Back to Book Details Report Reviews

ভবিতব্য

কালীপুজোর দিনটা আসলেই মনটা আবার কেমন যেন হয়ে যায় কাজলের। পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় ওর । বাবার দেশের বাড়িতে কালীপুজো হতো কতো ঘটা করে। কাজলের ঠাকুরদা মারা গেছিলেন কাজলের দশ বছর বয়সেই। কালীপুজোটি হয়ে আসছে কাজলের ঠাকুরদার বাল্য বয়স থেকেই। কাজল ওর বাবার কাছে শুনেছিল যে ওর ঠাকুরদার জ্যাঠা স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিলেন বাড়িতে মায়ের ভবতারিণী রূপে পুজো করার। সেই থেকে ঐ পুজো চলে আসছিল বছরের পর বছর ধরে। ঐ জ্যাঠামশাইয়ের দুটি মেয়ে ছিল। তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছিল একসময়। জ্যাঠামশাই মারা যাবার পর কাজলের ঠাকুরদার বাবা এবং পরে ঠাকুর দা নিজেই দায়িত্ব সহকারে পুজোটি করে এসেছেন। তারপর সেই পুজো কাজলের জ্যাঠা, বাবা আর কাকা তিনজন মিলেই করতেন। কাজলের বাবা কাজের সূত্রে কলকাতা চলে আসলেও পলাশপুরে দেশের বাড়িতে কাজলের ঠাকুমা জ্যাঠা, জেঠিমা জ্যাঠতুতো দুই দাদা আর ছোটকা থাকতেন। কাজলের মনে পড়ে ছোটকার কথা।ছোটকার তখনও বিয়ে হয়নি। উনি কাজল আর মিনু মানে কাজলের পিসতুতো বোন এই দুজনের জন্য নিজের হাতে তুবড়ি আর রঙমশাল তৈরি করে রাখতেন। আর পুজোর দিন সন্ধ্যেবেলা দুই বোনকে সাথে করে সেই বাজিগুলো পোড়াতেন। তাছাড়া এই ছোটকাই তো ছিল ওদের যতরকমের আবদার মেটানোর মানুষ। এরপর ছোটকার বিয়ে হলে বাড়িতে আরও একজন সদস্য বেড়ে যায়। ছোটকাকির সাথেও কাজল আর মিনুর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।


আর মিনুর সাথে কাজলের সম্পর্ক ছিল পিঠোপিঠি। কাজল জন্মানোর মাস তিনেক পড়েই হয়েছিল মিনু। ফলে দুজনের মধ্যে ভাবও যেমন ছিল কথা কাটাকাটিও হতো মাঝেমাঝে। বিশেষ করে যখন মিনু কাজলকে নাম ধরে ডাকত আর কাজল রেগে যেত। বলত - আমি না তোর থেকে বড়ো। দিদি বলে ডাকবি। মিনুও ঠোঁট উলটে বলত - ইস্ ভারি তো তিন মাসের বড় তাকে আবার দিদি বলে ডাকতে হবে। বয়েই গেছে আমার। বলেই খিলখিল করে হেসে দৌড় লাগাত আর কাজল তার পেছন পেছন।


বারান্দায় মোমবাতিগুলো লাগাতে লাগাতে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে যাচ্ছে কাজল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল যেন অন্তর থেকে। একটা অনুতাপের আঁচ যেন গনগনিয়ে উঠছে মনের গভীরে। কাজলের একটা ভুল, ক্ষণিকের মতিভ্রম চিরকালের মতো মিনুকে দূর করে দিয়েছিল ওর থেকে ভাবলেই এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে এসেও কুঁকড়ে যায় কাজল।

পুজোর সময় দেশের বাড়িতে দুজনে এক হলে আর দেখে কে ওদের। সারাক্ষণ দুজনে একসাথে। পুজোর কোন কাজই হোক বা খেতে বসা সবেতেই দুটিতে পাশাপাশি। সারাবছর জমিয়ে রাখা শতেক কথা বলে চলত একে অপরকে।

সেবার দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। কে কেমন প্রিপারেশন নিচ্ছে সেসব কথা আলোচনা করার ফাঁকেই মিনু হঠাত্ই কাজলকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে শুনিয়েছিল তার প্রথম প্রেমের কথা। ছেলেটির নাম ছিল প্রভাত। তখন মোবাইল ছিল না। তবে ল্যান্ডফোন ছিল দেশের বাড়িতে। কিন্তু সেখান থেকে কথা বলা সম্ভব নয় বলে মিনু কাজলকে নিয়ে সুবিধে বুঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশেই একটি দোকান থেকে ফোন করে কথা বলিয়েছিল কাজলকে প্রভাতের সাথে। প্রভাতের স্থানীয় একটি ইলেকট্রনিক্সের দোকান ছিল। ব্যবসার মান নাকি বেশ ভালোই ছিল। মিনুর মুখেই শুনেছিল কাজল। তারপর পুরো পুজোটাতেই শুধু তারই কথা বলে গেছিল মিনু। শুধু কী তাই । বাড়ি ফেরার পরেও ফোন করে দেওয়া চলত প্রভাত বার্তা। সরস্বতী পুজোতে কিভাবে দুজনে মিলে স্কুলে স্কুলে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিল।


- তোর ভয় করেনি ? কেউ যদি দেখে ফেলত। কাজল জিজ্ঞেস করেছিল।

- ধ্যাৎ ! ভয় করবে কেন ? আমরা কী থোড়াই হাত ধরে হাঁটছিলাম। ও কখনো আগে হাঁটছিল তো কখনো পিছনে। আর আমার সাথে এক বান্ধবীও তো ছিল।

সেদিন কাজলের মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল। মিনুর প্রতি এই অনুভূতি কাজলের হওয়ার কথা নয় তবুও হয়েছিল। তাই যখন মিনুর ভালোবাসার কথা আঁচ করতে পেরে ওর মা কাজলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন - হ্যাঁ রে কাজল মিনুর কী কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ? তোকে তো ও সব বলে। তুই নিশ্চয়ই জানবি। তখন কাজল চাইলেই বিষয়টিকে আড়াল করে দিতে পারত। বলতেই পারত - কৈ আমাকে তো মিনু কখনো তেমন কিছু বলেনি। কিন্তু কাজল তা করেনি। বলে দিয়েছিল সবকিছু।


ঠাকুরঘরে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে বিগ্রহের দিকে তাকায় কাজল। চোখটা ছলছল করে ওঠে ওর। যেন বিগ্রহও জানতে চায় ওর কাছে কেন সেদিন এমন কাজ করেছিল কাজল। নিজের ভালোবাসা অপূর্ণ থেকে গেছিল বলে ? তাইই তো। কাজলও তো ভালোবেসেছিল অপূর্ব দা'কে। অঙ্ক করাতো অপূর্ব দা। কী ভালো স্টুডেন্ট ছিল অপূর্ব দা। এম এস সি করছিল তখন। সকলের মুখে অপূর্ব দার প্রশংসা কাজলকে অপূর্বের দিকে আকর্ষিত করেছিল ওর অজান্তেই। কিন্তু যেদিন শুনল অপূর্ব পাড়ারই মেয়ে পারমিতা দি'কে ভালোবাসে সেদিন সারারাত বালিশ ভিজিয়েছিল কাজল।  ওদের দুজনের বিয়ের দিন পেট ব্যাথার অজুহাত দিয়ে বাড়িতেই থেকে গেছিল কাজল।যেখানে নিজের প্রেম পূর্ণতা পায়নি সেখানে মিনুর প্রেম পরিপূর্ণতা পাক এমনটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি কাজল। ফলও হয়েছিল মারাত্মক। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরই মিনুর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল ওর মা। যদিও মিনুর বাবা আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু ধোপে টেকেনি। আর মিনুও অভিমানে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সকলের কাছ থেকে। কাজলের কাছ থেকেও।


কিন্তু মিনুর সে বিয়েটা সুখের হয়নি কোনদিন। নেশা করত ওর বর। গায়ে হাতও তুলত মিনুর। লেখাপড়াটাও আর করতে দেয়নি মিনুকে।  কাজলদের বাড়ি এসে আফসোস করেছিলেন কাজলের পিসি মিনুর মা। বলেছিলেন - সরকারি চাকরি দেখে বিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম মেয়েটা ভালো থাকবে। এখন দেখছি তড়িঘড়ি বিয়েটা দিয়ে ভুলই করেছি। কথাও শুনেছিলেন উনি এইজন্য বাড়ির লোকেদের কাছে। আত্মগ্লানিতে ভুগেছিল কাজলও। কিন্তু তাতে মিনুর ভাগ্য খন্ডন করা যায়নি।মিনু যখন ছেলের মা হলো সে খবরও পেয়েছিল কাজল ওর পিসির কাছ থেকে কিন্তু এরপরও কাজল শত চেষ্টা করেও মিনুর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। মিনুর কাজলের প্রতি অভিমান কাজলের পায়ে সংকোচের বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। সাহস করে উঠতে পারিনি কখনো কাজল মিনুর সাথে দেখা করার। চিঠি লিখে ক্ষমাও চেয়েছিল কাজল কিন্তু সে চিঠির জবাব কাজল কোনদিন মিনুর কাছ থেকে ফেরত পায়নি। কিন্তু গেল বছর যখন খবরটা এলো, মিনু আর নেই। পৃথিবীর সব মোহমায়া কাটিয়ে সে পরপারে যাত্রা করেছে তখন কাজল ছুটে গেছিল। মিনুর নিথর শরীরটাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। সেদিন মিনু কোন বাধা দিতে পারেনি। মনে হয়েছিল সেদিন যেন মিনু অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করেছে কাজলের কাছে। যেন বলেছিল আর কিসের দ্বন্দ্ব। এবার যে কেবলই শান্তি। মিনুর ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল কাজলকে - জানো তো মাসি মা তোমার কথা খুব বলতো আমাকে। বলতো তোমাদের দেশের বাড়ির পুজোর কথা। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সেই পুজোয় যেতে কিন্তু মার বারণ ছিল। কারণ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত। তবে আমাকে মা বলেছিল - যেদিন আমি থাকব না সেদিন তোর কাজল মাসিকে খবর দিস। সেদিন সে আসুক আমার কাছে।

- তোর মা যে অভিমান করেছিল আমার ওপর।এইটুকুই সেদিন বলতে পেরেছিল কাজল। সেদিন যেন মিনুর মুখমণ্ডলে অন্যরকম এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল।


দেশের বাড়ি পুজোটা এখনও হয়। পুরোনো প্রজন্মের অনেকে একে একে বিদায় নিলেও পরের প্রজন্ম খুব সুন্দর করে ধরে রেখেছে পুজোটাকে। তবে নানা কারণ দেখিয়ে কাজল সেখানে যায় না বহুদিন হলো। মিনুর বিয়ের বছর দুই পর কাজলেরও বিয়ে হয়ে যায়। তারপর বছর ঘুরতেই মেয়ে। প্রথম প্রথম সংসারের আর  এখন তো শরীরের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায়। মিনুকে যে ভীষণ মনে পড়ে। মনে পড়ে নিজের কৃতকর্মের কথা। সেদিন যদি পিসিকে ঐ কথাগুলো না বলত কাজল তবে কী মিনুর জীবনের পথটা অনেক মসৃণ হতো নাকি এটাই ছিল মিনুর ভবিতব্য? প্রশ্নটা আজও কাজল নিজেকে করে চলে কিন্তু কোন সদুত্তর মেলে না।

*****************************

 ছবিঋণ :- গুগল

Reviews


Your Rating

blank-star-rating

Left Menu