বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ়

বাবাকে দেখতে গিয়েছিলুম দাদার বাড়িতে।  আমি বাবার চোখের দিকে তাকালাম - বাবার কোনো খিদে নেই, তিনি আর বাঁচতে চান না। অথচ, এতদিন বাবা দরকারের চেয়ে বেশি খেতে চাইতেন; হঠাৎ ওঁর সমস্ত ইচ্ছে, সমস্ত খিদে হারিয়ে গেছে।
অনেক খোঁজখবর ক’রে বাবাকে গঙ্গারাম হাসপাতালে ভর্তি ক’রলাম। এক সপ্তাহেই বাবা অনেকটা সুস্থ হ’য়ে উঠলেন। আমি যে কোম্পানীতে কাজ ক’রছিলাম, সেখান থেকেই হাসপাতালের সব খরচ পেলাম।
পরের দু-সপ্তাহে বাবা আরও সুস্থ হ’য়ে উঠলেন। বাবাকে হাসপাতালে আর রাখা যাবে কিনা তা ভাবতে হ’য়েছিল। চিকিত্সার জন্যে আমি বছরে কতটা খরচ ক’রতে পারি তার সীমা বাঁধা ছিল। বাবা যদি আরও এক দিন হাসপাতালে থাকতেন, তবে আমি পরের এক বছর ধরে আমার পরিবারের কারও জন্য কোনও চিকিত্সার খরচ পাবোনা।
আমি এখন কি ক’রবো? ভাবছিলাম বাবাকে দাদার বাড়ীতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। মেজদি ব’ললো যে দাদা বাবাকে আর ফিরিয়ে নিতে রাজী হবে না।
বাড়ি ফিরে আমি সুভদ্রাকে ব’ললাম, আমাদের বাড়িতে বাবার থাকার ব্যবস্থা ক’রতে। সুভদ্রা রাজী হ’লো না – আমাদের দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটবাড়ীতে মেজদিও থকে সুভদ্রা, দোয়েল এবং আমার সঙ্গে; বাবাকে রাখার জায়গা নেই। এছাড়া অসুস্থ শয্যাশায়ী বাবার আশেপাশে ছোট্ট দোয়েলকে রাখা ঠিক হবেনা। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা - বাবাকে হাসপাতালে রাখার জন্যে আমার আর সঙ্গতি নেই, আর  হাসপাতালের বাইরে বাবাকে রাখার কোনো জায়গা নেই।
*****

 

'আমার গরীব বাবা', - ব’লতে চাইলুম বাবাকে, - ‘আপনার বাবা পরলোকে গিয়েছিলেন তাঁর বিশ বছর বয়সী সন্তান, আপনার কাঁধে সংসারের সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে।

‘নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে আপনি মানুষ ক’রেছেন আপনার ভাইবোনেদের। ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়ে কাজের যোগ্য ক’রেছেন। বোনেদের বিয়ে দিয়ে সংসারী ক’রেছেন। তারপর শুরু ক’রেছেন আপনার নিজের বিবাহিত জীবনের দায়িত্ব।

‘সারা জীবন ধরে পরিশ্রম ক’রেছেন রোজগার বাড়িয়ে খরচের সঙ্গে পাল্লা দিতে – প্রথমে মা, ভাইবোনেদের জন্যে – পরে বৌ, ছেলেমেয়েদের জন্যে। সপ্তাহের ছ-দিন সরকারী অফিসে কাজ ক’রেছেন, তার উপর রোজ চার-ঘন্টা ক’রে প্রাইভেট ট্যুইশন ক’রেছেন। কতটুকু সময় পেয়েছেন একটু জিরোবার জন্যে?

‘অবসর নেওয়ার পর, শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটুকুই ছিল আপনার সারা জীবনের জমানো সম্বল, দাদাকে একটি বাড়ি কেনার জন্যে সাহায্য ক’রতে খরচ ক’রলেন তার পুরোটাই।

‘হায়রে, কেউ এখন বসবাস করেনা সে বাড়িতে। আপনি যদি আপনার ভাড়া ফ্ল্যাটেই চালিয়ে যেতেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটুকু ব্যাঙ্কে রেখে, তাহলে নিজের জীবন চালিয়ে যাবার জন্য কিছু থাকতো হাতে শেষ সময়ে।

‘আজ যদি মা বেঁচে থাকতো, হয়তো আমি তার উপদেশ নিতে পারতাম। আমি এখনো ভুলতে পারিনি যে একদিন একা পেয়ে মা একটা প্রশ্ন ক’রেছিল, আমি সে প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই কেউ এসে পড়েছিল, আমি জবাব দিতে পারিনি।

‘মা জিগ্যেস ক’রেছিল – কেন আমি আপনাদের দুজনকে কলকাতা থেকে জামসেদপুরে নিয়ে এসেছিলাম, যদি সারা জীবন আমার কাছে রাখার ক্ষমতা না থাকে? কেন আপনাদের দিল্লীতে দাদার বাড়ীতে আসতে হোলো?

‘সেদিন আমি জানতাম না জামসেদপুরের চার-বেডরুমের কোয়ার্টারে আমি চিরদিন থাকতে পারবো না।

‘মা তো অনেকদিন চলে গেছেন – আমার দিল্লীতে আসার অনেক আগেই। এখন আপনাকে আমি কোথায় রাখবো? আর বেশী দিন হাসপাতালে আপনাকে রাখা আমার সাধ্যের বাইরে। কোথাও তো নিয়ে যেতে হবে আপনাকে! দাদা তার ফ্ল্যাটে আর ঢুকতে দেবে না আপনাকে। আমার দু-বেডরুমের ফ্ল্যাটেও আপনার থাকার জায়গা হবে না – সেখানে আমি থাকি সুভদ্রা আর দোয়েলকে নিয়ে – এখন মেজদিরও সেখানেই ঠাঁই। আমাকে এখনই একটা ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে হবে, যে ফ্ল্যাটের ভাড়া আমার সামর্থ্যের মধ্যে – হাসপাতালের বেডের মতো খরচ ক’রতে হবে না।‘

******

পরের দিন সকালে, আমি একটি বাড়ীর চারতলায় দু-বেডরুমের ফ্ল্যাট ভাড়া ক’রলাম, আর দুটি খাট ভাড়া ক’রলাম বাবা এবং মেজদির জন্য।  সুভদ্রা  ভাবলো এই সুযোগ মেজদিকে বাড়ী থেকে হাটাবার;  ওকে বললো ওর জামাকাপড়ের স্যুটকেশ সঙ্গে নিতে; প্লেট, কাপ, ডিস আর রান্না করার কিছু বাসনপত্র দিল যাতে মেজদি বাবার জন্যে এবং নিজের জন্যে রোজকার খাবার বানাতে পারে।

যখন মেজদি ফ্ল্যাট গুছোচ্ছিল, তখন আমি হাসপাতালে গিয়ে বিল মিটিয়ে, বাবাকে ছাড়িয়ে নিলাম হাসপাতাল থেকে; তারপর ট্যাক্সি ক’রে ওঁকে নিয়ে এলাম সদ্য ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। এখন বাবাকে আর জামাকাপড়ের কিট-ব্যাগটি তুলতে হবে উপরের চারতলার ফ্ল্যাটে। আমি বুঝতে পারলাম – চার তলার ফ্ল্যাট নেওয়া কত বড় ভুল হ’য়েছে। বাবা মোটেই ভারী নয়, কিন্তু একা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তাঁকে কোলে ক’রে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা। বাবা আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙ্গে একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা উঠে এলেন; তারপর বসে পড়লেন বাবা; চারতলা যাবার সিঁড়িগুলো বড্ড খাড়া খাড়া। আমি বুঝতে পারলাম কেন চারতলার ফ্ল্যাট সস্তা ভাড়ায় পাওয়া যায়। এখন আর কী উপায়? মেজদির হাতে বাবার দেখাশোনার ভার দিয়ে আমি নীচে নেমে গেলাম কোনো মজদুরের সাহায্য পেতে। সৌভাগ্যবশতঃ বাড়ীর দারোয়ান ছিল বেশ গাঁট্টাগোট্টা শক্ত-সমর্থ, বাবাকে কাঁধে তুলে অনায়াসে নিয়ে গেল চার তলার বিছানায়। মেজদি যত্ন করে বালিশে ঠেসান দিয়ে বসাল বাবাকে। এর পরের তিন সপ্তাহ কাটলো ভালোই, বাবাকে বেশ খুশী আর সুস্থ মনে হচ্ছে; কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছিলাম না। আমি বসকে বললাম যে আমি কাল থেকে আবার ক্লায়েন্ট ভিসিটে বেরোবো দিল্লীর বাইরে।

কিন্তু হোলো না আমার ক্লায়েন্ট ভিসিটে বেরোনো। অফিস থেকে বাড়ী ফিরেই দেখি বাবার অবস্থা খারাপ; ছুটে গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে, সেখানে ডাক্তার নেই; ফিরে এসে দেখলাম শ্বাস পড়ছেনা, সিপিআর ক’রে কিছু হ’লো না; এবারে চেম্বারে গিয়ে ডাক্তারকে পেলাম; উনি এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখলেন।

******

চার তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি, নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে – শীগগিরই দাদা আসবে, এখান থেকে নিয়ে যাবে বাবার মৃতদেহ। প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছে বাড়ীর দরজার সামনে; কেউ একটা খাট নিয়ে এসেছে আমার কথা মতো। দাদা এসে পৌঁছলো ওর নিজের গাড়ীতে; গাড়ীর পেছনে শব-বাহী ট্রেলার। দাদা চার তলায় উঠে এলো, বাবার বিছানার দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো; অশ্রু ভরে এলো তার চোখে, মেজদিও কাঁদতে শুরু ক’রলো; আমি পারলুম না কাঁদতে; মেজদির কান্না দেখে ভাবলুম – এতক্ষণ মেজদি কেন কাঁদে নি।

নতুন কেনা খাটে শুইয়ে দেওয়া হ’লো বাবার শবদেহ। দুজন জোয়ান ছেলে অনায়াসে নেমে এলো খাট নিয়ে, চারতলার খাড়া খাড়া ধাপ বেয়ে। আমি হতবাক হ’য়ে দেখছিলাম ওদের হাত ফসকে খাটটা পড়ে যাবে কিনা – কয়েক সপ্তাহ আগে অনেক সাবধানে উপরে তুলতে হ’য়েছিল বাবাকে; এখন আর কোনো উদ্বেগ নেই বাবার দুর্ব্বল শরীরে আঘাত লাগার।

******

‘কয়েকমাস ধরে অনেক খেটেছিস, কিরীটি, এবার একটু জিরিয়ে নে। বস আমার পাশে। তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।‘ – বাবার জ্বলন্ত চিতার আগুন থেকে যেন বাবার কণ্ঠস্বর। মার্চের হিমশীতল রাতে, যমুনা নদীর তীরে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল বাবা; স্বর্গে পৌঁছাবে কি এই ধোঁয়া? আমার চোখের সামনে ভাসছে – ব্যস্ত শহরের রাস্তায় বাবার আঙুল ধরে হাঁটছে আমি। গত দু-মাসের দৌড়ঝাঁপের সমস্ত দরকার ফুরিয়ে গেছে। চোখ জুড়ে আসছে ঘুমে, ঢুলে চিতার আগুনে পড়ে যাচ্ছিলাম আমি; দাদা ধাক্কা দিয়ে জাগালো, ব’ললো – ঠিক আছিস তো? একটু দূরে গিয়ে বস।

মনে পড়ছিল - একদিন বাবার মতো হাঁটতে শিখেছি। বাবার হাত ধ’রে হেঁটেছি শহরের রাস্তায় – দেখেছি বিলবোর্ডে বিরাট আলোভরা কেটলি থেকে লিপটনের চা পড়ছে কাপে – কেটলি খালি হ’য়ে ভর্ত্তি হচ্ছে কাপ; তারপরে আবার ভর্ত্তি হ’চ্ছে কেটলি, খালি হ’চ্ছে কাপ – চলেছে একই খেলা। তারপরে দেখেছি – বাবার জুতোটা আমার চাইতে অনেক বড়ো, লেখাপড়ায়-কাজকর্ম্মে বাবা অনেক জানে। বাবা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকতেন, সাতজনের সংসারে অনেক খরচ – দশটা থেকে পাঁচটা চাকরী এ.জি.বেঙ্গলে,-  টিউশনীও ক’রতেন- একটা কাজের আগে সকালে, আর একটা কাজ থেকে ফেরার পরে সন্ধ্যায়। সকালে টিউশনীতে যাবার আগে বাবা যখন দাড়ি কামাতেন, তখন শুনতেন আমি বাংলা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ ঠিক ঠিক ক’রেছি কিনা, শুধরে দিতেন ভুলগুলো; তেমনিই দেখতেন আমার অঙ্কগুলো ঠিকমতো কষা হ’য়েছে কিনা। তখনও আমার স্বপ্ন – আমি ‘বাবা’ হবো; বাবার মতো অনায়াসে ক’রবো সব অঙ্ক, অনায়াসে লিখবো বাংলায়, অনায়াসে লিখবো ইংরেজীতে।

মনে পড়ছিল - বাবা কখনও আমাকে খারাপ ছেলেদের সঙ্গ ছাড়তে বলেননি, কখনও সিনেমা দেখতে বা বই পড়তে বারণ করেননি, ব’লতেন, “তুমি যদি ভালো হও, তোমার খারাপ ছেলেদের থেকে দূরে থাকার দরকার নেই, বরঞ্চ তুমি তাদের সাহায্য ক’রবে ভালো কিছু করার জন্য। মানুষ হিসেবে এটাই তোমার কর্ত্তব্য আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, দেশবাসী, বিশ্ববাসী প্রতিটি মানুষের জন্যে।” - কর্ত্তব্যপালনের নিষ্ঠা পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে।

মনে পড়ছে,- বাবার মৃত্যুর পনেরো বছর পরের কথা - আমি কানাডা থেকে ক’লকাতায় এসেছি কয়েক সপ্তাহের ছুটিতে। আমার দাদা দিল্লীতে থাকে ব’লে আমাকে অনুরোধ ক’রলো, ‘বাবার পৈতৃক বাড়ীর দলিলটা নতুনকাকার কাছে আছে। তুই নতুনকাকার বাড়ীতে গিয়ে ঐ দলিলটা চেয়ে নিয়ে আয়। এখন বাবার পৈতৃক বাড়ীতে যে খুড়তুতো ভাইরা থাকে তাদের সঙ্গে আলোচনা ক’রে ঐ বাড়ীর জায়গায় একটা অনেক-তলা বাড়ী তৈরী করাবো। এতে খুড়তুতো ভাইদের প্রত্যেকে একটা ক’রে ফ্ল্যাট পাবে।‘

অনেক দিন পরে দেখা ক’রতে এলাম নতুন কাকার সঙ্গে। নতুন কাকার বাড়ীর দরজায় বেল বাজাতেই বেরিয়ে এলেন নতুন কাকা। আমি অবাক হ’য়ে দেখলাম- অশ্রুমাখা দুচোখ নতুনকাকার; ‘দাদা’ ব’লে আমাকে বুকে নিলেন জড়িয়ে। ঘটনার দিনে আমার বয়সে লেগেছে পঞ্চাশের ধকল, ঐ বয়সে বাবাও কি ছিলেন আমার মতো অবিকল?

আমার ঠাকুর্দা যখন ইহলোক ছেড়ে যান তখন বাবা সবে বি.এ. পাশ ক’রে এ.জি.বেঙ্গলে চাকরীতে ঢুকেছেন। বিধবা মা আর সব ভাইবোনেদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আমার বাবা; নতুনকাকা তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তেন; ছোটকাকা তখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি। নতুনকাকা আমার বাবাকে ‘দাদা’ ব’লে ডাকলেও ভালবাসতেন নিজের বাবার মতো। জানিনা, বাবাকে বা নতুনকাকাকে কি এতো ভালো বেসেছি কখনো? বাবার গর্ব্বে ফুলে উঠলো বুক, মাথা উঁচু হোলো – অন্ততঃ নতুনকাকার চোখে আমি ‘বাবা’ হ’তে পেরেছি। বাবা তাঁর ভাইবোনেদের বড় ক’রে তোলার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে; কর্ত্তব্য পালন ক’রেছিলেন ভালবেসে, পেয়েছেন ভাইবোনেদের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

***সমাপ্ত***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু