড়ানেরও একই দশা হ’লো। কারণ, এই উড়ানেরও সব যাত্রী বিদেশে যাবার ভিসা ছাড়াই হাজির হ’য়েছে বিদেশ যাওয়ার জন্যে। তার পরের উড়ানের অবস্থাও কিছু আলাদা হ’লো না।  সারাদিন কোনো বিদেশগামী বিমান ছাড়লো না ওয়েলিংটন বিমানবন্দর থেকে। কিছু পরে খবর পাওয়া গেলো নিউজিলান্ডের অন্য বিমানবন্দর থেকে যে, ১৫ই আগস্ট-এর সারাদিনে নিউজিল্যান্ডের কোনো বিমানবন্দর থেকে কোনো আন্তর্জাতিক উড়ান ছাড়েনি, কারণ ভিসা ছাড়াই যাত্রীরা এসেছে বিমানবন্দরে,  দাবী ক’রেছে জগতের নাগরিকের জন্মগত অধিকার জগতের যে কোনো নগরে যাওয়ার, দরকার নেই কোনো ভিসার।

 

কয়েকঘন্টা পরে একই ঘটনা ঘটলো সিডনী, মেলবোর্ন, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, কুয়ালালামপুর এবং অন্যান্য বিমানবন্দরে। বীরু তার জাল বিছিয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, পৃথিবীর প্রতি বিমানবন্দরের প্রতিটি আন্তর্জাতিক উড়ানের প্রতিটি সিটের টিকিট কাটার জন্যে যাত্রীর ব্যবস্থা ক’রেছে। প্রতিটি টিকিট কেনা হয়েছে ক্রেডিট কার্ডে, ট্রাভেল ইনসুর‍্যান্সের সঙ্গে। বীরু খোঁজ নিয়ে জেনেছে – যদি নির্ধারিত সময়ে উড়ান না ছাড়ে আর যাত্রীকে বোর্ডিং পাশ না দেওয়া হয়, তাহ’লে ইনসুর‍্যান্স কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে। যাত্রীর ভিসা না থাকার ব্যাপারে কোনো শর্ত নেই, কারণ টিকিট ইস্যু হ’য়েছে।

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চললো ভিসার আইন অমান্য করার একটানা অহিংস আন্দোলন। এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়ার সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান হ’লো স্থগিত। অতর্কিত পূর্ণচ্ছেদ পড়লো শুধু বিমান উড়ানেই নয়- কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বীমার বেচাকেনা বন্ধ ক’রলো যাবতীয় ইনসুর‍্যান্স কোম্পানি। বিমানবন্দরের কর্মচারীদের কোনো কাজ রইল না করার মতো। শূন্য হ’লো বিমানবন্দরের তহবিল। কোনো আয় না থাকলে কর্মচারীদের মাইনে কীভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে চিন্তিত হ’লো বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ। দিনের পর দিন ভিসাহীন যাত্রীদের কারাগারে ভরার পর কারাগারেও স্থান সংকুলানের সমস্যা দেখা দিলো। স্থগিত রইলো যাবতীয় আমদানি-রপ্তানী। বিমান-পরিবহন শিল্পের তাগিদে ও অনুরোধে জরুরী মিটিং ডাকলো ইউএনও। কিন্তু ইউএনও-এর সভ্যদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে মিটিং করার উপায় নেই। সমস্ত উড়ানই বাতিল হ’য়ে গেছে। মিটিং হ’লো স্কাইপে।

সমস্যার কোনও সমাধান নেই ইউএনও-এর সামনে। ভিসা ছাড়াই উড়তে দিতে হবে সমস্ত বিমানযাত্রীকে। কিন্তু তাতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের। অবাঞ্ছিত আগন্তুকদের  আশ্রয় দিতে সেখানে দারুণ আপত্তি। ওদিকে সারা দুনিয়ার লোক উৎসুক বিনা ভিসায় উড়ে যাবার জন্যে। দিনের পর দিন একই যাত্রীরা টিকিট কেটেছে একই গন্তব্যে যাবার জন্যে। কী করবে এখন ইউএনও?  ইউএনও-এর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দেখলেন, বীরু সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়, কোটি-কোটি লোক ট্যুইটার-ফেসবুকে তার কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব। তারা আদেশ দিলেন বীরুকে গ্রেফতার ক’রে জিজ্ঞাসাবাদ করার, যাতে পৃথিবীর মানুষের আইন-ভাঙ্গার আন্দোলন থামানো যায়, পরিস্থিতিকে আনা যায় আয়ত্ত্বের মধ্যে। কিন্তু কী করে গ্রেফতার করা যাবে বীরুকে? অগুন্তি মানুষের দাবি তারা প্রত্যেকে এক একজন  বীরু, কিন্তু কে আসল বীরু? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেন হঠাৎ বীরু হ’য়ে গিয়েছে।

ইউএনও-এর  সমৃদ্ধশালী দেশের প্রতিনিধিদের আদেশ অনুযায়ী গ্রেফতার করা হ’লো প্রতি ভিসা-ছাড়া যাত্রীকে।  এদের জিজ্ঞাসাবাদের পর দুটি নাম এলো সকলের মুখে – বীরু আর খোকা।  কোন্ বীরুকে গ্রেফতার ক’রবে পুলিশ? পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষ হাত বাড়ালো  বীরুর পরিচয় দিয়ে, বীরুর মুখোশ পরে গ্রেফতার বরণ ক’রবে তারা। আসল বীরুর হদিশ পেলো না নিরাপত্তা বাহিনী।  জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে গ্রেফতার হ’লো খোকা।

পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-সহায়ক তদন্ত হ’লো খোকার মনের অভ্যন্তরে। প্রমাণ হ’লো খোকা সন্ত্রাসবাদী নয়, কোনো দিন নেয় নি হিংসার আশ্রয়; সে অহিংস, সত্যের ভক্ত; কারাগার থেকে খোকা হ’লো মুক্ত; যে আইন অমান্য করার জন্য খোকার গণ আন্দোলন, সারা পৃথিবীর সংসদে হবে তার আলোচনা, পর্যবেক্ষণ।

খোকা স্বপ্ন দেখলো সারা পৃথিবীর মানুষ কন্ঠ মিলিয়েছে – গাইছে একসুরে -

‘Imagine there's no countries
It isn't hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion too’

খোকা ভাবলো:

দাদা ব’লতো, "কেমন করে হবে,

খোকার গায়ে এতো কি জোর আছে।'

 

********

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু