বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

বৃষ্টি

"বৃষ্টি আসলে আমি একটু ঘুমাই " মেসেঞ্জার এ সৌম্য কথাটা লিখেই লগআউট হয়ে গেলো।ওপ্রান্তে থাকা সদ্য ভিজতে থাকা রিক্তার মনটা এক অদ্ভুত বিষাদে ছেয়ে গেলো।গত একমাস ধরে ও কথা বলে চলেছে এই অদ্ভুত ছেলেটার সাথে।সচরাচর ইনবক্স এ কথাই বলেনা রিক্তা।কিন্তু এ ছেলের ভিতর কি যেনো আছে,একমাত্র ওর জন্যই মেসেঞ্জার টা ইনস্টল করিয়েছে রিক্তা।ঘণ্টা,সময় ,সপ্তাহ করে একটা মাস কেটে গেছে রিক্তার অনায়াসে।প্রথম দিন ওর ইনবক্স এ যে কবিতা টা এসেছিল,সেটা ছিল" উজাড় করে দেবো/বৃষ্টি এলে জানলা খুলে হাত বাড়িয়ে ছোঁব/তোর কান্না কোথায় পরিযায়ী শিকল নিয়েও ওর/ঝুটমুটকা মিছিল হবে, মরবি বড়োজোর/ শান্ত সেদিন চোখ দুটিতে থাকবে স্বপ্ন আঁকা/সরল রেখায় জীবন চলেনা, বড়ই আঁকাবাঁকা।"ওকে নিয়েও কবিতা লেখা যায়!রিক্তা হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে।যে কোনো অভিজ্ঞ চোখই ওর ফেসবুক প্রোফাইল দেখে বলে দেবে,ওর ভিতর জমে আছে অসংখ্য বিষাদ।পাওয়া,না পাওয়া সব কিছুর ভিতরে ছট্ফট্ করতে থাকা রিক্তা পালাতে চায়,পালাতে চায় সব কিছু ছেড়ে।আর এই ছেলেটার মধ্যে ও ক্রমশঃ ওর আকাশ খুঁজে পাচ্ছে।একদিন বলেছিল রিক্তা সৌম্যকে," তুই আমার মুক্তি হবি ?"

সৌম্য বলেছিল," আমিও কি মুক্ত? " একটু থেমে যোগ করেছিল," ভালবাস,ভালোবেসেই মানুষ মুক্তি পায়"।ভিতরে ভিতরে রিক্তা সত্যিই রিক্ত হয়ে গেছে  সেই মুহূর্তেই।

        এই এক ছেলে,ইচ্ছামত যায় আর ইচ্ছামত আসে।অদ্ভুত যা হোক।রিক্তা অনুভব করে ও ভিতর ভিতর উন্মুখ হয়ে থাকে সৌম্যের অনলাইন হবার জন্য।ক্রমশ এই স্মার্ট ফোনটা বেঁধে ফেলছে ওকে অদৃশ্য কোনো বন্ধনে।তবে কি যে মুক্তি ও খুঁজছিল,সেটা সৌম্যই! কি জানি?সৌম্যর দিক থেকে তো তেমন কিছু বোঝেওনা রিক্তা।এটা ঠিক সৌম্য ওকে পছন্দ করে,কিন্তু ভালো বাসেকি? মাত্র একমাসে শুধু কথার আলাপে ভালোবাসা যায়?যায় যে না,সেকথাও বা রিক্তা বলে কি করে?যে ভালোবাসা থেকে ও বিগত সাতটা বছর ও পালাতে চেয়েছে,সেই সব অনুভূতিই যে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ওর সব কিছুকে উথাল পাথাল করে দেবে,এত কম সময় আর এইভাবে,সেতো ও কি ভেবেছিলো?নাঃ বড্ড বেশি জড়িয়ে পড়ছে ও। ও রিক্তা সেন,নামজাদা প্রফেসর,রিসার্চার,লেখিকা,ওকে এসব মানায় না।তাছাড়া,কে একটা কোথাকার ছেলে,যখন ইচ্ছা আসবে যাবে,যেনো ওর নিজের ইচ্ছার কোনো দামই নেই।এর একটা বিহিত করা দরকার।আর পারছে না রিক্তা।যতবারই সৌম্যকে দেখা করার কথা বলেছে, ও এড়িয়ে গেছে,এমনকি কিছুতেই যেনো ধরা দিতে চায়না।একটা লুকোচুরি লেগেই আছে।এত ছেলে রিক্তা সেনের একটা হাসির ,কথার জন্য অধীর হয়ে থাকে, ও কখন ফিরে পর্যন্ত দেখেনা,সেই রিক্তার চোখ,মন সর্বস্ব একজনকেই খুঁজে চলেছে গত একমাস যাবৎ।বাড়ির লোকের ও নজরে পড়েছে ওর এই হটাৎ বদল।

         না আবার বৃষ্টি নামলো।জানলাটা বন্ধ করতে গিয়েই ছাট্  এসে চোখ মুখ ভিজিয়ে দিল,রিক্তার হাত টা সেখানেই থমকে গেলো।জানলা দেওয়া ওর আর হলনা।আরো কাছ ঘেঁষে দাড়ালো জানলার।ভিজতে ভিজতে গুন গুন করে উঠলো," মন মোর মেঘের সঙ্গী"।কতদিন পর গাইলো ও।হচ্ছেটা কি!নিজেকেই আজকাল অচেনা লাগে রিক্তার।আবারো প্রেম!পাগলামি!ভিতর টা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে রিক্তার।না,না,আর না।অনেক কষ্টে নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে ও ভগ্নস্তুপ থেকে।কাউকে নষ্ট করতে দেবেনা।চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রিক্তার।আর সেই মুহূর্তেই মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন সাউন্ড টা বেজে ওঠে।

       ফোনটা হাতে নিতেই রিক্তা দেখলো সৌম্য,আবার উদয় হয়েছে।লিখেছে," বৃষ্টি হচ্ছে,তোকে হঠাৎ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,দেখা করবি?" অবাক হলো রিক্তা,এর আগে বহুবার ও চেয়েছে,কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি সৌম্য।অপমানিত রিক্তা আর কখনো বলেনি।আজ হঠাৎ কি হলো!রিক্তা উত্তর দিল," ভর দুপুরে মাতাল হলো নাকি?ড্রিংক করেছিস!?" সৌম্য বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো," তুই জানিস আমি ওসব খাইনা"," মিট করবি কিনা বল!এখনই"।" পাগল নাকি,এই বৃষ্টিতে,"উত্তর দেয় রিক্তা।"এই তোর এত ভালোবাসা,বলছিলি না আমার জন্য সব ছাড়তে পারিস" বলে হাসির ইমোজিতে ইনবক্স ভরিয়ে দেয় সৌম্য।কেমন একটা রোখ চেপে যায় রিক্তার,নাঃ!আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও।এভাবে চলতে দেওয়া যায়না।অনেক হয়েছে।নিজেকে এই নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে হবে ওকে।যে করেই হোক।ছেলেটা ক্রমাগত ছেলেখেলা করছে ওকে নিয়ে,আঙ্গুলের ডগায় নাচাচ্ছে ওকে।" কোথায় দেখা করতে চাস!" লিখলো রিক্তা।" তোর যেখানে সুবিধা" সৌম্যর উত্তর ভেসে এলো।রিক্তা লিখলো," তাহলে আমাদের মাঝামাঝি যে মল টা আছে ও খানেই মিট করি,দুজনেরই সুবিধা,আর যা বৃষ্টি তাতে ঘোরা তো আর যাবেনা"।" ওকে, বেরো,আমিও বেরোচ্ছি,পৌঁছিয়ে ফোন করবি"।এই প্রথম নিজের ফোন নম্বর দিল সৌম্য।রিক্তা আগেই দিয়েছে, কিন্তূ সৌম্য ফোন করেনি বা কথাও হয়নি।মেসেঞ্জার এ কল করলে ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে,সবটাই চ্যাটে।রিক্তা বহুবার ভেবেছে,এটা কি হচ্ছে ওর সাথে,শুধু মেসেজেই ও এভাবে জড়িয়ে গেছে!কিন্তু যতবারই ভেবেছে,বুঝেছে যাই হোক এই ছেলেটার জন্য ও অনন্তকাল অপেক্ষা করে ছিল, ও চাইলেও যেতে পারছেনা ।
   
     মায়ের অবাক চোখের সামনে দিয়ে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রিক্তা।একটা ট্যাক্সি ধরে বেশি ভাড়া দিয়ে পৌঁছিয়ে গেলো মলটার সামনে।আর প্রথমবার ফোন করলো সৌম্যকে,রিং হচ্ছে আর রিক্তার বুকের ভিতর ঢেউ আছরে পড়ছে,আসবে তো ছেলেটা?ফোনটা রিসিভ হলো,আর একটা ভীষণ পেলেব কণ্ঠ বললো," এসে গেছি, দাঁড়া" ।বলেই কেটে দিল ফোনটা।রিক্তার সারা শরীরে কেউ অদ্ভুত একটা ঝর্না ছড়িয়ে দিল।এই গলাটা শোনার জন্য যেনো ও কত জন্ম প্রতীক্ষা করেছে।দাঁড়িয়ে থাকলো স্থানু হয়ে,বৃষ্টির জল ওর ছাতা চুঁইয়ে কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছে,ওর খেয়াল ই হলনা।

হটাৎ ফোনটা বেজে উঠলো,সৌম্য,ভেসে এলো   " কোথায় তুই,আমি তো সিনেমার পোষ্টারের সামনে"।চমকে ঘুরে তাকালো রিক্তা,একটা রোগা ছেলে ফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে,একমুখ দাঁড়ি।কতদিন কামায়নি কে জানে!ছবির ছেলেটার ছায়া যেনো,মিল আছে,তবু ভীষণ অমিল।মাথার চুলগুলো এলোমেলো ।রিক্তা এগিয়ে গেলো," সৌম্য!" "হ্যাঁ,এত আকাশ থেকে পড়ছিস কেনো! মুভি দেখবি,?" ঘোরের মধ্যেই ঘাড় নারলো রিক্তা।টিকিট কেটে মুভি হলে ঢুকে সিটে বসা অবধি শুধু সৌম্যকে অনুসরন করে গেলো রিক্তা।আর তারপর যে কখন ও জ্বলতে থাকা মোমবাতি হয়ে গলে নিঃশেষ হয়ে গেলো,বুঝতেও পারলনা।

   বাড়ি ফেরার পর সৌম্যর একটা মেসেজ এসেছিল," তুই আমাকে সত্যিই ভালবাসিস।আমি এতটাও ভাবিনি।আমাকে জানিসনা তুই।এমন অনেক কিছু আছে,যা কিছুতেই তোর সাথে আমাকে মিলতে দেয়না।কিন্তু আজ কিছুতেই এত ভালোবাসা ফেরাতে মন চাইছেনা।তুই জানিস আমি এক কথার মানুষ।এই একাউন্টটা আমি ডিলিট করছি।এটার আর দরকার নেই।ফোন নম্বর থাকলো দরকারে কল করিস।আমাকে একটু সময় দে,বেশি না,একটু গোছানো দরকার,নিজেকে,এত ছড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে আর সবকিছু,এটুকু সময় লাগবে।সবটা তোকে বলব কখনো।আমি জানি তুইও বুঝবি।ভয় নেই, পালাবোনা।তোকে আমার খুব কাছে চাই,ভীষণ কাছে।সবসময়ের জন্য।তাই আর বৃষ্টি দিনে বাইরে নয়,নিজের ঘরে চাই তোকে।মুক্তি টা না হয় ঘরেই হক।অনেক তো খুঁজলাম বাইরে।ভালোবাসি।"
অনেকদিন পর কেঁদেছিল রিক্তা,আকাশ ছাপানো কালো মেঘের হুড়মুড়িয়ে এই ঝরে পড়া,এতদিনের সব কালো মেঘকে সরিয়ে একদম ঝকঝকে করে দিয়েছিল আকাশটাকে।।


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু