বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কনকবালা

সদ্য পুকুর পাড় থেকে তুলে আনা কচুশাক গুলো দত্ত বাড়ির হেঁশেল ঘরের সামনে দালানে রেখে মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে একবার মুছে নেয় কনকবালা তারপর দত্ত বাড়ির বড় বৌ সুরমাকে ডাক দেয় -"ও বড় বৌ একটু জল খাওয়াবি মা? গলাটা বড্ড শুকিয়ে গেছে রে।" রান্নাঘরের ভেতর থেকে সুরমা বিরক্তির সুরে ফিসফিসিয়ে মেজ বৌয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে -"ঐ এলেন।আমাদের শাশুড়ি মা মরেছেন তো কী একজনকে রেখেও গেছেন বটে। সাথে করে আবার কিছু কচু শাক এনে হাজির করেছে দ্যাখ।"
-"এই অবেলায় আবার কচুশাক রেঁধে খাওয়ানোর আবদার করবে নাকি গো বড়দি। এই হয়েছে এক জ্বালা।" মেজ বৌয়ের কথা শুনে সদ্য বিয়ে হয়ে আসা ছোট বৌ মৃদুলা ঘোমটার আড়াল থেকে একবার বাইরে উঁকি দিয়ে কনকবালাকে দেখে সুরমাকে জিজ্ঞেস করে -"উনি কে গো বড়দি। পরশুও এসেছিলেন বোধ করি। তোমরা আবার ভাত তরকারি বেড়ে দিলে। কে গো উনি?"
-"কে আবার , আমাদের শাশুড়ি মা'র ছোট বেলার সই।আমাদের আরেক শাশুড়িও বলতে পারিস"। বলেই বড় মেজ দুই বৌ মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ওঠে। মৃদুলা কেমন যেন একটু অবাক হয়।বাইরে মানুষটা জল চাইছে আর এরা এখানে রসিকতা করতে ব্যস্ত। মাটির কুঁজো থেকে কাঁসার গ্লাসে জল গড়িয়ে কনকবালার সামনে ধরে মৃদুলা।
-"ওমা ছোট বৌ যে। বেঁচে থাকো মা। তোমার শাশুড়ি মা তোমার এমন লক্ষীপানা মুখ খানি আর দেখে যেতে পারলো না। সে রইলে দেখতে পেতে কেমন মাটির মানুষ ছিল সে। তোমার ভাগ্যে নেই, কী আর করবে মা।" বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে মৃদুলার। সত্যি বোধহয় তাই। এই বাড়িতে আসা ইস্তক শাশুড়ি মার প্রশংসা তো কম শোনেনি সে। সেইরকম মানুষের সাক্ষাৎ না পাওয়া বোধ করি দুর্ভাগ্যেরই অংশ এমন মনে করে মৃদুলা আবার রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। মৃদুলাকে শুকনো মুখে আসতে দেখে সুরমা চোখ টেঁরিয়ে মুচকি হেসে ঠাট্টার সুরে বলে -" হোল তো ? জ্ঞানের কথা শুনে এলি তো ? নে এবার তাড়াতাড়ি হাত চালা দেখিনি।" বলে কিছু সব্জি আর বঁটি মৃদুলার দিকে এগিয়ে দিল সুরমা।
বাইরে থেকে আবারও কনকবালার ডাক শোনা গেল -" ও বড় বৌ বঁটি খানা একবার দে দেখি কচুশাক গুলো কেটে ধুয়ে দিই। বড় ভালো রাঁধার হাত ঐ মেজ বৌয়ের।এইবেলা রেঁধে ফেললে আমাকেও একটু দিস। খেয়ে বড় সুখ পাই তোদের হাতের রান্না।"
-" ঐ দ্যাখো বড়দি যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো গো।এই অবেলায় এখন নাকি ওনাকে কচুশাক রেঁধে খাওয়াতে হবে।আমার দ্বারা হবে নাকো এই বলে দিলাম।" মেজ বৌয়ের কথা শুনে আশ্বস্ত করে সুরমা। -" আহ্ দাঁড়া না আমি দেখছি।তুই কিচ্ছুটি ভাবিস না।" বলে সুরমা কনকবালার কাছে গিয়ে বলে -" ও মাসি এখন কত বেলা হল সে খেয়াল আছে তোমার? আমাদের রান্না শেষ হয়ে এলো বলে।এখন কী আর এই শাক পাতারি রান্না করা চলে? তাছাড়া কচুশাকে মাছের মাথা নইলে নিদেনপক্ষে নারকেল তো দিতেই লাগে।সে কী বাড়িতে মজুদ আছে যে রেঁধে খাওয়াবো তোমায়। এসব অন্যদিন হবে ক্ষণ।এখন একবাটি বড়ি ভাজা দিয়ে লাউঘণ্ট করেছি তাই দিচ্ছি নিয়ে যাও।"
-" ওমা এবারে এখনও জামাই নারকেল পাড়ায়নি বুঝি? তোদের তো ভাঁড়ারে থাকে পড়ে কত নারকেল দ্যাখ না যদি একখান থাকে।বাড়িতে হাবুর বৌয়ের দেওয়া পান্তা আছে তাই দিয়েই নয় খেতাম কচুশাক একটুখানি।কতদিন যে খাইনি কচুশাক।নিজে যে রেঁধে খাবো তারও যে উপায় নেই "- কনকবালা অনুনয়ের সুরে বলে।
-" ওমা দ্যাখো কী কাণ্ড। বুড়ির কথা শোন।আমাদের বাড়িতে কোথায় কী থাকে সে ব্যাপারে বুড়ির টনটনে জ্ঞান। এই বয়সেও বুড়ির নোলা যায় না।" রান্নাঘর থেকে মেজ বৌয়ের শ্লেষ বাক্য কনকবালার কানে পৌঁছালে সে আশাহত হয়ে খালি হাতেই ফেরার পথ ধরে। মৃদুলার মন কাঁদে, বলে -" ও বড়দি ভাঁড়ারে তো নারকেল আছে গো কচুশাক গুলো রেঁধে ফেললে তো হতো।"
-"তুই থাম তো ছোট। ও বুড়িকে আস্কারা দিলেই মুশকিল। আমাদের শাশুড়ি মা'র জন্য কম আস্কারা তো পায়নি কনক মাসি।" মেজ বৌ মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে ।
-" আচ্ছা ওনাকে কী একটু রেঁধে বেড়ে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই ?" জিজ্ঞেস করে মৃদুলা।
-" নেই তো । ছেলেপুলে কেউ নেই। শাশুড়ি মা'র কাছে শুনেছি ওনার স্বামীর ছিল মস্ত ব্যবসা। ওনার টাকায় নাকি দানছত্র করা হত। এই যে আমাদের বাড়ি যে জমির ওপর সেও নাকি কনক মাসিদেরই। আমাদের শাশুড়ি মাকে বাড়ির অমতে বিয়ে করার অপরাধে ত্যাজ্যপুত্র হয় আমাদের শ্বশুরমশাই। তখন এই কনক মাসি আর তার বর এই জমিটা শাশুড়ি মাকে এমনিতেই দিয়ে দেয় সাথে কিছু টাকাও যাতে আমাদের শ্বশুরমশাই নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।শ্বশুরমশাই নিজের বুদ্ধিতে ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠে এই জমিতে বাড়ি তৈরি করেন।ততদিন ঐ মাসির বাড়িতেই নাকি সংসার পেতেছিলেন শ্বশুরমশাই" - সুরমা কথাগুলো বলে থামে কিছুক্ষণ।
-" ওমা ! তাহলে ওনার এমন অবস্থা হল কেমন করে?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মৃদুলা।
-" কপাল বুঝলি কিনা কপাল। ছেলেপুলে না হওয়াতে নিজের ভাগ্নেকে কাছে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের ব্যবসার কাজে লাগিয়েছিল মেসোমশাই। ভাগ্নে হাবুও মামা মাইমা বলতে অজ্ঞান ছিল। আসলে সব ছিল ভান। নকল মায়া হাবুর। ওদিকে মরার আগে ব্যবসার সকল দায়িত্ব ভাগ্নেকে দিয়ে মেসোমশাই ভেবেছিলেন যে হাবু মামিকে দেখবে। হল তার উল্টো। মেসোমশাই চোখ বুজলে হাবু আর তার বৌ কনক মাসি কে দিয়ে তাঁর নামে বাড়িটা ছলে বলে নিজেদের নামে লিখিয়ে নেয়। মাসি এখন নিজেরই অতবড় বাড়িতে নিচের তলার একটা ছোট ঘরে থাকে।একটা তক্তাপোষ ছাড়া সে ঘরে কিছুই নেই। হাবুর বৌ মাসিকে একবেলা খেতে দেয় তো অন্যবেলা দেয় না। আমাদের শাশুড়ি মা বেঁচে থাকতে মাসি এখানে এসে খেত। পরিবর্তে কখনো আটা মেখে দিতো তো কখনো কুটনো কুটে দিতো। শাশুড়ি মা না চাইলেও করে দিতো। এমনি এমনি খেতে নাকি তার সম্মানে লাগতো । আর আমাদের শাশুড়ি মা'ও রেঁধে বেড়ে সাত সতেরো পদ একেবারে পাত পেড়ে খাওয়াতো মাসিকে আবার সাথে করে দিয়েও দিতো । এখনও সে স্বভাব যায়নি কো বুড়ির। এসে এটা ওটা কাজ করে দেওয়ার নাম করে খেতে চাইবে।" সুরমার কথা শুনে মৃদুলা আশ্চর্য হয়ে বলে -" ওমা যে মানুষটা এই বাড়ির জন্য এতো করেছে তাকে একটু রেঁধে খাওয়াতে এত আপত্তি কেন গো বড়দি? এ তো আমাদের কর্তব্য গো।"
-"তুই আর কর্তব্য দেখাস না তো ছোট।কবে কে কী করেছে তার খেসারত আমরা বইতে যাবো কেন বল দেখি ? নেহাত শ্বশুরমশাই বলেছেন ওনাকে কোন অসম্মান না করতে তাই মুখের ওপর কিছু বলি না নইলে কবে এ ঝামেলা মিটিয়ে দিতাম।যাকে নিজের লোকেই দ্যাখে না তার ঠ্যালা আমরা কেন সামলাবো ? আর শ্বশুরমশাইয়ের মতো এমন বৌ সোহাগী যদি তাঁর ছেলেগুলো হতো তাহলে বর্তে যেতাম "। কর্কশ কণ্ঠে যেন কথাগুলো বলে ওঠে সুরমা।
-" অসম্মান করতে আর বাকি থাকলো কোথায়। শুকনো মুখে মানুষটাতো ফিরেই গেল" মনে মনে ভেবে জায়েদের ওপর বেশ বিরক্তই হয় মৃদুলা ।
-" আসলে ছোটর এই বাড়িতে জিনিসের আতিশয্য দেখে চোখ টাটিয়েছে বড়দি।তাই এত আস্ফালন।" মেজ বৌয়ের ঠেস দেওয়া কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে মৃদুলা।
-" এই সংসারটা তোমরা যদি নিজেদের মনে করে শ্বশুরমশাইয়ের কথা অমান্য করতে পারো, নিজেদের মতে চলতেও পারো তবে আমিও পারি শাশুড়ি মা'র আর শ্বশুরমশাইয়ের ইচ্ছের মান রাখতে।তোমাদের মতো এতো অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না।প্রয়োজনে বাবার কানে কথাগুলো তুলতেও পিছপা হবো না আমি।" কথাগুলো দৃঢ় কণ্ঠে বলে মৃদুলা নিজেই কচুশাক গুলো দালান থেকে তুলে কেটে ধুয়ে রান্না করে কনকবালার জন্য নিয়ে গিয়ে তাকে যত্ন করে বেড়ে খাইয়ে জিজ্ঞেস করে -" কেমন লাগলো মাসি আমার রান্না। খেয়ে সুখ পেলে বলো তো রোজ রেঁধে খাওয়াই তোমায়।আর তার জন্য তোমায় আটাও মেখে দিতে হবে না কুটনোও কুটে দিতে হবে না।" কনকবালার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে । এত বছর পর নিজের নিঃসন্তান হবার দুঃখ যেন দূর হল তাঁর জীবন থেকে। আর ওপর থেকে এমন দৃশ্য দেখে বোধহয় শান্তি পেল কনকবালার সই আর মৃদুলার শাশুড়ি মায়ের বিদেহী আত্মাও।

***************

ছবি :- গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু