বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

চমক


যন্ত্রণায় ককিয়ে কুঁকরে যাচ্ছিলো কিজিতোর শরীরটা।বাঁচা কতটা অসম্ভব ওর চাইতে ভালো কেউ জানে না!তবুও যতক্ষণ প্রাণ আছে,যতক্ষণ নিজেকে প্রবোধ দেওয়া যায়,ততক্ষণ এই পৃথিবীর ছেলেখেলা র খেলোয়াড় তুমি!এক পা যন্ত্রণায় চেপে ধরে,অন্য পা টাকে শুকনো ঘাসের উপর থেকে কোনরকমে ঘষটাতে থাকে কিজিত।হাতের লাঠিটা কখন ছিটকে পড়েছে, ও বুঝতেও পারেনি।আসলে সমস্ত ঘটনাটাই এতো আকস্মিক ভাবে ঘটে গেলো যে ওর চিন্তাশক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।কোনরকমে অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে রক্ষা করতে চাইছে ও নিজেকে।


   আজ ওর একুশতম জন্মদিন,তাই মিশা মানে ওর বান্ধবী ওর জন্য নিজের হাতে রান্না করেছে,শুধু তাই নয়, দিয়েছে এক বিশেষ সারপ্রাইজ গিফট্,একটা পারফিউম,অদ্ভুত তার গন্ধ! কিজিত আর মিশা গত দুবছর ধরে একসাথে থাকছে, কিন্তূ বিয়ে করতে পারেনি এখনও।মিশাকে বিয়ে করার জন্য, মিশার বাবাকে অনেক টাকা দিতে হবে,যা কার্যত কিজিতর পক্ষে অসম্ভব।যদিও ওরা দুজন মিলেই পয়সা রোজগার করছে বিয়ে করবে বলে।প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় হলেই ওরা দুজন মিশার বাবার কাছে যাবে অনুমতি নিতে,তারপর বিয়ে।কিজিতর বয়সী ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে,বাচ্চাও আছে কারো কারো। ও আর মিশা যথেষ্ট খাটছে টাকা টা জোগাড় করবে বলে।মিশা ওদের পাশের গ্রামের মেয়ে।আর পাঁচটা মেয়ের চাইতে অন্যরকম,উচ্চাকাঙ্খী।সব মিলিয়ে মিশার চেহারায় এক ছটফটে উজ্জ্বলতা আছে,যা ওর কালো চকচকে মসৃণ ত্বকের সাথে মিলে,ওকে এক অদ্ভুত দীপ্তিময় মোহিনী নারী করে তুলেছে।আফ্রিকান আদিমতা আর সদ্য আসা আধুনিকতার এক লোভনীয়  ' ককটেল ' মিশা। মিশার বাবার আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়, কিন্তূ কিজিত র বাবা কে দরিদ্র ই বলা চলে।যদিও এক্ষেত্রে ধনী গরীব সীমারেখার চাইতেও উগান্ডার বৈবাহিক রীতি ই প্রধান অন্তরায়। 'কুইন এলিজাবেথ ' অভয়ারণ্যের চাকরিটা মাত্র তিনমাস হলো পেয়েছে কিজিত।ওর কাছে এটা বিশাল পাওনা,ওর স্বপ্ন দেখার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে এই চাকরি।একটা এজেন্সি র মাধ্যমে গার্ডের চাকরি হয়েছে ওর।এমনিতে অফিসেই থাকতে হয়,মাঝে একঘন্টা অন্তর সার্চ লাইট নিয়ে ঘুরে আসতে হয়।এদিকটায় সিংহ বা কোনো হিংস্র প্রাণী আসেনা সচরাচর।বন্দুক আছে অস্ত্রধারী গার্ড দের কাছে,কিজিত কেও দেওয়া হয়েছে একটা।তবে প্রয়োজন হয়না বলে সাধারণত ওটা নেয়না ও। অনেকসময় শুধু একটা লাঠি আর সার্চ লাইট নিয়ে বেরিয়ে পরে টহলে।একুশের তাজা রক্ত ভয় বিষয়টা কমই বোঝে।তবে বণ্য প্রাণীর তেমন ভয় না থাকলেও সাপ আছে যথেষ্টই,সে ব্ল্যাক মাম্বাই হোক বা ফরেস্ট কোবরা! স্পিটিং কোবরা ও আছে,তাই লাঠিটা সঙ্গে রাখতেই হয়।পায়ে গাম্বুট থাকাটা আলাদা প্রটেকশন দেয় যদিও।অন্যদিন এর তুলনায় আজ কিজিত একটু দেরী করে ফেলেছিল কাজে আসতে,বকুনিও খেয়েছে  তার জন্য।তবে এতে কিজিত র দুঃখ নেই,আজ দিনটাই ভীষণ সুন্দর।গত সপ্তাহখানেক ধরে ওর ভিতর বইতে থাকা একটা ভারী বোঝা আজ নেমে গেছে।


গত কয়েকসপ্তাহ আগে কিজিত র এক বন্ধু বলেছিল, ও নাকি মিশাকে দেখেছে অন্য একটা লোকের সাথে।মিশা অস্বীকার করেছিল সবটা,কিন্তু কিজিত র মনের কাঁটা টা বিধেই ছিলো,কিছুতেই সহজ হচ্ছিল না ওদের সম্পর্ক।তারউপর প্রায় ওর নাইট শিফট পড়ছে,হতাশা গ্রাস করেছিল ওকে।আজ সকালে মিশা ওর জন্মদিনের যা আয়োজন করেছে,ঘুম থেকে উঠেই ওর হাতের সারপ্রাইজড কেক,সব মিলিয়ে কিজিত র ভিতর টা খুশিতে ভরে উঠেছে।না!মিথ্যে সন্দেহে কতগুলো দিন ওর কষ্টে কেটেছে।আসলে মিশার মত মেয়ে ওর প্রেমিকা হবার পর থেকেই ওর বন্ধুরা ওকে হিংসার দৃষ্টিতেই দেখে,ভালোভাবেই জানে কিজিত।আজ মিশার দেওয়া পারফিউম টা মেখে এসেছে ও,কেমন একটা বণ্য গন্ধ, খুব পছন্দ না হলেও,আজকের দিনে মিশার কথা ফেলতে পারেনি কিজিত।গুনগুন করে একটা আদিবাসী সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সাইকেল চালিয়ে কাজে এসেছে কিজিত।ওকে রোজ যাতায়াত মিলিয়ে দুঘন্টা সাইকেল চালাতে হয়,একটু কষ্ট হলেও এতে অনেকটা খরচ কমে,আর নিজের মর্জি মত যাতায়াত ও করা যায়।কিজিত জানে সামান্য সঞ্চয় ও ওর জন্য কতটা জরুরী!


" এই কি হচ্ছে!"খিলখিল হাসির রোল উঠেছে মিশার গলায়।সে এখন আছে রিচার্ড এর সাথে।কিজিত বেরিয়ে যাবার পর পরই মিশাও বেরিয়ে পড়েছিল।রিচার্ড ইংল্যান্ড এর বাসিন্দা,গবেষক।বন্য গাছপালা ও তার সাথে বন্য প্রানীদের থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন রাসায়ানিক পদার্থ তার গবেষণার বিষয়।আসলে যেকোনো ওষধি বা বন্য গাছপালা র নির্যাস এ থাকে বিভিন্ন রাসায়ানিক সমন্বয়।প্রতি টা পদার্থের মিশেলে তৈরি হয় বিশেষ গন্ধ বা উপকরণ।সেগুলো ওষুধ তৈরি বা বিজ্ঞানের অন্যান্য গবেষণায় লাগায় মানুষ।উজ্বল চোখের যুবক রিচার্ড, এই সব কিছু নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে উগান্ডায় এসেছে কয়েকমাস আগেই।এই জায়গাটা সে বেছেছে প্রধানত দুটি কারণে, প্রথমত ন্যাশনাল পার্ক খুব দূরে নয়,আর দ্বিতীয়ত এখানে থাকার সুবিধার সাথে গাছপালার প্রাচুর্য।রিচার্ড একটা আস্ত বাড়ি ভাড়া নিয়েছে,এটা আদপে এক সাহেবের ই বাড়ি ছিলো,রিচার্ড এর এক বন্ধু সন্ধান দিয়েছিল এই জায়গাটার।মিশা কাজ খুঁজছিল বেশ কিছুদিন ধরেই।রিচার্ড এর একজন ইংরেজি জানা লোকের প্রয়োজন ছিলো।মিশা খুব সরগর না হলেও,সে ইংরেজি বুঝতে ও অল্প বলতে পারে।সেই সূত্রেই কাজটা পেয়ে গিয়েছিল।কাজ বলতে রিচার্ডের ঘরের সমস্ত কাজ করে দেওয়া আর মাঝে মাঝে ওকে জায়গাটা ঘোরানো।আর কয়েকদিনের মধ্যেই মিশা কে রিচার্ডের ভালো লেগে গেলো,ওর উপচে পড়া যৌবন, ছট্ফট্ এ সতেজতা, ওর কালো রং কে ছাপিয়ে রিচার্ডের চোখে এক বন্য আদিমতা ছড়িয়ে দিয়েছিল।কিজিত র বন্ধু মিশাকে সেদিন রিচার্ড এর সাথেই দেখেছিল,তবে রিচার্ড এর মুখ দেখতে পায়নি ও।যদিও কাজের সূত্রেই রিচার্ড কে সঙ্গ দিতে হয় মিশাকে,তবুও নিজেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক টা মনে মনে অস্বীকার করতে পারেনি মিশা।এদিকে কিজিত র প্রতি মিশার ভালোবাসায় খামতি ছিলো না,তাই রিচার্ড এর থেকে সরে আসতে চাইছিল সে।রিচার্ড এটা বুঝেই কিজিত কে না চিনেও অদৃশ্য শত্রু হয়ে উঠেছিল ওর।তাই মিশা যখন রিচার্ড কে জানতে চেয়েছিল কিজিত কে কি গিফট্ করা যায়,সে ' ফেরোমন' ভর্তি পারফিউম স্প্রে বোতল টা তুলে দিয়েছিল মিশার হাতে।


     মিশা আজ রাতে এসেছে রিচার্ড এর কাছে,এখন দুজন কাছাকাছি। রিচার্ড মিশার বন্যতায় মাখামাখি হতে থাকে,আর ঠিক সেই সময় তার দরজার ঘন্টি টা বেজে ওঠে।চমকে ওঠে রিচার্ড!এখন কে এলো!মিশাকে তৈরি হতে বলে নিজের নাইট গাউন টা পরে নেয় রিচার্ড।দরজা খুলতেই পৃথিবীর সমস্ত আশ্চর্য,হতবুদ্ধি ভাব ঘিরে ধরে ওকে।দরজার বাইরে  হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে কেইলি, ওর হবু স্ত্রী।আর সাথে আছে রিচার্ডের বন্ধু জোসেফ।দুজনে যুক্তি করে  রিচার্ড কে ' সারপ্রাইজ ' দিতে চলে এসেছে এখানে!কেইলির ভিসা পেতে একটু সময় লাগছিলো নইলে আগেই আসতো।ফ্লাইট দুঘন্টা লেট্ থাকায় আসতে এত দেরী,তাছাড়া গাড়ি পাবার সমস্যা ছিলো।ভাগ্যিস জোসেফের এক পরিচিত স্থানীয় লোক গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল,নইলে আজ রাত টা এয়ারপোর্ট এই কাটাতে হতো দুজনকে।রিচার্ড এর আসতে দেরী দেখে মিশা অবিন্যস্ত পোষাক আর খোলা চুল নিয়ে এসে দাঁড়ায় রিচার্ডের পিছনে।কেইলির চোখ এখন রিচার্ড এর কাঁধ ছাপিয়ে মিশার উপর স্থির হয়ে আছে!


অন্যদিনের মত আজ প্রথম টহল সেরে এসে কিজিত বসে ছিলো,তারপর ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের মনেই মৃদু হাসছিল ও।সেই সময় অফিসে ঢুকেছিল আব্বো। আব্বো ওর সহকর্মী, বয়স ও প্রায় একই।সেইজন্য দুজনের বেশ সখ্যতা আছে। আব্বোর ডাকে বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল কিজিত,তারপর দুজনে মুখোমুখি বসে বেশ কিছুক্ষন গল্প করেছিল।হাতঘড়িতে সময় দেখে দুজনেই উঠে পড়েছিল যে যার কাজে যাবে বলে। হাতে লাঠি আর সার্চলাইট নিয়ে কিজিত বেশ কিছু টা ঘুরে একটা শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো,কিন্তু না কিছুই চোখে পড়েনি।ঘুরে আসতে যাবে,সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে লাফিয়ে পড়েছিল একটা ভারী কিছু।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে পরেছিল কিজিত।তারপর এক গরগর আওয়াজ ওকে জানিয়ে দিয়েছিল কি ঘটেছে!সত্যি বলতে কি কিজিত র মাথা কাজ করছিল না।হাতের লাঠি,সার্চলাইট দুই ছিটকে পড়েছে। ওর সামনে এক ক্রুদ্ধ সিংহ,গলা থেকে অদ্ভুত গরগর শব্দ করছে!   কিজিতর কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে,ছিটকে পরার ফলে কিজিত র একটা পা মারাত্মক জখম হয়েছে।অন্য পাটাকে টেনে টেনে ও চেষ্টা করছে পালাতে। ওতো জনেও না,সকালের সারপ্রাইজ এর মধ্যেই রাতের আর এক বিভীষিকার বীজ লুকিয়ে আছে!কিছুটা সম্বিত ফিরতেই কিজিত " হেল্প! হেল্প! " বলে চিৎকার করতে শুরু করে। কিন্তূ এই অদ্ভুত ঘন আঁধার আর নিকষ অভয়ারণ্যে ওর এই আর্ত চিৎকার কারো কান অবধি পৌঁছয় কিনা বুঝে উঠতে পারেনা কিজিত।অথবা বলা ভালো,এত বোঝার মত মানসিক অবস্থা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনো নশ্বর প্রাণীর ই থাকেনা। কিজিতর চোখ এখন  ওর সামনের দুটো জ্বলতে থাকা চোখের উপর স্থির হয়ে আছে!


   জীবন কত ধরনের ' সারপ্রাইজ  ' নিয়ে অপেক্ষা করে নিরন্তন,আজ সকালেই যা ছিল অতীব সুন্দর,সূর্য পশ্চিমে যেতেই তা রূপ নিয়েছে এক ভয়ংকরের।জীবন পরতে পরতে নিজেকে মেলে ধরে তার নানান রূপ নিয়ে,যেমন মানুষের মনের কোন কুঠুরি থেকে যে কখন কে উঁকি দেয়,সে নিজেও জানেনা।ভিতর আর বাইরের এই নিরন্তন চমক ই জীবনকে সুন্দর আর ভয়ংকরের রঙে রঙিন করে তোলে।


✍️ সুণীপা

অলংকরণ : সুণীপা

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু