বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

পরলোক থেকে পুনঃপ্রত্যাবর্ত্তন

মহাকাশে দিগন্তব্যাপী অন্ধকারে অসংখ্য আলোর কণা! প্রাণবন্ত জীব-জীবাণুদের দিকে তীব্রবেগে কে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে? কিরীটির বোধশক্তি অবলুপ্ত; কোনো এক অদৃশ্য শক্তি নির্দেহ কিরীটিকে নিয়ে চলেছে স্বর্গে বাবা-মায়ের কাছে, বাবা-মা যে ওকে এত ভালবাসতো, কিরীটি বুঝতে পারেনি কোনোদিন।

‘জ্ঞান ফিরেছে এবারে’- মহাকাশের স্বর্গ থেকে ফেরা কিরীটি শুনতে পেলো এই কটি কথা; বুঝলো ও এখন হাসপাতালের বেডে; ‘ওয়ান, টু, থ্রী’- এক বেড থেকে অন্য বেডে, অপারেশন থিয়েটারে।

মনে পড়লো, সকালে কাজে যাবার জন্যে বেরিয়েছিল কিরীটি; ছয়-লেনের রাস্তা; পাঁচটা লেন পার হবার পর বাস-লেন; কোনো গাড়ী নেই; বাস-লেনে ঝাঁপ দিয়েছিল কিরীটি; তারপর কি হ’য়েছে কিরীটি জানে না, মৃত্যুর অন্ধকারে গিয়েছিল পরলোকে, ফিরে এসেছে গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে।

 

…কিরীটি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনে, আরও দুজন রোগীরও হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ী যাওয়ার দিন; তাদের দিকে তাকিয়ে বিচলিত হ’য়ে উঠলো কিরীটির স্বর্গ-ফেরৎ মন। হয়তো এরাও ফিরে এসেছে পরলোক দেখে।  

এদের একজন এখানে ৪-মাস ধ’রে ছিল, তার একটি পা অ্যামপ্যুট করার পর থেকেই। যখন ওকে এখানে আনা হয়েছিল, তখন ওর ফিরে যাবার জন্যে ঘর ছিল, সেই ঘরে ছিল তার গৃহ-সঙ্গিনী, যার জন্যে ফিরে যাবার টান ছিল। এখন পঙ্গু হওয়ার পরে তার চাকরী গেছে, ধারের কিস্তি না দিতে পারায় ব্যাঙ্ক তার বাড়ী দখল ক’রে বিক্রি ক’রে দিয়েছে। গৃহ-সঙ্গিনীর সঙ্গে বিয়ে করার সুযোগ হবার আগেই, সে ঘর ছেড়ে চলে গেছে একটি সক্ষম পুরুষের সঙ্গে। এখন রোগীটি কাকুতি মিনতি ক’রছে সমাজসেবী মহিলার কাছে- কোথাও একটু মাথাগোঁজার আশ্রয়ের জন্যে।

অন্য রোগীটি একেবারে ভুলে গেছে তার অতীত। তার স্ত্রী এসেছে তাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ ক’রে বাড়ী নিয়ে যাবার জন্যে, সঙ্গে এক বছর বয়সী মেয়ে আর তিন বছর বয়সী ছেলে। কিন্ত রোগীটি চিনতে পারছেনা কাউকেই– কেন এসেছে একটি অপরিচিতা নারী তার শিশু পুত্র আর কন্যাকে নিয়ে, তাকে আপন ক’রে নিয়ে যাওয়ার জন্যে?

 

কিরীটি ফিরে এলো বাড়িতে; দুর্ঘটনার আগের বাড়ি থেকে এ বাড়িটা যেন অনেক আলাদা। হাসপাতালের সীমারেখার বাইরে এসে কিরীটি হাসপাতালের কথা ভাবতো– সেখানে পাশের বেডের রোগীর সঙ্গে, ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়েরা কেমন আপন বন্ধুর মতো হ’য়ে উঠেছিলো। বাড়ীর পরিবারের গণ্ডির মধ্যে নতুন ক’রে শিখতে হবে নিয়ম কানুন।

 

…..মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার মাত্র দুমাস আগে এই বাড়ীটা কিনেছিল কিরীটি। সৌভাগ্যের কথা এই যে দুর্ঘটনার পরেও কিরীটির দেহ ও মন কর্ম্মক্ষম ছিল। বারো বছরের মধ্যেই শোধ ক’রেছিল বাড়ী কেনার ঋণ। আরো কুড়ি বছর এই বাড়ীতে সুভদ্রার সঙ্গে থাকার পরে কিরীটি ঠিক ক’রলো এবাড়ী ছেড়ে যেতে হবে।

জীবনে অনেক বার বাড়ী বদল ক’রেছে কিরীটি, ঘুরেছে দেশ থেকে দেশান্তরে; চাকরীর প্রয়োজন ছাডা বাড়ীবদলে এবারেই কিরীটি একা। একেবারে ছেলেবেলা ছাড়া সব বাড়ী বদলেই সুভদ্রা ছিল কিরীটির পাশাপাশি। এবারে কিরীটি বেরিয়ে এসেছে একা, ওদের বহুদিনের বাড়ী সুভদ্রার হাতে ছেড়ে দিয়ে। ডিভোর্সের চিন্তা বরাবর এড়িয়ে গেছে কিরীটি, আইনের প্যাঁচকষ আর খরচের কথা ভেবে।

বাড়ী বদলের আর একটা বড় কারণ, মামা অনেক সস্তায় ওঁর বাড়ীটা বিক্রি ক’রেছেন কিরীটিকে। ছ-মাস আগে এই বাড়ীতেই মামীমা আত্মহত্যা ক’রে নিজের জীবন শেষ ক’রে দিয়েছেন। এই মৃত্যুর পর থেকেই মামা আর এ বাড়ীতে থাকেন নি; ওদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থেকেছেন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে; সম্প্রতি আর একটি বাড়ী কিনেছেন; সেই সময়েই মামার অনুরোধে কিরীটি বাড়ীটি কিনে নিয়েছে।

আজ কী-কী করার আছে মনে মনে তার হিসেব ক’রলো কিরীটি। প্লাম্বারের সঙ্গে ব্যবস্থা হ’য়েছে টয়লেট ফ্লাশ ঠিক করার জন্যে; হ্যান্ডিম্যানের সঙ্গে লাউঞ্জের জানলা ঠিক করার জন্যে। সুভদ্রার সঙ্গেও কথা ব’লেছে কিরীটি, সুভদ্রা এখনও বহাল তবিয়তে আছে ওদের ইদানীন্তন বাড়ীতে।

কী ক’রবে কিরীটি এই সন্ধ্যায়? কিছু আনপ্যাকিং করার আছে; বেশী নয়। মাত্র দুটো স্যুটকেশ এনেছে বাড়ী থেকে; মাসখানেকের ট্যুরে যাবার মতো।

এ বাড়ীতে মামীমার ছোঁয়া লেগে আছে সর্ব্বত্র- বিছানার চাদরে, দরজা-জানলার পর্দায়, দেওয়ালে টাঙানো গীটারে, হাতে আঁকা ছবিতে; কিন্তু সব ছাড়িয়ে মনে পড়ছে মামীমার পাদুটিকে; শ্মশানে চিতার আগুনে যখন মামীমার সারা দেহ পুড়ে ছাই হ’য়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখন অক্ষত পাদুটি খাট থেকে ঝরে পড়েছিল।

 

হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে সাড়া দিলো কিরীটি।

উত্তর শোনা গেল ঠিক মামীমার কণ্ঠস্বরে, ‘আমি রাণী, কিরীটি। তোমার মামীমার বোন; জামাইবাবু ব’লেছিলো, তুমি আজ গৃহপ্রবেশ ক’রবে। প্লীজ আমার ফোন নম্বরটা লিখে নাও; কোনো অসুবিধে হ’লে আমাকে ফোন কোরো।’

কিরীটি রাণীর নম্বরটা লিখে রাখলো; মামীমা থাকলে হয়তো এমন ক’রেই ব’লতো।

 

…..সুভদ্রা কিরীটির হাসপাতালে গিয়ে জানলো- কয়েক দিন আগে কিরীটি এখানে ভর্ত্তি হ’য়েছে। হাসপাতালের নার্সের কাছে খবর পেলো যে এক সপ্তাহ আগে কিরীটির হার্ট অ্যাটাক হয়, কিন্তু ডায়াবেটিক কিরীটি সেটা বুঝতে পারেনি। চলতে ফিরতে অসুবিধে হ’চ্ছিল বলে পাড়ার ডাক্তারের কাছে দেখাতে গিয়েছিল। ডাক্তার ওকে দেখেই বুঝতে পারে যে ওর অসুখ গুরুতর, বাড়ী ঘুরে যাবার সময় নেই। অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে তখনই পাঠিয়ে দেয় হাসপাতালে। সুভদ্রা যখন কিরীটির বিছানার কাছে পৌঁছাল তখন কিরীটির কোনো জ্ঞান নেই। নার্সের কাছে শুনলো- কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত বাঁ দিকটা অবশ হোয়ে গেছে, বাঁ হাত আর বাঁ পা একেবারে নাড়াতে পারছে না। সুভদ্রা জিগ্যেস ক’রলো ওর ফোন-নং কী ক’রে হাসপাতাল জানতে পারলো- কিরীটির মোবাইল ফোনে সুভদ্রার নম্বর ছিল আই-সি-ই অর্থাৎ ইন কেস অফ ইমার্জেন্সীতে জানাবার জন্যে।

 

এই সময়ে কিরীটি অসুস্থ হ’য়ে পড়াতে সুভদ্রা বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লো। সুভদ্রা এখনও কিরীটির বিবাহিতা স্ত্রী, তাই কিরীটির শরীরের উপর কোন্ ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বা প্রোসেডিওর চালানো হবে তার নির্ণয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুভদ্রাকে। সে নিশ্চিৎভাবে জানে কিরীটি এ ব্যাপারে তাকে মোটেই জড়াতে চাইতো না। কিন্তু ভুল ক’রে আই-সি-ই হিসেবে সুভদ্রার নম্বর রেখে দিয়েছে।

সপ্তাহখানেক বাদে কিরীটির হাসপাতাল থেকে জরুরী ফোন এলো। কিরীটির জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ কিরীটির চিন্তা করার ক্ষমতা কম। সুভদ্রাকে ঠিক ক’রতে হবে দুটি ডাক্তারী প্রক্রিয়ার কোনটা কিরীটির উপর চালানো হবে-

১) কোনো কষ্ট দেওয়া হবে না কিরীটিকে, কিরীটি আরাম ক’রুক ওর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।

২) এ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুইড দেওয়া হোক ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপের মাধ্যমে। এতে কিরীটিকে অনেক কষ্ট সহ্য ক’রতে হবে। পুরো সুস্থ হবার সম্ভাবনা ১০%, কষ্ট পেয়ে মরার সম্ভাবনা ৯০%।

 

এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে সুভদ্রা যে কারুর পরামর্শ নেবে তার উপায় নেই। চঞ্চল আর জ্যানেট জানে না কিরীটি আসলে কোথায় থাকে- এদেশে না বিদেশে, তার উপর শয্যাশায়ী জ্যানেটকে ছাড়া আর কিছু ভাবার সময় নেই চঞ্চলের। কিরীটির যদিও জ্ঞান আছে, তার কথা বলার ক্ষমতা নেই ব’ললেই চলে, এসব জটিল কোয়েশ্চেনের উত্তর দিতে পারবে না। হতবুদ্ধি সুভদ্রা ব’লতে গেলে কিরীটিকে বিনা কষ্টে মেরে ফেলাটাই ভালো মনে ক’রলো।

 

কিরীটি ইতিমধ্যে রাণীর ফোন নম্বর খুঁজে পেয়ে নার্সকে ব’লেছে যোগাযোগ করার জন্যে। রাণী এসে সার্জেন-ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা ক’রে জেনেছে যে এ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুইড দিয়ে পুরো ভালো হবার ভালোই সম্ভাবনা আছে। এর আগে রাণী সুভদ্রার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায় নি, এখন দেখা হ’লো হাসপাতালে, ফোনে এ্যাপয়েন্টমেন্ট ক’রে। ওরা সুভদ্রাকে এ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুইডের জন্যে রাজী করালো। দুমাস লড়াই ক’রে সুস্থ হ’লো কিরীটি, তার কোনো অঙ্গই অবশ রইলো না। কিরীটি বাড়ী ফেরার কদিন পরেই রাণীর সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা শুরু ক’রলো।

 

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে কিরীটি আগের মতো সুস্থ-সবল-সচেতন নেই। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়ী থেকে বেরোয় নি কিরীটি। বরং প্রায় রোজই রাণীর বাড়ী থেকে কেউ না কেউ দেখা ক’রতে এসেছে। এমনই একটা দিনে কিরীটি লাউঞ্জের রকিং চেয়ারে বসে টিভিতে সকালের খবর শুনছিল, তখন শোনা গেলো কলিং বেল বাজার আওয়াজ- রাণী এসেছে। রাণী দেখা ক’রতে এলে সকাল সকাল আসে। তৈরী ব্রেকফাস্ট থাকে সঙ্গে। দুপুরের খাবার রান্না করার জন্যে মাছ-সব্জীও সঙ্গে নিয়ে আসে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ রান্না ক’রে- খেয়ে-খাইয়ে- গল্পগাছা ক’রে বাড়ী ফিরে যায় বিকেলের দিকে, যাতে ওর দাদা ফেরার আগেই বাড়ীতে হাজির থাকতে পারে। কিরীটির কাছে রাণী এখনও মামীমার মতোই অল্পবয়সী গুরুজন, ইয়ার্কি করা যায় সম্ভ্রম বজায় রেখে। একেবারে মামীমার মুখ বসানো রাণীর মুখটাতে, কথা বলার ধরণও মামীমার মতোই। মামীমার পাদুটির কথা কিরীটি ভুলবেনা কোনোদিনও। শ্মশানে খাট থেকে ঝরে পড়া আলতা-পরা পা-দুটিকে তুলে নিয়েছিল কিরীটি; মামার আদেশে আগুনে নিঃক্ষেপ করার আগে, নিজের মাথায় ছুঁইয়ে প্রণাম জানিয়েছিল। রাণীর পা-দুটো তেমন ক’রে কখনও দেখতে পায়নি কিরীটি; ও সাধারণতঃ লম্বা ফুলপ্যান্ট পরে, পায়ের পাতাও ঢাকা পড়ে যায়।

 

‘হ্যাপী বার্থডে কিরীটি’,- রাণী খুললো একটা কেকের বাক্স- কেকের ওপরে লেখা- ‘শুভ জন্মদিন’।

‘আর এক বছর বয়স বাড়ার কথা মনে ক’রিয়ে দিলে, ধন্যবাদ।‘,- ব’ললো কিরীটি- ‘একেবারেই মনে ছিল না আমার।‘

 

‘আমিই বা কি ক’রে জানবো? কখনো কি ডেকেছ আমায় তোমার জন্মদিনে? হাসপাতালে তোমার রিষ্টব্যান্ড থেকে তোমার জন্মতারিখ মনে ক’রে রেখেছি।‘

 

‘তুমি আমার বয়স জানলে কিছু এসে যায় না। আমার বেশী বয়স দেখে হয়তো তোমার দুশ্চিন্তা বাড়বে। কেউ কি খুঁজবে আমায় যখন আর থাকবো না এই পৃথিবীতে?’

 

‘হয়তো কেউ খুঁজবেনা তোমাকে; একটা জীবন থেমে গেছে ব’লে পৃথিবীর জীবন থমকে দাঁড়াবে না; তবু কিছু লোকে কাঁদবে, তারা চাইবে না আর কোনোদিন সূর্য্য উঠুক, তোমাকে ছাড়া আর একটাও দিন আসুক।‘

 

‘তোমার জন্মদিন কবে, রাণী? নেমন্তন্ন ক’রবে আমাকে?’

 

‘ব’লবো না তোমাকে। তোমার কাছে ওটা কোনো বিশেষ দিন নয়। মনে আছে সুভদ্রার জন্মদিন কবে?’

 

‘নিশ্চয়ই মনে আছে। তবে ও কাছে না থাকলে উদযাপন ক’রিনা দিনটা। ওর জন্মদিনের উপহার সাধারণতঃ কিনে রাখি অনেক আগেই- ওকে জানিয়ে; একবার ওর জন্মদিনের সাতদিন আগে ওকে উপহার দিয়ে ম্যানিলা গেছি। এক শনিবারে ওকে ফোন ক’রেছি ম্যানিলা থেকেই। প্রায় কুড়ি মিনিট ধ’রে অনেক কথা হোলো। যখন ফোনটা শেষ ক’রতে যাবো তখন ও আমাকে ব’ললো- ও সকাল থেকে পঞ্চাশটা শুভেচ্ছা পেয়েছে, ফোনে বা এস্-এম্-এসে। ব’লেই কেটে দিল ফোনটা। আমি বুঝলাম- আমার একেবারেই মনে আসেনি যে এদিনটা ওর জন্মদিন ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ক’রলাম ছেলেকে- মাকে এখনই জানাও জন্মদিনের প্রণাম।‘

 

‘সুভদ্রা কি তোমায় দেখতে এসেছে হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে?’

 

‘ও হয়তো ব্যস্ত আছে ওর মরণাপন্ন শয্যাশায়ী বন্ধুকে নিয়ে। মনে আছে, আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম ওর বন্ধু জ্যানেটও তখন হাসপাতালে। রাণী, আমি মরার সময় আত্মীয় বা বন্ধুরা কেউ কাছে থাকলো কিনা তাতে কিছু এসে যায় না; আমার শরীরের সমস্ত কলকব্জা দান ক’রে রেখেছি, যাতে আমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার পরে ওগুলো খুলে নিয়ে কোন জীবন্ত মানুষের কাজে লাগানো যায়; আমার শরীরটাও ডাক্তারী ছাত্রদের শেখা আর গবেষণার কাজে লাগবে; দাহ ক’রতে হবে না আমার দেহটাকে, শ্রাদ্ধ-শান্তিরও কোন প্রয়োজন হবে না।‘

 

‘হয়তো তোমার কিছু এসে যায় না, তোমার স্ত্রী বা অন্য কেউ তোমার পাশে রইলো কিনা। দাদা আর আমার কাছে সবচেয়ে দরকারী শেষ সময়ে তোমার কাছে থাকা। যেখানেই থাকি ঠিক এসে যাবো।‘

 

‘তাই নাকি, তাহলে তোমাকে আজ আটকে রাখবো এখানে। বাড়ীতে কি জানে যে তুমি এখন এখানে?’

 

‘অবশ্যই ব’লে এসেছি দাদাকে। তোমার-আমার উপরে ওর অগাধ বিশ্বাস, তবু আমি যদি সময়ে না ফিরি ও আমার জন্যে চিন্তা ক’রবে, আমাকে ফোন ক’রে জানবে- আমি কোথায় আছি, ঠিক আছি কিনা।‘

 

‘রাণী, দাদা কি জানেনা- আমি তোমাকে লুটে নিতে পারি?‘

 

‘তবে ছোটবেলায় ধ’রে নিয়ে গেলে তুমি যা ক’রতে এখন তুমি তা ক’রবে না।‘- এই কথা ব’লেই রাণী কিরীটির খুব কাছাকাছি চলে এলো। খুব ফিসফিস ক’রে আদর-জড়ানো ডাক দিলো,- ‘একটু চুমু খাও আমাকে, কিরীটি। তোমার ঠোঁট দেখে লোভ লাগছে।‘

 

একথা শুনে হেসে উঠলো কিরীটি- হাসতেই থাকলো কিরীটি- অনর্গল হাসি, হাসতে হাসতে কাশি শুরু হ’লো তার। মিনিট-দেড়েক প্রচণ্ড হাসি আর কাশির পরে থামলো কিরীটি- রকিং চেয়ারের হাতলের উপর ঝুলে পড়েছে কিরীটির মাথা।

কিরীটির কপালে টোকা মেরে রাণী জিগ্যেস ক’রলো,- ‘ওঠো কিরীটি, ঠিক আছো তুমি?’ কোনো উত্তর নেই কিরীটির- ঠোঁটের পাশ থেকে লালা বেরিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে চেয়ারের হাতল। কিরীটির নাড়ী টিপে দেখলো রাণী, কোনো স্পন্দন নেই।

 

কী ক’রবে এখন রাণী? আর একটা চেয়ার টেনে এনে তার উপর কিরীটির পা-দুটো তুলে দিল। বেডরুম থেকে বালিশ নিয়ে এসে কিরীটির মাথার নীচে রাখলো। তারপর এ্যাম্বুল্যান্সকে ফোন ক’রলো রাণী, জীবনে এই প্রথমবার ওর এ্যাম্বুল্যান্স ডাকার দরকার হ’য়েছে। কিরীটির ঠিকানা মনে ক’রে ব’ললো, ব’ললো হাসি-কাশির উপসর্গের কথা। এরপরে রাণী ফোন ক’রলো দাদাকে, কাঁপা-কাঁপা গলায় কোনক্রমে ব’ললো কিরীটিকে নিয়ে ওর অসহায় অবস্থার কথা; দাদা ওকে আশ্বাস দিয়ে ব’ললো ও এখনই রওনা হ’চ্ছে; পঁয়তালিশ মিনিটের মধ্যে কিরীটির ওখানে পৌঁছে যাবে। এর মধ্যে এ্যাম্বুল্যান্স এসে গেলে রাণী যেন আবার ফোন করে।

 

রাণী ফোন করার ঠিক ২০ মিনিট বাদে হাজির হ’লো এ্যাম্বুল্যান্স। এ্যাম্বুল্যান্স স্টাফ কিরীটির জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ক’রলো, সফল হোলো না। স্ট্রেচারে ক’রে কিরীটির দেহটা নামিয়ে এ্যাম্বুল্যান্স-ভ্যানে তুললো। রাণী ফোন ক’রলো দাদাকে,- ‘কিরীটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ওর বাড়ীর দরজায় তালা লাগিয়েছি। তুমি সোজা হাসপাতালে চলে এসো।‘

 

রাণী চললো হাসপাতালে এ্যাম্বুল্যান্স-ভ্যানে চড়ে। কিরীটির দেহটা যেন শক্ত হ’য়ে যাচ্ছে। কিরীটির জীবন ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় খুঁজছিল রাণী। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছালো রাণী। হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ডাক্তারেরা কিরীটিকে দেখাশোনার ভার নিল।

নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হ’লো রাণীকে। কেউ জানতে চাইলো কিরীটির পরিচয়- কোন দেশের নাগরিক? কী নাম? কোথায় থাকে- বাড়ীর ঠিকানা কি? কত বয়স- জন্মতারিখ? অসুখের ইতিহাস- কীসে কীসে এ্যালার্জি?

আরও প্রশ্ন রাণীকে- কিরীটির সঙ্গে ওর কীসের সম্পর্ক? কেন কিরীটির কাছে গিয়েছিল ও? কিরীটির এই অবস্থা কখন হোয়েছে? আর কেউ কি ছিল সেখানে, যে রাণীর কথা যাচাই ক’রতে পারবে?

রাণীকে ব’লতে হোলো- কিরীটির সবচেয়ে নিকট আত্মীয় তার স্ত্রী সুভদ্রা- দিতে হোলো তার নাম, ফোন-ঠিকানা।

ইমার্জেন্সী ডাক্তারেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু ক’রেছে- এমন সময়ে রাণীর দাদা এসে পৌঁছাল। রাণী এতক্ষণে একটু ভরসা পেলো- ওর বুকে মাথা দিয়ে একটু চোখের জল ফেলতে পারলো। কান্নায় গলা বুজে আসছে- তবু রাণী ব’ললো কী কী ঘটেছে- কিরীটির এই দশার জন্যে দায়ী ক’রলো নিজেকেই।

 

কিরীটিকে কোথায় কোন্ বেডে রাখা হবে তার কিছু ঠিক হ’লো না। দুঘন্টা ধরে কিরীটির দেহ নানা জায়গায় ঘুরলো- অপারেশন থিয়েটারে, ল্যাবোরেটরীতে, সিটি স্ক্যান, এম-আর-আই আর প্যাথোলজিক্যাল টেস্টিংএ। অবশেষে আড়াই ঘন্টা পরে ডাক্তারেরা মত দিলো যে কিরীটির জন্যে কোনো বেডের দরকার নেই; কিরীটির দেহাবসান হ’য়েছে- বেঁচে ওঠার কোনো আশা নেই। ঠিক এই সময়ে এসে পৌঁছালো সুভদ্রা, চঞ্চলের সঙ্গে। দাদা আর রাণী মিলে সুভদ্রা আর চঞ্চলকে ঘটনার বিবরণ দিল, শোনালো অনেকটা জবাবদিহির মতো। ওরা চারজনে মিলে খোঁজ নিল কখন ওরা কিরীটির শবদেহ বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারবে; হাসপাতালের স্টাফেরা জানাল শবদেহ রেখে দেওয়া হবে বিচার-সহায়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে, রাণী আর সুভদ্রার ইন্টারভিউ হবে হোমিসাইড বা সুইসাইড-এর চেষ্টা বোঝার জন্যে।

 

‘তোমাকে এত দিশেহারা লাগছে কেন, রাণী? কিরীটিকে তুমি কী যন্ত্রণা দিয়েছিলে যে ও সহ্য ক’রতে পারলো না?’; সুভদ্রা জিগ্যেস ক’রলো,- ‘পুলিশ তো ভাবছে এটা সুইসাইড বা হোমিসাইডের কেস। কী ব’লবে তুমি পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে?’

 

‘কিছু মাথায় আসছেনা; একটু ঠাট্টা ক’রেছিলাম আমি। কিরীটি শুরু ক’রলো হাসতে। আমি ভাবতে পারিনি যে ও এত জোরে হাসবে আর এত জোরে কাশবে যে ওর শ্বাস বন্ধ হ’য়ে যাবে।‘

 

‘জানতে পারি তুমি কী ব’লে ঠাট্টা ক’রেছিলে?’

 

এ-প্রশ্নের জবাব দিতে অপ্রস্তুত হ’য়ে গেলো রাণী। ও ব’ললো,- ‘সকলের সামনে ব’লতে খারাপ লাগছে- কিরীটি জিগ্যেস ক’রছিলো আমি ওর সঙ্গে সময় কাটালে বাড়ীতে আপত্তি ক’রবে কিনা। আমি ব’ললুম- আমার উপর বাড়ীর সকলের অগাধ আস্থা। তারপরে ওর দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে ব’ললুম- পারোতো একবার আমাকে ধ’রে চুমু খাও। এই শুনে ও এত জোরে হাসতে কাশতে শুরু  ক’রলো যে চেয়ারের হাতলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো অজ্ঞান হ’য়ে। আমি ওকে জাগাতে না পেরে এ্যাম্বুল্যান্সে খবর দিলাম।‘

 

‘আশা করি, পুলিশ আর ডাক্তারেরা বিশ্বাস ক’রবে তোমার কথা; তোমার কোনো সাক্ষী নেই, রাণী।‘,- ব’ললো সুভদ্রা,- ‘গতবারে তোমার পরামর্শ-মতো কিরীটিকে এ্যন্টিবায়োটিক দেওয়াতে বেঁচে গিয়েছিল কিরীটি। আমি জোর করে ব’লবো পুলিশের কাছে যে কখনই তুমি কিরীটিকে খুন ক’রতে চাইবে না।‘

 

পুলিশ আর হাসপাতালের ডাক্তারেরা রাণীর সব কথা সত্যি ব’লে মেনে নিলো, সুইসাইড বা হোমিসাইডের অভিসন্ধি খুঁজে পেলো না। ঠিক এই সময়েই পাওয়া গেল এক অভাবনীয় সংবাদ; কিরীটির শবদেহ অটোপ্সির জন্যে প্রস্তুত করার সময় বোঝা গেলো- এখনও ওর দেহে প্রাণ আছে। কিরীটির ইচ্ছেমতো শবদেহ থেকে কাজের কল-কব্জা সব বার ক’রে নেওয়ার কথা; তারপরে শব ফেরৎ যাওয়ার কথা হাসপাতালে ডাক্তারী ছাত্রদের শেখার কাজে লাগতে। কিরীটি চেয়েছিল মরার পরে ওর দেহ কিছু কাজে লাগবে। ডাক্তারেরা বুঝলো- এখনও কিরীটির ইচ্ছাপূরণের সময় হয়নি; ওকে পাঠানো হ’লো হাসপাতালের আই-সি-ইউতে। কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে ওকে; হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কিরীটি কোথায় থাকবে আর কী অবস্থায় থাকবে সেই নিয়ে গবেষণা শুরু ক’রলো রাণী, দাদা, সুভদ্রা আর চঞ্চল। ঠিক হ’লো, রাণী আর দাদাই হাসপাতাল-ফেরৎ কিরীটির দেখাশোনা ক’রবে, প্রথমে রাণীদের বাড়ীতে, পরে মামার কাছ থেকে কেনা কিরীটির বাড়ীতে।

 

এবারের জন্মদিনে কয়েক ঘন্টার জন্যে আবার পরলোকে বেড়িয়ে এলো কিরীটি; হাসতে হাসতে শ্বাসরোধ হ’য়ে মরার কষ্ট গাড়ীর ধাক্কায় প্রাণ হারানোর চেয়ে অনেক কম, কিন্তু সেই একই ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়’ অনুভূতি। এই মৃত্যুর আগে রাণীকে নিয়ে এক নতুন স্বপ্ন উদ্ভ্রান্ত ক’রেছিল, সেই স্বপ্ন নিশ্চিহ্ন হ’য়ে গেলো আবার সেই দুটি পা দেখে, পাদুটির সঙ্গে ছিল অবয়ব- ছিল কন্ঠস্বর, অনুরোধ- ‘রাণীকে মামীমা ক’রে নাও আমার জায়গায়; রাজা করো মামাকে’।

কিরীটি সুস্থ হওয়ার পরে, ওর অনুরোধে মামা ওর মেয়েকে নিয়ে ফিরলো বাড়ীতে, রাজা হ’য়ে নিয়ে এলো রাণীকে; নতুন বউ হ’য়ে ঘরে ঢোকার সময় শাড়ী-পরা রাণীর আলতাপরা পা-দুটো দেখতে পেলো কিরীটি; শ্মশানে দেখা পা-দুটোর সঙ্গে কোনো তফাৎ নেই; কিরীটি মাথা ছোঁয়ালো।

ওদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ক’রে কিরীটি চ’ললো মামার নতুন বাড়ীতে, আবার পরলোকে যাবার জন্যে প্রস্তুত হ’তে।

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু