বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

ঋতু বসন্ত

আলো আঁধারে তোমায় দেখেছি।
দেখেছি গোধূলির অবগাহনে, সন্ধ্যার দীপমালা গলে।
- তাই বুঝি ?
- নয়ত কী। মনে নেই আমার বন্ধু অশোকের বাড়ির ছাদে সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যেবেলা যখন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম তখন সূর্য পশ্চিম পাটে শেষ পর্যায়ে।অবশিষ্ট আবছা আলোয় তোমার মায়াবী রূপ আমায় প্রথম দর্শনেই ঘায়েল করে দিয়েছিল ঋতু।
- মানে যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট?
- একদম।
- ধূর ! তোমার যত বাড়াবাড়ি। অমন আবার হয় নাকি।
- হয় গো হয়। যাদের হয় একমাত্র তারাই বোঝে প্রথম দেখা প্রেমের গুরুত্ব । যেমন বুঝেছিল তোমার বান্ধবী, অশোকের বোন সুতপা। আমাকে পরেরদিন ওদের বাড়িতে যেতেই একফাঁকে সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল - কী ব্যাপার বলো তো বসন্তদা, কাল যেন মনে হল ঋতুর প্রতি তোমার নজর একটু বেশিই তীক্ষ্ণ ছিল। আমিও কথা ঘুরিয়ে সময় নষ্ট না করে বলেই ফেললাম - কিছু ব্যাবস্থা কর তপু। নইলে যে ধনে প্রাণে মরব। শুনে মুখটা করুন করে খবরটা দিয়েছিল তপু - হাল ছেড়ে দাও বসন্ত দা। ঋতুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের বৈশাখে।


- আহারে ! খুব দুঃখ পেয়েছিলে নিশ্চয়ই?
- একটা বৈদ্যুতিক শক বলতে পারো। কারণ ততক্ষণে তোমাকে নিয়ে একটা গোটা রাতে আমি অনেকটা জীবন কাটিয়ে ফেলেছি। পাশাপাশি বসে নন্দনে সিনেমা দেখেছি। হাতে হাত ধরে হেঁটেছি ভিক্টোরিয়ার সামনে। তুমি গ্যাস বেলুন কিনে বাচ্চাদের মতো উড়িয়ে দিয়েছ আকাশে।কখনো বাচ্চাদের মতো বায়না করেছ ফুচকা খাবে বলে। যদিও সবটাই ছিল আমার রাতজাগা ঘরে তোমাকে নিয়ে হাজার কল্পনার আঁকিবুকি তবুও সেই মুহূর্তগুলো সত্যি করার তাগিদ জেগেছিল আমার মধ্যে। তাইতো সুতপাকে বলেছিলাম একবার তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিতে। দুদিন বাদে সুতপা সুযোগ পেয়েছিল তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসার। তুমি এসে দাঁড়ালে আমার সামনে আকাশ নীল পোষাকে। ঠিক যেন ভোরের কুয়াশায় সদ্যস্নাতা পদ্মের কুঁড়ি। তোমার চোখে একরাশ বিস্ময়। আমি কোনরকম ভণিতা না করে বলেছিলাম - তোমায় ভালবাসি। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠেছিল তোমার। স্পষ্ট দেখেছিলাম তোমার চোখদুটো জলে ভরে গেছিল। ছুটে চলে গেছিলে তুমি সেখান থেকে। সুতপা আফসোস করছিল ,বলল - কথাটা না বললেই বোধয় ভালো হতো বসন্ত দা। আসলে ও তো খুব শান্ত আর চাপা স্বভাবের। এসব প্রেম টেম ওর ধাতে সইবে না। ওর জন্য ঐ সম্মন্ধ করা পাত্রই ঠিক। আমি বলেছিলাম - না রে সুতপা। ঋতুদের মতো মেয়েরাই তো প্রেমে পড়ে। আর যখন পড়ে তখন বিপ্লব আসে। সুতপা অবাক হয়েছিল শুনে। এরপর কেটে গেছিল পুরো তিনদিন। তুমি ছাড়া আমার ছন্নছাড়া জীবনটাকেই যখন মেনে নিতে শিখছিলাম ঠিক তখনই সুতপার ফোন -করেছ কী বসন্ত দা, আমার সাদাসিধে বন্ধুটাকে প্রেমের পাঠ পড়িয়ে ছেড়েছ দেখছি। সে যে তোমার প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে বসে আছে। সুত্রপাত সেই সরস্বতী পুজোর দিন। আমাদের বাড়ির ছাদটা তোমাদের প্রেমের পীঠস্থান হয়ে গেল দেখছি। শুনে আমার আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু তখনই সুতপা বলল - এবার কী করবে তুমি বসন্ত দা। ওর বাবা তো মানবে না কিছুতেই। শুনেছি নিজের বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে ঋতুর। বললাম - আগে বুঝিয়ে বলব। না বুঝলে পালিয়ে যাব। সুতপা বলল - অতো সহজ নয় বসন্ত দা। ওদের অনেক ক্ষমতা। তবুও গেছিলাম তোমাদের বাড়ি। তোমার বাবার সামনে খুলে বলেছিলাম মনের কথা। দারোয়ান দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়েছিলেন উনি। তুমি এসে রুখে দাঁড়িয়েছিলে। তোমার বাবা আমার দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন - কী পাবে ও তোমাকে বিয়ে করে?  কী সুবিধা হবে আমার ? আমি আমার বন্ধুর সাথে একই ব্যবসায় পার্টনার আছি। ওর ছেলে ধীমান সেনকে ঋতু বিয়ে করলে আমার ব্যবসার উন্নতি হবে। শুনে আমি বলেছিলাম - নিজের স্বার্থের জন্য মেয়ের বলি দেবেন ? উনি বলেছিলেন - কেন মেয়ে হিসেবে ঋতুর কী কোন দায়িত্ব নেই তার বাবা মা'র ওপর ? সে চাইবে তার বাবা মা কে পথে বসিয়ে নিজের সংসার বসাতে ? ঐ কথাটাই হয়ত তোমাকে পিছনে হটতে বাধ্য করেছিল। তাই না ঋতু? -না বসন্ত। আমি জানতাম বাবার কথাগুলো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ছাড়া আর কিছু ছিল না কিন্তু যখন কথাগুলো ধীমানের কানে পৌঁছল তখন একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার ঘরে এলো সে স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের ক্ষমতার আভাস দিতে । বলল ক্ষতি করে দেবে তোমার। তোমার ভাই আর বোনের জীবন বিপন্ন করে দিয়ে প্রতিশোধ তুলবে সে যদি আমি তাকে বিয়ে না করি। আমি নিজের স্বার্থের পরিবর্তে তোমার ভাই বোনের জীবনে ক্ষতি ডেকে আনতে চাইনি। তাই বাধ্য হয়েই ধীমানের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। জানি তুমি আমাকে ভুল বুঝেছিলে। বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিলে কিন্তু ... । না ঋতু তোমাকে ভুল বুঝলে যে নিজেকে ঠকানো হতো। তোমাকে যে আমি নিজের থেকে আলাদা কখনো মনেই করিনি। প্রথম দিন থেকেই যে তোমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিলাম। আমি চাইলেই তোমাকে স্পর্শ করতে পারতাম মনের মধ্যে দিয়ে।


-জানো বসন্ত ফুলশয্যার রাতে শয়তানটা আমার মনের সাথে সাথে শরীরটাকেও ছিন্নভিন্ন করেছিল। বলেছিল যে মেয়ে মনে এক পুরুষকে রেখে অন্য পুরুষকে বিয়ে করে তাকে এমনভাবেই ভোগ করতে হয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম - সব জেনেও বিয়ে করলে কেন ? জবাব দিয়েছিল -  তোমাকে বিয়ে না করলে ঐ দু পয়সার ছেলেটার কাছে হার মানতে হতো।আর ধীমান সেন কোনদিন কারোর কাছে হারতে শেখেনি। বুঝেছিলাম এক নরকের ঘেরাটোপে নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছি।
এরপর ওরা ব্যবসার অংশীদারি থেকে বাবাকেও বিচ্ছিন্ন করে। আমি অবশ্য তাতে দুঃখ পাইনি। ওটা বাবার প্রাপ্য ছিল। আরও যেটা প্রাপ্য ছিল সেটা ঘটল কদিন পরেই যখন ধীমান নিজের ব্যবসার খাতিরে আমাকে ব্যবহার চাইল। ব্যবহার করতে চাইল আমার রূপ আমার শরীর। কিন্তু না , ধীমানের সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছিলাম আমি। জানো বসন্ত ধীমানের সামনেই যখন সেই বারো তলার হোটেলের ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিলাম তখন ধীমানের ভয়ার্ত মুখটা তুমি যদি দেখতে। ওকে হারিয়ে দেওয়ার আনন্দে সেদিন মৃত্যু ভয়কেও কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম।
- আর আমি যখন শুনলাম তোমার ভয়াবহ পরিণতির কথা। তখন তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাবলাম যদি একবার তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, যদি আমাকে দেখে তুমি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ফিরে আসো। বাইক নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছিলাম তোমার কাছেই। মধ্যরাতে বাইপাসের রাস্তা তখন প্রায় ফাঁকা। হঠাত উল্টো দিক থেকে আসা লড়িটা বেসামাল হয়ে ধাক্কা মারল। ছিটকে পড়লাম উল্টোদিকে রাস্তার ধারে। ডিভাইডারে মাথা লেগে ফেটে চৌচির। তোমার কাছে আর পৌঁছানো হল না আমার। মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরাতে পারলাম না তোমাকে তবে নিজেই পৌঁছে গেলাম মৃত্যুর দোরগোড়ায়।
- আর সেই মৃত্যুই মিলিয়ে দিল আমাদের
- ঠিক তাই। রাতের আঁধার কাটিয়ে আমি আবার তোমাকে দেখলাম যে অনন্তলোকের আলোয় এখন থেকে আজীবন এই আলোর মধ্যেই প্রেমের মূহুর্তগুলো কাটাবো আমরা দুজন নির্বিবাদে, নির্বিঘ্নে ।

- দেখ বসন্ত চারিদিকে কী সুন্দর ফুল ফুটেছে। কতো অলি জড়ো হয়েছে ওদের বুকে।
- হবেই তো। এখন যে বসন্ত ঋতু এসেছে।
************************
ছবিঋণ - গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু