বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

কার্স ট্যাবলেট

 

      পুরাতত্ত্ববিদ, হাওয়ার্ড কার্টারের সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। প্রায় ত্রিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর, সাফল্য তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হ'ল। তুতেনখামের সমাধি স্থলের খোঁজ যখন মিলল, প্রায় ছাব্বিশ জন সঙ্গীকে নিয়ে তুতেনখামের সমাধি খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যান তিনি। কাজ চলতে থাকলেও একের পর দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে তার পর থেকেই। কার্টারের খাঁচার পাখি বা বলা ভাল বড় আদরের ক্যানারি পাখির মৃত্যু। এরপর তাঁর সঙ্গী সাথীদের একের পর এক মৃত্যু, একের পর এক অঘটেনের সাক্ষী থেকে যান তিনি। কাকতলীয় ভাবে, তাঁর সঙ্গীদের বেশির ভাগ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও, কার্টার বহাল তবিয়তে জীবিত ছিলেন এবং ১৯৩৯ সালে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

 

    পুরাতত্ত্ববিদ হওয়ার শখটা, আমাকে স্কুলের জীবন থেকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। ইতিহাসের ক্লাসে, ইতিহাসের শিক্ষক মধু বাবু যখন মিশর দেশের বর্ণনা দিতেন ! চোখের সামনে স্বচ্ছ নীলরঙা নীল নদের ছবি ভেসে উঠত। ত্রিভুজাকার স্থপতি গুলোর কাছে এক ঝটকায় পাড়ি দিত, চঞ্চলতা পূর্ণ মতি। কাঠের বেঞ্চের ওপর হাতের হেলানে আটকে থাকত, মানসভ্রমণে যাওয়া মস্তিষ্ক। শুধুমাত্র অবয়বটা পড়ে থাকত আট ফুট বাই দশ ফুট, ক্ষয়িষ্ণু ইঁটের ঘরের মধ্যে। পাশে বসে থাকা বন্ধুদের অস্তিত্ব, প্রায় মুছে যেত আমার বর্তমান থেকে। সেই শুরু। ইতিহাস যখন আমার সব বন্ধুদের কাছে একঘেয়েমি লাগত! আমি তখন ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম পাঠাগারে। একের পর এক নতুন তথ্য সংগ্রহের পর চোখেমুখে হাসির ঝিলিক খেলে যেত। স্কুল পেরিয়ে কলেজ। কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটির দোর। ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি ইতিহাসের হাতছানিতে।

*****

   মিশরীয় পুরাকথা অনুযায়ী, ওসাইরিস হল সর্বপ্রথম মমি। অর্থাৎ ওসাইরিসের উপর, তাঁর স্ত্রী আইসিস সর্বপ্রথম এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেন। ওসাইরিস ছিলেন, পৃথিবীর দেবতা গেব এবং গেবের বোন আকাশ অর্থাৎ তাঁদের ঔরসজাত পুত্র। মিশর পুরাণ অনুযায়ী রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার তাগিদে ভাই-বোনের সঙ্গে বিবাহ সম্পাদিত হত। সেই অনুযায়ী গেব বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন, নিজের বোন আকাশের সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে ওসাইরিস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁর বোন আইসিসের সঙ্গে। তৎকালীন মিশরের নানারকম টানাপোড়েনের ফলে, মিশরের শান্তি বিঘ্নিত হতে শুরু করে। প্রজাবর্গ নরমাংস ভক্ষণে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এইসময়,পুনর্জন্ম, 'কারণ' এবং শষ্যের দেবতা ওসাইরাস, প্রজাদের বার্লি, গম এবং উৎকৃষ্টতম 'কারণ' উৎপাদনে উৎসাহী করে তোলেন। কিন্তু বিধি বাম। ওসাইরিসের, ভ্রাতা সেথ... রাজসিংহাসনের প্রতি লোভের কারণে ওসাইরিসকে নানাভাবে আক্রমণ করতে থাকে। অবশেষে পরিকল্পনা করে  সেথ, ওসাইরিসকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে তাঁর শরীরের অংশ ছড়িয়ে দেয়। বিষণ্ণচিত্ত আইসিস, সেইসময় ওসাইরিসের শরীরের টুকরো গুলো একত্রিত করে গোপনে তার মধ্যে সাময়িক প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ, আইসিস ছিলেন যাদুর দেবী। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ওসাইরিসের সাথে মিলিত হন আইসিস এবং ওসাইরিসের ঔরসজাত সন্তান আইসিসের গর্ভে গর্ভস্থ করা হয়। এরপর ওসাইরিস, চিরতরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আইসিস, তাঁর স্বামীর মৃতদেহ কে প্যাপিরাস সল্ট প্রয়োগ করে পচন রোধ করে, মমিতে পরিণত করেন।

 

      তুতেনখাম, ওসাইরিস.... একের পর এক তথ্য যখন গোগ্রাসে গলধঃকরণ করে চলেছি, মুঠোফোনের কাঁপুনি মনোযোগটা নষ্ট করে দিল। মুঠোফোনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে যারপরনাই অবাক হলাম। অবাক হওয়ার আমার আরও বাকি ছিল!

******

 

     বন্ধুদের বেশে কত শত্রু মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। সেদিনের ফোনের পর, ক্ষণিকের ভাবনায় পর্দা ফেলে বন্ধুর ডাকে সাড়া দিই। মমি নিয়ে গবেষণা করার পুরোনো পরিকল্পনা একজনই জানত। কিন্তু আমার অজানা ছিল, আমার ক্রমোন্নতির কারণে কেউ একজন ভেতরে ভেতরে হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরছে। মমিটা বাড়িতে আনার পর থেকেই, আমার জীবনে একটার পর একটা অঘটণ ঘটতে থাকে। ঠিক যেমন কার্টারের জীবনে ঘটেছিল। মমি নামক বস্তুটি বাড়িতে পদার্পনের পর পরই আমি আমার প্রিয় পোষ্য কে হারালাম। তারপর একে একে মা-বাবা...

 

   বাক্স বন্দী মমির দেহ থেকে জড়ানো কাপড় ভেদ করে তার মগজের ঘিলু গুলো বেরিয়ে আসা অনুভূত হয়। যা প্রায় অসম্ভব। কারণ মৃত মানুষের শরীর, মমিতে রূপান্তরিত করার পূর্বে তার মস্তিষ্কের মধ্য থেকে সমস্ত ঘিলু এবং মগজ বের করে নেওয়া হয়। প্রতিদিন কেমন পাগল পাগল হয়ে উঠছি বুঝতে পারি। ঘরে থাকলেই একটা পচা গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঝাপটা মারে। মনে হয় গন্ধটা মমির কাছ থেকে ভেসে আসছে। মমির শরীরের মধ্যেকার নাড়িভুঁড়ি গুলো আমাকে যেন নাগপাশে জড়িত করতে থাকে। এগুলোর কোনোটাই সম্ভব নয়। কারণ অবশ্য একটাই, মমি বানানোর পূর্বে মৃত মানুষের শরীরর পেট কেটে সমস্ত নাড়িভুঁড়ি সমেত পচনশীল অঙ্গ যেমন, বৃক্ক, ফুসফুস, পাকস্থলি সবকিছুই বের করে নিয়ে কাটা চামড়া পুনরায় সেলাই করে দেওয়া হয় এবং সেই কাজ এতটাই সিদ্ধ হস্তে করা হয়, মৃত শরীরের ভেতরের অংশে বায়ু প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করা হয়। তাহলে কিসের জাদুতে আমার মধ্যে এইসব অনুভব অনুভূত হচ্ছে! সমস্ত কিছু  বোঝার উর্ধ্বে আমার। পরপর তিনটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে মানসিক ভাবে আমি পরিশ্রান্ত। এমতাবস্থায়, বন্ধুটির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। মমির উৎস স্থলের সাথে, এই অদ্ভূত মমির সন্ধানের খবরাখবর নেওয়ার আশু প্রয়োজন। সাথে আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই।

 

    চোখের নীচের বলি রেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে আমার। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছি না। ওদিকে বন্ধুটিও বেপাত্তা। মমিটি আমাকে হস্তান্তর করে সে পাড়ি দিয়েছে অজানার দেশে। মুঠোফোনে পরিচিত কন্ঠস্বর প্রতিবার জানান দিচ্ছে...

 

-" ডায়াল করা নম্বরটির বর্তমানে পরিষেবা বন্ধ করা আছে। পরে আবার চেষ্টা করুন।"

 

একরাশ ক্লান্তি গ্রাস করেছে আমাকে। প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক বয়স্ক লাগছে। বহুদিন ঠিকঠাক ঘুম এবং খাওয়াদাওয়ার অভাবে শরীরের ভার নিতে অক্ষম হয়েছে অশক্ত মেরুদন্ড। পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা প্রায় শিকেয় উঠেছে। মমিটা বাক্স বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে শূণ্য ঘরে।

 

      আজকাল আর বাড়িতেও থাকতে ইচ্ছে করে না। শূণ্য ঘর যেন আমাকে গ্রাস করতে আসে। সারাদিন এখানে ওখেনে সময় কাটিয়ে, বিনিদ্র রজনী কাটাতে বাড়িতে ফিরে আসি। এরকমই একটা দিনে ধর্মতলার চা গুমটিতে বসে ভাঁড়ের  ধোঁয়া ওঠা চায়ে একটা সুড়ুৎ আওয়াজ তুলেছে। পিঠের ওপর একটা আলতো চাপড়ে ঘুরে তাকালাম। বুকান দা।

*****

  ময়দানে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সমস্ত ঘটনা বুকান দা কে যথা সম্ভব বিবৃতি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সব শুনে, ছয় ফুটের লম্বা, পেটানো শরীরের  শুভ্রতা মাখা মুখমন্ডলের বুকান দা  সংক্ষেপে উত্তর করল,

 

-" ব্ল্যাক ম্যাজিক।"

 

    মানুষটা সত্যিই অদ্ভুত। কখন যে কোথায় উদয় হয়। আবার কখন যে অস্ত যায়! সে সব বোঝার সাধ্য কারোর নেই।  মানুষটাকে দেখলেই বোঝা যায় কতটা গুণী। সেদিন ময়দানে বসে কালো জাদুর উপর ছোট্ট একটা স্পিচ দিয়ে দিল। বুকানদা'র মতানুযায়ী,

 

-" ব্ল্যাক ম্যাজিক মানেই কিন্তু তন্ত্রমন্ত্র নয়। এর কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাও আছে। তবে ব্ল্যাক ম্যাজিককে একমাত্র হারাতে সক্ষম হোয়াইট ম্যাজিক। অর্থাৎ দেবতার অস্তিত্ব বা পুজো পার্বন বা শান্তি স্বস্ত্যয়ন যজ্ঞে এইসব নির্মূল করা সম্ভব।"

*****

  বুকানদা'র তত্ত্বাবধানে বাড়িতে আজ মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। রক্তবর্ণ কাপড় পরিহিত, ললাটে রক্ত চন্দনের তিলকে বুকানদা কে একদম অন্যরকম লাগছে। যজ্ঞবেদীর সামনে কম্বলাসনে অধিষ্ঠিত বুকানদা মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে। অগ্নিকুণ্ডে ঘৃত প্রদানের ফলে, হলকা গুলো বৃহৎ থেকে বৃহত্তর আকার ধারণ করছে। ঘরময় ঘৃত, পুষ্প, চন্দন এবং ধূপের সুগন্ধে একটা অন্যরকম প্রশান্তি বিরাজ করছে। বুকানদা আসার পর এই প্রথমবার নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হচ্ছে। মমির শরীর থেকে, নাকের ছিদ্র থেকে মাথার ঘিলু ও মগজ যেরকম ভাবে নিষ্কাশন করা হত আমার কিছুদিন আগে ঠিক সেইরুপ প্রতিত হচ্ছিল। আজকে মনে হচ্ছে আমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গ যেমন - বৃক্ক, ফুসফুস, পাকস্থলি পুনরায় প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। ব্ল্যাক ম্যাজিকের ক্ষমতা ক্রমাগত আশক্ত হচ্ছে! সেটা বুঝতে কষ্ট হয়না। অন্ধকারের শক্তি নিস্তেজ করে আলো ফুটছে আমার জীবনে। বুকানদা'র কারণে আমি আরও  পুনরায় জীবন ফিরে পেলাম। বন্ধুরূপী শত্রুর দেওয়া, 'কার্স ট্যাবলেট' প্রায় গলধঃকরণ করে ফেলতাম ! যদি না ফেরেস্তা হিসাবে বুকানদা'র আবির্ভাব হত আমার জীবনে।

 

     বুকানদা আবারও হারিয়ে গেছে। তবে এইবার যাওয়ার আগে ওর বিশেষ যোগাযোগ নম্বর আমার কাছে রেখে গেছে। আমার একাকিত্বের জীবনে, বুকানদা এক আকাশ প্রাণবায়ু প্রদান করে গেছে।

 

     ব্ল্যাক ম্যাজিক আজ পরাজিত হোয়াইট ম্যাজিকের কাছে। সাদা আছে বলেই কালোর এত কদর মতান্তরে আলোর জন্য অন্ধকারের উপস্থিতি অনুভূত হয়! যে কালো মানুষের জীবনেকে অন্ধকারময় জগতের সাথে পরিচিত করে মৃত্যুর মুখে সজোরে আঘাত করে ফেলে দিতে পারে! সেই কালো নাই বা থাকল!

 

    বুকানদার সেদিনের উপকার আমি আজও ভুলিনি। সেদিন বুকানদার হোয়াইট ম্যাজিক না থাকলে আমিও কালের অতলে হারিয়ে যেতাম। প্রাচীন মমি আমার বিশেষ ক্ষতি না করতে পারলেও ভীষণ উপকার করেছে। 'বন্ধু'র দেওয়া মমিকে নিয়ে গবেষণায় মত্ত হয়ে পড়ি। সেদিনের গবেষণার ফল স্বরূপ, বর্তমানে আমার নাম পরিচিত মহলে বহুল প্রচারিত... বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ হিসাবে।

 

কয়েক বছর পর...

 

বন্ধুটিকে খুঁজে পাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছিলাম। একসময় না পাওয়ার আশায়, তার খোঁজ থেকে নিজেকে বিরত করেছিলাম। তাকে শুধুমাত্র এটুকুই জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম, লোভী সেথ যেভাবে তার আপন ভাই ওসাইরিসের দেহ খন্ড বিখন্ড করতে তৎপরতা দেখিয়েছিল! আমার বন্ধুটি, মমির মাধ্যমে প্রেরিত কার্স ট্যাবলেট দিয়ে আমাকে কাবু করতে পারেনি। আজ আমি একজন সফল, পুরাতত্ত্ববিদ।

 

                ____________

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু