বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

দ্বৈতসত্ত্বা

বিকেল চারটের সময় খোকনের স্কুলের ছুটি হয়; খোকনের বাবা শ্যামল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে চারটে বাজার পনেরো মিনিট আগে; তারপরে স্কুল থেকে খোকনকে নিয়ে শ্যামল ওকে বাড়ীতে পৌঁছে দেয় খোকনের মা কল্পনার কাছে। খোকনকে বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়ার পরে, বেশীর ভাগ দিনেই আবার অফিসে ফিরে যায় শ্যামল, কারণ অনেক কাজ থাকে; মাঝেমাঝে, সাধারণতঃ শুক্রবারে শ্যামল আর অফিসে ফিরে যায় না; সেদিনগুলো খোকনের খুব মজা হয় বাবার সঙ্গে খেলতে; নয়তো মা আবার পড়তে বসায়। বাবাকে খুব ভালবাসে খোকন, ভক্তিও করে; এত লেখাপড়া ক’রেছে বাবা, কিন্তু খেলার সময়ে খোকনের মতোই বাচ্ছা ছেলে হ’য়ে যায়; খেলার মধ্যে অবশ্য কিছু কিছু কায়দা শেখায় মাঝে মাঝে; যেমন ধরো ক্যারম খেলার সময় বাবা বলে, ‘ধরো, ক্যারম বোর্ডের পকেটগুলো এক একটা সার্কেল; ঘুঁটিগুলোও এক একটা সার্কেল; তোমার যে ঘুঁটিটা ফেলতে চাও সেই ঘুঁটিটার সার্কেলের সেন্টার আর যে পকেটে ফেলতে চাও সেই পকেটটার সেন্টার যোগ ক’রলে যে সরলরেখা পাবে, সেই সরলরেখা যে বিন্দুতে ঐ ঘুঁটিটার সার্কেল বা বৃত্তকে ছেদ ক’রবে, ঠিক সেই বিন্দুতে স্ট্রাইকার দিয়ে টিপ ক’রে মারো, অন্য কোনো বাধা না থাকলে ঘুঁটিটা পকেটে পড়বেই।‘

গত ছ’মাস ধ’রে রোজ বাবার সঙ্গে বাড়ী ফেরার পরে হঠাৎ ব্যতিক্রম হ’লো এক শুক্রবারে। সাড়ে চারটে নাগাদ স্কুল থেকে ফিরলো খোকন একা, কান্না-কান্না ভয় পাওয়া মুখ। ওকে আসতে দেখেই ছুটে বাইরে এলো কল্পনা; জিগ্যেস ক’রলো, ‘কী হ’য়েছে তোর খোকন? তোর বাবা কোথায়? তোর স্কুলের ব্যাগ কোথায়?’

খোকন কাঁদতে কাঁদতে ব’ললো, ‘মা, বদলে গেছে বাবা।‘

কল্পনা ব’ললো, - ‘কিরকম বদলে গেছে বাবা? বাবার সঙ্গে কেন আসিস নি? বাবা কোথায় এখন?’

খোকন ব’ললো, ‘বাবা ব’ললে, এতদিন ধ’রে এই পথ ধ’রে বাড়ী ফিরছিস্; বাড়ীর ঠিকানা কি বলতো? উত্তরে আমি ব’ললুম –একের একের বি, বিনয় বসু রোড। বাবা ব’ললে, ঠিক ব’লেছিস। রমেশ মিত্র রোড ধ’রে সোজা চলে যাবি; বকুল বাগান রোড ক্রস্ করার পরে ডানদিকে ঘুরে গেলেই পাবি বিনয় বসু রোড। পারবি না যেতে? বল্।

আমি বললাম, - পারবো। তখন আমি আবার ব’ললাম, - টীচার ম্যডাম ব’লেছে, তুমি যেন আজ ওঁর সঙ্গে দেখা ক’রে যাও। বাবা ব’ললে, - ঠিক আছে, তুই  বাড়ী ফিরে যা; ম্যাডামের সঙ্গে কথা সেরে অফিসে চলে যাবো।‘

কল্পনা ব’ললো, ‘তাহ’লে বাবা অফিসে ফিরে গেছে, আর তুইও নিরাপদে বাড়ীতে ফিরে এসেছিস্। তোর স্কুল ব্যাগটা কোথায়?’

খোকন ব’ললো, ‘স্কুল ব্যাগটা বাবা নিয়ে গেছে। বাবা ব’ললো, এত ভারী ব্যাগ নিয়ে তোকে যেতে হবে না, আমার সঙ্গে থাক্, অফিস ঘুরে ব্যাগ নিয়ে বাড়ী ফিরবো।‘

কল্পনা ব’ললো, ‘তাহ’লে বাবা সন্ধ্যেবেলায় ব্যাগ নিয়ে ফিরবে; তার আগে আর পড়াশোনা ক’রতে হবে না। বাবা বদলে গেছে কেন বলছিলিস্?‘

খোকন ব’ললো, ‘বাবা যখন টীচার ম্যডামের ঘরের দরজায় টোকা মেরে ওঁর ঘরে ঢুকে পড়লো, তখন ওঁর জামাকাপড় বদলানোর সময়; ঐসময়ে উনি স্কুলের ড্রেস ছেড়ে বাড়ীতে যাবার জামাকাপড় পরেন। আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম – ম্যডামের স্কুলের ড্রেস ছাড়া হ’য়েছে, কিন্তু বাড়ীতে যাবার জামাকাপড় একেবারেই পরা হয়নি। এই অবস্থায় বাবা টীচার ম্যডামকে জড়িয়ে ধ’রে চুমু খেলো। বলো মা এটা অসভ্যতা নয়? বাবা একেবারে বদলে গেছে। অল্প জামাকাপড় পরা কোনো মেয়ের সঙ্গে খেলতে গেলে তুমি বলো অসভ্যতা। এটা কি অসভ্যতা নয়? টীচার ম্যডামও আমাদের ভদ্রতা শেখান; বাবাও এমনিতে খুব ভদ্র। তবে দুজনে একসঙ্গে মিলে এমন করেন কি ক’রে?’

কল্পনা ব’ললো, ‘এখন আর ব’লতে হবে না। এখন একটু হরলিক্স্ দিচ্ছি; ওটা খেয়ে বাইরে খেলে এসো। সন্ধ্যেবেলায় যখন তুমি, ঠাকুমা, বাবা আর আমি একসাথে ডিনার ক’রবো, তখন বুঝিয়ে ব’লবে বাবা আর কী কী ক’রেছে; কেমন ক’রে বাবা এরকম বদলে যায়।‘

*** ***

কল্পনা ভাবলো, ওর স্বামী শ্যামল দ্বৈতসত্ত্বার মানুষ; লেখাপড়ায়, কাজে-কর্ম্মে খুবই উঁচুদরের, ওর জুড়ি মেলা ভার, লোকজনের সঙ্গে নিখুঁত ব্যবহার, কিছুটা বোকা-সোকা – ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, অথচ খোকনের টিচার ম্যডামকে জামাকাপড় খুলে চুমু খায়, আদর করে। আমার খোকন ওর বাবা আর ওর টিচার ম্যডাম দুজনকেই খুব ভালবাসে – শ্রদ্ধা করে। ওরা দুজনে মিলে খোকনের চোখের সামনে এমন নির্লজ্জ আচরণ ক’রলে, কোথায় থাকবে খোকনের ভক্তি বা শ্রদ্ধা, কী ক’রে জাগবে পড়াশোনা করার ইচ্ছে, বাবার মতো বড়ো হবার আকাঙ্ক্ষা?

কল্পনা ভাবলো, আজ সন্ধ্যেবেলায় যখন ও স্বামী ও শাশুড়ীর সঙ্গে এক টেবিলে ব’সে ডিনার ক’রতে ব’সবে, তখনই ওখানে খোকনকে ডাকবে- আজ স্কুলে ও কী কী ক’রেছে তা বলার জন্যে।

*** ***

স্কুল থেকে ফেরার পর, দুটো বিস্কুট আর এক কাপ হরলিক্স খেয়ে খোকন গিয়েছিল পাড়ার ক্লাবের মাঠে, ওরই মতো খুদে খুদে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে। তারপরে ফিরে এসে, চান ক’রে, ডিনার খেয়ে নিয়েছে। এখন পড়ার টেবিলে ব’সে একটু পড়াশোনা ক’রে নিচ্ছে।

*** ***

সাড়ে ছ’টা নাগাদ শ্যামল ফিরলো অফিস থেকে; সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা চেক ক’রে নিলো- ও খোকনের স্কুল ব্যাগটা নিয়ে এসেছে কিনা। ব্যাগটি ঠিকমতো ফিরেছে; ব্যাগের ভেতরে টিফিন বাক্সটিও খালি আছে; কাজেই শ্যামল বা খোকন কাউকেই বকুনি দেবার দরকার নেই।

লেটার বক্স থেকে আনা চিঠিগুলোর উপরে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে শ্যামল ঢুকলো স্নানঘরে। তারপরে ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় ডাইনিং টেবিলে।

কল্পনাও রেডী ডিনার নিয়ে; আজকের ডিনারে পদ বেশী নেই, কিন্তু মুখরোচক – ডিম আর মাংসের চপ, আর কড়াইশুটির কচুরী। কল্পনার সঙ্গে ডিনার টেবিলে হাজির কল্পনার শাশুড়ী অর্থাৎ শ্যামলের মা মাধবী।

ডাক পড়লো খোকনেরও – মূলতঃ  স্কুলে আজ ওর কী কার্য্যকলাপ ছিল তার বিবরণ দেওয়ার জন্যে; ওর ডিনার খাওয়া হ’য়ে গেছে, তবুও একটা গরম কড়াইশুটির কচুরী দেওয়া হ’লো ওকে, যাতে বড়দের প্লেটে নজর না দেয়।

প্রথমেই খোকন একটা কবিতা শোনালো; বাবার শেখানো এই কবিতা আবৃত্তি ক’রে ও শুধু টীচার ম্যডামের নয় বন্ধুদেরও মন জিতে নিয়েছে:-

“Forward, the Light Brigade!

Charge for the guns!” he said.

Into the valley of Death

   Rode the six hundred.

এর পরে ও অঙ্ক কষেছে, ছবি এঁকেছে, আরও কত কি ক’রেছে; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা – ও আজ একা, নিজে নিজে বাড়ী ফিরেছে। বাবার নির্দ্দেশমতো. ওর একার light brigade ও নিয়ে এসেছে রমেশ মিত্র রোড ধ’রে; বকুল বাগান রোড পার হবার পরে ডানদিকে ঘুরেছে বিনয় বসু রোডে – তারপরে ঢুকেছে ওদের বাড়ীতে।

এবারে কল্পনা ফোড়ন দিলো খোকনকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্যে, ‘খোকন, বাবা তোমার সঙ্গে বাড়ীতে ফিরলো না কেন, ব’ললে না?’

খোকন ব’ললো, ‘হ্যাঁ, বাবার অফিসে ফিরে যাবার ছিল, তাই প্রথমবার বাবা আমাকে একা একা বাড়ী ফিরতে ব’ললো।‘

কল্পনা আবার ধ’রিয়ে দিলো খোকনকে, শ্যামলের দ্বৈতসত্ত্বার কথাটাতো খোকনকে দিয়েই বলাতে হবে,- ‘খোকন, অফিসে ফেরৎ যবার আগে বাবা কী ক’রেছিল?’

খোকন ব’ললো, ‘অফিসে ফেরৎ যবার আগে বাবাকে টিচার ম্যডামের সঙ্গে দেখা ক’রতে হ’য়েছিল, কারণ উনি বাবার সঙ্গে দেখা ক’রতে চেয়েছিলেন।‘

কল্পনা ব’ললো, ‘বলো, কেন তোমার মনে হ’য়েছিল যে, বাবা বদলে গেছে?’

খোকন ব’ললো, ‘বাবা যখন টিচার ম্যডামের দরজায় ধাক্কা মেরে ঢুকেছিল, তখন টিচার ম্যডাম একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলেন। স্কুল থেকে বেরোবার আগে উনি, স্কুলের জার্সি খুলে বাড়ীর জামাকাপড় পরে নেন। বাবা যখন ঢুকেছিল, তখন টিচার ম্যডামের বাড়ীর জামাকাপড় পরা হয়নি।‘

কল্পনা ব’ললো, ‘তারপরে বাবা কি ক’রেছিল, বলো, খোকন।‘

খোকন ব’ললো, ‘বাবা আর টিচার ম্যডাম পরস্পরকে চুমু খেয়েছিল, এইটুকু দেখেছি। আমার ভালো লাগেনি ব’লে চলে এসেছি। ভয় পেয়েছিলাম, পাশের বাড়ীর কাকু যেমন তোমাকে কোলে চড়িয়ে নাচায়, আদর করে আর তুমি বাচ্ছা দুষ্টু মেয়ের মতো হাসতে থাকো, সেরকমই কিছু হবে আর টিচার ম্যডামও হেসে গড়িয়ে পড়বে।…..

খোকনের কথা শেষ হবার আগেই, কল্পনার মনে হ’লো – ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কোনোরকমে টেবিলে হাত দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় গেলাসটা পড়ে গেলো, ভিজে গেলো ওর শাড়ীর অনেকটা।

কল্পনার শাশুড়ী খোকনকে ব’ললো, ‘দাদুভাই, তোমার গল্প শুনেছি। এবার তুমি শুয়ে পড়ো।‘

খোকন চলে যাবার পরে সবাই চুপচাপ; কথা শুরু ক’রলো মাধবী, ‘বৌমা, তুমি দ্বৈতসত্ত্বার কথা ব’লছিলে না; আমাদের সকলেরই আছে দ্বৈতসত্ত্বা; প্রতিটি পুরুষই কখনো বাবা, কখনো স্বামী বা প্রেমিক; প্রতিটি নারীই কখনো মা, কখনো স্ত্রী বা প্রেমিকা; ধরো শ্যামলের ঠাকুর্দা আর ঠাকুমার কাছে আমি ছিলাম মেয়ের মতো বৌমা; শ্যামলের বাবার কাছে একমাত্র স্ত্রী এবং প্রেয়সী; আবার শ্যামলের কাছে আমি মা; যখন যার কাছে তখন যে সত্ত্বার দরকার সেটাই হয়েছে আমার সত্ত্বা।‘

শ্যামল ব’ললো, ‘ডাঃ জেকিল মিঃ হাইড হ’তো সিরাম খেয়ে, আবার মিঃ হাইড থেকে ডাঃ জেকিল হ’তো উল্টো সিরাম খেয়ে।‘

মাধবী ব’ললো, ‘সাধারণ মানুষের সিরাম লাগে না, লাগে উপযুক্ত সঙ্গ। যখন যার সঙ্গে থাকি, তা সঙ্গটাই সিরামের কাজ করে।‘

কল্পনা ব’ললো, ‘আপনাদের সময়ে মেয়েরা বাড়ীর বাইরে বেরোতো না; কাজেই একজনের বেশী পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতো না, মেয়েরা বাইরে কাজ ক’রতো না ব’লে পুরুষদেরও কোনো সহকর্ম্মিনী থাকতো না।‘

মাধবী ব’ললো, ‘এজন্যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে কাজ করার সময় যেন কোনোরকম অসম্মান বা অত্যাচার না করা হয়। এছাড়া নানান রকম ওষুধের উদ্ভাবন হ’য়েছে।‘

শ্যামল ব’ললো, ‘অনেকে ব’লছে, পঞ্চাশ বছর বাদে আর কেউ বিয়ে ক’রবে না; তরুণ যুবকেরা তাদের স্পার্ম হিমঘরে জমিয়ে রেখে নির্বীজিত হবে; তরণীরা তাদের ডিম হিমঘরে জমিয়ে রেখে নির্বীজিতা হবে। সন্তান চাইলে IVF করা হবে। পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ক’রলেও সন্তানের জন্ম হবে না।‘

মাধবী ব’ললো, ‘অত শক্ত কথা বুঝতে পারিনা। মা ব’লতো, আমাদের সত্ত্বা জলের মত নিরাকার, যে পাত্রে রাখবে, সে পাত্রের আকার নেবে। আমার মতে যার বা যাদের সঙ্গে থাকবে, তার বা তাদের প্রভাবে নানা রূপ নেবে।‘

*** সমাপ্ত ***

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু