বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চিরন্তন বাঁধনে

আজ বাড়িতে রাখী উৎসব । প্রিয়া সকাল সকাল বাসি জামাকাপড় ছেড়ে তৈরি হয়ে চলে আসে ওর শাশুড়ি বিনতা দেবীকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে । আজ অনেক রকম রান্না হবে বাড়িতে ।প্রিয়ার বড় জা বিথীর ভাইয়ের পছন্দমতো চিংড়ি মাছের মালাইকারী ,পিসি শাশুড়ির পছন্দের ইলিশ ভাপা, এছাড়া ওর স্বামী আকাশ আর ভাসুর বিকাশের পছন্দমতো চিকেন মটন তো আছেই। একটু আগে বাড়ির ছোট্ট সদস্য শিবম ,বিথীর ছেলে,বলে গেল তার গুলাব জামুনটা যেন মেনুতে থাকে ।তাকেও তো তার মামাতো বোন রাখী পরাবে ।

প্রিয়া বিথীকে ডাক দেয় "দিদিভাই একটু শোন না"

বিথী বেরিয়ে আসলে প্রিয়া বলে, "তুমি চিংড়ি মাছের মালাইকারী রাঁধতে জানো"?

"কেন জানবো না" বিথী উত্তর দিল

"তাহলে এক কাজ করো এই চিংড়ি মাছগুলো ধুয়ে চটপট মালাইকারীটা বানিয়ে ফেল"।

প্রিয়ার কথা শুনে বিথী যারপরনাই চমকে উঠে কিছু বলতে যাবার আগেই প্রিয়া বলে, "তুমি চমকাচ্ছ কেন দিদিভাই, এই প্রথম নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে তোমার ভাইকে চমকে দাও দেখি। তাছাড়া আজ আরও কিছু চমক অপেক্ষা করে আছে যে "।

************************

দাদার শিক্ষা ও মা বাবার আদর এবং সংস্কারে লালিত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বিনতা দেবীকে শুধুমাত্র রূপ দেখে চৌধুরী বাড়ির বৌ করে এনেছিলেন ওনার শ্বশুরমশাই ।বিয়ের দুদিন বাদে পুরোনো রান্নার লোককে বিদায় দিয়ে বিনতা দেবীর শাশুড়ি আশালতা দেবী সেই যে তাঁকে রান্নাঘর দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওইটাই তার জগত যার মাধ্যমে তিনি এই সংসারে তাঁর অবদান রাখতে পারেন, কারণ এছাড়া এই চৌধুরী বাড়ির বৌ হওয়ার আর কোন যোগ্যতাই নাকি তার নেই । স্বামী প্রণবেশ চৌধুরী নামি উকিল, নিজের কাজে সদা ব্যস্ত মানুষ সংসারে স্ত্রীর পদমর্যাদার হাল হকিকত জানার বিন্দু মাত্র সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই তাঁর ছিলনা। কিন্তু বিনতা দেবীর শ্বশুরমশাই যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন বৌমার খেয়াল রাখতেন বৈ কি ।

তবে সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই রান্নাঘরটিই হয়ে উঠেছে তার একান্ত উপাসনা ক্ষেত্র, যার মাধ্যমে তিনি আজও সবাইকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করে চলে এসেছেন । ছেলেদের ছোট থেকে কাজের লোক আর ঠাকুমার সাহচর্যে বেড়ে ওঠার ফলে মায়ের সাথে আত্মিক সম্পর্ক সেরকম গড়ে ওঠেনি ।মায়ের প্রয়োজন নিয়ে আগ বাড়িয়ে কখনো জানতেও চায়নি এমনকি বিথী এ বাড়িতে আসার পর সংসারে শাশুড়ির এ হেন পরিস্থিতি দেখে সেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না।চারিদিক থেকে বিভিন্ন ফরমায়েশ আসে আর বিনতা দেবী আজও হাসিমুখে পালন করে চলেন সবকিছু । কারোর ঠিক ভুল ধরার বা কোনপ্রকার আদেশ বা উপদেশ দেবার অধিকার আজও তাকে দেওয়া হয়নি বা তিনি নিজেও সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেননি হয়তো। যেমন চলছে তেমনই চলুক এমন মনোভাবই পোষণ করে এসেছেন ।

বিনতা দেবীর মনে পড়ে রাখীর দিন ওনাদের বাড়িতে এত আড়ম্বর না হলেও একটা কম দামি রাখী দাদার হাতে পরিয়ে দিয়েও যে অনাবিল আনন্দ উৎসবে সবাই সামিল হত, তার গুরুত্ব তাঁর কাছে অপরিসীম । কিন্তু বিয়ের পর প্রথম রাখীর দিন এই বাড়ির বৌকে দেওয়ার মতো উপযুক্ত উপহার আনার যোগ্যতা না থাকার ফলে আশালতা দেবীর কাছে অপমানিত বিনতা দেবীর দাদা অমরেশ বাবু সেই যে এ বাড়ির চৌকাঠ পেরোলেন, আজও তাঁর পায়ের ধুলো এই বাড়িতে পড়েনি।

*************************

কিন্তু বিনতা দেবীর ছোট বৌ প্রিয়া সবার থেকে আলাদা । সে যেন একটু একটু করে বিনতা দেবীর মনের সকল গোপন যন্ত্রণায় আবদ্ধ দুয়ার খুলে সেখানে প্রবেশ করিয়েছে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার আলো । নিজেকে নিয়ে একটু হলেও ভাবতে শিখেছে সে। রান্নাঘরের বাইরে বিনতা দেবী গড়ে তুলেছে তার আর একটি জগত, যেখানে সে বাড়ির ছাদে টবের মধ্যে বিভিন্ন গাছের জন্ম দেয়, গুন গুন করে গেয়ে ওঠে ফেলে আসা হারমোনিয়ামে তুলে রাখা সুরের বাহার, ছুঁচ সুতোর মিলনগাঁথায় ফুটিয়ে তোলে বাহারি ফুলের নকশা, প্রিয়ার আব্দারে অনেকদিন পর তৈরি করে ফেলে নানাবিধ আচার ।আর প্রণবেশ বাবু এত বছর পর যেন নতুন করে চিনতে শুরু করে তার স্ত্রীকে। ছেলে দুটোও আজকাল মায়ের দরকার অ-দরকারের খেয়াল রাখে মাঝেমাঝে। বিনতা দেবী ভাবে সত্যি মেয়েটা বোধহয় জাদু জানে, তা না হলে এতদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা ওর মধ্যেকার সকল গুণগুলোকে একে একে জাগিয়ে তোলে কিভাবে। সে তো নিজেই ভুলতে বসেছিল নিজের প্রতিভা ।প্রিয়া অফিস থেকে ফিরে কিংবা ছুটির দিনগুলোতে শাশুড়ির পায়ে পায়ে ঘোরে ওর হাতে হাতে কাজ করে ,শিখে ফেলে আচারের রেসিপি কিংবা সেলাই এর ফোঁড় আর ফাঁক পেলেই শোনে তাঁর জীবনের ফেলে আসা কিছু কথকতা। বিনতা দেবীর মনের কোণে জমিয়ে রাখা অনেক ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা এখন প্রিয়া জানে।

*************************

বিথী কোন কথা না বাড়িয়ে মালাইকারী রান্নার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। কারণ ও জানে এর আগে একদিন ছেলের জন্য বিনতা দেবীকে স্টু বানাতে বলতেই প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল "ওহো দিদিভাই তুমি নিজেই একটু বানিয়ে নাওনা প্লিজ, আমার মায়ের সাথে একটু দরকার আছে"

সেই কথা শুনে আশালতা দেবী বলেছিলেন, "আগে ও বড় নাতবউ এর কাজটা করে দিক, তারপর না হয় তুমি নিয়ে যেও তোমার শাশুড়িকে"

শুনে প্রিয়া বলেছিল, "কেন ঠাম্মি দিদিভাই যদি নিজের হাতে স্টু বানিয়ে শিবমকে খাওয়ায়, তবে তো কোনও দোষের নেই, তাই না ?কারণ মা তো এতদিন ধরে এই কাজটিই করে এসেছে"

প্রিয়ার কথায় ভরপুর যুক্তি লক্ষ করে বিকাশ-ও সেদিন প্রিয়াকে সমর্থন করে বলে, "ঠিকই তো বিথী যখন আজকে বাড়িতেই আছে, তখন স্টু টা করে ফেলতে অসুবিধা কোথায়"।

বাড়িতে অতিথি সবাই হাজির । সকলের হাতে রঙিন সব রাখী শোভা পাচ্ছে ।বিনতা দেবী সকলকে খেতে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন কি প্রিয়া এগিয়ে এসে বলে "দাঁড়াও মা এখনও একটা কাজ বাকি আছে যে, আমাদের বাড়িতে এখনও একজনের এসে রাখী পরা বাকি আছে "- সবাই একটু অবাক হয়।

আশালতা দেবী প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, "আবার কে আসবে শুনি সবাই তো এসে গেছে।"

"সবুর করো ঠাম্মি, এক্ষুনি দেখতে পাবে" বলে প্রিয়া কলিং বেল বাজার পর দরজা খুলতে এগিয়ে যায়।

দরজা খুলতেই সবার নজরে পড়ে সেখানে অমরেশ বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। বিনতা দেবী এর বিন্দু বিসর্গ জানতেন না, তাই খুবই অবাক হন, কিন্তু পরক্ষণেই বহু বছর পর দাদাকে দেখে যারপরনাই আনন্দিতও হন।

"আসুন মামাবাবু " বলে প্রিয়া অমরেশ বাবুকে ভেতরে নিয়ে এসে বিনতা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, " দাও মা মামাবাবুর হাতে রাখী পরিয়ে দাও" তারপর আশালতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে, "আজ আর মামাবাবু মা'র জন্য কত দামি উপহার এনেছে দেখতে যেওনা ঠাম্মি । ভাইবোনের চিরন্তন সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে রাখীর বাঁধন, একজন বোনের কাছ থেকে এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না । তাছাড়া আমি বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই মামাবাবুকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম"।

তারপর একটা রাখী নিয়ে বিকাশের কাছে গিয়ে বলে, "দাদাভাই আমার তো কোন দাদা নেই, তোমাকে যদি রাখী পরাই তবে কি তুমি কিছু মনে করবে"?

শুনে বিকাশ হেসে ফেলে, " ধুর পাগলী তোর মতো বোন পাওয়া তো ভাগ্যের কথা রে, যা আমরা কোনদিন করার কথা ভাবিনি, আসলে ভাবার প্রয়োজনই মনে করিনি, তা তুই করে দেখিয়ে দিয়েছিস। আজ থেকে তুই আমার আদরের ছোট বোন-ই তো হলি। নে পরা রাখী" বলে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয়।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ, বিকেলে বসার ঘরে সবার সামনে বিনতা দেবী প্রিয়ার অনুরোধে অনেক দিন পর গান গাইছেন ,ফিরে পেয়েছেন নিজের হারানো সুর, হারানো সম্পর্ক। আর আকাশ প্রিয়ার কানের কাছে মুখটা এনে বলে, "প্রাউড অফ্ ইউ প্রিয়া ।আগের থেকে আরও অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়" আর লজ্জায় প্রিয়ার মুখটা পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের লাল ছটায় রেঙে ওঠে।

ছবি - গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু