বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

সই

- এখন আর ওসব কাজ হয়না গো দিদিমণি

- সেকি!হয়না মানে!

- এখন সব হলো গিয়ে কম্পিউটার মেশিন।ওসব হাত কাজই বলুন আর এমনি পুরনো মেশিন কাজ,ওসব আর চলেনি কো।

- ওহ,তাহলে ফরোজ এখন কি করে?ওই কম্পিউটার মেশিন কিনেছে?

- কি যে বলেন দিদিমণি!ওর তো মেলা দাম!আমাদের পক্ষে কি সম্ভব!

- তাহলে!

- তাহলে আর কি, ফরোজ এখন কলকেতার বড়বাজারে কাজে যায়।দোকানে বসে গো।

- আর ওর বউ,আঞ্জুরা?

- তারেও চেনেন!সে তো এখন মেশিন সেলাই করে গো।(লোকটা তার ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত গুলো বেরকরে বলে)

- এত ভালো হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করতো,ছেড়ে দিলো!

- ওতে আর কটাকা হয় দিদিমণি!তিন তিনটে বাচ্চা,সংসার তো চালাতি হবে , নাকি?

- ওহ

- তা আপনি কে হন বলুন তো?এত প্রশ্ন করছেন!

- তেমন কিছুনা।আগে কাজ করতো ওরা আমার।

ফরোজ এলে এই নম্বরে ফোন করতে বলবেন।আপনি তো ওর পাশের বাড়ি থাকেন বললেন।


কথাটা শেষ করেই, নিজের কার্ড লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়েই, পা বাড়ালো উল্টো পথে,অর্থাৎ ফিরতি পথে।পিছন থেকে লোকটা কি যেনো বলছে, ওর আর শোনার ইচ্ছাই নেই।এগিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললো," চলো "।


গাড়ি ছুটে চলেছে।তিতাসের মন টা উদাস হয়ে আসে। ওর স্মৃতি এখন পিছন দিকের রাস্তা ধরে,দশ বছর পুরনো এক মাটির বাড়ির দাওয়ায়।তখন সবে বুটিক টা দাঁড় করাচ্ছে ও আর মহুয়া।দুজনে মিলে ,স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায়,হ্যান্ড এমব্রয়ডারি শেখাচ্ছে ওই গ্রামের মেয়েদের।ফরোজ এর বাড়ি র দাওয়া টা বড় বলে,ওখানেই বসা হয়েছে।ওর বউ অঞ্জুয়ারা,একটা বাচ্চা কোলে শিখছে সেখানে,অসম্ভব ভালো হাত। তুহিনা,ফিরোজা,মেহেরুন,কতগুলো নাম ভিড় করে আসতে থাকে তিতাসের মনে।কি ভালো কাজ শিখেছিল ওরা।ওদিকে ফরোজ এর মত অনেকেরই এমব্রয়ডারি মেশিন আছে,বাইরে থেকে কাজ এনে করে। ওরা সেইসব কাজের ফাঁকে, ওদের বুটিকের মেশিন ওয়ার্ক গুলো করে তখন।ধীরে ধীরে তিতাস আর মহুয়ার " সই " ডানা মেলছিল তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে।এক একটা নকশা ফুটে উঠছিল কাপড়ের সাথে সাথে ওদের জীবনের রোজ নামচাতেও।তারপর একদিন সব বদলে গেলো.......


- বাহ,তোমাদের বুটিক তো দারুণ গুছিয়েছ!হবে নাকি আমার জন্যও কিছু!

দরজার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে তখন তিতাস আর মহুয়া দুজনেরই গালে রং ধরেছে,যদিও ভিন্ন কারণে।মহুয়া তার হবু বরকে আশা করেনি এভাবে,আর তিতাস এত হ্যান্ডসাম স্মার্ট কাউকে আশা করেনি।মহুয়া আলাপ করিয়ে দিলো, স্নেহাশীস,বিলেত ফেরত ডাক্তার।ফেরত না বলে অতিথি বলাই ভালো,অর্থাৎ আবার সেখানেই ফিরে যাবে।তিতাস জানতো,ছবিও দেখেছিল,অনেক দিনই ঠিক হয়ে আছে দুজনার বিয়ে।কিন্তু সামনে থেকে ভদ্রলোক সত্যিই ক্যাচি!


এরপর জল বেশ লম্বা গড়ালো।সংক্ষেপে যা দাঁড়ালো,তাতে মহুয়া আর তিতাসের ' সই ' ও সইত্ব দুই ভেঙে গেলো।তিতাস স্নেহাশীস কে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো।যুদ্ধে আর প্রেমে,ভুল বা অন্যায় বলে কিছু হয় না!এই অপ্তবাক্য টাই ছিল তিতাসের একমাত্র জাস্টিফিকেশন।নিজেই মহুয়ার ফোন থেকে নম্বর নিয়ে কথা বলেছিল।তারপর স্নেহাশীষ এর মন যে,তিতাসের মত সুন্দরী,স্মার্ট,অতিফর্সা মেয়ের দিকে ঘুরবে তাতে আর কি!একটু অন্যভাবে আর্টিস্টিক ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল তিতাস আর মহুয়া।কিন্তু হলো একদম আলাদা।তারপর মহুয়ার আর কোনো খোঁজ রাখেনি তিতাস।


আজ আট বছর পর ফিরে এসেছে তিতাস।সব ছেড়ে,স্নেহাশীষ এর সাথে বিচ্ছেদ টাও সারা।অনেক চেষ্টা করেছে সম্পর্ক টা বাঁচানোর।কিছুই করার ছিলনা,যেভাবে মহুয়ার থেকে তিতাস ভাসিয়েছিল স্নেহাশীষ কে,সেভাবে কিয়ারা ভাসালো ওর থেকে।বাড়ি ফিরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল,মহুয়া বিয়ে করেনি।ওর বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাওয়াটা বাকি ছিল,সেটাও করেছে।মহুয়ার বাড়ির লোক মারমুখী হলেও,মহুয়া ওদের থামিয়ে দিয়েছে।নিজে একটা কথাও বলেনি।তিতাস দেখেছিল,মহুয়ার খাটে ফ্রেম সমেত একটা অর্ধেক তৈরি শাড়ি পরে আছে।মহুয়া এখন কোনো বুটিকের হয়ে কাজ করে,নিজের ' সই ' হারিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে ও !


তিতাস আট বছর আগের ভুল শোধরাতে আবার শুরু করতে চেয়েছিল। পৌঁছিয়ে গিয়েছিল ,যেখান থেকে পথ চলা শুরু সেখান থেকে। মন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছুই বোধহয় নতুন করে শুরু করা যায়না!সে জীবন হোক বা সেলাই! ভুল ভুলই! হয় সব সেলাই খুলে একদম নতুন করে শুরু করতে হবে।যদিও সব কাপড়ের এত শক্তি থাকেনা সহ্য করার।অথবা,ভুলটাকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তিতাস সামনে এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা!


ফোনটা এলো আটটা নাগাদ।ফরোজ,প্রচুর কথা বললো। আঞ্জুরা ও ফোন পেয়ে কলকল করে বকে গেলো।তিতাস নিজের পরিকল্পনা জানালো ওদের।

ফরোজ বললো:

- নিশ্চয়ই করবো,আমার মেশিন টা তো আছে এখনো,ছুটির দিন দেখে আপনার কাজ করে দেবানি।

- পারবে!

- একদম পারবো।

- আর হ্যান্ড এমব্রয়ডারি!

- সে আমি লোক জোগাড় করে দেবো!রেট একটু বাড়াতি হবে,বোঝেন ই তো!


কথোপকথন শেষ করে ফোনটা রাখলো তিতাস।এখন নিজেকে হাল্কা লাগছে অনেক।ডিভোর্স কম্পেনশেশন ভালোই পেয়েছে,নিজের পাপস্খলন ওই দিয়েই হবে। তিতাস ঘাড় টাকে বার দুই ঘোরায়। এখন অনেকটা রিল্যাক্স লাগছে। কাল থেকে নতুন মার্কেট সার্ভে তে নামতে হবে। এ যুদ্ধ ওর একার।জানে কঠিন রাস্তা,তবুও! এবার বুটিকের নাম রাখবে  "মহুয়া "। এইসব চিন্তায় ছেদ পরলো ফোনটা বেজে উঠতেই,মহুয়া! ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে দিলো তিতাস। মহুয়ার গলা ভেসে এলো,


- আঞ্জুরা ফোন করেছিলো,আমার তো নম্বর বদলায় নি।বললো,তুই নাকি আবার শুরু করেছিস?

- হ্যাঁ,ওই মানে....

- তুই কি করে ভাবলি আমি সেটা তোকে করতে দেবো?

- মানে?

তিতাসের মুখে কথা যোগায় না। কি বলবে বুঝে ওঠার আগেই মহুয়া বলে,

- স্নেহাশিস কখনোই কারো ছিলো না,তাই ওটা নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। বিয়ে করিনি,কারণ আর ভরসা করার সাহস নেই। তবে ' সই ' দুজনের ছিলো,আর সেটাই থাকবে। এখানে তোকে আমি একা ভাগ বসাতে দেবোনা।

তিতাস কখন যে কাঁদতে শুরু করেছে ও নিজেই জানেনা।কান্নার রেশ একটু কমলে শুনতে পায় মহুয়া বলছে,

- সব আমি গুছিয়ে রেখেছি। কাল যাচ্ছি তোর বাড়ি,আমাদের নতুন যাত্রার প্ল্যান অফ অ্যাকশন ঠিক করতে। আর তুই ভেবেছিলি,আমি অন্যের বুটিকে কাজ করি! নারে বুদ্ধু,ওই শাড়িটা আমাদের শেষের দিকের কাজের একটা,তোর মনে নেই। এই ক'বছরে আমি সব খালি শাড়ি গুলো এমব্রয়ডারি তে ভরে রেখেছি। ওটা শেষের টা। এবার কিন্তু আর তোকে পালাতে দিচ্ছিনা। ভেবে নিস ভালো করে।


তিতাসের মুখ তখন, লোনা জলে ভরে রয়েছে।।


✍️ সুণীপা

ফটো কার্টেসি:গুগল

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু