বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

রন্ধন অভিযান

রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অতুলের রান্নাঘরটিকে এই মুহূর্তে একটি যুদ্ধের ময়দান আর নিজেকে এক অসহায় সৈনিক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। যে কিনা যুদ্ধের কারণটি তো জানে কিন্তু রণকৌশলটিই  জেনে উঠতে পারে নি । প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার। বৌ গেছে বাপের বাড়ি। দুদিন থাকবে বলেছে। তাকে এই সময়ে ডেকে নিয়ে আসা আর জেনেশুনে বাঘের সামনে থুড়ি বাঘিনীর সামনে দাঁড়িয়ে বাহাদুরী দেখানো একই ব্যাপার। মেয়েও গেছে কলেজ এক্সকারশনে। থাকলে হয়তো একটু সুরাহা হতো। যদিও তাকে খুব একটা রান্নাঘরে রন্ধনরত অবস্থায় দেখা যায় না। তবে মায়ের রান্না করা পদের ছবিটবি তুলতে দেখা যায় অবশ্যই তবুও মেয়েদের মধ্যে রান্না ব্যাপারটা কেমন যেন সহজাত ক্ষমতার মতো বিরাজ করে বলেই মনে হয় অতুলের। মেয়ে বাড়ি না থাকায় সে গুড়েও বালি। কোথায় ভেবেছিল রবিবার, ছুটির দিন। সকাল থেকেই দু পেগ দু পেগ করে ফোয়ারা ছোটাবে তারপর ফোন তুলে মেজাজে মনের মতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দেবে তা নয় সকাল সকাল বসের ফোন -- অতুল আজ দুপুরে লাঞ্চটা তোমার ওখানেই করব। কিছু আলোচনা আছে নতুন প্রোজেক্ট টা নিয়ে সেটাও সেরে ফেলব। আমতা আমতা করে অতুল বলেছিল বটে -- কিন্তু স্যার আজ তো গিন্নী বাড়িতে নেই। শুনে তিনি মোটেও নিরাশ হলেন না বরং আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে বললেন -- তাতে কী। সে তো আমারও নেই পাঁচদিন ধরে। তুমি এতো বড়ো বড়ো ডিল হ্যান্ডেল করতে পারো আর রান্না করতে পারো না। শোনো আমি ঠিক দেড়টায় পৌঁছে যাব। তুমি তৈরি থেকো। খাওয়া দাওয়া সেরে আলোচনায় বসতে হবে। বেশি কিছু করতে হবে না। ঐ মাছের কালিয়া কোরো আর পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল। ওটা আবার আমি খুব ভালোবাসি। তার সাথে গোটা কতক পেঁয়াজি করলে ভালো হয়। আর হ্যাঁ শুক্তো টা কিন্তু অবশ্যই কোরো। ওটি আমার বড়ই প্রিয়। মুখের বিকৃতি করে অতুল --উঁ উঁ উঁ উঁহ্ ! এমন করে খাবারের তালিকা বললেন যেন আমার বাড়িতে নয় শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠী খেতে চলেছেন। সেখানেও জামাইরা রয়ে সয়ে কথা বলে। এনার তো সে বালাইও নেই। নিজের বৌ বাপের বাড়ি গেছে তো উনি চললেন কলিগের বাড়ি কব্জি ডুবিয়ে খেতে। আরে বাবা এতো যখন জ্ঞান দেওয়া নিজে রাঁধুন না। শুক্তো, ঘণ্ট, আর অফিসে আমাদের যাদের মাথাগুলো বারো মাস চেবান তারা গিয়ে গিলে আসি। একটা দিন আমাদের জন্য এটুকু তো করতেই পারেন। কতবার যে অতুলের ইচ্ছে হচ্ছিল কথাটা বলেই দিতে। নিজেকে সংযত করে নিয়েছে। এমনিতেই ওর মনে হয় বিন তুঘলকের পরের জন্ম ওদের বস। কখন যে কী ঘোষণা করে দেন ঠিকঠিকানা নেই। তাই তাকে চটিয়ে লাভ নেই বরং খুশি করতে পারলে লাভ দ্বিগুণ। তাহলে এখন উপায় কী ? অলোকা ফোন করেছিল কী করছে জিজ্ঞেস করতে। অতুল বলল সবকিছু। শুনে কেমন নির্বিকার চিত্তে -- আমি কী করব ? তোমার ব্যাপার তুমি বোঝ। এখন আমি এখান থেকে গিয়ে তোমার বসের জন্য রান্না করতে যাব নাকি ? কী আহ্লাদ। আমি বলে কিনা কতদিন পর এলাম এখানে। ওটি হচ্ছে না বলে দিলাম। কবে থেকে বলেছি রান্নাটা শিখে নাও। তা কে শোনে কার কথা। ওসব নাকি ওনার কাজ নয়। আমার জামাইবাবুকে দেখ । কত ভালো ভালো রান্না করতে জানে। দেশের বিদেশের।তোমার জায়গায় জামাইবাবু থাকলে দেখতে আজ একটা বিপ্লব বাধিয়ে দিত। তা বটে। অলোকার জামাইবাবু বেশ পাকা রাঁধুনি। একবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিজে হাতে রেঁধে খাইয়েছিল। এই ব্যাপারে তার নাক উঁচু ব্যাপারটিও কম নয়। বলে -- রান্নাঘরকে যদি আয়ত্তের মধ্যে আনতে পেরেছ ভায়া তবে দেখবে পৃথিবীর কোন কাজই আর তোমার কাছে কঠিন মনে হচ্ছে না। সে না হয় হলো। কিন্তু এই মুহূর্তে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাবার উপায় বের করাটাই বিশাল কাজ। ওদিকে বসের আবার বাইরের খাবার মুখে রোচে না। ঘরে বানানো শুদ্ধ বাঙালি খাবারই সে খাবে। মেয়েকে ফোন করতে বলে -- চিল বাবা ! ইউটিউব আছে কী করতে ? দেখে দেখে রেঁধে ফেল। মেয়েকে কী করে বোঝায় অতুল যে বারান্দায় বসে যুদ্ধ দেখে হঠাত ঢাল তলোয়ার নিয়ে হারে রে রে করে যুদ্ধ করতে যেমন নামা যায় না তার জন্য যেমন প্রয়োজন রণনীতি কৌশল আয়ত্ত করা তেমনই ইউটিউবে রান্না দেখে রান্না করতে হলে প্রাথমিক ধ্যান ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রথমে কোনটা কোন মশলা চিনতে হবে তারপর সব্জি কাটার ধরন ধারন জেনে বুঝে কাটতে হবে। ভাত ঠিক সময়ে বুঝে নামাতে হবে। আর মাছ ভাজা ?  সে তো শত্রুর প্রধান সেনাপতিকে পরাজিত করার মতো কাজ। ওর জ্ঞানের সীমা তো ঐ ভাতে ভাত করা পর্যন্ত। খোসা সুদ্ধ আলু আর ডিম ফেলে দাও তাতে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে অতুলের। কী ভালো রান্না করতে পারতেন তিনি। অতুলের মা'কে একবার কী একটা অপারেশনের জন্য এক মাস শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। সেই সময়ে একাহাতে রান্না থেকে অফিস দুইই সামলেছিলেন অতুলের বাবা। ভাতে ভাত নয় রীতিমত ভাত, ডাল, তরকারি; মাছের ঝোল করে করে খাইয়েছিলেন। তাঁর ছেলে হয়ে কিনা অতুলের এই অবস্থা? ভাগ্যিস ওনারা বেঁচে নেই নাহলে আজ অতুলকে দেখে হয়তো লজ্জাতেই মরে যেতেন। অতুল ভাবনা চিন্তা থামিয়ে আপাতত ফ্রিজ খুলে দেখে সেখানে চিংড়ি মাছ আর কাৎলা মাছের টুকরো বেশ কয়েকটা রয়েছে আর নিচে সব্জি ভান্ডারও বেশ পরিপূর্ণ। অতুলের মনে হয় ঐগুলো যদি একটু রেঁধে টেধে রেখে যেত অলোকা তবে কতোই না ভালো হতো। গরম টরম করে খেতে দেওয়া যেত অন্তত। কিন্তু তারও তো উপায় নেই। অলোকা আবার বাসি খাবার খাওয়া পছন্দ করে না তা সে যতোই ফ্রিজে রাখা থাক। এতে নাকি শরীরের ক্ষতি হয়। ঐ যন্ত্রটি কাঁচা মাল সংরক্ষণের জন্য। বার করো আর রেঁধে খাও। অতুলের মনে হল ওর ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল -- আর বলবি বৌকে রান্নাঘর ছাড়া জীবনে আর কী চিনলে ? এবার বোঝো হাড়ে হাড়ে কত ধানে কত চাল। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়েই চলেছে। অতুলের কপালে ঘাম ছুটছে। এমন সময়ে দরজায় কলিং বেল টিং টং। দরজা খুলতেই চক্ষু হতবাক অতুলের। অলোকা দাঁড়িয়ে সামনে। মুখ টিপে টিপে হাসছে। অতুল দরজা খুলতেই বলে উঠল -- নাও সরো দেখি আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আসতে আসতেই অনেক সময় চলে গেছে। তোমার জন্য শান্তিতে বাপের বাড়িতেও থাকা হবে না আমার। অতুল অলোকার হাতদুটো ধরে আপ্লুত হয়ে বলে -- উফ অলোকা বাঁচালে আমায়। তুমি না আসলে যে কী হতো। অলোকা হাত ছাড়িয়ে টাগড়ায় জিব ঘোরাতে ঘোরাতে বলে -- হুম সে না হয় হল কিন্তু আজকের রান্না করে দেওয়ার আগে আমার একটা শর্ত আছে।

-- কী শর্ত ? শাড়ি চাই তো। দেবো দেবো। যেটাতে হাত রাখবে সেটাই দেবো। 

-- উহু!  শাড়ি না তোমাকে কথা দিতে হবে এবার থেকে ছুটির দিনগুলোতে তুমি আমার কাছে রান্না শিখবে।

-- অ্যাঁ? 

-- অ্যাঁ নয় হ্যাঁ। তোমার বাবা পারতেন, আমার জামাইবাবু পারেন আর তুমি কেন পারবে না ? তুমি রান্না শিখলে আমিও দিদি জামাইবাবুকে একদিন ডেকে এনে তোমার হাতের রান্না খাওয়াবো। তাছাড়া আমি বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেলে আবার যদি তোমার বস খেতে আসতে চায় তবে আমাকেও ফিরে আসতে হবে না মাঝপথেই। 

-- কারোর কাছে প্রমাণ করার জন্য নয় শুধু তোমার জন্য কথা দিলাম অলোকা আমি রান্না করাটা শিখেই নেব। আজ বুঝলাম রান্নাঘরটা কোন ছেলেখেলার জায়গা নয়। অনায়াসে একে আয়ত্তে আনা যায় না। পটু লোকেদের কাছে এই স্থানটি যেমন মন্দিরের মতো আনাড়ী লোকেদের কাছে তেমনই বিভীষিকাময় সাথে এও বুঝলাম শুধু মেয়েদের নয় ছেলেদেরও সব কাজ একটু আধটু জেনে রাখা প্রয়োজন। অলোকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলে উঠল অতুল।

""""""""""""""""""""""""""""         

 ছবি:- গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু