আঙুলে আঙুল রাখলেও
হ্যালো!
হাই!
চলো।
কোথায়?
লং ড্রাইভে।
এ...খ...ন?
হ্যা... জলদি তৈরি হয়ে নাও। বিকেল হয়ে আসছে। ঠান্ডা ঠান্ডা দিন। বেশ রোমান্টিক ওয়েদার কিন্তু... দারুন লাগবে। আমি আসছি তোমায় পিক আপ করতে।
ধানী সবুজ পাড় ওয়ালা আকাশনীল শাড়ি, হাতে রূপালী কঙ্কণ, চোখে আলতো কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। বেশ সেজেছে রূপসা। গমরঙা উজ্জ্বল ত্বকে, খুব সুন্দর লাগছে তাকে।
অরিন্দমের গায়ের রং খুব একটা ফর্সা না হলেও ওর পেটানো শরীর আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, হালকা সবুজ পাঞ্জাবী আর ডেনিমে, অন্য দিনের চাইতে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে অরিন্দমকে। অরিন্দম গাড়ি নিয়ে এসে রূপসাকে পিক আপ করে নেয়।
বিকেলের ঝিরঝির বাতাসের বুক চিরে, অনেক ক্ষন ধরে তাদের গাড়ি ছুটে চলে হাইওয়ে ধরে। বেশ কিছুটা দূর এগিয়ে গাড়িটা রাইটটার্ন নিয়ে পশ্চিম দিকের একটা সরু রাস্তা ধরে চলতে থাকে সোজা। খানিকটা গিয়ে গাড়িটা থামে একটা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের কাছে। ওরা এসেছে "শনবিল" ঝিলে, সূর্যাস্ত দেখার জন্য। ঝিলটা মাঠের আরেক প্রান্তে।
সূর্যাস্ত এখনো বেশ কিছু সময়ের অপেক্ষা। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করেছে মাত্র। মাঠভরা কাঁচা ধানের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঢেউ খেলানো বাতাস, দূরে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফিরে এসে আবার ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের আলতো করে। আলবেয়ে দুজনে এগোতে থাকে হাতে হাত রেখে, প্রজাপতির মতো। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, হেঁটে যেতে যেতে পৌঁছে যায় একসময় ঝিলের ধারে।
এখানে আসার কথা অনেক দিন ধরেই ভাবছিলো ওরা। আজ আসতে পেরে তাই খুব ভালো লাগছে ওদের। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল, আর নানা রকমের পরিযায়ী পাখির সমারোহ! রূপসা তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করে চারদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য।
ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। একটা নৌকা ডেকে নিয়ে তাতে প্রথমে উঠে পড়ে অরিন্দম, তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় রূপসার দিকে। অরিন্দমের হাতে হাত রেখে রূপসা চড়তে যেতেই ঈষৎ দুলে উঠে নৌকাটা। ভয়ে, উঠেই অরিন্দমকে জাপ্টে ধরে রূপসা। কিছুটা সামলে নিয়ে, দুজনেই বসে সাবধানে নৌকার পাটাতনের উপর। তারপর পরম নিশ্চিন্তে অরিন্দমের কাধে মাথা রাখে রূপসা।
মাঝি দাঁড়ে টান দিলে, নৌকা চলতে থাকে। যেতে থাকে এগিয়ে ধীরে ধীরে। ঝিলটা আজ প্রায় অনেকটাই ফাঁকা। মাঝি ছাড়া ঘুরতে আসা মানুষজন কেউ নেই বললেই চলে। নৌকা যখন ঝিলের প্রায় মাঝখানে, তখন খানিক দাঁড় টানা বন্ধ করে দিয়ে নৌকাটাকে ভাসিয়ে রাখে মাঝি কিছুটা সময়।
অরিন্দম আর রূপসা দেখে , গোধূলির আলো মাখানো জলের উপর কেমন ভেসে খেলা করতে ব্যস্ত মাছেরা। ঝাকে ঝাকে বলাকারা ফিরে চলেছে আপন কুলায়। আশে পাশের গাছগুলো থেকে কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝিলের সীমান্তে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হারিয়ে যায় ওরা। আপন মনে গান ধরে রূপসা, অরিন্দম গলা মেলায় তার সাথে।
জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। এবার ওদের ফেরার পালা। মাঝিকেও নৌকা ভেড়াতে হবে ঘাটে। ঘাটে ফিরে নৌকো থেকে নামতে আবার সেই ভয়। শাড়ি সামলে নামতে গিয়ে টালমাটাল অবস্থা। অরিন্দম রূপসার হাত দুটো, শক্ত করে চেপে ধরে সাবধানে নামায় তাকে।
এতক্ষণ যে মেঘ সূর্যের সাথে খেলা করছিল হঠাৎই ঝরে পড়তে শুরু করে বৃষ্টি ধারায়। আচমকা বৃষ্টিতে হতচকিত দুজনেই ঝটপট আশ্রয় নেয় একটা গাছের নীচে। ততক্ষণে ভিজে গেছে রূপসার শাড়ির নিচের অংশ। গাছের নীচে রূপসার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে অরিন্দম। অরিন্দমের ভেজা চুল পরম যত্নে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে থাকে রূপসা।
মেঘ কাটিয়ে তখন তারাদের নিয়ে ঝলমল করছে পূর্ণ চাঁদ, পূর্ণিমার আকাশ জুড়ে। তারই ছটা এসে পড়েছে জলে স্থলে! রূপসার বুকের কাছ থেকে ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধ মাতাল করতে থাকে অরিন্দমকে। রূপসার এলোমেলো ভেজা চুল অরিন্দমের মুখ ঢেকে পূর্ণিমার রাতে এনেছে অমাবস্যার ঘোর। অরিন্দম একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রূপসার মায়াবী কাজলা চোখের দিকে। তার দৃষ্টি আবেশ মাখায় রূপসার মনের গভীরে। রূপসা আস্তে আস্তে মুখটা নামিয়ে এনে অরিন্দমের ঠোঁটে আঁকে একটা দীর্ঘ চুম্বন।
এলার্মের শব্দে কেঁপে ওঠে রূপসা। চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। ফোনটা রেখে দেয় সাথে সাথে। মনে মনে বলে, "পুরনো স্মৃতি আর হাতরে লাভ নেই।"
বেশী চলাফেরা করতে পারে না আজ আর সেদিনের সেই প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা। অরিন্দমের আবদারে কপট রাগ দেখিয়ে বলা 'আমি চলেই যাব' অভিমানী কথাটা যে জীবনের সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবে তা আজও ভাবতে কষ্ট হয় রূপসার।
এপোড়া সংসারে সে যতই একা হোক, যতই কষ্ট পাক, পুরোনো বন্ধুকে মনে করে মন ভুলানোর নাম এখন শুধুমাত্র বদনাম, পরকীয়া। অরিন্দম যে আজ বিবাহিত। দূরে কোথাও থেকে গান ভেসে আসে
" মনে পড়লেও
আজকে তোমায় মনে করা বারণ।
প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ। তোমায় যতো গল্প বলার ছিলো...."
দুচোখ ঝাপসা হয়ে উঠে মুহূর্তে।
DCR