বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চিরসখা - ঝিলিক মুখার্জী গোস্বামী

বকখালি

 

  বকখালির নদীর চর জনমানবশূন্য প্রায়। নদীর পাড়ের কাঁটা গাছ গুলো, তিক্ত স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র বেগে ধেয়ে আসা 'ইয়াস' ঝড়ের ক্ষতির পরিমাণ প্রচুর হলেও, কাঁটাগাছ গুলো দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। প্রন্তিক মানুষ গুলোর স্বজন হারানোর কান্না, আমি আজও শুনতে পাই। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়েও আগলে রাখতে পারিনি ওদের। নদীর আসুরিক ক্ষমতার কাছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানব জাতি সর্বদা পরাজিত সৈনিকদের মতো বিধ্বস্ত।

 

  শহরতলি তে থাকলেও, শহরের আদবকায়দা রপ্ত করতে পারিনি। নিজের মধ্যেকার মনুষত্ব বা বিবেককে গঙ্গার জলে বিসর্জিত করতে পারিনি। হতে পারিনি যান্ত্রিক। অফিস কাছারি সেরে বাকি সময়টুকু উৎসর্গীকৃত ছিল, মানুষের সেবা ধর্মকর্মে। কথায় আছে, 'জীবে প্রেম করে যেই জন। সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।' সেই টানেই, ঝড়ের ঠিক আগেই চলে আসি প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে।

 

****

 

নদীর শূণ্য চরে, বালিকণা মাখা পদ যুগল দৃষ্টিগোচর হল। চেনা মানুষের শরীরের ঘ্রাণে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। সেদিনের আঁধার কেটে গিয়ে, আকাশ জুড়ে নক্ষত্রমণ্ডলের ক্রীড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমার উপস্থিতি জানান দিতে, গলার আওয়াজ তুললাম। রাঙা জবার মতো আঁখি যুগল দেখে, যতটা না চমৎকৃত হয়েছি তার থেকে পেয়েছি বেশি দুঃখ। ওই চোখের ভাষা আমার খুবই চেনা।

 

-" তোর সাথে ভাব জমানোর কোনো রকম ইচ্ছা নেই।"

-"তোর অহেতুক অজ্ঞাতবাসে, আমি যারপরনাই বিরক্ত।"

 

ইয়েলিনের কথার প্রতি উত্তর দিয়ে বলি,

 

-" আমাকে যে তোর কাছে আসতেই হতো।"

-"প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে।"

-" তার থেকেও বেশি যেটা... "

 

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে, ইয়েলিন বলে ওঠে

 

-" আমরা কৃষ্ণার্জুনের মতো চিরসখা।"

 

সেদিনও আকাশে নক্ষত্ররাজির বিরাজ ছিল। আজও ঠিক তাই। দুই সখা একে অপরের কাছে সাজিয়ে তুলেছে দুঃখের ডালি। পরমাত্মা যেন কোনো কিছুর ইঙ্গিত প্রকাশিত করতে চায়। ইয়েলিনের অভিযোগ পর্বে সমাপ্তির রেখা টানা হলে আমি শুরু করি,

 

" কোলকাতা থেকে এসেছিলাম প্রান্তিক মানুষ গুলোকে সাহায্য করতে। ওদের সাথে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নদীর বাঁধের মেরামতের কাজে সাহায্য করেছিলাম। যখন আমরা সবাই ক্ষিপ্র গতিতে সেই নদী বাঁধের মেরামতের কাজে ব্যস্ত ! অকস্মাৎ..."

 

ইয়েলিন উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,

-" অকস্মাৎ?"

 

-" প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নদী হঠাৎই ফুঁসতে শুরু করে। অকস্মাৎ সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। যখন পাড়ে এসে আছাড় মারল আমরা সবাই একসঙ্গে কোথায় হারিয়ে গেলাম।"

 

আমার কথা শেষ করে ওর দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম ওর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠেছে ঠিক যেমন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় নদী পাড়ের বালি গুলো চিকচিক করছে।

 

-" তার মানে তুই তুই..."

 

ওর কথা শেষ হতে না দিয়েই বলি,

- " হ্যাঁ আমি হারিয়ে গিয়েছি তোর থেকে। আলতো ছুঁয়ে দেখ।"

 

-" তোকে বলেছিলাম যে, আমরা কৃষ্ণার্জুনের মতো চিরসখা।"

 

****

 

কোলকাতা

 

বই পড়ার নেশা আমার বরাবরের। যতই অফিসে কাজের চাপ থাকুক না কেন, রাতের বেলা ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর আগে বই এর দেশে পাড়ি দিতেই হয়।

 

গতকাল রাতে খুবই সুন্দর একটা বই পড়ার পর সকাল থেকে মনের মধ্যে খুশির তান্ডব নৃত্য চলছে। বইটা পড়ার পর থেকে কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছি।

 

কৃষ্ণার্জুনের বন্ধুত্বের গল্পটা ঠিক আমাদের বন্ধুত্বের মতো না হলেও কিছু কিছু জায়গার সাথে নিজেদের বন্ধুত্বকে রিলেট করতে পারি। ওঁদের মতো আমরাও যে চিরসখা। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগের ফলাফল যে এক।

 

এদিক ওদিক ভাবতে ভাবতেই মুঠোফোন হাতে তুলে, প্রাণের সখাকে টেক্সট করে বসি,

 

-" কৃষ্ণার্জুনের মতো আমাদের সুখ-দুঃখের পরিধি এক।"

-" আমরা যে চিরসখা।"

-" বন্ধুত্বে নাই বা লিঙ্গ খুঁজতে এলি!"

 

****

 

প্রভাস

 

দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষ ব্যাপি, ফাল্গুনী কঠোর এবং কঠিন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনে লিপ্ত হয়েছেন। গঙ্গাদ্বার, মণিপুর সহ আরও কয়েকটি বিশেষ জায়গা পরিভ্রমণ করে অবশেষ এসে পৌঁছেছেন প্রভাসে অর্থাৎ সোমতীর্থে। কয়েকজন সঙ্গী সাথী যথা, পুরোহিত, সূপাকার সমেত প্রভাসের স্বচ্ছতোয়া সরস্বতী নদীর তীরে তাঁদের অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের সকলের দিন-রাত্রি যাপনের নিমিত্ত একটি পর্ণকুটির নির্মিত হয়েছে। কয়েকজন সঙ্গী সাথী সমেত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকলেও অর্জুনের মন সর্বক্ষণ একটি নাম স্মরণ করে। তাঁরা প্রিয় সখা, দ্বারকাধীশকে। প্রভাসে আসা ইস্তক তাঁর মন বলছে, কাছেপিঠে কোথাও যেন তাঁর প্রিয়সখা অবস্থান করছেন। মনে মনে বার কয়েক কৃষ্ণনাম যপ করল সে। এ ব্যপারেও অর্জুন নিশ্চিত, তাঁর দুঃখের কারণ গুলো যদি কেউ বুঝতে পারে সে হল এক এবং একমাত্র তাঁর প্রিয়সখা।

 

  সকালের প্রাত্যহিক কাজকর্ম সমাপ্ত করে সূপকারের তৈরি করা খাবার খেয়ে স্বল্পাহারী অর্জুন নিভৃতে বসলেন 'বূহ্য' পাঠে। মণিপুর রাজ, চিত্রবাহনের থেকে উপহার স্বরূপ পয়েছেন তিনি। পঠন পাঠনে প্রায় মনোনিবেশ করেছেন! এমন সময় তাঁর নামের আওয়াজ ভেসে এল। এই কন্ঠস্বর তাঁর অতি পরিচিত। এ যে তাঁর প্রিয়সখা, কৃষ্ণের কন্ঠস্বর।

 

  সূপকারের কর্তৃক আয়োজিত সুস্বাদু, রাতের খাবার খেয়ে কৃষ্ণার্জুন  নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে সরস্বতীর পাড়ে সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর নিজেদের শরীর এলিয়ে দিলেন। দুই সখা নিশ্চুপ প্রায়। অর্জুন ই প্রথম বলে উঠল,

 

-" হা কৃষ্ণ!"

-" তুমি তো অন্তর্যামী।"

-" কুচক্রী যুধিষ্ঠিরের কুচক্রের বলি হিসাবে নিজের জীবনের দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষ পাঞ্চালী সমেত মাতা এবং গৃহছাড়া।"

 

এরপর দুই সখা একে অপরের কাছে নিজেদের দুঃখের কথা ব্যক্ত করলেন। এতগুলো বৎসর পেরিয়ে, দুই প্রাণসখা একে অপরকে কাছে পেয়ে বিগলিত প্রায়।

_______

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু